#শখের_সাদা_শাড়ি
১৭.
তুলি রাগ দেখিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছে। সৌজন্য দু একবার ফোন করা সত্তে ও তুলির বাবা মুখের উপর সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ে দিবেন না। আর খুব দ্রুত নাকি ডিভোর্স ফাইল করা হবে।ঝোকের বসে বিয়ে করেছিল সৌজন্য। তাই কাবিন এর টাকা টা বসিয়েছে পনেরো লাখ। তুলি বড়লোকের মেয়ে। সে যখন পনেরো লাখ টাকা কাবিন এর কথা বললো সৌজন্য নিজেকে প্রভাবিত করে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেল। কারণ স্বপ্নে ও ভাবে নি দুজনের ছাড়াছাড়ি হবে। এদিকে সেভিং এর টাকা টা ও করেছিল তুলির নামে। সেটা থাকলে ও কিছু একটা সাহায্য হতো। এতো গুলো টাকা কোনো ভাবেই সৌজন্যের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না। কি দিন কাল এলো ভালোবাসার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন টাকার চিন্তা করতে হয়।একবার ভাবলো বাড়ি টা বিক্রি করবে কিন্তু নিজের ভাগের টা বিক্রি করলে ও খুব হলে এই অসময়ে সাত লাখ টাকা আসবে। এর বেশি পেতে হলে অপেক্ষার প্রয়োজন। উর্মি আর মেঘনা নিজেদের অংশ দিয়ে দিবে বলে স্থির করলো। ঠিক তখনি বের হলো বাড়ি টা আটকা পরে আছে ব্যাংক এ। নোটিশ দেওয়া হয় নি ষড়যন্ত্র করে। এতো শতো চিন্তা এসে উদয় হলো যে উর্মি সহ সকলের মাথা খারাপ। বড় ভাবি কান্না জুড়ে দিয়েছেন। স্বামীর বেতন ভালো না। অতি সামান্য ই সেভিং পরে আছে। অন্তুর ভবিষ্যৎ একে বারেই ফাঁকা। মেঘনা খুব ই বিরক্ত। আজকাল এমনি তেই আবেগ এর থেকে মেজাজ চলে বেশি। ব্যক্তি গত জীবনে খুব একটা সুখে নেই যে। উর্মি ভেতরে ভেতরে একে বারেই ভেঙে গেছে তবে বাইরে টা নারিকেলের মতোই শক্ত। জীবনে প্রথম বারের মতো সৌজন্য কেঁদে উঠলো। খুব ছোট সময়ে কাঁদলে ও একটু বুঝ হওয়ার পর থেকে কেন যেন ছেলেটার চোখে কখনো জল আসে নি। কেমন যেন শক্ত ধাঁচের। এটা সত্য তুলি কে খুব ভালোবাসে সে। না হলে স্ত্রী এর কথা তে পরিবার কে কেউ অবহেলা করে? নিজের ভুলে পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ভাইয়া। এসব দেখে উর্মির মনে চলছে নিরব ঝড়। যে ঝড়ে উর্মি কে সঙ্গ দেবার জন্য কেউ নেই। ভাইয়া কে জড়িয়ে ধরে সৌজন্য। অমর খুব একটা সান্ত্বনা দিতে পারলো না। সঞ্চয় যা আছে এতে করে নিজেদের ই টানাটানি লাগবে। এদিকে ব্যাংক এর লোন বেড়ে গিয়ে হয়েছে বিশ লাখ টাকা। এগুলো পরিশোধ না করলে মাস খানেক এর মাঝে পরিবার নিয়ে বের হতে হবে রাস্তায়। জোৎস্না চোখ রাঙালো। স্বামী সন্তান নিয়ে কেটে পরাই মঙ্গল। তবে অমর আসছে না দেখে তেঁতে উঠলেন তিনি।
” কি শুরু করলে তুমি? এখানে পঁচে গলে মরবে নাকি? আর কার জন্য ঠাই খুঁজো? দুদিন আগে ও যে বউ এর আঁচলের তলা তে পরে থাকতো। ”
” আহ জোৎস্না। ”
” একদম কথা বলবে না। চুপ থাকি বলেই আজ আমাদের কপাল পুরলো। ”
জোৎস্না আবার মরা কান্না জুড়ে দিলো। সৌজন্য ফুপিয়ে উঠে। অমর দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে চলে যায়। মেঘনা বসে আছে সোফা তে। পেটে চেঁপে রাখা হাত। মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বলে। উর্মি ধীরে ধীরে সব কাগজ পত্র ঘাটে। একে একে বের করে সমস্ত ডিটেলস। চোখের সামনে সব যেন ভাসে। বড় আপার বিয়ের জন্য বাবা লোন নিয়েছিলেন। তবে সেটা ছিলো দুই লক্ষ। এখানে দেখাচ্ছে বারো লক্ষ। একে একে সব কাগজ ঘাটতে লাগলো উর্মি। এই যে লোনের কাগজ পত্র সব ঠিক করেছিল নয়ন ভাই। ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়া তে লোন টা ও খুব সহজেই পেয়ে গিয়েছিল। আর এই কারনেই নয়ন ভাই এর সম্মান ছিলো একটু বেশি। বিয়ের আগে থেকেই এই পরিবারের জন্য অনেক কিছু করেছে এটাই ছিলো সকলের ধারণা। উর্মির মাথা টা ভন ভন করছে। একটা ব্রেক দরকার। সে যা ভাবার ভেবে নিলো। শেষ টা যাই হোক না কেন সব টা খোলসা করবেই।
সৌমেন কে নিয়ে আর্তনাদ চলছে বাড়ি তে। সব থেকে বেশি পাগলামো শুরু করেছেন লতিফা বেগম। একমাত্র ছেলের জন্য প্রাণ যেন বেরিয়ে আসে। ব্রেন হ্যামারেজ হয়েছে সৌমেন এর। এর কারণ জানা নেই। উর্মি এসেছিল অফিস এর ফাইল নিয়ে। কান্নার শব্দে স্থির হয়ে যায়। অনুজ কিছু একটা ভাবছে। যেন দ্বিধা তে ভুগছে। মাহফুজ সাহেব তীব্র বেগে চিৎকার করে যাচ্ছেন। ডাক্তার জানিয়েছেন সৌমেন কে দীর্ঘ দিন ধরে এমন বি ‘ ষ দেওয়া হয়েছে যার ফলে সমীর এর ব্রেনের নার্ভ গুলো শুকিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পুরো দমে পাগল করার জন্য এই মেডিসিন এর ব্যবহার করা হয়। এসব ষড়যন্ত্র কার সেটা জানার জন্যই তিনি পুলিশের কাছে কেস ফাইল করেছেন। উর্মি কে দেখে বাড়ির কাজের লোক সরবত দিয়ে গেলেন। সরবতের তরল গলা দিয়ে নামছেই না।
অনুজ মাহফুজ সাহেব এর সাথে কথা বলে।
” আঙ্কেল আপনার সাথে আমার কথা আছে। ”
” বলো বাবা। আমার ছেলেটার অবস্থা ভালো হবে না তাই না? ”
” ভেঙে পরবেন না। ডাক্তার বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
” সান্ত্বনা দিও না বাবা। ”
ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পরলেন। উর্মি মুখ চেপে ধরে আছে। চোখ দুটো কেন যেন ভিজে আসে। অনুজ মাহফুজ সাহেব এর কাধে হাত রেখে ভেতরে চলে গেল। ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে রইলো উর্মি। সমীর এর কল দেখে নিজেকে পরিপাটি করলো। কথা বলতে বলতে বের হলো বাসা থেকে।
” স্যার এর অবস্থা ভালো না সমীর। ”
” সেটাই শুনলাম। সেই জন্য ই তোমায় কল করেছি। ”
” ওও। ”
” তুমি কোথায় এখন? ”
” সৌমেন স্যার এর বাসা থেকেই বের হলাম। ”
” ঠিক আছে। ”
” তুলি ভাবির বিষয় টা? ”
” খোঁজ চালাচ্ছি। আমার এক বন্ধু আছে গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। সে দেখবে বিষয় টা। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। ছোট ভাইয়া কে বড় অসহায় লাগে। ভালো লাগে না আর। ”
” তুমি খুব একা ফিল করছো তাই না? ”
” আরে না। একা ফিল কেন করবো। আমি ঠিক ই আছি। ”
উর্মির ভাঙা গলা বুঝতে পারে সমীর। চোখ দুটো ছলছল করছে। উর্মি কে খুব দ্রুত গুড নিউজ দিতে চায় সে। সে জন্যেই এখন চুপ রয়েছে।
” কি করো এখন? ”
ধ্যান ফিরে সমীর এর। গলা টা কেশে নিয়ে জানায় কাজ করছে। তারপর বলে
” আজ সন্ধ্যায় সময় আছে তোমার? ”
” হ্যাঁ। এখন তো অফিসে কাজ ও হয় না। স্যার যাওয়ার পর যা হলো। কি জানি চাকরি টা থাকবে কি না। বাড়ির লোন আর ছোট ভাবির কাবিন এর টাকা। একে বারে পয়ত্রিশ লক্ষ টাকার ধাক্কা। ”
টাকার অংক টা এতো বেশি যে কোথাও থেকে সাহায্য চাওয়ার ও পথ নেই। উর্মি হাসার চেষ্টা করে।
” তবে দেখি কি করা যায়। ”
” হুম। আর শোনো,আজ শৌখিন এর সাথে দেখা করবে সন্ধ্যায়। ও আমার গোয়েন্দা বন্ধুর ব্যপারে খোঁজ দিবে আর তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। ”
” আচ্ছা। ”
অফিস থেকে কাজ সেড়ে শৌখিন এর সাথে দেখা করলো উর্মি। এক টা কেস নিয়ে ব্যস্ত থাকাতে আধ ঘন্টার মতো লেট হলো প্রবীণের। ছেলেটা খুব করে আশা দিয়েছে উর্মি কে। আর যাই হোক সত্য টা বের করে দিবে সে। এতে করে বেশ ভরসা পেল উর্মি। তবে বাসায় ফিরে দেখলো অবস্থা খারাপ। রান্না হয় নি আজ। মেঘনা কোনো মতে কিচেনের দিকে আগাচ্ছে। উর্মি ছুটে গিয়ে বাঁধা দিলো। তারপর ডাল চাল ফুটিয়ে রান্না করলো। এক পর্যায় মনে হলো আজ তো ডাল ভাত জুটলো কপালে। তবে কাল কি হবে? কে জানে কি আছে কপালে।
তিন দিন পর
তুলি আজ পরেছে ওয়েস্টার্ন ড্রেস। লাল টকটকে লিপস্টিক ঠোঁটে। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে বসেছে বার এর সব থেকে শেষের টেবিল টা তে। উর্মি কে ফোন করেছে প্রবীণ। লোকেশন পাঠাতেই চলে এসেছে উর্মি। ট্যাক্সির ভাড়া দিয়ে ভেতরে আসলো। কল করতেই প্রবীণ চলে এলো। উর্মি চার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল
” বার এ কেন? ”
” ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবে। ”
” ছোট ভাবির কোনো ইস্যু? ”
” ইয়েস। ”
ব্যস্ত দেখালো উর্মি কে। খুব দ্রুত হাঁটা তে হাত ধরে ফেললো প্রবীণ। উর্মি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
” কি হলো? ”
” ধীরে যাও। না হলে কিছুই দেখতে পাবে না। ”
” ও আচ্ছা। ”
নিস্তব্ধ গতিতে হাঁটতে লাগলো উর্মি। প্রবীণ ক্ষণে ক্ষণে কারো সাথে কথা বলছে। দুটো মাক্স হাতে নিলো। এক টা মাক্স উর্মি কে দিয়ে আরেক টা নিজে পরে নিলো। আর তারপর দুজন এমন ভাবে ভেতরে গেল যেন গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। উর্মির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। যদি ও সমীর এর খুব ভালো বন্ধু প্রবীণ। তবে ওর জীবনে সমীর ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। জীবনে কোনো পুরুষের স্পর্শ পাওয়া হয় নি। তবে সমীর এর অনেক কাছাকাছি ছিলো। এক মুহুর্তের জন্য সেই ভাবনায় ডুবে গেল উর্মি। প্রবীণ ইষৎ টান দিতেই ছেলেটার কাছাকাছি চলে এলো। দম বন্ধকর পরিবেশ!
উর্মি হাফসাফ করছে। প্রবীন ওয়াইন এর গ্লাস এগিয়ে দিলো। উর্মি অবাক হয়ে বলল
” আমি এসব খাই না। ”
” আরে আমি ও খাই না। জাস্ট দেখানোর জন্য। ”
” ওও। ”
প্রবীণ এর অনুকরণ করলো উর্মি। দুজন ই মদের গ্লাস টা ঠোঁটের কাছে নিয়ে আবার রেখে দিচ্ছে। দেখে মনে হলো দুজনেই মদ পান করে। উর্মির গা গুলিয়ে আসে। বমি বমি ভাব হতেই ওয়াসরুমের দিকে যেতে নেয়। ঠিক তখনি দরজা দিয়ে প্রবেশ করে নয়ন। গায়ে টি শার্ট। প্যান্ট এর হাঁটুর দিক টা স্টাইল করে কাঁটা আর ভ্রু তে লাগানো রিং। মাথার ক্যাপ টা পরা তে পুরোপুরি বখাটে লাগে। উর্মির মাথা ঘুরে যায়। বমির কথা ভুলে যায় সে। প্রবীন ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। উর্মি হতবিহ্বল! ইষৎ কাছে আসে প্রবীণ।কানের কাছ টায় ঝুকে বলে
” এখন দেখবে ফিল্ম টা। ”
হাতের আঙুল উপরে উঠিয়ে মৃদু স্বরে কাউন্ট করে প্রবীণ। উর্মি দেখতে পায় নয়ন ধীর পায়ে তুলির দিকেই আগাচ্ছে। এবার যেন উর্মি মাথা ঘুরিয়ে ই পরে যাবে। পায়ের তলা তে মাটি নেই বললেই চলে। প্রবীণ মুখ দিয়ে জিরো উচ্চারণ করার সাথে সাথে নয়ন আর তুলি একে অপর কে জড়িয়ে ধরে! শুধু তাই নয় একে অপর এর সাথে এমন মাখামাখি শুরু করে যে ঘৃনায় জ্বলে উঠে উর্মির চোখ। সব টা পরিষ্কার এখন। উর্মি আর সহ্য করতে পারে না। ছুটে গিয়ে তুলি আর নয়ন এর গালে চড় বসায়। প্রবীণ মাথায় হাত রেখে বলে ” শীট”। আর একটু আগালে ব্যাপার টা অন্য রকম করার একটা চান্স ছিলো। হয়তো বা দুজনের চরিত্রের গুন গুলো নিয়ে কেস ফাইল করা যেতো। তবে এখন দুজনেই সাবধান হয়ে যাবে। বড় ভুল হয়ে গেল!
চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
পর্ব ১৮
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/159677399926496/