সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৩)

0
96

#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৩)

অভিনবর শারীরিক অসুস্থতার খবরটা জানত না ঝিল। মেয়েটি অনেক দিন পর একটু ঘুমিয়েছে। কিন্তু একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। পুনরায় চেষ্টা করেও লাভ হলো না। লাইট জ্বালিয়ে দেখল পাশে মৌনতা নেই। বারান্দায় আলো জ্বলছে। ধীরে উঠে পড়ল মেয়েটি। বারান্দার কাছে আসতেই কথাটা কানে এল।
“অভিনব ভাইয়ার এখন কি খবর? শরীরে ব্যথা রয়েছে।”

তখুনি বুঝতে পারল না ঝিল। অভিনবর নামটা কানে এসে শব্দ করছে। মৌনতা আরও কিছু শব্দ ব্যক্ত করতেই ঝিলের শরীর জেগে উঠল। প্রতিটা লোমকূপ জানান দিচ্ছে ব্যগ্রতা। মৌনতা পেছন ঘুরতেই ঝিলকে দেখতে পেল। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে। ঝিলের অবসাদগ্রস্ত মুখখানায় বিন্দু ঘাম জমেছে। চিন্তিত মুখমন্ডলে উষ্ণতার অভাব। লাল হয়ে উঠেছে মুখশ্রী।
“ঝিলি শোন আমার কথা।”

মেয়েটির পা পিছিয়ে এসেছে। মৌনতা আরও কয়েকবার ডাকল কিন্তু লাভ হলো না। বেডের উপর বসে পড়ল সে। শরীর যেন বোধ শক্তি হারিয়েছে। মৌনতা তরুণের কলটা রেখে ঝিলের পাশে বসল।
“চিন্তা করিস না। ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে।”

অনেকক্ষণ মেঝেতে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। তারপর আচানাক বলল, “কি হয়েছে মৌন? উনি ঠিক আছেন তো? আমায় কেন কিছু বলেন নি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে। মস্তিষ্কে ভীষণ যন্ত্রণা করছে। কেন বললেন না তিনি। বল না মৌন। কি হয়েছে উনার।”

“এমন করিস না ঝিলি। ভাইয়া ঠিক আছে। জাস্ট একটু অসুস্থ।”

“লুকাচ্ছিস কেন। আমি ঠিক আছি তো। প্লিজ তুই সবটা বল আমায়।”

“বলছি,তুই আগে শান্ত হ।”

শক্ত হয়ে বসে রইল ঝিল। মৌনতা পুরো ঘটনাটা বলার পর ঝিলের মাঝে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। খানিক বাদে কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটি। ওর ভেতরে আগুনের তপ্ত শিখা গুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে।

সকালের মিষ্টি রোদে বসে গান শুনছিল মৌনতা। সারাটা রাত ঘুম হয় নি। ঝিলকে সামলাতে সামলাতে ভোর হয়ে এল। তারপর আর ঘুমাতেও ইচ্ছে করল না। এখন সে বসেছে মিষ্টি রোদ মাখতে। রোহন অভ্যাসগত কারণেই ছাদে এসেছে পুশ আপ দিতে। তখনি মৌনতাকে দেখতে পেল। মেয়েটির স্নিগ্ধতা ওর অন্তরে ফুল হয়ে ঝরছে। একটা সময় গাঢ় হয় চাহনি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর শুভ্রতা পরখ করে। এই মুহূর্তে মেয়েটির প্রতি কোনো রাগ অভিমান কাজ করছে না। বরং ভালো লাগায় ভরে উঠেছে সময়টা।
“এত ভোরে এখানে কি করছো?”

চোখ খুলে রোহনকে দেখতে পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে মৌনতা। ওর পাশে এসে বসল রোহন। মেয়েটি আরেকটু গুটিয়ে বসেছে।
“কালকের জন্য স্যরি।”

“স্যরি বলার কিছু নেই। আমার প্রাপ্য যা তাই পেয়েছি।”

“বিদ্রুপ করলে?”

“যা সত্য তাই বলেছি।”

“আমি সত্যিই দুঃখিত।”

“বুঝতে পেরেছি।”

উঠে যাচ্ছিল মৌনতা। রোহন খপ করে ধরে ফেলল হাত।
“আমি কথা বলছি।”

“কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না।”

“কেন? কেউ আছে যে অন্য পুরুষ মানুষের সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছে।”

“থাকা না থাকা বিষয় না। আমি এই মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।”

“রাগাবে না।”

“আপনি রেগে গেলে সেটা আপনার সমস্যা। আমি কি করতে পারি!”

“খুব বেশি বলছো তুমি।”

মৌনতা এবার উত্তর দিল না। ওর গলা ধরে এসেছে। চোখের কোণ ভেসেছে নোনা জলে।
“স্যরি। আমি শুধু জানতে চাই ঝিলের সাথে অভিনবর কি সম্পর্ক।”

“কাল তো শুনেছেনই।”

“তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। প্লিজ ওদের বিষয়টা জানাও।”

“ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। যেন তেন ভালোবাসা নয় যে একটুখানি ঝড় হলেই সরে যাবে। ওদের ভালোবাসাটা সুন্দর ও মজবুত।”

কথাগুলো যে রোহনকে আঘাত করার জন্যই যেসব বুঝতে অসুবিধা হলো না। একটা ভাঙা আর্তনাদ বুকের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেছে। মেয়েটি ওকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিল!
.

ঝিল শুনেছে তরুণের বাসায় আছে অভিনব। এই সুযোগটা মিস করতে চায় নি মেয়েটি। সে চলে এসেছে মৌনতাকে নিয়ে। বাগানে তরুণের ভাই তুহিনের সাথে দেখা। ছেলেটি একটুও অবাক হয় নি। গত কয়েক মাসে ঝিল আর অভিনবর সম্পর্কের গভীরতা মনে মনে মেপে নিয়েছে সে। ওদের নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল। বসতে বলে স্ত্রীকে বলল নাস্তা দিতে। ঝিলের অস্থিরতা দেখে মৌনতা বলল,
“ভাইয়া যদি কিছু না মনে করেন অভিনব ভাইয়া কোন রুমে আছেন?”

তুহিন ইষৎ হেসে রুম দেখিয়ে দিল। ঝিল শব্দহীন চলে গেল। বিছানায় শুয়ে আছে অভিনব। শরীরে চাদর টানা। অসুস্থ থাকাতে প্রায় সারাদিনই শুয়ে বসে থাকতে হয়। সে এখন ঘুমিয়ে। ঝিল নিজেকে সামলাতে পারল না। ছুটে গিয়ে অভিনবকে জড়িয়ে ধরল। ওর স্পর্শে ছেলেটির ঘুম ছুটে গিয়েছে। শরীরে চাপ লাগাতে হাল্কা ব্যথাও হচ্ছে। ওর চুল থেকে আসা সুবাসটা একদম মাতাল করে তুলেছে। যত্ন নিয়ে হাত বুলায় অভিনব।
“জানতাম আপনি এমন পাগলামি করে বসবেন প্রজাপতি।”

“আপনি কেন জানালেন না আমায়।”

“জানালে রক্ষে থাকত? এই যে এখনি কেমন পাগলামো করছেন।”

“আপনি খুব খারাপ অভিনব। খুব খারাপ।”

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল অভিনব। ঝিলের কানের কাছে কিছু চুল গুছিয়ে বলল,”জানি তো আমি খুব খারাপ।”

“খারাপ ই তো।”

“একদম ঠিক। বউ কাছে আসলে আমি দূরে সরিয়ে দিই। ভালোবাসার বদলে দুঃখ ছড়াই। রাগ তো হবেই।”

“আপনি আবার এসব বলছেন।”

“খুব মিস করেছি প্রজাপতি।”

“শরীরে খুব ব্যথা?”

“ছিল তবে এখন নেই। আপনাকে দেখে ভালো লাগছে ঝিল। বুকে মাথা রাখবেন প্লিজ।”

ছেলেটার বুকে প্রশান্তি নেমে এল। বাইরে থেকে এ দৃশ্য দেখে হাসল তরুণ। তার বিদেশী বন্ধু বুঝি বদ্ধ পাগল।

প্রায় দুটো ঘন্টা অভিনবর কাছে ছিল ঝিল। এই সময়টুকুতে অভিনবর যত্নের শেষ ছিল না। ছেলেটার শরীর মুছিয়ে দেওয়া। মাথায় পানি দেওয়া, নিজ হাতে খাবার খাইয়ে দেওয়া কত কিছুই না করেছে। অথচ জীবনে সে হাত গলিয়ে পানি এনে পান করে নি। মেয়েরা এমনি হয়। ভালোবাসার মানুষ গুলোর জন্য নিজের সবটা উজাড় করে দেয়। ওরা নিখুঁতভাবে ভালোবাসতে জানে।

দুদিন পর ঝিলের সাথে দেখা করতে এল আয়ুষ। ছেলেটার বলিষ্ঠ দেহে কেমন ভাঙন ধরেছে। চিন্তার রেখা ফুটেছে মুখমন্ডলে। তার বোন যে এমন কাজ করতে পারে কোনো কালেই মাথায় আসে নি। আয়ুষের অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগল ঝিলের। ওর ইচ্ছে করল সবটা বলে দিতে। কিন্তু এটা করলে রজনী আপুর সাথে খুব অন্যায় হবে। এত ঝামেলার মাঝেও আয়ুষ একটা উপহার এনেছে। ঝিলের জন্য লাল রঙের একটি শাড়ি এনেছে সে। আসার পথে নাকি পছন্দ হলো। বিষয়টা বলতেই ঝিলের মন খারাপ হয়। রজনীর সাথে আয়ুষের সম্পর্কটা গভীর ছিল না। ভাই বোন কেউ ই একে আপরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানত না। অথচ হৃদয়ে অনেকখানি ভালোবাসা জমে আছে। ঝিল ভরসা দিতে আয়ুষের কাঁধে হাত রাখল।
“রজনী আপুর কথা ভাবো?”

“হুম।”

“আপু নিশ্চয়ই ভালো আছে।”

“ভালো আছে কি না জানি না। তবে ভালো থাকার জন্যেই তো পরিবার ফেলে পালিয়েছে।”

“হয়ত আপুর কাছে সেটাই সুখ।”

“এই সুখ একটু বেশি স্বার্থপরতার পরিচয় হয়ে গেল না রে?”

আয়ুষের দিকে তাকানোর সাহস পেল না ঝিল। অন্যদিক ফিরে ভাবতে লাগল বিষয়টা।
“মানুষ খুব খারাপ প্রাণী। যে পরিবারটা এত গুলো দিন আদর ভালোবাসা দিয়ে বড় করল তাদের ফেলে যেতে একটুখানি বুক কাঁপল না?”

গলা শুকিয়ে এসেছে ঝিলের। আয়ুষ আবার বলল, “পরিবারের ভালোবাসা ছিন্ন করে দিন দুনির ভালোবাসা যারা আপন করে নেয় তারা আদৌ কি জানে ভালোবাসার মুগ্ধতা।”

কেন যেন মেয়েটির এবার কান্না পেল। আয়ুষ এভাবে কেন বলছে। পরিবারের ভালোবাসার বাইরেও তো কিছু ভালোবাসা থাকে। তাছাড়া শুরুতেই তো পরিবার ছাড়তে চায় না কেউ। উপায় না পেয়েই তো এ সিদ্ধান্ত নেয়।
“জানিস ঝিল, পরিবার ফেলে যারা অন্য মানুষের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেয় তারা কখনো ভালোবাসাই বোঝে না। জীবনে সব কিছু পেয়েছে এমন কোনো মানুষ নেই। তাছাড়া কে বলেছে জীবনটা সুন্দর হওয়ার জন্য সব পেতে হবে। কিছু সময় ত্যাগেও প্রশান্তি আসে।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

পর্ববর্তী পর্ব
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/208348051726097/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here