#সুখ_একটি_প্রজাপতি (২৯)
কানাডার হীমশীতল বাতাসে ঝিলের শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। বরফ শীতল বাতাসটা সোজা নাক দিয়ে প্রবেশ করে হৃদপিণ্ড অবধি পৌছে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে শ্বাস ফেলছে সে। রাস্তা, গাছ, বাড়ি সব কিছু তুষারের নিচে। কয়েক দিন ধরেই বেশ তুষারপাত হচ্ছে। শহরের রাস্তা গুলো জ্যাম হয়ে আছে বরফে। এই বরফকে জয় করে কানাডিয়ানরা বের হয়ে এসেছে। ঝিলের শরীরে মোটা জ্যাকেট। তবু ঠান্ডায় কম্পন ধরে গেছে। ছোট ছোট বাচ্চারা চলছে স্কেটিং বোর্ড হাতে। কেউ কেউ আবার বাড়ির সামনে তৈরি করে রেখেছে ছোট বড় তুষার মানব। এসব দেখে ঝিলের বাচ্চা মন নড়ে উঠল। বিকেলের শেষ ভাগ নির্বিঘ্নে বাইরেই পার করল সে। সন্ধ্যার আলো যখন কানাডার টরন্টো শহর স্পর্শ করেছে তখন বরফ গুলো অন্যরকম দেখতে লাগল। কিছুটা রক্তিম হয়ে ধরা দিচ্ছে। এই সৌন্দর্য আগে দেখেনি ঝিল। আরও কিছু সময় বাইরে থাকতে পারলে ওর ভালো লাগত। তবে রাত বৃদ্ধির সাথে সাথে ঠান্ডার প্রকোপ ও বাড়ে। মেয়েটি তড়াক গতিতে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। ড্রয়িং রুমে এ হিটার জ্বালানো হয়েছে। পুরো ঘর উষ্ণতায় ভরে উঠেছে। লম্বা করে শ্বাস নিতে গিয়ে অনুভব হলো নাক বন্ধ হয়ে আছে। এই বিষয়টা ওর নিকট মারাত্মক বাজে। শ্বাস না নিতে পেরে মেয়েটি মুখ হা করে রইল। কি যন্ত্রণা! এমি সুস্বাদু রান্না বসিয়েছে। সেটা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ বের হচ্ছে। হাল্কা একটু নাকে এসে লাগলেও পরে আর ঘ্রাণটা বুঝতে পারল না ঝিল। এমি ইশারায় ডেকে নিল। কাছে যেতেই স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, “অনা দেখ তো খাবারটা কেমন হয়েছে।”
ঝিল মৃদু হেসে বাটিটা তুলে এক চামচ স্যুপ মুখে তুলল। খাবারটা নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। তবে ঘ্রাণটা ঠিক মতো নাকে যাচ্ছে না। এটাই সমস্যা। তবু সে হেসে প্রশংসার সাথে জবাব দিল।
“আমেজিং,তোমার হাতে রান্না সত্যিই অসাধারণ এমি।”
প্রশংসা শুনে হাসল এমি। ঝিল বাটিতে থাকা খাবারটুকু শেষ করে ডিভানে এসে গা এলিয়ে দিল। এত সময় বাইরে থেকে শরীর বরফ শীতল হয়ে গিয়েছে। এমি খাবার রান্না শেষে কিচেন গুছিয়ে দিল। তারপর ডাইনিং এ সব রেখে ঝিলের পাশে বসল। টিভি অন করে কিছু সময় এক সাথে ইংলিশ সিরিজ দেখল।
“অনা তুমি কানাডা ইনজয় করছো?”
“খুব। কানাডা আমার সত্যিই ভালো লেগে গেছে। তবে একটু বেশি ঠান্ডা।”
এমি হাসল। ঝিলের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে খুব দ্রুতই। মেয়েটির নাম উচ্চারণ করতে কিছুটা সমস্যা হয়। তাই অহনা নামটা থেকে অনা বলে শর্ট করে নিয়েছে। ঝিল নামটি সে কিছুতেই বলতে পারে না। প্রথম দিন নিজের নামের বিকৃতি শুনে ঝিলের দু চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। অনা কয়েকবার ইংলিশে অহনা মির্জা ঝিল লিখে প্র্যাকটিস ও করেছে। কিন্তু লাভের লাভ হলো না। উচ্চারণটা কিছুতে হলো না। হতাশ হয়েছিল সে। ঝিল কিছুটা বিরক্ত হলেও পরে অবশ্য সামলে নিয়েছে। কানাডার বরফ শীতল বাতাস এখন ঝিলের কাছে ভীষণ প্রিয়। চারপাশের অচেনা রূপ লাবণ্য ওকে আকৃষ্ট করছে। শুধু মনে হয় আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর!
এমি আর ঝিল গল্প করতে করতে বেশ কিছুটা রাত হয়ে গিয়েছে। অভিনবর গাড়ির শব্দ শোনা গেল। ঝিল ধরমরিয়ে উঠে পড়ে। দরজা খুলেই নজরে এল চওড়া বুক। লম্বাটে অভিনবর গায়ে সেমি লং জ্যাকেট। গলায় লাগানো আছে শুভ্র রঙা মাফলার। হাতে ব্যাগ। সব মিলিয়ে মানুষটাকে অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। পুরো দমে বিদেশী! ঝিল হা হয়ে তাকিয়ে। অভিনব ভেতরে এসে ডোর অফ করে দিল। এমির সাথে কুশলাদি করতেই এমি বলল, “আই হ্যাভ টু গো নাউ।”
অভিনব ভদ্রতার খাতিরে বলল, “আজকে থেকে যাও এমি। অনেক রাত হয়েছে।”
“নো। ইনজয় ইউর টাইম। বাই অনা। মিট ইউ টুমোরো।”
হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় ঝিল। অভিনব কিছুটা ক্লান্ত। হাতের ব্যাগটা সোফায় রেখে জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। ভারী পোষাকে অতিষ্ঠ সে।
“ক্লান্ত লাগছে?”
“কিছুটা।”
ঝিল পানি এগিয়ে দিল। অভিনব পানিটা শেষ করে বলল, “খাবার খাও নি কেন?”
“একা খেতে ইচ্ছে করে না।”
“এমি তো ছিলই।”
“তবু ভালো লাগছিল না।”
“বুঝেছি। আর লেট করবে না। আজই শেষ,ওকে?”
“হুম।” বরাবরের মতোই হুম বললেও অভিনব জানে ঝিল অপেক্ষা করবে। ওর ফেরা অবধি না খেয়ে থাকবে। স্যুপ আর রুটি করে গেছে এমি। শুরুর দিকে টেস্ট মিলাতে সমস্যা হচ্ছিল ঝিলের। কিছু দিন যেতেই সবটা মানিয়ে নিল। অভিনব ধীর স্থির ভাবে খাবার খেল। পুরোটা সময় সে খাবারে মনোযোগ দিয়েছে। খাবার শেষ হতেই ঝিল বলল, “তুমি কোনো ভাবে রেগে আছ?”
“না।”
“তাহলে?”
“তাহলে আবার কি?”
“কেন যেন মনে হচ্ছে রেগে আছ।”
“রেগে কেন থাকব!”
“আগের মতো ভালোবাসো না আমায়।”
“সত্যিই বাসি না?”
“হুম।” মাথা নুইয়ে ফেলল ঝিল। অভিনব অগোচরে হাসল। জ্যাকেট গুছিয়ে রেখে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এল। এদিকে ছটফট করছে ঝিল। গত দু মাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে। ঝিল সেদিন পারে নি অভিনবকে ছেড়ে দিতে। পরিবারের সম্মানের সাথে সাথে অভিনবর প্রতি ভীষণ আসক্ত সে। পরিবারের মায়া ফেলে সেদিন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল নিজের ভালোবাসাকে। বলেছিল দূরে কোথাও নিয়ে যেতে। যেখানে কোনো পরিবারের মোহ থাকবে না। থাকবে না কোনো দ্বন্দ্ব। মেয়েটির কথায় সায় জানায় অভিনব। পালিয়ে আসে ওরা। চোখের পলকে পাসপোর্ট ভিসা তৈরি করে ফেলে। দশ দিনের মধ্যে চলে আসে কানাডা। কেউ জানে না ওদের খবর। পারিবারিক দ্বন্দ্বের রোষানলে পুনরায় গা ভেজাবে না ওরা। এখানে এসেই ব্যস্ত হয়ে যায় অভিনব। ঝিল বুঝতে পারে ছেলেটির ব্যস্ততা। তবু কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করে। কতদিন হয় একে অপরের সাথে ঠিক ঠাক গল্প জমানো হয় না। দিনের বেলা এমির সাথে কাটিয়ে দিলেও রাতের আঁধার ওকে একাকিত্ব বোঝায়। এই নিয়ে কখনো অভিযোগ করে না মেয়েটি। ও বুঝতে পারে সব। তবু আজ অভিমান হলো। পুনরায় ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে ছেলেটা। ঝিলের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। মেয়েটি চাতক পাখির মতো চেয়ে। মানুষটা দেখছে না একটিবার! ওর মন খারাপ হলো। রুম থেকে বেরিয়ে ট্রেরেসে এসে দাঁড়াল। টরন্টো শহরটা তখন আলোয় ঝলমল করছে। ভীষণ রকমের সুন্দর লাগছে। বরফে ঢাকা গাছ গুলো থেকে থেকে ঝলকানি দিচ্ছে। কোথাও কোথাও আগুন জ্বালানো হয়েছে। সেই হলুদ আলোতে সিক্ত হয়ে আছে চারপাশের পরিবেশ। ঠান্ডা বাতাসটা একেবারে শরীর মন স্পর্শ করে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করল ঝিল। সবুজ সোনালি বাংলার বুক ভেসে উঠল। হঠাৎ করেই মনে হলো বাংলাদেশের থেকে সুন্দর বুঝি কিছু নেই। পাখির কিচিরমিচির, লোকজনের সমাগম। থেকে থেকে জঙ্গল নদী নালা পুকুর ঘাট। সবটাই ভীষণ সুন্দর। ঠান্ডা শক্ত পুরুষ হাতটি ঝিলের ঘাড় স্পর্শ করে গেল। এই স্পর্শটা ওকে নুইয়ে ফেলল মুহূর্তেই। চুল গুলো রাবার ব্যান্ডে বাঁধা ছিল। সেটা খুলে দিয়ে ঘ্রাণ নিচ্ছে অভিনব। ধীরে ধীরে নাক ঘষতে শুরু করেছে উন্মুক্ত ঘাড়ে। ঝিলের শরীর দৃশ্যমান ভাবে কাঁপছে। অভিনবর একটা হাত আচমকা তুলতুলে কোমরটা ছুঁয়ে গেল। ঝিলের বুঝি ম র ণ এসে গেছে। এই অনুভূতিটা ওকে একদম মিইয়ে ফেলেছে। ছেলেটার বাহুডোরে আটকে আছে ঝিল! ধীরে ধীরে কাছিয়ে এসেছে মুখটা। উষ্ণ ঠোঁটের আন্দোলনে ঝিল নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলল। খামচে ধরল ছেলেটির বাহু। ততক্ষণে অভিনব নিয়ন্ত্রণহীন। মেয়েটি আজ ওকে বাধ্য করেছে কাছে আসতে, সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে!
অভিনবর বুক জুড়ে প্রশান্তি। চিন্তাহীন ঘুমিয়ে আছে ঝিল। মেয়েটির ফর্সা উন্মুক্ত পিঠে ভালোবাসার চিহ্ন বসে গেছে। অভিনবর ক্ষেত্রেও তাই। মেয়েটি যেন ভেবেই রেখেছিল আজ নিজের উত্তাপে ভস্ম করে দিবে ওকে। এত যন্ত্রণা দিয়ে স্বার্থপরের মতো ঘুমিয়ে আছে মেয়েটি। অভিনবর হাসির রেখা লম্বা হলো। মেয়েটাকে বুকের সাথে আরেকটু মিশিয়ে ফেলল। পর পর চুমু খেল চোখে মুখে। ঝিল কিছুটা নড়ল। ঘুমুঘুমু দুটি চোখ। চাইল একবার। তারপর আবার আগের মতোই জড়িয়ে ধরল। ধীরে ধীরে অভিনবর হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল। বুকে মাথা এলানো। এক হাত গলা জড়িয়ে। অভিনব একটু নড়তেই বিরক্তি প্রকাশ করল।
“এত নড়ছো কেন? ঘুমাতে দাও প্লিজ।”
হেসে ফেলল অভিনব। মেয়েটির খোলা চুলে হাত গলিয়ে বলল, “সারা রাত আমাকে অশান্ত করে দিয়ে শান্তির ঘুম দিচ্ছ প্রজাপতি।”
ঝিল শুনল না। সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভোর হতে শুরু করেছে। অথচ অভিনবর ঘুম হারিয়ে গেছে। ঝিলের তুলতুলে পেটে হাত রাখতেই অভিনব চোখ বন্ধ করে নিল। মেয়েটা বুঝি ওকে সত্যিই মে রে ফেলবে!
দেড়ি করেই ঘুম ভাঙল ঝিলের। কানাডায় সূর্য কবে উঠবে কে জানে! সারাক্ষণ তুষার পাত হতে থাকে। এই সময়টা কিছু মানুষের জন্য আসলেই কষ্টের। কাজ কর্ম ফেলে ঘরে থাকতে হয় প্রায় সকলের। কম্বলের নিচে থাকা ঝিলের ছোট্ট দেহটা নড়েচড়ে উঠল। ধীরে ধীরে দিনের আলো দৃশ্যমান হলো। চোখ পিট পিট করে চাইল সে। উঠতে গিয়ে নিজেকে অনেকটাই উন্মুক্ত মনে হলো। লজ্জায় নুইয়ে পড়ল সে। পাশে তাকিয়ে বুঝল অভিনব নেই। চটপট উঠে পড়ল। সাইট টেবিলে একটা চিঠি। সাথে আছে এক কাপ চা। চিঠির ভাঁজ খুলল সে।
‘আমার লজ্জাবতীর মুখটা মিস করতে চাইছিলাম না। পরে ভাবলাম থাক আর লজ্জা না দেই। এমনিতেই গত রাতে আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। নখের দাগ বসে গেছে শরীর বেয়ে। ভাগ্যিস কানাডায় আছি নতুবা নিশ্চিত ধরে ফেলত বন্ধুরা।’
লেখাটা পরে আরেক দফায় লজ্জা পেল ঝিল। নুইয়ে পড়ল কম্বলের উপর। মানুষটা লজ্জা দেবার জন্যেই বুঝি এভাবে লিখেছে। চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেটা গরম করে নিল সে। তারপর জ্যাকেট জড়িয়ে বের হলো। অনেকেই উঠে গেছে। উঠার ই কথা। কম তো নয়। দশটা বাজে! রাস্তা গুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। যথাসম্ভব বরফ সরিয়ে রাখছে। প্রতিটা বাড়ির উঠোনেই রয়েছে ম্যাপল গাছ। সেগুলো এখন বরফে ঢাকা। দু একটা পাতা তবু উঁকি দিচ্ছে। বিষয়টা খুবই সুন্দর লাগে। ঝিল মুগ্ধ নয়নে তাকাল। এই সময়ে ওর মনে হলো কানাডার সব সৌন্দর্য বুঝি এই ম্যাপল গাছেই!
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
**অনেকেই গতকাল ঝিলকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন। একটা কথা বলেন নায়ক নায়িকা মানেই কি সে সবার সেরা? তার কোনো ভুল থাকবে না? যদি তেমনি হয় তবে আমি সত্যিই মাফ চাইব। ঝিলের দিক থেকে ঝিল ঠিক ছিল। অভিনবর কাছে অভিনবর পরিবার যেমন আপন তেমনি ওর নিকট। তাছাড়া আমি বাস্তব কিছু তুলে বসাচ্ছি না অনেক ঘটনা ঘটে যা আমরা জানি না। সবার মাঝেই ভালো খারাপ মান অভিমান রয়েছে। মেইন চরিত্র মানেই তুলসিপাতা নয়।পাঠক একটু ধরে সয়ে বুঝে মন্তব্য করার অনুরোধ।**