#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩০)
টরন্টো শহর দিনকে দিন বড্ড আপন হয়ে উঠেছে ঝিলের। ভ্রমণপিপাসু সে টরন্টোর সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা লিখতে চায়। তবে কবি না বিধায় লিখতে পারে না। এক বিকেলে কথা। অভিনব দ্রুতই চলে এসেছে। এমি রান্না করছে। সুস্বাদু খাবারের গন্ধটা একেবারে জ্বালা ধরিয়ে দিল। ক্ষুধাটা তর তর করে বৃদ্ধি পেল। ঝিল তখন জানালার কাছে। হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বাইরের তুষারপাত থেমেছে। বরফ জমে আছে সব খানেই। কাচের জানালাটা ঘোলা হয়ে এসেছে। তার মাঝেই আঙুলের সাহায্যে বড় বড় অক্ষরে লিখেছে অভিনব ও ঝিল। বিষয়টা দেখতে পেয়ে হাসল সে। মেয়েটির স্বভাবে বাচ্চামো রয়েছে। আসলে প্রতিটি মানুষের মাঝেই বাচ্চামো লুকিয়ে থাকে। ঝিল আনমনে বাইরে তাকিয়ে। গায়ে জড়ানো পাতলা সোয়েটার। হিটারের উত্তাপে উষ্ণ কক্ষ। এর মাঝে শীতল হাতটা ঘাড়ে এসে স্পর্শ করল। মেয়েটির পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। অভিনব হেসে আরেকটু কাছে এল।
“কি ব্যপার প্রজাপতি। আপনার শরীরে দেখি বিষণ্নতার গন্ধ। মন খারাপ?”
“উহু।”
“তাহলে? এত বিষণ্ন কেন লাগছে?”
“বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“এমির সাথে ঘুরে আসতে।”
“সেটা তো রোজ ই যাই। আমার অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে।”
ঘরবন্দী ঝিলের মনের অবস্থা স্মরণ করে অভিনবর মন খারাপ হলো। এত দিন হলেও ঝিলকে নিয়ে বাইরে যাওয়া হয় নি। কানাডায় আসার পর থেকে বড্ড ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। নতুন কিছু শুরু করেছে বিধায় কাজের চাপ ও বেশি। মেয়েটিকে ভার্সিটিতে ভর্তি করানো দরকার। কিন্তু কাগজ পত্র সমস্যা করছে। সেগুলো ঠিক ঠাক করার জন্য ছুটতে হচ্ছে এদিক সেদিক। অভিনব খেয়াল করল শুরুর দিকে ঘরবন্দী জীবন উপভোগ করলেও ঝিল আজ বড্ড তিক্ত। টরন্টো শহরের শীতল হাওয়া ওর উপরিভাগ স্পর্শ করলেও কোথাও একটা খামতি মিলছে। দীর্ঘশ্বাস গুলো চোখে মুখে পড়তেই ঝিল প্রশ্ন ছুঁড়ে, “খাবার খাবে না? চেঞ্জ করে নাও। আমি এমিকে সাহায্য করি।”
ঝিল চলে যেতে নিলে অভিনব হাত ধরে আটকে দিল। সামান্য এগিয়ে এসে খুঁটিয়ে দেখছে ওকে।
“কি হলো?”
“দেখছি।”
“কি দেখ?”
“তোমাকে।”
“রোজ ই তো দেখ।”
“উঁহু আজ স্পেশাল ভাবে দেখছি।”
অভিনবর জ্যাকেটের বোতাম গুলো খুলতে লাগল ঝিল। মাথাটা নিচু করেছে বিধায় ডান হাতের সাহায্য থুতনি উঁচু করল অভিনব। ঝিলের দুটি চোখ কেমন ব্যাথার সুর তুলেছে। অভিনবর দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মেলাতে অস্বস্তি হলো ওর। দৃষ্টি নিচু করতেই বিরক্তি প্রকাশ করে অভিনব।
“আমার দিকে তাকাও।”
“এসো তো তুমি। খাবার খেতে হবে। এমি চলে যাবে একটু পর।”
“আগে তাকাও।”
“চলো তো।”
“তাকাতে বলেছি ঝিল।”
ধমকের সুরটা ঝিলকে তাকাতে বাধ্য করল। মেয়েটির চোখ থেকে এবার পানি ঝরতে লাগল। একটা সময় পর দূরে সরে এল অভিনব। খাবারের টেবিলে বসে দুজনের একটা কথাও হলো না। এমি কিছু সময় পূর্বেই চলে গেছে। পুরোটা রাত অভিনব ঘুমাতে পারে নি। ঝিলের সকল সুখ শান্তি যেন আজ হারিয়ে গেছে। মেয়েটি নিশ্চয়ই কষ্টে আছে। এত ভালোবাসার পর ও অভিনবর মনে হলো পরিবার ছাড়া আসলেই ওরা সুখে নেই। এই সুখের মাঝে পরিবারকে না পাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে। শেষ রাতে ঝিলের কাছাকাছি হয় অভিনব। মেয়েটি নিজেও ঘুমায় নি। অভিনবর উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ গুলো ঝিলের শরীরে উত্তাপ ছড়ায়। শরীর থেকে ভেসে আসা সুবাসে আরেকটু সুন্দর হয়ে উঠে মুহূর্তটা। ঝিলের গলার কাছটায় এগিয়ে এসে অভিনব বলে, “এই কষ্টটা সহ্য করে নাও ঝিল। কথা দিচ্ছি আমি পুনরায় চেষ্টা করব।”
এতদিন অভিনব সত্যিই কারো খোঁজ খবর নেয়নি। এমনকি নিজ বাবা মায়ের সাথেও কথা বলে নি। তরুণ ও জানে না কোথায় আছে ওরা। ঝিল যেমন পরিবার ছাড়া কষ্টে আছে অভিনবও তেমনি। মেয়েটির কষ্টের মাত্রা বুঝতে পারে সে। মা বিহীন পাঁচ ভাইয়ের আদরে কিশোরী জীবন গত করা ঝিলের হৃদয়ের হাহাকার অভিনবর পরের পদক্ষেপ গুলোকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিল। পুনরায় চেষ্টা করেও কি বিশেষ লাভ হবে? ভাঙবে কি পাষাণ মানুষগুলো মনের দেয়াল। তারা কি বুঝবে কখনো, তাদের আত্মসম্মানের তাপে পু ড় ছে দুটি হৃদয়? এই ভাবনার কোনো ব্যাখা নেই। কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না সে। সে সময় অভিনবর পার্টনার দরজায় নক করে। ড্যানিয়েলকে দেখে হাসল অভিনব। ছেলেটা ওর বয়সী।
“কি খবর ড্যানিয়েল?”
“ভালো অভিনব। তোমার কথা স্মরণ হচ্ছিল। তাই চলে এলাম।”
“গুড। কফি নিবে নিশ্চয়ই?”
“একদম।”
কফি আসার আগ অবধি অগোছালো কিছু কথা চলল ওদের। অভিনব বার বার মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। ওর এই অবস্থা বেশ বুঝতে পারল ড্যানিয়েল। কফি কাপটা রাখার সময় ইষৎ শব্দ করল। মনোযোগ ফিরিয়ে অভিনব বলল, “স্যরি। আসলে আমি একটু অন্যমনস্ক ছিলাম।”
“ইটস ওকে। তোমার জন্য একটা সংবাদ নিয়ে এসেছি।”
“হ্যাঁ বলো।”
“ক্রিসমাসের জন্য উইনিপেগে পার্টির আয়োজন করেছি। তোমার ওয়াইফের সাথে তো দেখা হয় নি। আশা করছি আসবে তোমরা।”
অভিনব সৌজন্যতায় হাসল। হাতে হাতে মিলিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই।”
আরফানের প্রতি বিরক্ত প্রতিটি মানুষ। এখন তার নতুন স্ত্রীও এই লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। প্রথম দিকে মেয়েটি তেমন কোনো অসুবিধা না করলেও আজকাল বড্ড জ্বালাতন করছে। বাড়ির সাহায্যকারী মেয়েদের সাথে যা তা ব্যবহার শুরু হয়েছে। খাবারের টেবিলে বসেও এক চোট ধমকাচ্ছে। এ বাড়ির খাবার খেয়ে নাকি তার ওজন বেড়ে যাচ্ছে। রূপও কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে। এ নিয়ে আরফানের সাথেও বেশ তর্কাতর্কি হলো কয়েকবার। ছেলেটা বলেছে আলাদা লোক রাখবে। কিন্তু এক সপ্তাহ গেলেও এর কোনো হেলদোল দেখা গেল না। মূলত এই নিয়েই পুনরায় রেগেছে সে। আজ তো সরাসরি রান্না ঘরে চলে এসেছে। সেখানে তার তিন শাশুড়ি রয়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করেই বলল,
“লতিফা আমার জন্য গ্রিন টি করে দাও। চিনি দিবে না।”
“ভাবী তরকারিটা নামিয়েই করে দিচ্ছি।”
“কত সময় লাগবে?”
“দশ মিনিট।”
“ওকে। এর বেশি যেন লেট না হয়।”
আমেনা বেগম রাগে কাঁপছেন। তার ছেলেটা কোথা থেকে এই মেয়েকে তুলে এনেছে। আস্ত আবর্জনা!
লতিফা গ্রিন টি দিয়ে গেলে পুনরায় ডাক পড়ল তার। মেয়েটির হাতে কাজের চাপ খুব।
“বলেন ভাবী?”
“আমার পায়ের নেলস গুলো কেটে দাও তো।”
লতিফার ভ্রু কুচকে গেছে। সে এ বাড়িতে কাজ করে অনেক বছর। কিশোরী বয়স পেরিয়েছে বহু পূর্বেই। এত বছরে কেউ তাকে এমন কাজ দেয় নি। লতিফার থেকে জবাব না পেয়ে রিসা ধমকে উঠল।
“কি হলো শুনতে পাও নি?”
“জী।”
লতিফার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস নেমে এল। রিসার পায়ের নখ গুলো সুন্দর করে কেটে দিল। রিসা ফোনে মগ্ন। কিছু সময় পর আরফান কল করল। দুজনের রোমাঞ্চিত কথা বার্তায় আরেক ধাপ কষ্ট হলো লতিফার।
মুনতাহার মতো সহজ সরল মেয়েটির কপালের কথা মনে হতেই শরীর কেঁপে উঠল। স্বামীর জন্য রাতের পর খাবার নিয়ে অপেক্ষা করত মুনতাহা। দিনে কতবার কল করে খোঁজ খবর নিত হিসেব নেই। অথচ সেই তার ভাগ্য কতটা নিষ্ঠুর!
রাতের একটি দৃশ্য ইববান শিকদারের টনক নড়িয়ে দিল। রিসার সাথে ওনার কখনো কথা হয় নি কিংবা প্রয়োজন পড়ে নি। আজ ওনি জ্ব ল ন্ত আগুনের ন্যায় তেঁতে উঠলেন। মেঝের মধ্যে পড়ে থাকা খাবার গুলো ওনার রাগকে বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ। আমেনা বেগম স্বামীর প্রতি অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। ভদ্রলোক দমলেন না।
“কি ধরনের বেয়াদবি এটা? খাবার ভালো না লাগলে খাবে না। তবে এভাবে মেঝেতে ফেলার সাহস কি করে হয়। এসব কি ফ্রি তে পেয়েছ!”
ভদ্রলোকর ধমকে কেঁপে উঠে রিসা। শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। আরফান সবে বাড়ি ফিরেছে। ভীষণ ক্লান্ত তার শরীর।
“কি হয়েছে বাবা? এত চেচাচ্ছ কেন?”
“দেখ তোমার স্ত্রীর কান্ড।”
“রিসা কি করেছে মা?”
আমেনা বেগম জবাব দিলেন না। ওনার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির ছোট দুই বউ। তারাও চুপ।
“ছোট কাকি,রিসা কি করেছে? বাবা ওকে কি বলেছে?”
“সেটা ওকেই জিজ্ঞাসা কর আরফান। এভাবে খাবার কেন ফেলেছে।”
বড্ড বিরক্ত হলো আরফান। রিসার কান্নারত মুখ দেখে বলল, “বাবা কি বলেছে তোমায়?”
“বাবা আমায় খাবারের খোঁটা দিয়েছেন।”
আরফান শীতল দৃষ্টি ফেলল। “খাবারের জন্য খোঁটা দেওয়া উচিত কি বাবা? ওর সমস্ত দায় দায়িত্ব তো আমার। আমি নিশ্চয়ই বসে বসে খাই না।”
ইববান শিকদার ছেলের এই সাফাই দেখে বড্ড অশান্ত হয়ে পড়লেন। এখানে থাকলে নিশ্চয়ই কলহ রটে যাবে। তিনি বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। পেছন পেছন ছুটলেন ওনার স্ত্রীও। রিসার কান্নার শব্দ আরও বেড়ে গেল। ছুটে গেল ঘরের দিকে। আরফানের ক্লান্ত হওয়া শরীর আজ অসহ্য য ন্ত্র ণা য় ভুগছে। নতুন নতুন অশান্তি আর নিতে পারছে না। অথচ তার জীবনটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। প্রকৃতি বুঝি প্রতিশোধ নিচ্ছে?
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি