#শখের_সাদা_শাড়ি
৬.
কাজ কে সর্বাঙ্গে লেপ্টে রাখে যিনি সে নিশ্চয়ই জীবনে উন্নতি করে। আর তার বড় উদাহরণ হচ্ছে সৌমেন। এই যে দীর্ঘ সাত দিন যাবত বেড রেস্ট এর মধ্যে আছে তবু ও কাজের প্রতি সে কি খেয়াল। ঘরে বসেই সব সামাল দেয়। পুরো এক সপ্তাহের সব কাজের সিডিউল নিয়ে উপস্থিত হলো উর্মি। যেই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে সেই ঠিকানায় এসে সৌমেন কে কল করলো। সৌমেন নির্দেশনা দেওয়ার পর ই গেট খোলা হয়। বিশাল বড় এক বাংলো। থাকা স্বাভাবিক। ওমন বড় কোম্পানির মালিক যারা তাদের বাড়ি নিশ্চয়ই খুপরি ঘর হবে না। বাড়ির এক পাশে ফুলের টপ দিয়ে বাগান করা। কোনো গাছ ই মাটি তে লাগানো নয়। এতে অবশ্য যখন তখন স্থান পরিবর্তন করে বাসার লুক টাই চেঞ্জ করে ফেলা যায়। এই ধার ঐ ধার চোখ ঘুরিয়ে দেখে উর্মি। কেমন এক আড়ষ্টতা আর ভয় লক্ষ্য হয়। হেসে ফেলে সমীর। মেয়েটা কে ভীতু মনে হয় নি তবে সব মানুষের মনেই যে ভয়ের বাস এটা আজ প্রমাণিত।
” উর্মি কত দিন ধরে কাজ করছে সৌমেন ভাই? ”
” দিন পনেরো হলো। মেয়েটা খুব কর্মঠ। এমন একজন ইমপ্লয়ি প্রয়োজন ছিলো আমার। ”
” হুম তাছাড়া মানুষ হিসেবে ও ভালো। ”
” যেমন? ”
” সেদিন হাইওয়ে ক্রস করছিলাম তখনি দেখলাম কিছু ফুটপাতের বাচ্চা দের সাথে খেলছে। যাওয়ার সময় আবার চকলেট ও কিনে দিলো। উর্মি না থাকলে হয়তো তুমি হসপিটালের বেডে ও যেতে পারতে না। ”
” তা ঠিক। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞ থাকবো। ”
মৃদু হাসলো সমীর। সি সি টিভি ফুটেজ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পেন্সিল দিয়ে ডিজাইন করতে লাগলো। সৌমেন অসুস্থ থাকায় দেখতে এসেছিলো। সাথে কিছু ডিজাইন দেখাবে বলে ও স্থির হয়েছে। উর্মি এসে গেছে। চক্ষু দুটো কপালে। এতো প্যারা নিতে হয়েছে যা ধারণার ও বাইরে। হাতের ছাপ দাও, বডি চেইক করো এটা সেটা কতো প্রযুক্তি। বাংলাদেশ তবে ডিজিটাল হয়েই গেল। শুধু মাত্র উর্মির কপাল খানাই ক্ষণে ক্ষণে বিতাড়িত হয়। বুক চিরে নেমে আসা দীর্ঘ শ্বাস টা সন্তপর্নে লুকিয়ে লম্বা করে সালাম দেয়। তারপর বলে–
” ভালো আছেন স্যার? ”
” বেডে শুয়ে বসে থেকে যতো টা ভালো থাকা যায়। ”
” কি করার। আল্লাহ আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দিক। ”
” বসো উর্মি। ”
উর্মি একটু দূরের কাউচে বসলো। ঘরের এক পাশে দোলনা রাখা। ভারী সুন্দর লাগে। উর্মি চেয়েই রইলো।সৌমেন বলল
” চাইলে বসতে পারো। এখন তুমি ইমপ্লয়ি না গেস্ট। ”
লজ্জা পেয়ে উর্মি বলে–
” না না আমি এখানেই ঠিক আছি। এমনি দেখছিলাম বেশ শৌখিন আপনি। ”
” শখ ছাড়া কি মানুষ বাঁচে উর্মি। প্রতি টা মানুষের ই শখের জিনিস থাকে। এই যে এই বাড়ি টা এটা আমার দাদুর শখ ছিলো তবে মজার বিষয় হচ্ছে তার শখের জিনিস তো পূরণ হয়েছে কিন্তু তিনি তা উপভোগ করতে পারেন নি। ”
” ইসস। ”
উর্মির কন্ঠে ব্যথা। সমীর পাশ থেকে বলল
” তবে সৌমেন ভাই শখের জিনিস পেয়ে গেলে শতভাগ আনন্দ টা ও থাকে না। ঠিক যতো টা কল্পনা করার ক্ষেত্রে অনুভব করা যায়। ”
” বরাবর ই তুমি ঠিক বলো সমীর। ”
হাসে সৌমেন। সমীর পেছন থেকে উঠে গিয়ে সামনে বসে। উর্মি একটু বেশিই অবাক হয়। সে পাঁচ মিনিট ধরে এই রুমে উপস্থিত অথচ সমীর কে নজরেই পরলো না। রোগা পাতলা লম্বা দেখতে এক ছেলে সেই তাকে নজরে না পরার বিশেষত্ব তো নেই।
” হাই। ভাবুক হচ্ছেন কেন? ”
” আমি আসলে খেয়াল ই করি নি। ”
” পেছনে ছিলাম যে তাই দেখেন নি। আচ্ছা দেখেন তো কেমন হলো ডিজাইন টা। ”
উর্মি ডিজাইন টা দেখে। এতো সুন্দর করে গ্রাউন এর ডিজাইন করেছে সমীর যে ওর চোখ জুড়িয়ে আসে। সৌমেন ও দেখে বেশ প্রশংসা করে। নাস্তা দেওয়া হয় উর্মি কে। অথচ উর্মি লজ্জা পায়। সৌমেন বুঝে বিষয় টা।
” লজ্জা পাওয়ার বিষয় না এটা। খাবার না খেলে মানুষ বাঁচতে পারে না। তাই সবাই কেই খেতে হয়। ”
” লজ্জা পাচ্ছি না তো। ”
দ্বিতীয় বারের মতো চায়ের কাপ তুলে নিয়ে ভ্রু বাকিয়ে তাকায় সমীর। উর্মি বাচ্চা দের মতো সাফাই গায়
” সত্যিই লজ্জা পাচ্ছি না আমি। ”
ফিক করে হেসে দেয় সমীর। সৌমেন তখন ধীর পায়ে উঠে বেরিয়ে গেছে। কিছু ফাইল পত্র গুছিয়ে নিতে হবে। সমীরের হাসি তে এবার আরও বেশি লজ্জিত হয় উর্মি। হাতের তালু তে নখ ঘষে। কেমন যেন এক অনুভব হয়। আজকাল বড্ড লজ্জায় পরতে হয় তাকে। পরিবারের সাথে যতো টা ফ্রেন্ডলি কথা বলতে পারে তার এক অংশ প্রযোজ্য হয় না অন্য দের ক্ষেত্রে।
মেঘনা আর অন্তু কথা বলছিলো। উর্মি ঘরে ঢুকতেই চুপ হয়ে যায় দুজনে। ক্লান্ত থাকা তে পাত্তা ই দেয় না। সাওয়ার নিয়ে গা এলিয়ে দেয়। সকাল ছয় টা থেকে তিন টে বাচ্চা কে পড়ায় তারপর আবার একটা থেকে অফিস। রাতে এসে রান্নায় হেল্প।সব মিলিয়ে পড়াশোনা টা চাঙ্গে। সময় এখন সাড়ে সাত টা। না খেয়েই পড়তে বসেছে। আজ অনেক টা পড়তে হবে। আলগোছে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেঘনা। অন্তু কে নিয়ে ব্যলকনিতে বসে। অন্তুর চুপচাপ থাকা টা ভালো ঠেকে না। মেঘনার বুকের ভেতর ভয় নেমেছে।
” বাবা সত্যি করে বল,কি হয়েছে? ”
” কিছু হয় নি বড় ফুপি। ”
” মিথ্যে বলে না। দেখ পরে কিন্তু ঝামেলা হবে। ”
” পিংকি রাগ করেছে। ”
” এটা আবার কে? ”
” পাশের বাড়ির মেয়ে। ”
” কি বলিস! আমি তো মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝি না। ”
” স্কুলে ব্রেক টাইমে আমি খেলতাম ওর সাথে। এখন খেলি না যে। তাই আমাকে ধাক্কা মেরেছে। ”
” সর্বনাশ! এই বাচ্চা কালে কি শুরু করেছিস তোরা। ”
অন্তু সামান্য চেচিয়ে বলে–
” কারো সাথে খেলা টা দোষের নাকি। তোমরা সব সময় এমন করো। ”
” কি রে কি হলো তদের। কার সাথে কি খেলা দোষের। ”
জোৎস্না কে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দুজন। মেঘনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হেসে উঠে।
” কি হবে ভাবি, তোমার ছেলে বলছে সে খেলবে। আমি বলছিলাম এই বয়সে কেউ খেলে নাকি। তাই বললো খেলা টা কোনো দোষের না। ”
” ও তাই বল। আর এখন কি খেলবি তুই। ঘরে যা পড়তে বোস। ”
নির্বিঘ্নে অন্তু উঠে যায়। জোৎস্না ছেলের পানে তাকিয়ে বলে–
” বাহ্বা এতো সুবুদ্ধি হলো কবে। মেঘনা তুই ঘরে গিয়ে উর্মি কে ডেকে দে তো কথা আছে একটু। আমি ভেজা কাপড় গুলো মেলে দেই। ”
” জী ভাবি। ”
পড়া শোনার পাঠ চুকিয়ে আসে উর্মি। পড়তে বসলেই যতো ঝোর ঝামেলা। বড় ভাবি কে বসার ঘরে না পেয়ে রান্না ঘরে যায়। সেখানে ই পেয়ে যায়। তুলি খাবার নিচ্ছিলো। উর্মি কে দেখে সৌজন্য হাসে। স্বামীর সাথে একান্তে খাবে বলে স্থির করেছে। বিষয় টা খারাপ না। যদি এর পেছনে ভালো উদ্দেশ্য থাকে।
” তুলি চলে গেছে? ”
” হ্যাঁ ভাবি। ”
” আচ্ছা শোন না রে। ”
উর্মি বলার পর ও তুলি গিয়েছে কি না সেটা দেখে নেয়। দেয়ালের ও যে কান আছে সেটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সে। উর্মি বুঝতে পারে কঠিন কিছু শুনতে হবে। হলো ও তাই। বড় ভাবি জানালো অন্তুর জন্য রাখা প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা সঞ্চয়ের কথা। উর্মি একটু সময় নিয়ে উত্তর করলো —
” এক মাসে তো সম্ভব না ভাবি। আমি দু মাসে পাঁচ হাজার করে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিবো। ”
” আচ্ছা ঠিক আছে। চিন্তা মুক্ত করলি রে। বেশ ঝামেলায় ছিলাম। ”
বড় ভাবি চলে যায়। উর্মি খোলা চোখে তাকিয়ে থাকে। আড়াল থেক সব টাই শুনেছে তুলি। রাগে ফুসতে থাকে। স্বামীর কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে। বউ সোহাগী স্বামী ক্ষিপ্ত হয়। তুলি যে মিথ্যে বলে না এই নিয়ে তার আবার বিরল ধারণা।
শশী কে পড়াচ্ছিলো উর্মি। দিন কে দিন বিগড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। পড়া শোনা করা যেন বিষ।
” পড়াশোনা থেকে মন সরে গেছে তোমার। এটা কিন্তু ঠিক না। ”
” পড়ি তো আপু। ”
” সেটার নমুনা দেখলাম। লাস্ট উইকলি টেস্টে ইংলিশে পেয়েছো ৩৮ আর ম্যাথ এ ৩৩। বুঝো এসব? এক মার্কস এর জন্য ফেল আসে নি। ”
” আমি তো সব দিয়েছিই কিন্তু ”
” তবু টেনে টুনে পাস। বাহ ”
হতাশ হয় উর্মি। শেষ বেলায় এসে যদি শশীর অবস্থা এমন হয় তাহলে তো বড় সমস্যা।শশী কে এই মাসেই ছেড়ে দিবে ভেবেছিলো তবে এখন মত বদলেছে। বাকি দুটো টিউশনি ছেড়ে দিয়ে শশী কেই পড়াবে। না হলে এই মেয়ে নাম ডুবাবে।পড়া শোনা শেষ করিয়ে চলেই যাচ্ছিলো তবে ডেকে পাঠান শশীর মা। একটা কার্ড দিয়ে বলেন সামনে মাসের পাঁচ তারিখ শৌখিন এর বিয়ে। উর্মি যেন আসে। মুখে আসবো বললে ও মন টা টানছে না। বিয়ে তে আসতে গেলে ও একটা খরচা আছে। যা উর্মির পক্ষে ঝামেলার। তবে আসতে যে হবেই।
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
পর্ব ৭
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=153448977216005&id=100076527090739