#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৫)
ফোনের এপাশ থেকে ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো করে চলেছে অভিনব। কিন্তু ঝিল সাড়াহীন। মেয়েটি যেন কোনো ঘোরের মধ্যেই চলে এসেছে। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। অসুস্থ শরীরটা উঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। হাক ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে, “তরুণ, তরুণ কোথায় তুই।”
তরুণ সাড়া না দিলেও ছুটে এসেছে তুহিন। হাপাচ্ছে সে। অভিনবর ব্যস্ততা দেখে সে নিজেও বিচলিত হয়ে পড়ল। উৎকণ্ঠা যেন ঠিকড়ে পড়েছে।
“কি হয়েছে অভিনব। এমন করছো কেন? কোনো কিছু প্রয়োজন।”
“ভাইয়া আমাকে একটু উঠে বসতে সাহায্য করুন।”
বিনাবাক্যে কাজটি করে ফেলল তুহিন। অভিনব মেঝেতে পা রাখতেই একটা শিরশির অনুভূতি পা থেকে উঠে গিয়ে ছড়িয়ে গেল মস্তিষ্ক অবধি। যন্ত্রণায় মুখ থেকে বের হয়ে এসেছে আ র্ত না দ।
“অভিনব। আর ইউ ওকে?”
“তরুণ, তরুণ কোথায় ভাইয়া।”
“ও তো এখন বাসায় নেই।”
“উফ ওকে প্রয়োজন আমার।”
“কি হয়েছে তোমার? এমন অশান্ত হয়ে পড়েছ কেন!”
“জানি না। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে না।”
মাথা চেপে রইল অভিনব। তুহিন ভয় পেয়ে গেছে। চটজলদি বেরিয়ে এল সে। ক্রমাগত কল করতে লাগল তরুণের নাম্বারে।
রোহনের মুখের পেশি গুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। বোনের প্রতি ওর ভালোবাসা কোনো ভাষাতেই প্রকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু এভাবে ওর বিশ্বাস ভেঙে দিবে তা কখনোই ভাবে নি সে। একটা কষ্ট ওর বুক ভারী করে দিল।
“ভাইয়া, আমার কথাটা শুনো।”
“আর কিছু বলার আছে?”
মাথা নিচু করে ফেলে ঝিল। চোখ থেকে বের হয়ে আসে দু ফোঁটা নোনা জল।
“স্যরি ভাইয়া। এভাবে কষ্ট দিতে চাই নি।”
“কবে এত বড় হয়ে গেলি বনু? তোর লাইফে এমন কিছু কি আছে যা আমার জানা নেই। অথচ এত বড় সত্যিটা।”
“আমি খুব স্যরি ভাইয়া। প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না।”
“ভুল বুঝি নি। তবে খুব কষ্ট হচ্ছে রে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ক্ষত।”
“ভাইয়া!”
“মায়ের দূর্ঘটনার পর সবথেকে বেশি একটা কথাই স্মরণ হয়েছে। আমাদের ছোট্ট বোনটা কেমন করে এই ব্যথাটা সইবে। তোর ব্যথার কথা ভেবে আমরা কষ্ট পাওয়া বন্ধের অভিনয় করেছি। আমরা পাঁচ ভাই সর্বদা একটা কথাই মনে রেখেছি। আমাদের বোন ছোট, তাকে সামাল দিতে হবে। দিতে হবে মায়েদের সবটুকু আদর। তুই ই তো বলিস আমি আর আহনাফ তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাহলে,তাহলে কেন লুকালি এত সব?”
এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল ঝিল। ওর কান্নার শব্দে চারপাশ আন্দোলিত। রোহন নিজেকে শক্ত করতে পারছে না। ওর ভেতরের কষ্টটা কেমন নুইয়ে পড়ল মেয়েটির চোখের জলে।
দু হাত বাড়িয়ে বুকে আগলে নিল বোনকে। ঝিলের কান্না এবার কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
“আমি আর কখনো কিছু লুকাব না ভাইয়া। প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।”
তরুণ আসতে না আসতে অভিনব বলল, “তুই একটা হেল্প কর দোস্ত।”
“কি হয়েছে তোর?”
“ঝিলের সাথে দেখা করতে চাই। মনে হচ্ছে ওর কিছু হয়েছে।”
“এত হাইপার হচ্ছিস কেন। তুই তো উঠতেই পারছিস না। বোস শান্ত হয়ে।”
“আহা তুই বুঝতে পারছিস না।”
“কথা নয়। আগে বোস।”
স্থির হতে পারল না অভিনব। ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে রয়েছে।
“সবটা ক্লিয়ার করে বল।”
“আমার মনে হচ্ছে কথা বলার সময় ওর ফ্যামেলির কেউ ধরে ফেলেছে।”
“কি বলিস!”
“হুম। ভয় হচ্ছে এবার। সন্দেহ হয়েছিল তখনি মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আর যদি ধরা পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে আমার থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দিবে।”
চিন্তিত হয়ে গেল তরুণ। অভিনব অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। ঠিক সে সময় একটা কল এল। নাম্বারটা অচেনা।
“হ্যালো।”
“অভিনব ভাইয়া বলছেন?”
“জী। আপনি কে?”
“রোহন, ঝিলের ভাই।”
শক্ত হয়ে এল অভিনবর মুখশ্রী। মনে মনে প্রস্তুত হয়ে রইল। রোহন খুব সংক্ষিপ্তে কথা বলল, “আপনি বোধহয় এতক্ষণে বুঝে গেছেন আমি কিছুটা হলেও অতীতের ঘটনা জানতে পেরেছি। ফোনে কথা বলে মনের দিক থেকে শান্তি মিলে না। সরাসরি কথা হলে ভালো হয়। কাল বিকেলে দেখা করতে চাই।”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কোথায় আসতে হবে?”
“আমি লোকেশন ম্যাসেজ করে দিব।”
“ওকে।”
ফোন রাখতেই তরুণ ভ্রু কুচকে তাকাল।
“এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
“তুই বিছানা থেকে উঠতে পারছিস না। আর কাল দেখা করার কথায় রাজি হয়ে গেলি।”
ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়েছে ছেলেটার। অভিনবর এই মৃদু হাসিটা মারাত্মক। তরুণ নজর ঘুরিয়ে নিল।
“কিছু কিছু লড়াই এর জন্য শারীরিক অসুস্থতা হারাম হয়ে যায়।”
.
২৪ বছর বয়সী রোহন সুপুরুষ ই বটে। ওর সমবয়সী আহনাফ ও কম কিসের। চাচাতো ভাই হলেও ওদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা বেশি। আর ঝিল হলো ওদের প্রাণ। ৫ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। রোহনের বড় ভাই রাফাত। সে বর্তমানে পারিবারিক বিজনেসে সময় দিচ্ছে। আহনাফ বেশিরভাগ সময় শহরের বাহিরে থাকে। ছেলেটার বাহিরভাগ অতিরিক্ত শান্ত। কিন্তু সে মোটেও তেমন প্রকৃতির নয়। লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে চুল সেট করে নিচ্ছে। রোহন ড্রাইভিং সিটে বসেছে। কিছুক্ষণ পর পর গভীর ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে। ওর ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া দেখে প্রশ্ন ছুড়ল আহনাফ।
“কি ব্যপার? অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে!”
“হুম। ভাবছি একটা বিষয়।”
“কোন বিষয়?”
“অভিনব ভাইয়ের বিষয়টা।”
“ও আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। ওনার বয়সের বিষয় নিয়েই তো ভাবছিস?”
“একদম। বনু আর ওনার বয়সের ফারাক ১০ বছর। এটা একটু বেশিই হয়ে গেল না?”
রোহনের দীর্ঘশ্বাসটা স্পষ্টত শুনতে পেল আহনাফ। ওর নিজের মস্তিষ্কেও এসেছে বিষয়টা। ১৯ বছর বয়সী ঝিল আর ২৯ বছর বয়সী অভিনব! দুজনের বয়সের ফারাকটা একটু বেশিই বলা চলে। সাধারণত এই বয়সের ছেলেরা মনের দিক থেকে অন্য রকম হয়ে থাকে। ঝিল আর অভিনবর জেনারেশনের পার্থক্য রয়েছে। দুই জেনারেশনে নিশ্চিতভাবে মতের অমিলের সম্ভাবনা থাকে। এই যে আহনাফ আর রোহন। দুজনের সাথে ঝিলের বন্ডিং খুবই সুন্দর। কিন্তু তাদের বড় ভাইদের সাথে বন্ডিং এত ভালো নয়। তারা সন্দেহহীনভাবে বোন কে ভালোবাসে। তবু কোথাও একটা বয়সের ফারাকটা বাঁধা দিয়েছে। ঝিলের বড় চাচার বড় ছেলে অর্থাৎ আহনাফের বড় ভাই মাহিন আর অভিনব সমবয়সী হবে। সেই দিক থেকে তুলনা করলে ঝিলের ভবিষ্যৎ বড্ড ভোগান্তির বলেই মনে হচ্ছে। দুই ভাই ভাবনাটা সরাতে পারছে না। বার বার মনে হচ্ছে সম্পর্কটা সঠিক হয় নি।
“আমাদের হাতে কোনো অপশন নেই। একটাই চয়েজ রয়েছে।”
“হুম। তবু যদি ছেলেটাকে বনুর জন্য পছন্দ না হয় তবে আমি অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবো আহনাফ। বনুর জন্য আমরা নিশ্চয়ই খারাপ চাইব না?”
“হুম। দেখা যাক কি হয়।”
রোহন আনমনা হয়ে উঠল। গাড়ি ড্রাইভিং এ মন বসছে না। একটা চিন্তা ওকে আড়ষ্ট করে দিচ্ছে। অভিনব সম্পর্কে অন্যরকম ধারণার জন্ম নিয়েছে। ছেলেটার কণ্ঠে বলিষ্ঠতা থাকলেও বয়সটা বড্ড ভাবিয়ে তুলছে। ঝিলের বয়সের তুলনায় ঊনিশ বয়স মানে অনেক বয়স। ওরা ভাই হিসেবে নিশ্চয়ই চাইবে বোনের জন্য সেরা পাত্র বের করার। কিন্তু এখন, এখন কি উপায়?
অভিনব সময়ের আগেই চলে এসেছে। ওর শরীরে ভীষণ জ্বর। তবু মুখের হাসিটা শারীরিক অসুস্থতার প্রকাশ দিচ্ছে না। পাশে বসেছে তরুণ। ঝিলের ভাইদের দূর থেকেই চিনতে পারল সে। ওদের দেখে এগিয়ে এলো। কুশলাদি করতেই আহনাফ বলল, “কি ব্যপার তরুণ ভাই। এমন শুকিয়ে এসেছেন কেন?”
“শুকাই নি ভাই। অনেকদিন বাদে দেখলে তো তাই এমন লাগছে।”
“হয়ত। আমাদের বাড়িতে আসেন না কেন?”
“যাব ভাই। খুব দ্রুতই যাব।”
কথাটা শেষ করে হাসল তরুণ। মাস কয়েক পূর্বেও মির্জা বাড়িতে গিয়েছে সে। তাও ওদের বোনকে পাত্রী হিসেবে দেখার জন্য! তারপর ওদের মায়েদের জন্য দোয়ার অনুষ্ঠানেও লুকিয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস এদের সাথে দেখা হয় নি। নতুবা প্রথমদিনের ঘটনাতেই এসপার-ওসপার ঘটে যেত। পাঁচ ভাই নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলত না অভিনবকে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি