নিজের পাগল স্বামীর জন্য বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে উর্মি। অথচ ছেলেটার আসার নাম ই নেই। ক্ষণিক পূর্বেই স্বীয় ভালোবাসার বিসর্জন দিয়ে সৌমেন কে বিয়ে করেছে সে। যখন দেখলো বিয়ের আসরে নিজের ভালোবাসার মানুষ টি এসেছে তখন মনে হয়েছে এই পৃথিবী টা ওর জন্য কেবল জাহান্নাম। তবে সময়ের স্রোত ওকে মনে করিয়ে দিয়েছে সৌমেন এর জন্যেই সাগরিকা আজ বেঁচে আছে। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। তাছাড়া সৌজন্য ভাই কে ও জেল থেকে বেল করানো হয়েছে। সব মিলিয়ে উর্মির মাথার বোঝা মুক্ত তবে মনের বোঝা বেড়েছে। নিজের ভালোবাসা কে বিধ্বস্ত হতে দেখে উর্মির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। সমীর এর চোখে থাকা অদৃশ্য জল উর্মির হৃদয় কে করেছে এক সাগর সম ব্যথীত। হায়রে ভালোবাসা!
কপাট রাগ নিয়ে ব্যলকনি তে এসে দাঁড়ায় উর্মি। অর্ধবৃত্তাকার চাঁদ আজ অপূর্ব ভাবে আকাশের বুকে মিশে আছে। চোখ নড়াতে পারে না মেয়েটি। বুকের ভেতর টা আগুন এর উত্তপ্ত শিখায় ঝলসে আসে। তবু মুখ থেকে টু শব্দ নামে না। চোখে মুখে হঠাৎ শীতলতা লেপ্টে আসে। এই বিয়ে টা কে কোনো বিয়ে বলা যায় কি আদৌ? তাছাড়া সৌমেন অসুস্থ। উর্মি কে নিজের গার্লফ্রেন্ড এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। সে জন্যেই না উর্মির জন্য অস্থির হয়ে উঠে। সব কিছু বাদ দিয়ে হলে ও উর্মি কে মাইশা বলে সম্মোধন করে চলেছে সৌমেন। যখন সে সুস্থ হবে তখন নিশ্চয়ই এই বিয়ে টাকে মুক্ত করে দিবে। উর্মি বুক ভরে শ্বাস নেয়। বিয়ে টা কেবল এক অসুস্থ মানুষ কে সুস্থ করার দায়বদ্ধতা। একজন মানুষ হিসেবে উর্মি পাশে দাড়িয়েছে সৌমেন এর। এর বাইরে কিছুই নেই। উর্মি তো কেবল একটি মানুষ কে ভালোবাসে। যে মানুষ টি কে আজ দহন দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা তিন ছেড়েছে। উর্মির ভেতরে যন্ত্রণা হয়। চট করে ফোন করে সমীর কে। কি আশ্চর্য এই গভীর রাত্রি তে ও এক সেকেন্ডেই কল রিসিভ হয়। অথচ গত কয়েক টা দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা সমীর কে কল করেছে। কোনো রেসপন্স আসে নি। উর্মির কান্না আসে। শরীরে এখনো জড়ানো বিয়ের লাল রঙের বেনারসি। জীবন টা বুঝি সত্যিই রঙিন হয়েছে? যদি রঙিন হয়েই থাকে তবে ওর অন্তরে কেন এতো ব্যথা!
কয়েক টা শ্বাসের শব্দ শোনে উর্মি। সমীর এর যন্ত্রণা গুলো যেন চোখে ভাসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামায়।
” এতো রাতে জেগে আছো কেন? ”
শীতল কন্ঠ সমীরের। অবাক হয় উর্মি। ছেলেটার এমন স্তব্ধতা ওকে বাধ্য করে চিন্তিত হতে। সমীর এবার কঠোর কন্ঠে শুধায় ” এতো রাতে জেগে আছো কেন? বলেছি না বারো টা আগে ঘুমিয়ে পরবে। কথা শোনো না কেন। ”
” সমীর আমি ”
কথা হারিয়ে যায় উর্মির। কি বলবে বুঝে উঠে না। সহজ করে সমীর। মৃদু কন্ঠে বলে
” রাত হয়েছে অনেক। ঘুমিয়ে পরো। ”
” ঘুম আসছে না। ”
” চেষ্টা করো আসবে। ”
” উহু। ”
” বাচ্চাদের মতো করে না উর্মি। দূর্ঘটনা হবেই জীবনে। তাই বলে শরীর কে কষ্ট দিবে? ”
” আমার ভালো লাগছে না সমীর। আমি ম’রে যাবো। সত্যিই ম’রে যাবো এবার। ”
কথার মাঝে ডুকরে উঠে উর্মি। সমীর কঠোর হয়। তার নিজের ও খুব কষ্ট হচ্ছে তবে সেটা বুঝতে দেওয়া চলবে না। সামনে অনেক টা জার্নি। উর্মি কে ভেঙে পরলে চলবে না। তাছাড়া উর্মির কান্না,ফোলা চোখ সমীর কে ও ভেঙে দেয়। সেই জন্যেই সমীর কল রেখে দেয়। ব্যস্ত হয়ে যায় উর্মি। ওর কেবলি মনে হয় সমীর ওকে ভুল বুঝেছে। ছেলেটা বোধহয় ওকে প্রতারক ই ভাবে। চটপট ম্যাসেজ লিখে
” আমি তোমাকে ভালোবাসি সমীর। এই বাজে পরিস্থিতি কেন কীভাবে হলো আমি জানি না। তবে আমি তোমাকে ছাড়া এক সেকেন্ড ও থাকতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার সর্বাঙ্গে বি’ষ ঢুকে পরেছে। প্লিজ সমীর আমাকে বাঁচাও। আমি ম’রে যাচ্ছি। মস্তিষ্ক আর মনের যুদ্ধে আমি হেরে যাচ্ছি। পারছি না আর। ”
পলক হীন ভাবে ফোনের স্ক্রিনে তাকানো সমীর। মেয়েটি তবে এই ভুল সম্পর্ক টা কে বদলাতে চাচ্ছে। খুশি তে চোখে জল নেমে আসে। ছেলেটা চট করে কল করে বসে। আবার কেঁটে দেয়। ফোন করলে উর্মি নিশ্চয়ই কাঁদবে। আর সে কান্না ওর সহ্য হবে না। তাঁর থেকে বরং উর্মি কে ম্যাসেজ করা যাক। তাই সে লিখে পাঠায়
” কাল কে দেখা করতে পারবে? ”
সারা রাত চোখের পাতা বুজে নি উর্মি। আর না কেউ এসেছে ঘরে। ফুলে সজ্জিত ঘরে এখনো কাঁচা ফুলের সুবাসে ম ম করছে। বাসর ঘরের কোনো খামতি নেই শুধু খামতি আছে দুটো মানুষের ভালোবাসার। এসব ভেবে উর্মির মন তিক্ত হয়ে উঠে। সাথে সাথে একটা স্বস্তির স্থান ও তৈরি হয় এটা ভেবে যে সৌমেন আসে নি ঘরে। উর্মি আশাবাদী সৌমেন নিশ্চয়ই কোনো বাজে আচারণ করবে না। তাছাড়া সৌমেন এর মস্তিষ্ক এখন শিশু সুলভ আচারণে মেতে আছে। সেই হিসেবে কিছু হওয়ার চান্স ও নেই। বাহিরে বের হওয়ার পূর্বে গোসল করে আসে উর্মি। নিচে নেমে দেখতে পায় ঘরোয়া আয়োজন চলছে। এসব দেখে উর্মির মন খারাপ হয়। তবে সে বিয়ের পূর্বেই মাহফুজ সাহেব এর সাথে একটি চুক্তি করেছে। সেটা হচ্ছে সৌমেন সুস্থ হলেই উর্মি এই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। মাহফুজ সাহেব প্রথমে রাজি না হলে ও পরে রাজি হয়ে যান। তবে শর্ত ছিল এমন যে কথা টা সৌমেন এর মা বা অন্য কেউ যেন না জানে। উর্মি অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলে নি। সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে এগিয়ে এলেন সৌমেন এর মা লতিফা বেগম। উর্মি সালাম জানালো। লতিফা বেগম পরম আদরে জড়িয়ে ধরলো উর্মি কে।
” আমার ছেলের জন্য যা করলে সেটার জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে। বসো তুমি আমি নাস্তা দিচ্ছি। ”
” না আন্টি আমি এখন নাস্তা করবো না। ”
” ওমা কেন? ”
” একটু বের হবো। ”
” বের হবে। ”
লতিফা বেগমের মুখ টা কেমন কালো আঁধারে নেমে এলো। মাহফুজ সাহেব সোফা তে বসা ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন ” কোথায় যাবে উর্মি? ”
” একটা ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে। ”
” ঠিক আছে। গাড়ি নিয়ে যেও। ”
” না না স্যার প্রবলেম হবে না আমার। ”
” ওমা স্যার কেন বলছো? বাবা বলে ডাকো। ”
লতিফা বেগম এর কথায় একটু চমকালো উর্মি। ওর ভয়ার্ত মুখ দেখে মাহফুজ সাহেব বললেন ” সমস্যা নেই। সময়ের সাথে সাথে হয়ে যাবে। ”
” আমি তাহলে যাচ্ছি আন্টি। ”
” ঠিক আছে মা। যাও, আর একটু দ্রুত ফিরো। দুপুরে তো তোমার বাসা থেকে লোকজন আসবে। ”
” জী। ”
বাহিরে বের হয়ে স্বস্তির দম ফেলে উর্মি। এতো টা হাঁফসাঁফ লাগছিল ওর। জীবনে প্রথম বারের মতো নাটক চালাতে হচ্ছে ওকে। উর্মি ভেবে পায় না কি হতে চলেছে। ওর মন শুধু বলে যা হচ্ছে তা ঠিক না।
সমীর কে দেখে বোঝার উপায় নেই ছেলে টা মনের দিক থেকে একদম ই ভেঙে গেছে। কতো টা সহজ সরল দেখাচ্ছে ওকে। পোষাকের সৌন্দর্য্যের কোনো খামতি নেই। চেহারায় রয়েছে সামন্য মলিনতা তবে সেটা বুঝতে হলে প্রয়োজন এক জোড়া গভীর চোখ। শীতল চোখে তাকানো উর্মি হঠাৎ ই ভীষণ লজ্জিত অনুভব করে। মেয়েটির আড়ষ্টতা লক্ষ্য করে সমীর। তাই কাছে এসে দাঁড়ায়। আলতো করে হাসে।
” কি হলো এমন লাল টুকটুকে হচ্ছো কেন? ”
লাল টুকটুকে কথা টা শুনে উর্মির রাগ হয়। কেন হয় জানা নেই। সমীর আবার হেসে উঠে। দুজনের মাঝে একটু দূরত্ব সৃজন হয়েছে বই কি। কেমন যেন অদৃশ্য দেয়ালে আটকে আছে। দুজনেই চুপচাপ। মনে হয় বিচ্ছিন্নতার কতো বছর পর আবার দুজনের দেখা। অথচ এই তো কাল রাতে কথা হলো। কাল সন্ধ্যা তেই হয়েছে দর্শন। তবু কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছে। উর্মি কথা খুঁজে পায় না। সমীর মৌনতা ভাঙে
” না খেয়ে চলে এসেছো? ”
” তুমি বুঝলে কি করে? ”
” আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে? ”
“ধ্যত বলো না কি করে বুঝলে। ”
” এমনিই বুঝে গেছি। ”
” মিথ্যে। ”
” ভালোবাসার জোড়ে বুঝেছি ম্যাডাম। ”
হেসে ফেলে উর্মি। সমীর এর গায়ে আলতো করে চাপড় মেরে বলে ” পাগল তুমি। ”
দুজনেই হাসে কিয়ৎক্ষণ। পর মুহূর্তেই কেমন করে যেন দমে যায়। উর্মির কান্না পায় ভীষণ। ছলছল নয়ন দেখে সমীর দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দেয়।
” আমি ও নাস্তা করি নি। চলো, আগে নাস্তা করে নেই। ”
উর্মি নিরবে হাঁটে। আগে দুজনে হাতে হাত রেখে চললে ও আজ দুজনের মাঝে এক হাত সমান দূরত্ব। উর্মি কষ্ট অনুভব করে তবে সমীর মুখ টা হাসি হাসি করে রাখে। অভিমান হচ্ছে উর্মির। ছেলেটা কেন বুঝে না ওর মন?
দুজনে নাস্তা করে। এই সময় টা তে অনেক টা সহজ হয়ে উঠে পরিস্থিতি। আইসক্রিম, ফুচকা, নৌকায় চড়া কোনো টাই বাদ দেয় না ওরা। ঘড়ির কাঁটা কখন যে তিন পেরিয়ে যায় খেয়াল ই হয় না। যখন মনে পরে তখন সাড়ে তিন টে বাজে। উর্মি মন খারাপ নিয়ে বলে
” যেতে হচ্ছে এখন। ”
” ঠিক আছে। আমি পৌছে দেই? ”
” উহু। ”
” রিক্সা ঠিক করে দেই? ”
” আচ্ছা। ”
হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডে আসে ওরা। রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। বেশ অনেক টা সময় পর রিক্সা পায়। যাওয়ার পূর্বে উর্মি তাকিয়ে থাকে। সমীর ও একি ভাবে তাকানো। চোখ দুটো ছলছল করে। প্রতি বার যাওয়ার আগে উর্মির কপালে চুমু খেত সমীর। কতো বার ঠোঁট স্পর্শ করাতো গালে সেটা ধারণার অতীত। অথচ আজ যোজন যোজন দূরত্ব মেপে চলতে হয়। জীবন টা কে অর্থহীন মনে হওয়া স্বাভাবিক। সমীর এর নিকটে এসে উর্মি বলে
” সব টা তো জানলেই তুমি। আমি কেবল পরিস্থিতির স্বীকার। সাগরিকার অপারেশন এর জন্য এতো গুলো টাকা প্রয়োজন ছিল। সৌমেন স্যার কে বিয়ে না করলে সাগরিকা কে বাঁচাতে পারতাম না। কি করতাম বলো। ”
” দুঃখ পেও না উর্মি। ”
” আমি জানি না কি করে এমন টা হলো। আর কেন বড় স্যার এমন করলেন। ”
আলতো করে হাসে সমীর। উর্মির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ” সৌমেন ভাই সুস্থ হলেই আমাদের ভালোবাসা আবার ফিরে পাব। আঙ্কেল নিজের ছেলের জন্য এমন একটা কাজ করেছে। এতে ওনাকে ও দোষ দেওয়া চলে না। তাছাড়া তুমি নিজেকে ও দোষ দিবে না। আমি যদি তোমার সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে এমন একটা পরিস্থিতি আসতোই নাহ। দোষ টা আমার উর্মি। আমার জন্য তোমাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। তবে আই প্রমিস আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকবো সর্বদা। ”
#শখের_সাদা_শাড়ি_২
লেখা : ফাতেমা তুজ
#সূচনা_পর্ব
চলবে……….
পর্ব ২
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=166545649239671&id=100076527090739
যারা সিজন ১ পড়েন নি পড়ে নিতে পারেন
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=163416436219259&id=100076527090739