#সুখ_একটি_প্রজাপতি (৩৫)
সুখের দাম অনেক বেশি। সেই সুখ যদি টাকা দিয়ে কেনা যেত তবে নিশ্চয়ই সুখ কিনে নিত অভিনব। নিজের জন্য নয়,কাছের মানুষগুলোর জন্য। এই যে ওর হৃদয়ে সকলের জন্য মায়া জাগে, এসবের নেই কোনো মানে। তবু সে চায় একটু সুখ এনে দিতে। তাই হয়ত কল করেছিল আরফানের নাম্বারে। ছেলেটার কথায় তখন আত্মগরিমা, সাথে অবশ্য স্বীয় পরিবারের প্রতি ঘৃণাও রয়েছে। সে সাফ সাফ বলল, “তোর জীবনটা আজ এমন কেন বল তো, তাদের জন্যেই তো। না হলে আজ কত সুখী থাকতি। আর তুই নিজেও বা কেমন, অন্যের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিচ্ছিস।”
কত সহজে কথা গুলো বলল আরফান। অভিনবর বলতে ইচ্ছে হয় পরিবারকে নিয়ে যে সুখ, সে সুখের মতো আর কিছু নেই। তবে সেসব বলল না সে। প্রসঙ্গ বদলানোর ন্যায় বলল, “তোমার জীবন কেমন চলে?”
“বিন্দাজ।” কথায় যে শরীর ছাড়া ভাব তা বেশ বুঝতে পারছে অভিনব। কথার এক পর্যায়ে মুনতাহার কথাটা বলল। ওপাশের ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই কেঁপে উঠেছে। অনেক দিন পর নামটি শুনেছে কীনা। কিন্তু চালাক চতুর সে খুব সুন্দর সামলে নিল নিজেকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভাব করে বলল, “মুনতাহাকে ধরে নেই আমি। সে নতুন জীবন শুরু করলেই পারে।”
কি নিষ্ঠুর শুনায় শব্দ গুলো। এই সময়ে আরফানের জন্য বড়ো আপসোস হলো অভিনবর। ছেলেটা বুঝতে পারছে না কত বড়ো ভুল করেছে সে। কথার বদল প্রয়োজন বোধ করে এক পর্যায়ে আরফান নিজ থেকেই বলল, “বাবা আমার সাথে কাজটা ঠিক করে নি।”
“মামা যা সঠিক মনে করেছেন তাই করেছে আরফান ভাই। তুমি তো তাও বাড়িতে থাকতে পেরেছ,কিন্তু দানেশ তো ঘর ছাড়া।” আরফান যেন একটু মজা পেল। হাল্কা হেসে জবাব দিল, “মাসে মাসে তো খরচ পাঠানো হয়।”
“টাকার থেকে সম্পর্ক বড়ো আরফান ভাই।”
“মামার হয়ে সাফাই গাচ্ছিস?”
“তেমন নয়। আচ্ছা বাদ দাও। তোমাকে যে কারণে কল করা,মুনতাহাকে বুঝিয়ে বলব যাতে তোমায় ডিভোর্স দেয়।”
“হুম।” বলেই মৌন হয়ে গেল আরফান। অভিনব বুঝল সঠিক জায়গায় ঘায়েল করেছে সে। হাজার হোক, একসাথে অতো গুলো বছর থেকেছে। ডিভোর্সের কথা বলে একটু হলেও টনক নড়ানো গিয়েছে। কল রেখে টান হয়ে বসল অভিনব। ঝিল গোসল করে এসেছে। ভেজা চুল গুলো থেকে টুপ টুপ করে পানি ঝরছে। সেদিকে তাকিয়ে পুরুষ মন জেগে উঠল। খানিকবাদেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সে। একে অপরের উষ্ণতায় মেখে যাচ্ছে কেবল। অথচ ওরা জানতে ও পারল না সুন্দর এই মুহূর্ত দেখে কারো বুকের শ্বাস থেমে গেছে!
বাচ্চাদের ঘুরাঘুরিতে যেতে চাইলেন না দম্পতি। তাদের জোরাজুরি করছে ঝিল। বার বার বলে যাচ্ছে গেলে ভালো লাগবে। কিন্তু তারা সায় দিচ্ছেন না। যৌবনে কম ঘুরেন নি ওনারা। তাছাড়া বাচ্চাদের মধ্যে গিয়ে একটা অস্বস্তি তৈরি করতে চান না। তার থেকে ভালো বাড়িতে বসে দুজনে সিনেমা দেখবে। অনেক দিন হয় এক সাথে বসে সিনেমা দেখা হয় না। প্রস্তাবটা দারুণ লাগল অভিনবর। সে ঝিলকে বুঝিয়ে বলল। মা বাবার একান্তে সময় গুলো নিশ্চয়ই সুন্দর। এদিকে আফরা আর মাহেরা তৈরি হচ্ছে। মেকাপ লাগাতে লাগাতে অগোছালো ভাবে মাহেরা শুধায়, “আমাদের জীবন থেকে প্রিয় মানুষ গুলোর অস্তিত্ব এত দ্রুত হারিয়ে যায় কেন রে আফরা?”
আফরা উত্তর করতে পারল না। মাহেরা আলগোছে উঠে এসেছে। চোখের নিচে তার কালি জমেছে। কনসিলার দিয়ে ঢেকে নিলেও চোখে মুখে বিষণ্নতা বোঝা যাচ্ছে। হাল্কা শীতল বাতাবরণের সাথে ভেসে আসছে চন্দন কাঠের মিহি সুবাস। কিচেন থেকে আসছে বাহারি সব সুস্বাদু রান্নার ঘ্রাণ। সেসব পেটের ভেতর মোচড় দিলেও মনটাকে প্রশমিত করতে পারছে না। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। আফরার হাতের উষ্ণতা পেয়ে ঘুরল মাহেরা।
“তুই ভেঙে পড়েছিস।”
“জানি না,কেন যে এত আকর্ষণ পাই। অথচ সে আমার জন্য নিষিদ্ধ।”
“নিষিদ্ধ বলেই এত আকর্ষণ। তুই অত্যন্ত জেদী মানুষ। মেনে নিতে পারছিস না ঝিল আর অভিনব ভাইয়ার বিয়েটা।”
“হয়ত।”
বিষণ্নতায় ভরা কণ্ঠটা কেমন কম্পন ধরে গেল। হৃদয়ে উদয় হয়েছে তকতকে সব ক্ষ ত। এত খারাপ লাগছে ওর। চোখের সামনে অভিনব আর ঝিলের প্রেমলীলা সত্যিই ওকে কষ্ট দিচ্ছে। একটু নয় অনেকখানি কষ্ট।
খুব সকালে রওনা হয়েছে ওরা। ঝিলের খোলা চুল গুলো হাল্কা দোল খাচ্ছে। অভিনব সেটা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,”তোমার এই চুলে আমার ভীষণ লোভ জাগে।”
“কেন?”
“জানি না। তবে বুকের ভেতর কেমন করে।”
“যা তা।”
“হুম সত্যি। সারাক্ষণ রোমান্স এর ভূতে ধরে। দিনের পরিধি কমিয়ে আনতে পারলে ভালো হতো। একজন স্বামী জানে দিনের থেকে রাত কতটা সুন্দর।”
চোখ রাঙিয়ে হাসল ঝিল। অভিনবর বলিষ্ঠ হাতের মধ্যে নিজের হাত ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“ইস তুমি কেন এত বছর আমার কাছে এলে না বলো তো।”
“আপনি তো তখন পিচ্চি ম্যাডাম। আঠারো না হওয়া অবধি কিছুই করা যাচ্ছিল না।”
ঝিল কিছু বলল না। অভিনবর কাঁধে মাথা এলিয়ে রাখল। ওরা গাড়ির পেছনের সিটে বসেছে। তার আগে বসেছে আফরা,মাহেরা আর মুনতাহা। ফিসফিস করে বলা কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে মাহেরা। সে ব্যথা নিয়ে আফরার দিকে তাকাল। আফরা শক্ত করে হাতটা ধরল। ইশারায় বুঝাল এটা ওদের অধিকার। পরের রাস্তাটুকু অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গান শুনতে শুনতে এল মাহেরা। ওর এই বিষণ্ন মুখটা দেখে মাহের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বোনের অনুভূতি ধরেছিল অনেক আগেই। ভেবেছিল অভিনবর সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করবে। কিন্তু তেমনটা হওয়ার ছিল না। সে বহু আগেই অন্যের অধিকার ধরে গেছে।
টরন্টো চিরিয়াখানা যেমন বিশাল তেমনি এর স্নিগ্ধ এর সৌন্দর্য। দারুণ এই পরিবেশে মুগ্ধ হতে থাকে কত পর্যটক। এর বিশেষত্বর মূল হচ্ছে পরিবেশ। চিরিয়াখানার ভেতরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য’র পাশাপাশি রয়েছে বিনোদন কেন্দ্রও। অনেকটা রুপকথার মতোই সাজানো। মাহের গাড়ি থেকে নেমে লম্বা এক শ্বাস নিল। মুক্ত বাতাসে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে এসেছে। ঝিলের হাত ধরে আছে অভিনব। বিষয়টা মাহেরাকে যন্ত্রণা দিলেও মুখ বুজে রইল সে। হাজার হোক,তাদের সম্পর্ক তো বৈধ। ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় পো ড়া গন্ধে পরিবেশটা নষ্ট না হোক। সে মুনতাহার পাশে এসে দাঁড়াল।
“কেমন লাগছে আপু?”
“ভালো। তোরা আছিস এতেই শান্তি।”
“আমি জানি তোর কষ্ট হচ্ছে।”
“একদমই নয়।”
“মিথ্যে বলিস না।” বলেই বোনকে চেপে ধরল মাহেরা। হাল্কা হাতে পিঠ বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “কথা ছিল এ বছরই আরফান ভাইয়ার সাথে কানাডা ট্যুরে আসবি তুই। টরন্টো জু তে আসা নিয়ে সব থেকে বেশি উত্তেজনায় ছিলি। অথচ সবটা হচ্ছে,কিন্তু আরফান ভাইয়া নেই।”
“এসব কথা বলিস না মাহেরা।”
“দুঃখ আড়াল করছিস?”
“উহু।”
“তবে?”
“ভালো থাকার চেষ্টা করছি। যেমনটা করছিস তুই।”
দৃষ্টি সরিয়ে নিল মাহেরা। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে মুনতাহা বলল, “দেখছিস তো, তোর আপু কত কষ্টে আছে। ঝিলের জীবনে বাঁধা হোস না বোন। সৃষ্টিকর্তা সইবে না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাহেরা। বোনের দিকে তাকাতেও অস্বস্তি হচ্ছে তার। খানিক বাদে অভিনব সবাইকে ডেকে নিল। ঝিলের হাতে চকলেট আর চিপসের প্যাকেট। আফরা একটু মজা করে বলল, “ভেতরে লাঞ্চ করার ব্যবস্থা আছে ঝিল। তবে এসব কেন?”
একটু করে হাসল ঝিল। অভিনব মেয়েটার কপাল বেয়ে নেমে আসা চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল, “ওর ছোট ছোট ক্ষিধে পায়।”
লজ্জা পেল মেয়েটি। অন্যদিকে সবাই হাসছে। অভিনব ও হাসল। নাকে স্পর্শ করে বলল, “আজকাল আমার ও ছোট ছোট ক্ষিধে পায়।”
আর কেউ না বুঝলেও অভিনবর ইশারা বুঝতে পারল ঝিল। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে ওর ফর্সা ছোট মুখটা। মানুষটা সকলের সামনে এমন ভাবে লজ্জা দিচ্ছে কেন!
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
**আগামী পর্ব থেকে আমরা টরন্টো জু ঘুরব। আসা রাখছি দারুণ হবে পর্ব গুলো।**