#শখের_সাদা_শাড়ি_২
৪.
মৃত মানুষের মতো করে ঘুমিয়ে আছে সৌমেন। ঘুমাবেই না কেন? ক্ষণিক আগেই ঘুমের ঔষধ মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়েছে। ঔষধ টা উর্মি নিজ হাতে দিয়েছে। এ ছাড়া অবশ্য কোনো উপায় ছিল না মেয়ে টার নিকটে। নিজেকে আড়াল করার জন্যে সৌমেন কে ঘুমে বিভোর করা জরুরী ছিল। আচানাক ওর মন খারাপ হতে শুরু করেছে। অভিমানের দেয়াল ডিঙিয়ে সমীরের নাম্বারে কল করে বসলো। সমীর ধরে চটপট। উর্মি চমকিত হয়। স্তম্ভিত বুকে হাত রেখে অনুভব করে ফোনের অপর পাশের মানুষ টা ও ওর মতো ভালো নেই। দু চোখ এর কোন ঘেঁষে জল গড়ায়। উর্মি ফুপিয়ে উঠে। সমীর নিশ্চুপ! যেন গল্প সাজায় নিজের হাতে। কিছু সময় চলে যায়। সমীর মুখ খুলে ” কল করেছো কান্না শোনাবে বলে? তাহলে বরং কাল শুনবো। আজ রাখি। ”
ফ্যাচফ্যাচানি ফেলে উর্মি প্রশ্ন ছুড়ে ” এতো রাত অব্দি জেগে আছো তুমি। ”
” হুম। নতুন কি আর। আগে ও তো জেগে থাকতাম রাত ভর। ”
” তখন ফোনের এপাশে আমি থাকতাম সমীর। ”
” আজ ও তো আছো। ”
নাকের পাটা লাল হয়ে আসে। উর্মি বিহ্বল! হতভম্ব হয়ে যায় ছেলেটার কাঠ কাঠ জবাবে। ইচ্ছে করছে দু গালে শক্ত হাতে লাল করে দিতে। ছেলেটা কি বুঝে না ওর মনের অবস্থা! দুজনেই ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। উর্মি পেছন ঘুরে দেখে বেঘোরে ঘুমায় সৌমেন। উৎকণ্ঠিত হয়ে যাওয়া তে ব্যলকনিতে চলে আসে। গলার স্বর নিচু করে। ” তুমি খুব কষ্টে আছো সমীর? এই সব টা হলো আমার জন্য। আমি খুব ই স্বার্থপর। খুব বেশি অন্যায় করেছি।”
ডুকরে ডুকরে বলতে শুরু করেছে উর্মি। সমীর এর মন টা ভেঙে যায় যেন। আজ এ পরিস্থিতির জন্য কাকে দায় দিবে ঠিক ঠাওর হয় না। তবু সান্ত্বনা দেয় ” ভাগ্যে যা ছিল সেটাই হয়েছে উর্মি। তুমি নিজেকে দোষোরোপ করতে পারো না। ”
” কেন ভাগ্য এমন টা করলো? ”
” সেটা তো জানি না আমি। তবে একটা কথা বলতে পারি এই যে তুমি আমি এই মাঝ রাতে কথা বলছি এটা ঠিক না। এটা অন্যায়।”
প্রথম দিকে কথা গুলো বুঝতে না পারলে ও সমীর যখন আবার বলল তুমি অন্য কারো স্ত্রী তখন উর্মির হাত কেঁপে উঠলো। ফোন টা পরে যেতে নিলে খপ করে ধরে ফেলল আঁচলে। উর্মি ভীষণ অসহায়। সমীর এর বলা কথা টা ওকে দাহ্য করেছে। মনে হয় এটা খুব অন্যায়! আবার মনে হয় এটা কে অন্যায় বললে ভুল হবে। এই টা কোনো বিয়েই নয়। এসব ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়ে রাত্রি অতিবাহিত করে! কাক সকালে অনুভব হয় চোখ দু খানা জ্বলছে ভীষণ। ঘুম হয় নি সারা রাতে। একটু ঘুমের তৃষ্ণায় চোখ দুটো ছটফট করছে। ঝিমুতে ঝিমুতে উর্মি ঘরে আসে। কাল রাতে সৌমেন কে যেমন করে ঘুমাতে দেখেছে এখনো তেমন ভাবে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত সৌমেন এর মুখের দিকে তাকিয়ে উর্মির চোখে থাকা ঘুম হারিয়ে যায়। কতক্ষণ চেয়ে ছিল খেয়াল নেই। তবে যখন খেয়াল হলো তখন ভীষণ ভাবে লজ্জায় পরলো। সৌমেন হাত নাড়াচাড়া করছে এখন। উর্মি নিজেকে তটস্থ করে মুখে হাসি ফুটায়। কালকে ডাক্তার এর সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন উর্মি যেন সর্বদা সৌমেন এর সাথে হাসি খুশি থাকে। কখনো যেন মুখ গোমড়া না করে। তাহলে সৌমেন এর ব্রেনে প্রভাব পরবে না। কারন উর্মিকেই মাইশার সাথে গুলিয়ে ফেলে। এটা খুব ই জটিল রোগ কি না!
সৌমেন কে নিয়ে নিচে নামে উর্মি। নাস্তার টেবিলে বসে এক মনে খাবার শেষ করেই বেরিয়ে পরে। সৌমেন তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। পর পর ই বলে উঠে
” মাইশা কে নিয়ে আমি ঘুরতে যাবো। ”
সকলের চোখ বড় বড়। খাবারের টেবিলে বসে থাকা মাহফুজ সাহেব খাবার খেতে খেতে বললেন ” তুমি কি করে যাবে সৌমেন? ”
” কেন বাবা আমি কি ছোট? অদ্ভুত তো! ”
গোমড়া মুখে রুটির শেষ টুকরো টা রেখে উঠে গেল সৌমেন। ওর আচারণে খুব একটা অবাক হয় নি কেউ। এটা হওয়া টা স্বাভাবিক তবে সৌমেন কে নিয়ে একা একা উর্মি বের হবে কি করে?
উর্মি কে ফোন করলেন মাহফুজ সাহেব। বাসা থেকে অনেক টা পথ চলে এসেছে উর্মি। তাই বললো বিকেলের কথা। তবে সৌমেন সেটা মানতে নারাজ। ছেলেটা বাবার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো এক প্রকার। ” আমার কথার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে। আগে তো খুব বলতে কেন ঘুরতে নিয়ে যাই না। আর এখন খুব মজা পেয়েছো তাই না? ”
” স্যার আপনি, শান্ত হোন। আমি একটা কাজে এসেছি। একটু সময় দিন আমায়। ”
” ওকে। তোমার কাছে সময় আছে আধ ঘন্টা। ইয়েস এই আধ ঘন্টার মধ্যে তুমি আমার কাছে আসবে। ”
মহা ফ্যাসাদে পরলো উর্মি। এই ঝামেলা যেন একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। নিজের চুল নিজে ছিড়তে পারলে বোধহয় স্বস্তি মিলতো। রাগে আক্রোশে হাঁটতে শুরু করে উর্মি। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে পরে যেতে যেতে বেঁচে যায়। তবে হাতের কব্জি তে বেশ অনেক টা ছিলে যায়। পথযাত্রী একজন মহিলা এসে আঁকড়ে ধরে। না চাইতে ও চোখের কোনে জল এসে যায়। মহিলা টি পানি এগিয়ে দেয়। হাতের কব্জি তে পানি দেয় উর্মি। ছিলে যাওয়া স্থানে পানি পরাতে দাহ্য পদার্থের মতো করে জ্বলে উঠে। শিউরে উঠে। যন্ত্রণায় যেন শরীর অষাঢ় হয়ে আসে।
দোকান থেকে কিছু কিনছিলো আলিদ। উর্মি কে দেখে চিনতে অসুবিধা হয় না। পাশে থাকা মহিলার হাত বরাবর চোখ দিতেই বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। দোকানের বিল পরিশোধ করে রাস্তা ডিঙিয়ে আসে। উর্মি তখন চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
” কি হয়েছে। হাতে র’ক্ত! কি করে হলো।”
” আলিদ ভাই! কবে এসেছেন।”
” এটা হলো কি করে। অনেক টা ছিলে গেছে দেখছি। ”
” দ্রুত হাঁটায় গতি সামলাতে না পেরে পরে যাচ্ছিলাম। রাস্তার ধারে টিন দিয়ে দেয়াল করা ছিল। সেখানেই লেগেছে। ”
” ইস। কি যে করিস। ”
ভদ্র মহিলার দিকে কৃতজ্ঞতা নিয়ে তাকায় উর্মি। মহিলা টা চলে যান। আলিদ এক হাতের সাহায্যে উর্মি কে টেনে ধরে। আজ ও ছেলেটা কতো সুন্দর রয়েছে। ভরাট মুখে খোচা খোচা দাড়ি। উর্মির চোখ দুটো লেগে আসে। এতো টা বিমুগ্ধ হয় যে ভুলে যায় ব্যথার কথা।
গাড়ির কাছে এসে আলিদ বলে ” বোস ভেতরে। আমি হালকা পাতলা মেডিসিন আর ব্যান্ডেজ নিয়ে আসি।”
” লাগবে না আলিদ ভাই। ”
” চুপ কর। একেই তো মহৎ কর্ম করে বসে আসিছ। আর আবার মুখে মুখে তর্ক। ”
হঠাৎ ই হেসে ফেলে উর্মি। কেন যেন এই দুঃখের মাঝে ও হাসি পেল ওর। আলিদ তাকাতেই মুখ টিপে হাসতে শুরু করলো। অস্বস্তি তে পরলো আলিদ। ” কি হয়েছে টা কি। এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন? ”
” মনে আছে আলিদ ভাই? আমি যে বছর ভার্সিটি তে যাই। সে বছর ই আপার সাথে আপনার গভীর প্রণয়। আর আপা কে ভেবে আমায় ফুল দিয়েছিলেন। পরে যে কি লজ্জা টা পেলেন। পুরো এক সপ্তাহ স্যরি স্যরি বলে টেক্সট করেছেন। তখন আবার আপার সাথে আপনার নীরব দন্ড চলে। যদি ও বা ছিল গভীর প্রেম। ”
শেষের কথাতে আলিদ চমকে উঠে। তবে বেশি ক্ষণ সে চমক থাকে না। উর্মি আবার বলতে লাগল ” আপা এই জীবনে আমার থেকে একটা কথাই লুকিয়েছে। অবশ্য আমি জেনে গিয়েছিলাম কোনো ভাবে। আপনার সাথে আপার তিন বছরের রিলেশন ছিল সেটা তো আমার অজানা নয়। অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। যাতে বাবার কথা তে আপা আপনাকে ছেড়ে না আসে। তবে আপা শুনে নি আমার কথা। ”
অপ্রস্তুত হয়ে পরলো আলিদ। উর্মি সরস হেসে বলল
” রক্ত পরা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বরং যাই। ”
” তোকে পৌছে দিবো। ”
” অন্য একদিন। আজ আপনি অস্বস্তি তে আছেন। আসি আজ। ”
ব্যাগ নিয়ে হাঁটা লাগায় উর্মি। আলিদ এর হাত টা কাপছে। চোখ দুটো তিমিরে ফোঁটা পদ্মফুলের মতো চকচকে। জলে ডুবে যাওয়া দু চোখ আজ বাঁধন হারা হতে চায়। মনের দুয়ার খুলে বলতে চায় ” কেন সেদিন তুমি আমায় বুঝলে না। কেন বুঝলে না আমার না শব্দের মাঝেই লুকিয়ে ছিল হ্যাঁ। ”
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
চলবে……..
স্পেশাল কিছু
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/167655195795383/?substory_index=0&app=fbl