#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৯)
তিনদিন ধরে বাড়ি নেই আরফান। কান্না আর অতিরিক্ত টেনশনের ফলে মুনতাহার যা তা অবস্থা। বাড়ির সকলে মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ স্বীয় স্বামীর থেকে অবহেলা সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। ভালোবাসার ছিঁটে অবধি নেই! মুনতাহা ধৈর্য্য ধরে চার খানা বছর সংসার করল। আশা তো একটাই আরফানের ভালোবাসা। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলেটা প্রচন্ড ভালোবাসা দিবে। কিন্তু এর লেশমাত্র নেই! মেয়েটির ডাগর দুটি চোখে নেমেছে বিষণ্নতা। একটু আগেই কল করেছিল। ধরেছে একটি মেয়ে। এর আগেও এমনটা হয়েছে। আজ মুনতাহার সহ্য হচ্ছে না। দিনের পর দিন শার্টে পাওয়া লিপস্টিকের দাগ আর মেয়েলি পার্ফিউমের সুবাস। এসব অনেক কিছুই বলে দেয়। তবু নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে। আজ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যন্ত্রণায় মাথা খারাপ। গুমোট অনুভূতিতে মেয়েটির হৃদয় হচ্ছে চুরমার। এভাবে আর নয়। চারটে বছর কম সময় নয়। এমন করে আর যাই হোক সংসার হয় না। দীর্ঘ চার বছরের ব্যর্থতা নিয়ে মুনতাহা উপস্থিত হয় সমঝোতার প্রয়াসে। এত গুলো কথা জানাতে ওর ভীষণ লজ্জা লাগছিল। স্বীয় স্বামী যে কি না দিনের পর দিন অবহেলা করেছে ভালোবাসার সীমা শুধমাত্র মাঝ রাত্রিতে। এসব আর কত দিন? মেয়েটি হৃদয় আর মস্তিষ্কের কোন্দলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সব কিছু বলে পাথর বনে যায়। ওকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ নেই। ইববান শিকদার বিচক্ষণ মানুষ। ছেলের খামখেয়ালিপানা নজরে এসেছে বৈকি। তবে বাহিরের মশ্রিণতা দেখে ঘাটাতে চান নি। তিনি ভেবেছিলেন সংসারে তো সুখ আছে। মুনতাহার তো কোনো অভিযোগ নেই। বরং সর্বদা চোখে ছিল প্রাপ্তি। ওনার সমস্ত ধারণা আজ বদলে গেল। আরফানের মা আবিদা বেগম নির্বাক। ছেলের এই কর্মকান্ড ওনার হৃদয়ে বেদনা দিচ্ছে। মা হিসেবে অযোগ্য মনে হয়।
“এসব আগে জানানো উচিত ছিল মুনতাহা। তুমি এ বাড়ির বউ হওয়ার পূর্বে আমার মেয়ে। আমি চাইব না আমার এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তান যন্ত্রণায় ভাসুক। আরফান ফিরলে এর একটা বিহিত করা হবে।”
“বাবা আমি আর পারছিলাম না। আমার সহ্য হচ্ছে না এতসব। দিনের পর দিন এত অবহেলা আমি সত্যিই নিতে পারছি না। কখনো অভিযোগ করেছি? আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যিই ভেঙে গেছি।”
“শান্ত হও মা, তোমায় সর্বদা স্বাধীনতা দিয়েছি। বরং আমি এটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছি দীর্ঘ চার বছর ধরে এত সব সহ্য করছো তুমি। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। আবিদা ওকে রুমে নিয়ে যাও।”
মেয়েটি এলেবেলে ভাবে ঘরে চলে গেল। ইববান শিকদারের কপালে চিন্তার রেখা। ওনার ছেলেটা এত পঁচে গেল কবে?
সে রাত্রিতে বড়সড় ঝামেলা হলো। শুরুতেই আরফান অভিযোগ করল,
“এখন কেন দোষারোপ করছো? আমি বলেছিলাম ওকে আমার পছন্দ নয়। তবু তোমরা শুনলে না।”
“ভদ্রতা বজায় রাখবে আরফান। কথা বার্তায় এতটা আবর্জনা মিশে গেছে!”
“মাফ করবেন বাবা। আপনি আমার মন কে গুরুত্ব না দিয়ে এমন এক মেয়ের সাথে আমায় জড়ালেন যাকে কোথাও নিতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”
“কি হচ্ছে কি আরফান! এত দিন পর কেন তোমার এসব মনে হলো?”
“অনেক আগেই মনে হয়েছে মা। তোমাদের বলেছিলাম এই মেয়ের সাথে আমার যায় না। তবু তোমরা…।”
এত গুলো কথা চুপ করে শুনছিল মেয়েটি। দু চোখে পানি নেই। অথচ ওর হৃদয়ে ভীষণ কান্না। ভেতরে ভেতরে চলছে কান্নার রোল। ধৈর্য্য ওকে এই অবধি এনেছে। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করত।
“বাবা, মা আমি কিছু বলতে চাই।”
একবার তাকালো ও না আরফান। টান হয়ে দাঁড়িয়ে। ইববান শিকদার মেয়েটির মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন। তবে জোর দিয়ে আদৌ কি সংসার হয়?
“আপনার ছেলে সম্ভবত আমার থেকে মুক্তি চায়। আমি চাই তাকে মুক্তি দিতে।”
কথাটা হজম করে নিলেন ইববান শিকদার। অন্য সময় হলে তিনি কি করতেন জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে সত্যিই ওনি কথা বলতে পারলেন না। আবিদা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আলগোছে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মুনতাহা। অভিনব বাইরেই ছিল। অনেক গুলো কথা ওর কানে এসেছে। মুহতানা ইষৎ হাসার চেষ্টা করল।
“কখন এলেন ভাইয়া?”
“এই তো মাত্র।”
“চা খাবেন তো? আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”
অভিনবর হৃদয় ভেঙে দীর্ঘশ্বাস নামে। মেয়েটিকে দেখে মনে হয় না এ এক বিষাদসিন্ধু। উপরটা কতটা পরিচ্ছন্ন রেখেছে। এমন এক মানুষের মর্ম বুঝতে পারছে না আরফান ভাই!
.
ছোট্র বক্সটার ভেতরে রাখা ছিল লকেটটা। সেটা খুঁজে পাচ্ছে না ঝিল। বাক্স সহ অদৃশ্য হয়ে গেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা না! অনেক যত্নে ছিল সেসব। মেয়েটির ব্যকুলতা দেখে চলেছে খাঁচায় বন্দী পাখি দুটো। মাঝে মাঝে ডেকে চলেছে। আরও কিছুক্ষণ খুঁজে কান্নায় ডুবে গেল। পাখি দুটো সেই কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে ডেকে যায়। মেয়েটি উঠে আসে খাঁচার কাছে। নিশ্চুপ হয়ে যায় দুটি প্রাণী। ওর ভীষণ মন খারাপ। চোখের নিচে থাকা জল বিন্দু মুছে নিয়ে খাঁচা নামিয়ে চলে আসে ব্যলকনিতে। ওর ঘরের সাথে লাগানো বারান্দাটা বিশাল বড়। এক পাশে সারি সারি গাছ। দেখলেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। মেয়েটির কোমল ত্বকে ছুঁয়ে যায় হাল্কা বাতাস। হৃদপিন্ডের শব্দ বেশি। পাখি দুটো ফের ডেকে উঠে। মুক্ত করে দেয় ঝিল। গোল গোল ঘুরে উড়ে যায় ওরা। মেয়েটি ঘরে চলে আসে। এই মাঝ রাত্রিতে একটা নিঃসঙ্গতা লেপ্টে আছে। এই সময়টায় সব থেকে বেশি মনে পড়ছে মা নামক মানুষটিকে। প্রিয় মানুষেরা এত দ্রুত কেন হারিয়ে যায়?
জাফর মির্জা একটু রগচটা। বদমেজাজি আর কিছুটা একরোখা। তবে ভেতরটা কোমল। খুব কাছের মানুষ ব্যতীত এ সত্য কেউ জানে না। বাবার রুমের কাছের এসে ঝিল দেখতে পায় ভদ্রলোক চেয়ারে শুয়ে। ভীষণ মায়া হয়। কোনো কথা বলার পূর্বেই ভেতর থেকে শব্দটা কানে আসে, “ভেতরে এসো।”
চমকায় না মেয়েটি। ও জানে বাবা কতটা বিচক্ষণ। জাফর মির্জা চোখ খুলেন। হাতের ইশারায় মেয়েকে কাছে ডাকেন। দুজনের চোখেই ঘুম নেই। এই দিনটায় গত কয়েক বছর কি ঘুমাতে পেরেছেন ভদ্রলোক?
“জেগে আছ পাপা?”
“হু,ঘুম আসছে না।”
“ডাক্তার বলেছিলেন তোমার ঘুমের প্রয়োজন। অনিয়ম যেন না হয়।”
“দু একটা অনিয়মে কিছু হবে না মামুনি। থাক না জীবনে কিছু অনিয়ম। খুব ক্ষতি নেই এতে।”
কথাটা ভীষণ ভালো লাগে মেয়েটির। জাফর মির্জা মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। তিনি তো জানেন প্রতি বছরের মতো মেয়েটি ওনার নিকট ছুটে আসবে। একি ভাবে বলবে জেগে আছ পাপা। চোখ আবছা হয়ে আছে। জল গড়াতে চাইলেও গড়াতে দেন না। ওনার মেয়েটা যে ভীষণ আবেগে ঠাসা।
সকাল থেকেই আয়োজন চলছে। প্রতি বছরের মতো এ বছর ও সকল ধরণের ব্যবসায়িক কাজ বন্ধ। ঝিল গোসল করে এসে বসল সবার সাথে। ভীষণ ব্যস্ত সবাই। হাজার খানেক মানুষের আয়োজন। খাবারের সাথে রয়েছে পোশাকের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে কারো হাতে সময় নেই।
“এ জামা কেন পড়েছ? তোমার জন্য তো নতুন জামা রেখেছি মামুনি।”
“পাপা,আমি একটা আবদার করব। দিবে প্লিজ?”
মলিন হাসলেন জাফর মির্জা। মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধালেন, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
“আম্মুর বিয়ের শাড়িটা দিবে আমায়?”
বুকের ভেতর ধক করে উঠে জাফর মির্জার। ভদ্রলোকের চোখের কোণ ভিজে। অস্পষ্ট দৃষ্টির সাথে ঠোঁট প্রসারিত করেন। আলমারিতে থাকা ভীষণ যত্নে রাখা শাড়িটা নিয়ে আসেন। সাথে কিছু গহনাও। ঝিল সেসব নিয়ে যায়। মনিরুল মির্জা ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখেন। মলিন চোখে তাকায় জাফর মির্জা। এ সময়ে ভীষণ কান্নার প্রয়োজন হলেও তিনি কান্না করতে পারছেন না।
মায়ের শাড়ির প্রতি মেয়েদের দূর্বলতা থাকে। প্রতিটা মেয়েরই ইচ্ছে হয় বউ সাজার। এর প্রথম ধাপ বোধহয় মায়ের শাড়িতেই পূর্ণ হয়। শাড়িটা বুকে ধরে গন্ধ নেয় ঝিল। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ যেন এখনো স্পষ্ট! বাবা কতটা যত্নে রেখেছিলেন। শাড়িটা জড়িয়ে নেয় ঝিল। লাল রঙটা ওকে একটু বেশিই সুন্দর করে তুলে। কোনো রকম প্রসাধনী ছোঁয়ায় না। মা তো এভাবেই সাজতেন। অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন তিনি। মেকাপের প্রয়োজন হতো না। ভদ্রমহিলা যখন বের হতেন তখনি পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে যেত। তবে কারো কপালেই জুটেন নি তিনি। নিজের ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নেন জাফর মির্জা। কত সুখের সংসার ছিল। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে আজ অবধি মায়া ভালোবাসা সবটাই কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি সে বয়স আর সুযোগ থাকত তবে নিশ্চয়ই পাগলামি করে বসতেন জাফর মির্জা। মা বাবার ভালোবাসা গুলো মনে করে হেসে ফেলে ঝিল। বেরিয়ে আসে। মেয়েটি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামে জাফর মির্জা থমকে যান।
“আম্মুর মত সুন্দর লাগছে আমায়?”
“তাঁর থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে মা।”
বাবার বুকে মাথা রাখে ঝিল। জাফর মির্জার দুটি চোখ এবার সত্যিই ভিজে উঠে। গড়িয়ে যায় দুটি ফোঁটা।
“আমরা এভাবেই মনে রাখব আম্মুকে। তুমি কষ্ট পেও না পাপা।”
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
ছবি: ইন্টারনেট