শখের_সাদা_শাড়ি ১৮.

0
130

#শখের_সাদা_শাড়ি
১৮.
মেঘনা কাতর চোখে তাকালো। উর্মির বলা প্রতি টা কথা শুনতে পেয়েছে। নেত্র যুগল বাঁধাহীন অশ্রু ঝড়ায়। এক সময় পেট চেপে ধরে বসে পরে। আর্তনাদ শুরু হয়। উর্মি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আপা কে। সৌজন্য নিজের রুমে বসে শূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো সিলিং এর পানে। উর্মির চিংকারে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে। মেঘনার পেইন দেখে বুঝতে পারে হসপিটালে নিতে হবে। প্রথমে চেষ্টা করে মেঘনা কে কোলে নেওয়ার। রোগা পাতলা বোন টা খুব ভারী হয়ে গেছে। একা নেওয়ার মতো শক্তি নেই শরীরে। পরমুহুর্তেই মনে হলো এই দায়িত্ব টা এক ভাইয়ের। আর ভাইয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তার রহমত ছিলো বোধহয়। মুটিয়ে যাওয়া বোন টা কে কোলে তুলে ফেললো সে। উর্মি আর্তনাদ এর স্বরে বলল–
” ভাইয়া তুমি পারবে না। ”

” পারবো। ”

কথা শেষ না করেই ছুটতে থাকে স‍ৌজন্য। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে উর্মি। তার বউ সোহাগি ভাই টা আজ বোন সোহাগি। এই ভাইয়ের দেহে কোনো পাপ নেই আর না আছে কোনো সংকোচ।

হসপিটালের করিডোরে পায়চারি করছে মানুষ গুলো। সবাই মেঘনার নিজের লোক। বড় ভাবি বড় ভাইয়া ছোট ভাইয়া অন্তু আর ওর মা সম বোন উর্মি। প্রতি টা মানুষ আজ এখানে উপস্থিত কেবল ভালোবাসা নিয়ে। বড় ভাবি লোভী হলে ও মেঘনার খবর টা পেয়ে ছুটে এসেছেন আজ। গত কয়েক দিন বাবার বাড়ি তে থেকে শিক্ষা হয়ে গেছে। বিয়ের পর বাবার বাড়ি যে অবহেলার স্থান হয়ে যায় সেটা খুব ভালো টের পেয়েছেন।অপরাধবোধ হয়েছে এতোদিন। আজ একে বারে সব ছেড়ে চলে এসেছেন। খুব করে বলে এসেছেন ভাই ও তাদের বউ দের বাঁচি মরি সব স্বামীর বাড়ি তে। রাস্তায় থাকলে স্বামী সন্তান ননদ দেবর দের নিয়ে এক সাথে থাকবো। তবু তোমাদের মতো হবো না আর। উর্মি এতো কষ্টের মধ্যে ও সুখ পেল। বহু দিন ধরে এমন পরিবার পায় নি সে। অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে আজ আলোর দিশা পেয়েই গেল। উর্মি কে বুকে টেনে ধরলো জোৎস্না। কয়েক বার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে তাকাতেই উর্মি বাধা দিলো। সে শুধুই বাবা মায়ের গড়ে তোলা শখের পরিবার টা কে দেখতে চায়। লাল বাতি টা নিভে গেল। কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। প্রতি টা মানুষ ছুটে এলো। ডাক্তার গম্ভীর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন
” মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ”

প্রতি টা চোখ ছলছল করে উঠলো। ছেলে মেয়ে নিয়ে কখনোই হিংসে ছিলো না কারো মনে। সুস্থ এক বাচ্চা চেয়েছে কেবল। উর্মি ভেতরে যেতে চাইলে ডাক্তার বললেন পরে যেতে। রোগীর রেস্ট এর প্রয়োজন।

একটু সুস্থ বোধ হতেই মেঘনা বাবু কে দেখতে চাইলো। পাশ থেকে নার্স বললেন বাবু কে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মেঘনা উঠে বসার চেষ্টা করে। ঠিক তখনি ডাক্তার এসে আটকে দেয়। স্পর্শ টা এতো টা কোমল যে মেঘনার নারী মন কেঁপে উঠে। স্পষ্ট অনুভব করে ডাক্তার এর হাত কাঁপছে। ডাক্তার বলে
” উঠো না এখন। ”

কন্ঠ টা ঠিক চেনে না মেঘনা। তবে চেনা লাগে। অচেনা কন্ঠের স্বর টা মাক্স পরে থাকায় মুখ টা দেখা যাচ্ছে না। মেঘনার শ্বাস কেমন ঘন হয়। ডাক্তার দ্রুত অক্সিজেন লাগিয়ে দেন। মেঘনা চোখ বন্ধ করতেই মাথায় হাত বুলায়। মেঘনা মৌন থাকে। তারপর হঠাৎ করেই কেঁদে উঠে। জীবন তাকে কি পরীক্ষায় ফেললো?

নর্মাল ডেলিভারী। এতো সময় যাওয়ার পর ও রোগীর সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না। বাবু কে নিয়ে আসা হয়েছে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা। তুলতুলে দেহ টা উর্মি কে কেমন দায়িত্বশীল করে তুলে। মনে হয় এই মাংসপিন্ড টা ওর নিজের শরীরের। খুব সুন্দর কপাল টা। এই কপালের দিকে তাকিয়েই সমীর এর কথা মনে হয়েছে। এই সময়ে ছেলে টা কে বিরক্ত করতে চায় না উর্মি। এমনি তে ও অনেক করেছে ওর জন্য। উর্মি কেবিন এর দিকে আগায়। দরজা খুলে যে দৃশ্য দেখে এতে করে ও নিজেই কেঁপে উঠে। দ্রুত প্রস্থান করে। হাত পা শীতল ঠেকে।

আলিদের বুকের ঠিক মাঝ খান টায় মাথা ছিলো মেঘনার। এই ছেলেটা কে জীবনে সব থেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে সে। বাবার সাথে কমিশনারের মৌন বিবাদ ছিলো। আলিদ কে ভালোবাসা সত্তে ও অনুভূতি গুলো কে লুকিয়ে রেখে ছিলো মেঘনা। সব টা উজাড় করে ভালোবেসেছে নয়ন কে। আলিদ কে ভুলেই গিয়েছিলো এক প্রকার। সেই আলিদ আবার ফিরে এলো ওর জীবনে। মেঘনা সচকিত হয়। আলিদ এর থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। ছেলেটা যেন কষ্ট পায়। মেঘনা চোখ মুছে।
” আমি আসলে স্যরি মেঘনা। ”

” স্যরি তো আমার বলার কথা। ”

” তুমি কেন স্যরি হবে তাই না। দোষ তো আমার কপালের। ”

ঠোঁট কামড়ে উত্তর করে মেঘনা
” আমিই অভাগি। যেখানে যাই কপাল পুরে যায়। ”

” ছিই ছিই কি সব বলছো! ”

” ভুল কি বললাম বলো। জীবনে সব থেকে বড় পাপ ছিলো তোমার মতো মানুষ কে ফিরিয়ে দেওয়া। আমি কখনোই তোমার যোগ্য ছিলাম না। অথচ সেই আমি টাই তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। ”

” প্লিজ মেঘনা এসব বাদ দাও। ”

” বরাবর ই আমার দোষ লুকাও তুমি। ”

কথা বলার সময় চোখ হাসে মেঘনার। আর তারপর ই মেঘনার রক্তে রক্তে ছেঁয়ে যায় বিষন্নতা। আলিদ এর মুখ টা এক বার দেখে নিয়ে বুঝে জীবন অনেক এগিয়ে চলেছে। আলিদ যেটা বলতে চায় সেটা সম্ভব না। দ্বিতীয় বারের মতো ছেলে টাকে ফিরিয়ে দিল মেঘনা।সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আর আজ ফিরিয়ে দিলো আলিদ এর ভালো ভেবে। আজ ওর কষ্ট নেই শুধু আফসোস হলো কেন সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলো সুদর্শন এই প্রেমিক পুরুষ কে? কি হতো বাবার অবাধ্য মেয়ে হলে। কত শত এলোমেলো চিন্তা করলো মেঘনা যার সৃষ্টি আছে তবে সমাধান নেই। বিচিত্র এ জীবন নিয়ে যতোই ভাবে ততোই অবাক হয়। শখের জিনিস গুলো বড্ড দামী হয় নতুবা হয় নিষিদ্ধ।

সৌমেন এর অসুস্থতা যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ভাঙচুর হয়ে গেছে নিত্য অভ্যাস। ডাক্তার রা সমাধান দিতে পারছে না। মানসিক ডাক্তার রা ভয়ে কাছে আসে না। উর্মি দূর থেকে এসব দেখছিল। ভয় লাগে কেমন। আচমকা একটা শো পিস ছুড়ে মারে সৌমেন। যার আঘাতে হাত কেঁটে যায় উর্মির। মেয়েটার আর্তনাদে সবাই ঘুরে তাকায়। এমন কি সৌমেন নিজে ও ঘুরে তাকায়। হাতের রক্ত দেখে দ্বিগুন আর্তনাদ করে। উর্মি বেরিয়ে আসতেই সৌমেন ওর দিকে ছুটে আসে। বেশ ভরকে যায় উর্মি। সৌমেন খপ করে ওর হাত টা ধরে ফেলে। রাগি ভাব টা এখনো যায় নি। উর্মির দিকে লাল চোখে তাকায়। উর্মি শুকনো ঢোক গিলে।
” এখানে কি করো তুমি? ”

” আমি তো এমনিই এসেছি স্যার। ”

” ফাঁকি বাজ হয়ে গেছে তুমি। যাও এখুনি কাজে যাও। ”

” জী স্যার। ”

উর্মি কিছু দূর যেতেই সৌমেন আবার ডাকে। উর্মি আসে। সৌমেন বলে–
” হাতে কি? ”

” কিছু না তো। ”

” লাল তরল কেন? ”

” একটু আগে আপনি– ”

” আমাকে ব্লেম দিচ্ছো তুমি? সাহস তো কম না। ”

” স্যার আমি সেটা বলি নি। ”

” চুপ। ”

উর্মি একদম স্থির হয়ে যায়। সৌমেন ঘুরে ঘুরে দেখে উর্মি কে। মাথা চুলকিয়ে বলে
” আমি তো মজা করছিলাম। ”

উর্মি এবার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাবে যেন। সৌমেন খিটমিটে হাসে। যাওয়ার জন্য আগাতেই সৌমেন রাগি কন্ঠে বলে
” আমি যেতে বলেছি তোমায়? ”

” নো স্যার। ”

” তাহলে যাচ্ছো কেন। ”

” স্যরি স্যার। ”

” আই ডোন্ট নিড ইউর স্যরি ওকে। গো ”

” ওকে স্যার। ”

উর্মি আবার এক পা আগায়। ওমনি সৌমেন ডাক দেয়। মাথা ভনভন করে উর্মির। সৌমেন কেমন যেন করছে। এই এখনি সিরিয়াস তো এখনি ফানি। মূলত ওর ব্রেনের নার্ভ গুলো কাজ করছে না ঠিক ঠাক। ছোট বেলা আর বড় বেলার এক টা মিলন ঘটেছে। এর ফলে দুটো বিষয় নিয়েই চলছে। হঠাৎ করেই আবার মাথা ব্যথা শুরু হয়। মাথা চেপে ধরে সৌমেন। লুটিয়ে পরে মেঝে তে।

সব ঘটনা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে সমীর। উর্মি এ পান্ত থেকে বল‍ে
” মানুষের জীবন কেমন যেন। ”

” কেমন? ”

” কি জানি। ”

” অদ্ভুত তো। ”

” ভালো লাগে না আমার। মনে হয় সব টা ভস্ম করে চলে যাই। ”

” আপার ডিভোর্স এর কি অবস্থা? ”

” ঐ আর কি। টাকার খেল। নয়ন ভাই ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আর কোর্ট এর রায় ছিলো বেবি আসার পর। ”

” আর তুলি ভাবির বিষয় টা? ”

” জানি না কি হবে। পনেরো লাখ টাকা জোগাড় করা সহজ না। কোর্ট এ রায় চলছে। ”

” সে সব তো বুঝলাম। কিন্তু তুলি ভাবির সাথে নয়ন ভাই এর কি সম্পর্ক? ”

” এটা আমার কাছে ও পরিষ্কার নয় সমীর। সব টা ঘোলাটে। ”

ভাইব্রেশন হয় সমীর এর ফোন। মা ফোন করেছেন। উর্মির কল রেখে মায়ের ফোন রিসিভ করে সে। ওপাশ থেকে মিষ্টি মৃধার গলা শোনা যায়।
” এক টা কথা বলবো? ”

” বলো না। এতো আড়ষ্টতা কেন মিষ্টি মা? তোমার ছেলে আমি। ”

” তোর বাবার ছবি দিবি একটা। কিংবা ভিডিও কলে দেখাতে পারবি একটু। ”

মিষ্টি মৃধার কন্ঠে কেমন লজ্জা কাজ করে। সমীর উত্তর করে না। কল কেটে ভিডিও কল দেয়। আর তারপর ব্যলকনি তে গিয়ে বাবার বরাবর দাঁড়ায়। ব্যথাতুর দৃষ্টি টা মিষ্টি মৃধার চোখ এড়ায় না। ভদ্র লোক জীবনে ভুল করলে ও একটা সময় এসে ভুল বুঝতে পেরেছেন। তবে একজন বাবা সর্বদাই বাবা। সন্তান বৈধ হোক কিংবা অবৈধ। এসকল চিন্তায় বাবার সাথে মিলমিশ করবে বলে স্থির করেছে সমীর। যদি ও সব টা কেবল মা ভাইয়ের কথা ভেবে। হয়তো কখনোই বাবা কে ক্ষমা করতে পারবে না তবে চেষ্টা করবে। অন্তত মায়ের জন্য এই চেষ্টা টা করবে সে। জীবনের শেষ কটা দিন ভালো থাকার এক প্রচেষ্টা করবেন মিষ্টি মৃধা।

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#পর্ব_১৯
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/160919396468963/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here