#শখের_সাদা_শাড়ি_২
২.
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। খানিক টা ভয় নিয়েই শশুর বাড়ি তে পা ফেললো উর্মি। আশে পাশে মানুষের ভীড় পরিলক্ষিত হলো। কেমন যেন সংকোচ কাজ করছে। হাজার হোক,সবাই তো জানে উর্মি এ বাড়ির বউ। আর এটা সত্য ও বটে। লুকিয়ে যেতে নিয়ে ও ধরা পরে গেল উর্মি। পাশ থেকে একজন মহিলা বললেন ” ঐ যে সৌমেন এর বউ। ”
কথা টা অদ্ভুত শোনালো। উর্মির কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। তবে বউ শব্দ টা কেমন যেন সুখ অনুভূতি দেয়। উর্মি মাথা নিচু করে আরেক পা আগানোর পূর্বেই মহিলা আবার বললেন ” বউ মা পালাও কেন? এদিকে আসো তো। ”
কাছে এসে সালাম জানালো উর্মি। তিনি জানালেন সৌমেন এর ছোট খালামনি সে। দীর্ঘ সময় জুড়ে ওনারা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত। কিছু দিন আগেই এসেছেন। ভদ্র মহিলা বেশ ভালোই গল্প জুড়ে দিয়েছেন। লতিফা বেগম ড্রয়িং রুমে এসে উর্মির নিকট হয়ে বসলেন। লেট করার জন্য উর্মি কিছু বলবে ওমন সময় তিনি বললেন
” ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও উর্মি। তুমি তো কথাই শুনতে চাও না। কি দরকার ছিল অতো দূরে গিয়ে ঔষধ কিনে নিয়ে আসার। কাউ কে পাঠিয়ে দিলেই তো হলো। ”
” আন্টি আমি। ”
উর্মির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে লতিফা বললেন ” জানি তো তুমি টেনশন করো, যে অন্য কেউ যদি ঠিক মতো ঔষধ না নিয়ে আসে। তাই বলে নিজে এতো ধকল নেওয়া টা ঠিক হলো কি? ”
ঝটকা খেল উর্মি। আবার কিছু বলতে যেতেই উর্মি কে এক প্রকার জোড় করে ঘরে পাঠানো হলো। কিছু সময় পর সে নিজে ও উপস্থিত হলেন। উর্মি কেমন ভরকে গেছে। কি হলো বুঝতেই পারলো না। দম ফেললেন লতিফা বেগম। উর্মির কাছে এসে নিচু কন্ঠে বললেন
” লুবনা আমার বোন হলে ও মানুষ হিসেবে খুব ভালো না। ওর মেয়ে আমার সৌমেন কে পছন্দ করে তবে সৌমেন বা আমরা কেউ ওর মেয়ে কে পছন্দ করি না। এমন নয় যে দেখতে ভালো না, সমস্যা হচ্ছে ওর মেয়ে টা নেশা পানি তে ডুবে থাকে। আর টাকা পয়সার জন্য ও একটা লোভ কাজ করে। ভালোবাসা টা নিছক ই লোক দেখানো।”
” ও আচ্ছা। ”
উর্মি তেমন আগ্রহ দেখালো না। লতিফা নিজ থেকেই জানালেন লায়লা সৌমেন কে নিজের প্রতি আসক্ত করার চেষ্টা করবে। যেহেতু সৌমেন অসুস্থ সেহেতু অনেক ভুল কর্ম করে ফেলতে পারে। উর্মি স্থির নয়নে শুনলো কথা। তবে আগ্রহ পাচ্ছে না একটু ও। তবু এক সময় নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল ” আমি স্যারের খেয়াল রাখবো। ”
” এখনো স্যার? ”
” অভ্যাস তো তাই। ”
” সে নয় ঠিক আছে। তবে মা আমার ছেলে টা খুব ভালো জানো তো। ওকে আগলে রেখো। ”
লতিফা কেঁদে দিলেন। উর্মি সান্ত্বনা দিতে পারছে না। বুক টা খচখচ করছে। কি বলে সান্ত্বনা দিবে? যেখানে বিয়ে টা কেবল দায়িত্ব। যেখানে নেই স্বামী স্ত্রী আচারণ কিংবা ভালোবাসা।
রাত আটটার দিকে উর্মি লাগাতার ফোন করে জানতে পারলো কাছাকাছি এসে পরেছে সবাই।
সৌজন্য ভাইয়ের বেল টা হলেও কিছু কিছু ফর্মালিটিস এখনো বাকি। সেটার জন্য ই থানায় গিয়েছিল সৌজন্য। তাই দুপুরে না এসে রাতে আসছে সবাই। উর্মি উবু হয়ে বেডের উপর গা এলিয়ে দিলো। সমীর এর কথা ভীষণ মনে পরছে। তবে কল করার মতো সাহস হচ্ছে না। কেন যেন একটা দ্বিধা এসে আগলে নিচ্ছে। মাথা ও ব্যথা করছে তাই চোখ দুটো বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ। খানিক সময় যেতেই কাচ ভাঙার শব্দ কানে এলো। ফট করে উঠে পরে উর্মি। উড়না টেনে নিয়ে ছুট লাগায় এক প্রকার। নিচ থেকে আসছে শব্দ। দোতলার করিডোর দিয়ে নামার সময় চোখে পরে সৌমেন কে। তার ই সামনে দাড়ানো দারুণ সুন্দর এক মেয়ে। পরনে শার্ট প্যান্ট। উর্মি চিন্তা করে না মেয়ে টি কে। তবে বুঝতে পারে সৌমেন এর রাগের কারন এই মেয়েটিই। উর্মি নিচে নামতে নামতে অনেকেই এসে গেছে। সার্ভেন্ট রা কাছে আগানোর সাহস পাচ্ছে না। উর্মি চোখ দিয়ে ইশারা করে সৌমেন কে থামাতে। কাচের শো পিস গুলো মাটি তে গড়াগড়ি খায়। ঐ মেয়ে টি বলে ” হোয়াট হ্যাপেন সৌমেন? তুমি কেন এমন করছো। ”
সৌমেন কথা বলছে না শুধু মাত্র ভেঙে চলেছে। সার্ভেন্ট রা কাছে এলে ধমকে দিচ্ছে। উর্মি নিজে যায় এবার
” স্যার থামুন। প্লিজ থামুন আপনি। ”
সৌমেন এর হাতে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস টা কেড়ে নেয় উর্মি। টেবিলের উপর রেখে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে।
” আপনি শান্ত হোন। রেগে যাচ্ছেন কেনো? দেখুন আমার দিকে। ”
তাকায় না সৌমেন। রাগে চোয়াল শক্ত।
হঠাৎ ই উর্মির পায়ে বিধে যায় কাচের টুকরো। ব্যথায় ককিয়ে উঠে মেয়েটি। তৎক্ষণাৎ সৌমেন এর ঘোর কাঁটে। সে ব্যস্ত হয়ে যায় ” মাইশা! দেখি দেখি কত টা কেঁটেছে। কি যে করো না তুমি। ”
কথার মাঝ পথেই উর্মির পায়ে হাত দেয় সৌমেন। উর্মি দূরে সরে যেতে চাইলে ও আবার আটকে ধরে। অস্বস্তি তে ভরে যায় উর্মির শরীর। সৌমেন খুব যত্ন নিয়ে কাচ সরায়। তখনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সমীর। উর্মির সাথে চোখাচোখি হয়। উর্মি কেমন অসহায় নিয়ে তাকায়। তবে সমীর একদম ই স্থির। ব্যথিত নয়নের দৃষ্টি লুকিয়ে কাছে আসে। উর্মির পা থেকে ঝরে লাল তরল। সৌমেন চেচিয়ে উঠে ” এই কেউ ব্যান্ডেজ নিয়ে আসো। আর মলম ও সাথে। ”
একজন সার্ভেন্ট ছুটে যায়। সৌমেন এর দৃষ্টি কেমন কঠোর হয়ে আসে। সমীর চুপ করে দেখছে বিষয় টা। হঠাৎ করেই আবার রেগে যায় সৌমেন। আচারণ হয়ে যায় বাচ্চা দের মতো। উর্মির রক্তে ভেসে যাওয়া পা ফেলে চলে যায় গার্ডেনে। উর্মি ব্যথায় মরে যাচ্ছে প্রায়। সার্ভেন্ট ব্যান্ডেজ এনে দিলে সমীর এসে বসে পাশে। ধীর হস্তে ব্যান্ডেজ করে দেয়। উর্মি চোখ খিচে আছে। ব্যথা টা পায়ে না বরং ব্যথা টা বুকে।
” চোখ খোলো। ব্যান্ডেজ হয়ে গেছে। ”
” হুম। ”
” কোন বিষয় নিয়ে রেগে গিয়েছিল সৌমেন ভাই? ”
” জানি না। ”
” হাত টা ধরো। ঘরে পৌছে দেই। মনে হয় না হাঁটতে পারবে। ”
সমীর এর হাতে ভর করে দাঁড়ালো উর্মি। বহু পূর্বেই নিজের রুমে চলে গেছে লায়লা। সৌমেন যখন উর্মির পায়ে হাত দিয়েছিল তখন খুব রাগ হচ্ছিলো ওর। রাগে দুটো গ্লাস ও ভেঙেছে।
উর্মি কে দাঁড়াতে সাহায্য করলো সমীর। একটু নিচু কন্ঠে সমীর বলল
” অন্য কেউ তোমায় ঘরে দিয়ে আসুক। ”
” কেন? ”
” তুমি এ বাড়ির বউ উর্মি। তুমি এখন না আমার বন্ধু না আমার কলিগ আর না আমার প্রেমিকা। ”
শেষোক্ত কথায় নীরব অভিমান জন্মালো উর্মির মনে। একটা শব্দ ও করলো না সে। চুপচাপ সার্ভেন্ট এর সাথে ঘরে চলে গেল। সমীর এর দেহ টা চলে না যেন। গত দুদিন যেন,সমীর কে পাল্টে দিয়েছে বহুগুন। এই তো বিকেল বেলায় সিয়াম এর উপর খুব চেচামেচি করলো। তারপর মায়ের সাথে ও কথা বললো না। পাছে যদি মা কে কটূ কথা বলে ফেলে সেই ভয়ে।
ডিনারের টেবিলে বসে উর্মি আর সমীর এর আবার চোখাচোখি। কারন টা হচ্ছে সৌমেন এর কাকি বলেছেন আজ নাকি আবার বাসর সাজানো হবে। যেহেতু কাল সৌমেন এর শরীর টা ভালো ছিল না তাছাড়া উর্মি নিজে ও খুব টায়ার্ড ছিল সব মিলিয়ে নিয়মকানুন এর ন ও মানা হয় নি। সমীর মুখের খাবার টুকু খুব কষ্ট করে পেটে নিল। উর্মি আর মেঘনা দুজনের ই মুখ টা চুপসে গেছে। বাকি সবাই ঠিক ঠাক খাচ্ছে। মেঘনা আর খাবার খেতে পারলো না। আধ খাওয়া প্লেট রেখেই চলে এলো। উর্মির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বোনের নিকট আবেগ লুকাতে ব্যর্থ।
” কেঁদে কি হবে। আমি বলেছিলাম তোকে, আমাদের মেয়ের কিছু হবে না। আর ভাই কে ও ছাড়িয়ে নিবো কিন্তু তুই শুনলি না।”
” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে আপা। তুই দেখলি সমীর এর মুখ টা। ”
” দেখে ও না দেখার মতো করে থাকতে হচ্ছে। ছেলেটা কি করে যে খাবার খাচ্ছে ভাবতেই অবাক হই। ”
” আমার ভালো লাগছে না আপা। বল না কি করবো আমি। ”
চুল গুলো টেনে ধরলো উর্মি। কষ্টে বুকের ভেতর ঝলসে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ পেয়ে চুপ হয়ে গেল দুজনেই। লায়লা এসে ভ্রু কুঁচকে হাত ধুয়ে নিলো। যাওয়ার আগে দু বোন কে আড় চোখে দেখলো আবার। উর্মি ঠোঁট কামড়ে তাকালো। শান্তি মতো কান্না করবে সেই সুযোগ টুকু ও নেই। কিছু সময় পর সমীর ও আসলো হাত ধুতে। মেঘনা সুযোগ দিয়ে চলে যেতেই উর্মি কে বলে সমীর
” চোখ মুছো। কান্না করার মতো কিছু হয় নি। এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। ”
” এটা স্বাভাবিক? ”
” হুম। ”
রাগ হলো উর্মির। সমীর এর নীরবতা ওর সহ্য হচ্ছে না। রাগে দুঃখে কেটে যাওয়া পা নিয়েই হনহনিয়ে ছুটতে লাগলো। ব্যান্ডেজ ভেদ করেক্ত মেঝে তে লাল তরলের রেখা নেমেছে উর্মির প্রতি পায়ের ধাপে। সমীর নিচু হয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলো সে তরল টা। তারপর ই লাল রঙের সেই তরলের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলো।
চলবে….
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ
আমার লেখা প্রথম ই বুক ” খোলা জানালায় “🥰
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/166516169242619/?app=fbl