সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩৩)

0
131

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩৩)

এতটা উত্তেজিত আগে কখনো দেখা যায় নি অভিনবর মাঝে। ছেলেটা যেন মনের সাথে যুদ্ধ করেই দাঁড়িয়ে আছে। ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা রাত দশটায়। সে আরও আগেই চলে এসেছে। অভিনবর এই ছেলেমানুষী দেখে ঝিলের মনটা ভালো হয়ে গেল। এই তো কিছু দিন আগের কথা। বাবা মায়ের খোঁজ নিতে নিতে অভিনব প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। যখন শুনল বাবার শরীর খারাপ সে রীতিমতো কাঁপছিল। সেটা দেখেই ঝিলের স্মরণ হলো মানুষগুলোর কথা। তখুনি তরুণের সাথে যোগাযোগ করে সে। তারপরের বিষয়টা তরুণ ই সামলে নেয়। অভিনবর বড়ো হাতের তালুতে নিজের হাতের প্রবেশ করাল ঝিল। একটুখানি তাকিয়ে পুনরায় সামনে নজর ফেরায় অভিনব। ঝিলের হাতের উষ্ণতায় ভরসা পায় ছেলেটা। কেমন করে যেন খামচে ধরে। ঝিল হাল্কা ব্যথা পেলেও শব্দহীন দাঁড়িয়ে রইল। খানিক বাদে দুটি মানুষ বেরিয়ে এল। অভিনবর শরীর কাঁপছে। ঝিল নিজেও অস্বস্তিতে ভুগছে। অহেদ সরকার শুরুতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন।
“মম,পাপা কে ভুলে গেলে বেটা?”

“স্যরি পাপা।”

“ইটস ওকে মাই বয়। তার আগে বল কেমন যাচ্ছে সময়?”

“ঠিক ঠাক।”

অভিনব মায়ের কাছে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে ঝিল ও কাছে এসেছে। অহেদ সরকার মাথায় হাত রেখে বললেন, “কি মিষ্টি আমার মামুনি।”

লজ্জা পেল ঝিল। মাথাটা নিচু রেখেই বলল,
“আপনাদের বড়ো চিন্তায় ফেলেছিলাম আমরা।”

“ব্যাপার না। তোমরা যে সকলের কথা ভাবো এটাই আমাদের প্রাপ্তি। আসলে মামুনি স্বার্থ জিনিসটা বড়ো খারাপ। নতুবা সম্পর্ক গুলো এমন হওয়ার কথা ছিল না।”

“বাদ দেও এসব কথা। আগে দেখতে দাও আমার মা কে।”

ইহরিমা সরকার ঝিলকে বুকে টেনে নিলেন। ভদ্রমহিলার সাথে দারুণ এক সম্পর্ক ছিল ওর। বছরের পর বছর কথা না হওয়াতে সম্পর্কটা মলিন হওয়ার কথা থাকলেও তেমনটি হলো না। মাতৃস্নেহ পেয়ে ঝিল নুইয়ে পড়ল। আচমকা কেঁদে উঠল সে। অভিনবর দুটি নয়ন প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে। কি সুন্দর দৃশ্যটি।

পরের কয়েকটা দিন এত মধুর পার হলো যে অভিনবর মনে হতে লাগল বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ না রেখে বড়ো ভুল হয়ে গেছে। ঝিলের মুখের হাসি ওর বুকে প্রশান্তি নামায়। এত স্নেহ, ভালোবাসার মাঝে মুনতাহার কথা স্মরণ ও হলো না। এদিকে খবর পেয়েছে আরফানের নতুন স্ত্রী বাড়িতে ঝামেলা করে বের হয়ে গেছে। সে থাকবে না। তার জন্য আলাদা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা কেনার জন্য ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে আরেকটচোট ঝামেলা হলো। ইববান শিকদার টাকা দিবেন না। আরফান রেগে গেল। সে বিজনেসে মূখ্য ভূমিকা রাখে বিধায় তাকে কিছু বলতেন না ভদ্রলোক। নতুবা বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তটা আগেই নিতেন। এই সেই চিন্তা করে বড়ো ভুল হয়ে গেছে। তিনি আপসোস করলেন ওদেরকে বাড়িতে জায়গা দেওয়ার জন্য। আরফান বাড়ি ছাড়ার পূর্বে রীতিমতো ধমকে গিয়েছে। কারণ সে ভালোই জানে তাদের বিজনেসে বড় ভূমিকাটা তার। এতে অবশ্য পাত্তা দেন নি ভদ্রলোক। বয়স হলেও তিনি কাজের প্রতি ধৈর্য্যশীল। যৌবনে নিজ হাতে ব্যবসা সামাল দিয়েছেন। আজ তার নিজের সন্তান তাকে হুমকি দিচ্ছে! উপরে উপরের নিজেকে শক্ত দেখালেও ভেতরে তিনি ভেঙে গেছেন। এর প্রধান কারণ বাড়িতে নেই দুই ছেলে। হাজার হোক, বাড়ির সন্তানরাই হচ্ছে মূল শক্তি। পারিবারিক ঝামেলাটা বাইরে রটে গেলে শত্রুরা মুখিয়ে থাকে। সে দিক থেকে কিছুটা দূর্বল হয়ে গেলেন তিনি। এক সপ্তাহের মাঝে বিজনেসে ধস নেমে এল। আরফানের শূন্যতা তিনি বুঝতে পারছিলেন। তবে এমন উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানকে তিনি ফেরাতে নারাজ। অবশেষে ভাই আর বাড়ির বাকি তিন ছেলেদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। শেষে সিদ্ধান্ত হলো সবাই বিজনেসে মনোযোগ দিবে। চেষ্টাই সফলতা। সকলে সৎ থাকলে কারো সাধ্য হবে না দমানোর। এসব খবর শুনে সব থেকে বেশি ব্যথিত হলেন ইহরিমা সরকার। ভদ্রমহিলা ভাইদের আদরে বেড়ে উঠেছে। অনেকটাই ঝিলের মতো। সত্যি বলতে ঝিলের মাঝে নিজেকে দেখতে পান তিনি। নিজ কক্ষে স্বামীর সাথে আলোচনা করছিলেন তিনি। সম্পর্ক গুলো কেমন জটিল হয়ে উঠেছে। ঠিক ভুলের কোনো ইয়াত্তা নেই। ওনাদের আলোচনা শুনে ভেতরে এল না অভিনব। সে এত দিন চুপ থাকলেও বস্তুত প্ল্যান সাজাচ্ছিল মস্তিষ্কে। মানুষগুলো তিক্ত হয়েছে কীনা। এদের ঘায়েল করার এক মাত্র অস্ত্র হচ্ছে আবেগ। এই আবেগ ধরেই টান মা র তে হবে।

মুনতাহাদের বাড়িটা মূলত দোতলা। সামনে রয়েছে উঠান। বাড়ির চারপাশে কাঠের দেয়াল করা। শীত কমে আসলেও উঠানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। কিছু চন্দন কাঠ রাখা আছে আশে পাশেই। প্রবেশ মাত্র তার সুবাস পেল অভিনব। চন্দনের ঘ্রাণ ভীষণ প্রিয় আরফানের। মুনতাহার কথা ভেবেও খারাপ লাগছে। মেয়েটি এখনো আরফানের প্রতি দূর্বল হয়ে আছে। পরিবেশ খুব বেশি মনোমুগ্ধকর বিধায় ঝিল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চারপাশ জুড়ে প্রায় একই ধরনের বাড়ি। খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে তফাৎ পাওয়া যায় না। ঝিলের মনোযোগ সরে এল মাহেরার কণ্ঠে। মেয়েটি ওর থেকেও লম্বা। দেখতে সুন্দরী আর মর্ডান।
“হে অভিনব! আপু বলেছিল তুমি আসবে। সেই থেকে অপেক্ষা করছি। কি খবর?”

“খুবই ভালো। তোমার কি অবস্থা?”

“গুড। সাথে…?”

“ঝিল, আমার ওয়াইফ।”

সৌজন্যতায় হাসল মাহেরা। কাছে এসে ঝিলকে জড়িয়েও ধরল। অথচ ওর দুটি চোখ ভীষণ জ্বলছে। তবু নিজেকে সামাল দিয়ে বলল, “বিয়ের দাওয়াত পেলাম না। এটা বেশ অন্যায় হলো।”

অভিনব এক গাল হাসল। যেতে যেতে জবাব দিল। “কখন যে বিয়ে করে ফেললাম টের ই পাই নি।”

“হা হা। বেশ ভালো বললে তো। টাকা বাঁচানোর ধান্দা।”

“না না একদম ই নয়। একদিন সময় করে ট্রিট দিব।”

“ওকে। পাওনা রইল তবে।”

“একদম।”

ওদের কথার মাঝে ঝিল টু শব্দটি করল না। এমন নয় মাহেরার আচারন অশোভন। তবু ভেতরে ভেতরে ওর খারাপ লাগা কাজ করছে। কেন এমন হচ্ছে?

মুনতাহার পরনে সাধারণ একটা থ্রি পিস। যা অভিনবর চোখে শান্তি এনে দিল। মেয়েটির অগোছালো ভাব ওর ভালো লাগে না। সে এগিয়ে এসে সকলের সাথে কথা বলল। এদিকে ঝিল কিছুটা বিব্রত। সহসা সকলের সাথে মেলামেশা করতে পারে না,তাই হয়ত। অভিনব সকলের সাথে কুশলাদি শেষ করে ঝিলের নিকটে এল।
“খারাপ লাগছে?”

“উঁহু।”

“একদম ঘাবড়ে যাবে না। আমি আছি।”

ঝিল অভিনবর জ্যাকেট খামচে ধরল। কেন যেন ওর বড়ো ভয় হচ্ছে।

“আপু তুমি অস্বস্তি বোধ করছ?”

“না মানে।”

“আমার সাথে এসো।”

মাহের ওকে নিজ ঘরে নিয়ে এল। ওর স্ত্রী চার মাসের গর্ভবতী। তাই ঘর থেকে বের হতে দেয় না। নতুন মানুষ পেয়ে গল্প করতে লাগল। চট জলদি মিশে গেল। উচ্চ শব্দে হেসে যাচ্ছে সে।

“কি ব্যপার ভাবি? এত হাসছ যে!”

“বোসো মাহেরা। ঝিলের সাথে গল্প করতে দারুণ লাগছে। ভারী মিষ্টি মেয়ে।”

“হুম। কোন ক্লাসে পড় যেন তুমি?”

“অনার্স প্রথম বর্ষ। আপাতত পড়ছি না।”

“কেন?”

“কাগজ পত্র নিয়ে একটু সমস্যা। অভিনব ঠিক ঠাক করে পুনরায় ভর্তি করাবে।”

ঝিলের মুখে অভিনবর নাম শুনে তিক্ত হয়ে এল মাহেরার ভেতরটা। মলিনা আড়াল না করেই সে চা ঢালতে লাগল।
“পালিয়ে বিয়ে করেছ তোমরা?”

“তেমন নয়।”

মাহেরা পুনরায় প্রশ্ন করার আগেই অভিনব এল। লম্বা হেসে বলল, “দুঃখিত। মেয়েলি আড্ডাতে বিরক্ত করার জন্য।”

“একদম ই দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি জয়েন করতে পারো আমাদের সাথে।”

“থ্যাংকস।”

পকেট থেকে একটা ছোট্ট বক্স বের করল অভিনব। সেটা মিশকাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “মাহেরের সাথে আমার একবার কথা হলেও মনের দিক থেকে আমরা বেশ ফ্রেন্ডলি হয়ে গিয়েছিলাম। বয়সে মাহের আমার ছোট। সেই হিসেবে তোমাকে ছোট আপু বলেই ট্রিট করছি। এটা আমার আর ঝিলের তরফ থেকে।”

“এসবের কি প্রয়োজন ছিল ভাইয়া। আপনি এসেছেন এটাই অনেক।”

“এটা বাবুর জন্য।”

“থ্যাংকস।”

মাহেরা চায়ের গ্লাসে চা দিয়ে বলল,”ফুলের চা দিয়ে তোমায় ওয়েলকাম করে নিলাম। খেয়ে দেখ রিফ্রেশ লাগবে।”

“ওয়াও। এটা তো বেশ ভালো।”

চটপট কাপ তুলে নিল অভিনব। ফুলের চা বেশ পছন্দ ওর। ঝিলের মুখটা বিরস হয়ে আছে। অভিনবর পাশে থাকা মাহেরাকে ওর ভালো লাগছে না। কেন ভালো লাগছে না তা জানা নেই। আসলেই কি এটার কোনো বিশেষ ব্যখা হয় না?

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here