#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ৩২
নির্জন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে রিকশা। অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে সুনহেরা। আজ তার প্রথম এক্সাম। সকালে ঘুম ভাঙতেই নিজেকে বিছানায় পায় সে। আয়াস ততক্ষনে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। সুনহেরা ওড়না ঠিক করে উঠে বসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শরীরে চোখ বুলাচ্ছে আয়াস। সুনহেরা বিছানা থেকে নেমে কাবাড থেকে ড্রেস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। আয়াস কিছু বলল না তাই সুনহেরাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করলো না। সুনহেরার মন চাইলো এখন অধিকার দেখিয়ে বলতে যে আপনার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বাসা থেকে বের হতে হবে না। কিন্তু আত্মসম্মানের জন্য পারলো না। আয়নার সামনে বসে হিজাব বাঁধছিলো সুনহেরা। আয়াস পিছন থেকে সুনহেরাকে দেখছে। আকস্মিক সুনহেরা আয়নায় আয়াসের দিকে তাকালে দুইজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল সুনহেরা। আয়াস গায়ে এপ্রোন জড়াতে জড়াতে বলল,
-ব্রেকফাস্ট করে বের হবো আমরা।
-আমি একা যেতে পারবো।
আয়াস শান্ত ভঙ্গিতেই মাথা তুলে চাইলো। রাগে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও সুনহেরার কথার জবাবে নরম কণ্ঠেই বলে,
-ওকে। বাহিরে ড্রাইভার আঙ্কেল অপেক্ষা করছে।
রাগে, জিদে. কষ্টে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো সুনহেরা। মানুষ একবার কোনোকিছুর জন্য না করলে দ্বিতীয়বার তো জিগ্যেস করে! কিন্তু না এই বদমাইশ লোক তা করবে কেনো! জেদেই কোনোরকম ব্রেকফাস্ট করে সুনহেরা গাড়ি ছাড়াই বেরিয়ে পরে। রাস্তায় রিকশা পেলে সেটাই উঠে বসে। মনে মনে আয়াসকে ইচ্ছে মতো বকতে থাকলো। মেডিকেলের সামনে আসতেই কিছুটা দূরে রিকশা থেকে নেমে পরলো সে। একবার ভেবেছিলো গতকালের মেয়েটিকে দেখে আসবে। কিন্তু আজ সে তার একদমই সময় নেই।ভাড়া মিটিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে সামনে পা দেয়।
-সুনহেরা?
পুরুষালি কণ্ঠস্বরে পিছন থেকে নিজের নাম শুনতেই মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো সুনহেরা। সামনের মানুষটিকে দেখে থমথমে খেয়ে গেলো। বাঁকা হাসি দিয়ে ফুয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। সুনহেরা শক্ত, গম্ভীর মুখে তাকে ইগনোর করে চলে যেতে নিলে ফুয়াদ ছুটে এসে তার স্মুখীন দাঁড়ালো। ঠোঁটে এক আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
-এতো পালাও পালাও করো কেনো সোনা? এখন কী আমাকে সয্য হয় না?
-সামনের থেকে সরে দাঁড়াও। মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনোরকম গেঞ্জাম করতে চাচ্ছি না আমি।
-দিনে দিনে এতো সুন্দর কেনো হচ্ছ? জামাই অনেক ভালোবাসে নাকি!
সুনহেরা ক্রোধে ফেটে পরছে। বারে বারে আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। তাঁদের চেনা কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে যে!
-কেনো বেহায়ার মতো আমার পিছনে পরে আছো? ঐরকম ছবি পাঠিয়ে নিজেকে কী প্রমান করতে চাও তুমি?
-কোনরকম ছবি?
-তুমি নিজে ভালো জানো কোনরকম ছবি।
ফুয়াদ নিকৃষ্ট ভঙ্গিতে হাসলো। কিছুটা ঝুঁকে সুনহেরাকে বলল,
-যার শরীরে আমার অধিকার তাকে অন্যকেউ ছুঁইবে ভাবলে কী করে সোনা?
-দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলো। ভুলে যেয়েও না আমি সেই আগেরই সুনহেরা যে তোমাকে মাঝ রাস্তায় থাপ্পড় মেরেছিলো। দ্বিতীয়বার আমি একই কাজ করতে চাচ্ছি না।
-উফফ! তোমার এই তেজ আমাকে তোমার প্রতি বেশি উইক করে দেয়! বলি কী তোমার ঐ আবা’ল জামাইকে ফেলে চলে এসো আমার কাছে। অনেক বেশি সুখে রাখবো।
সুনহেরার মন চাইলো ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। শুধুই আশেপাশে লোকজন ছিল বলে বেঁচে গেলো ফুয়াদ। সুনহেরা বিকৃত মুখ করলো। কোনো একসময় এই জঘন্য ব্যক্তিকে সে ভালোবেসেছিল! ছি! তার পছন্দ কতটা খারাপ ছিল আগে। ভালো হয়েছিলো এই লোকের সাথে তার বিয়ে হয়নি। নাহলে আয়াসের মতো জামাইয়ের জায়গায় এইরকম চরিত্রহীন জামাই তার কপালে জুটতো! মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে অনেক শুকরিয়াও জানালো সুনহেরা।
-কী ভেবেছিলে এইরকম নকলি ছবি দিয়ে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করবে? আসলেই তুমি বড় একটা বেবাকুফ! আমি ভালোভাবে বলছি ফুয়াদ আমাদের মধ্যে এসো না। ভাইকে বলে তোমাকে তোমার আসল জায়গায় পাঠাতে আমার এক মিনিটও লাগবে না।
পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সুনহেরা। ফুয়াদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ভাই ভাই ভাই! কয়েক বছর আগে এই ভাইকে দিয়েই রাস্তার মধ্যে মার খাইয়েছিল তাকে! কোনোকিছু ভুলেনি সে। এক এক করে নিজের সব প্রতিশোধ নিয়েই দম নেবে।
-তুমি আমার না হলে অন্যকারোও হতে পারবে না সোনা। তোমার ভাই জানে না আমি কী জিনিস। গতকাল তোমার আ’বা’ল জামাইয়ের ওপরে আক্রমণ করিয়েছিলাম না, দরকার পরলে আবার করবো। শা’লারে একদম জানে মে’রে ফেলবো।
_______________
আজ ভার্সিটি এসেছে মাহানুর। সামনে তাঁদের এক্সাম। কিছু কাজ শেষ করে অফিসে চলে যাবে। তিনজন মিলে বক বক করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলো। ক্লাসরুমের দরজার সামনে এসে দেখে স্যার অলরেডি ভিতরে চলে গিয়েছে। মাহানুর মেকি হেসে সিয়ামের দিকে তাকায়। মুহিব বিড়বিড় করে বলল,
-আজ আমরা গেছি!
-এই ধলা লেংটি ইঁদুর কে আবার?
প্রশ্ন করলো মাহানুর। মুহিব গলা ঝেরে বলল,
-নতুন স্যার। একদিন ক্লাস করলে মজা বুঝে যাবি দোস্ত।
-বাবা! তাই নাকি!
সিয়াম স্যারকে কিছু বলতে উদ্যত হতেই স্যার নিজের কাজ করতে করতে শান্ত, গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন,
-সিয়াম আর মুহিব ভিতরে আসেন।
সিয়াম চমকিত হয়ে তাকিয়ে থাকলো স্যারের দিকে। মাহানুরের দিকে তাকালে সে ইশারায় তাঁদের ভিতরে যেতে বলল। সিয়াম মুহিব চলে যাওয়ার পর একা একা বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো মাহানুর। স্যার আড়চোখে মাহানুরের দিকে তাকালো। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহানুর। স্যার সবাইকে পড়া দিয়ে মাহানুরের স্মুখীন এসে দাঁড়ালো। কঠিন স্বরে প্রশ্ন করলো,
-হু আর ইউ?
-আমার নাম মাহানুর খান। আমি এই ক্লাসেরই স্টুডেন্ট স্যার।
-আমি তিনদিন ধরে ক্লাস নিচ্ছি একদিনও আপনাকে দেখলাম না! ক্লাসে প্রতিদিন আসতে হয় জানেন তো?
-জি স্যার।
-আর কোনো ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও আমার ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে। বুঝতে পারছেন?
-জি স্যার।
-আসুন। আর শুনে রাখুন মাহানুর আপনি যে বড় কেউই হন না কেনো আমার ক্লাসে আপনি সর্বপ্রথম একজন স্টুডেন্ট। মনে রাখবেন।
মাহানুর মাথা নাড়িয়ে থমথমে মুখে সিয়ামদের পাশে বসে পরলো। তাকে চেনে না এইরকম কোনো স্যার এই ভার্সিটিতে নেই আর এই স্যার নতুন এসেই তাকে বকে ফেলল! ভীষণ অপমানিত বোধ করলো মাহানুর। বাঁকা নজরে সিয়ামের দিকে তাকালো। অতঃপর পড়ায় মনোযোগ দিলো।
স্যার বার বার মাহানুরের দিকে তাকাচ্ছে। মুহিব সূক্ষ্ম ভাবে সেটা খেয়াল করলো। ক্লাস শেষ হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সকলে। মাহানুর পানি খেতে খেতে একজন ক্লাসমেটের সাথে কথা বলছিলো সহসা তার নজর যায় দূরে বসা রাফিনের দিকে। সেও তার দিকেই তাকিয়েই ছিল। যখন মাহানুর তাকালো দৃষ্টি দ্রুত সরিয়ে ফেলল রাফিন। মাহানুর অবাক হলো রাফিনের আচরণ দেখে। মাহানুর বেঞ্চ থেকে উঠে রাফিনের কাছে যেতে নিলে রাফিন ত্বরিত ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। মাহানুর থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুহিব হাসতে হাসতে বলল,
-এটার আবার কী হইলো ভাই!
-কে জানে! যেভাবে পালালো মনে হলো ওরে কু’ত্তায় দৌড়ান্তি দিয়েছে!
সিয়ামের কথা শুনে স্মিত হাসলো মাহানুর। আজকের মতো এখানেই ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসলো সে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে আর মাহানুর ফোন হাতে নিয়ে দেখছে। এখন বাসায় যাবে তারপর অফিসে। স্টাডি, অফিস আবার সংসার সবকিছু যতটা সহজ ভেবেছিলো তার একটুও নয়। সকালে ছয়টা বাজে তার ঘুম থেকে উঠতে হয় আবার রাতে কাজ করতে করতে একটা কী দুইটা বেজে যায় ঘুমাতে ঘুমাতে। অথচ একসময় সে সকাল এগারোটা কী বারোটায় ঘুম থেকে উঠতো! আনমনে হাসলো মাহানুর। শামীরের কল আসায় ধীরেসুস্থে রিসিভ করলো।
-হ্যাঁ বলুন শামীর?
-ম্যাম আপনি অফিসে কখন আসবেন?
-এইতো একটার আগেই পৌঁছে যাবো অফিসে। আপনাকে যে ফাইল গুলো দিয়েছিলাম দেখেছেন?
-ইয়েস ম্যাম। আর ম্যাম আজ বিকালে কিন্তু মেওর আলতাফ শেখ আসবে আপনার সাথে দেখা করতে।
মুখে কুটিল হাসি ফুটে উঠলো মাহানুরের। সে যেনো এই দিনের আশায়ই ছিল। হাস্যজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,
-হ্যাঁ। আমি চাই তাকে বিশেষ ভাবে আপ্যায়ন করা হোক আশা করি আপনি সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
-ওকে ম্যাম আপনি নিশ্চিন্তায় থাকুন।
-গুড।
কল কেটে দিলো মাহানুর। বাসায় এসে পরেছে। গাড়ি থেকে নামতেই দূর থেকে শিবু বড় বড় পা ফেলে আসলো তার কাছে। মাহানুর তাকে দেখে বড় একটি হাসি দিয়ে বলল,
-শিবু ভাইয়া আপনার স্যার সাথে যোগাযোগ হয়েছে?
-গতকাল রাতে কল দিয়েছিলো ম্যাম।
-আপনাকে কল দেয় অথচ বাসায় কোনো কল টল দেয় না সে!
-আসলে স্যার অনেক ব্যস্ত তাই হয়তো যোগাযোগ করার সুযোগ পায়নি।
-বুঝলাম।
ওপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকলেও মনে মনে আরহামকে ইচ্ছে মতো বকছে মাহানুর। আরো কিছুক্ষন শিবুর সাথে কথা বলে রুমে চলে আসলো সে। ফ্রেশ হয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে নিজেকে একবার দেখে বেরিয়ে পরলো সে।
চট্টগ্রামে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে দুইদিন ধরে। এই বর্ষণের মধ্যেও কাজ অফ না সৈনিকদের। মাঠে নতুনদের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে সবাই ভিজে চুব চুব। ক্যান্টনমেন্ট এর রুম থেকে বের হয়ে নিদিষ্ট একটি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হেঁটে চলছে আরহাম। গায়ে আটসাট হয়ে লেগে আছে সাদা রঙের শার্ট আর ইউনিফর্মের সবুজ আর মাটি রঙের পেন্ট। ক্লিনশেভ করা চকচকে শ্রী মুখ। মাথার চুল গুলোও একদম ছোট ছোট করে ছাটানো। মাহানুর তাকে এই রূপে দেখলে নিঃসন্দেহে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেত আর বলতো “আপনার বয়স তো দশ বছর কমে গিয়েছে ফৌজি সাহেব!” এতদিনে অনেকগুলো কাজ জমে গিয়েছে তার। বরাদ্দকৃত একটি রুমের লোহার দরজার স্মুখীন এসে পা জোড়া থেমে গেলো তার। উঁচু স্বরে বলল,
-ওপেন দা ডোর।
-হু ইস দেয়ার?
-মেজর চৌধুরী।
সাথে সাথে দরজা আপনে আপনেই খুলে গেলো। আরহাম সুঠাম শরীরে টানটান হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। সাথে সাথেই দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেলো। একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে সালাম দিলো সম্মান জানালো আরহামকে। আরহাম মাথা নাড়িয়ে সালামের উত্তর দিয়ে সামনে তাকালো। পুরো রুমই লোহার তৈরি। হলুদ রঙের বাতির আলোতে ভিতরে আরো একটা রুম দেখা যাচ্ছে। সেটার দরজা নেই। এখানে সাধারণত শত্রুর দলের কেউ ধরা পরলে তাঁদের রাখা হয়। কিছুদিন আগে একজন ধরা পরেছিল। এইসবদের আরহাম ভীষণ ভালো করে টাইট দিতে পারে তাই সবসময় সেই এখানে আসে। আরহাম ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলো,
-সে কী ভিতরে?
-ইয়েস স্যার।
-আমি ভিতরে ঢোকার পর দরজা লাগিয়ে দেবেন।
-ওকে স্যার।
আরহাম ভিতরে প্রবেশ করলো। অন্ধকারে তলিয়ে আছে পুরো রুম। সাবধানে পা ফেলে বাতি জ্বালিয়ে দিলো সে। চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা এলিয়ে বসে আছে একজন রমণী। এলোমেলো চুল তার মুখ ঢেকে রেখেছে। আরহাম নিজের কপাল চেপে ধরলো। মেয়ে মানুষ যে জিনিস পারবে না সেটা কেনো করতে আসে! প্রত্যেকবার মেয়ে গুপ্তচর দেখলেই আরহামের রাগ উঠে যায়। এই মেয়েদের গায়ে হাত তুলতে ভীষণ মায়া হয় তার। কিন্তু কী করার তারা ইচ্ছে করেই নিজের জীবন বাজি রেখে এখানে আসে। আরহাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে এগিয়ে গেলো। চেয়ার টেনে বরাবর বসলো। টেবিলে ঠক ঠক আওয়াজ করতে করতে মেয়েটি মাথা তুলে তাকালো। আরহাম শক্ত, গম্ভীর কণ্ঠে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলো,
-ডিড ইউ নো বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ?
মেয়েটি কিছুই বলল না। ক্লান্ত চাহনি নিক্ষেপ করে চুপচাপ বসে রইলো। আরহাম পুনরায় জিগ্যেস করলো,
-আনসার মাই কোয়েশ্চন। ডিড ইউ নো?
মেয়েটি এবার হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। আরহাম আড়চোখে তাকালো। আগাগোড়া পরোক্ষ করে নিলো মেয়েটির।
-এখানে কেনো এসেছো? আর কার কথায় এসেছো?
-জানি না।
আরহাম ক্রোধে ফেটে পরলো মেয়েটির কথা শুনে। ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে মন চাইলো তার। নিজের রাগকে কোনোরকম দমিয়ে রেখে রাগী কণ্ঠে বলল,
-মেয়ে বলেই আমি এখনো আমার হাত দমিয়ে রাখছি। ভালোভাবে উত্তর দেও তোমার জন্যও ভালো হবে।
-আমি নিজ থেকেই এসেছি।
-প্রফেসর মনিরা সেন হটাৎ কোন কারণে গুপ্তচর হওয়ার প্রয়োজন পরলো?
থমথমে মুখে মেয়েটি মাথা নত করে বসে রইলো। মেজর আরহাম চৌধুরীর নাম সে অনেকবার শুনেছিলো। আজ নিজ চোখেও দেখে নিলো। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
-আমি কোনোকিছু বলতে ইচ্ছুক নই। আপনাদের যে শাস্তি মন চায় দিন আমার সমস্যা নেই।
-বাহ্! এইরকম বিশস্ত মানুষ এই যুগে কোথায় পাওয়া যায়!
আরহাম নিজের ফোন বের করলো। কিছু একটা বের করে মেয়েটির স্মুখীন ধরলো। অতি শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
-দেখো তো চেনো নাকি?
আরহামের ফোনের দিকে তাকাতেই মেয়েটির হৃদপিন্ড ধপ করে উঠলো। চিন্তার ছাপ দেখা গেলো তার মুখে। আরহাম সেটা দেখে বাঁকা হাসলো। মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
-নিজের ছেলেকে চিনতে পেরেছো নিশ্চই?
-আপনাদের দোষী আমি আমার নির্দোষ ছেলেকে আপনারা কিছু করতে পারেননা।
-আমরা সব পারি। দেখবে কী কী পারি?
-না না। প্লিজ আমার ছেলেকে কিছু করবেন না।
-এখন তুমি সবটা স্বীকার করবে নাকি আমার উল্টো পথ বেছে নিতে হবে?
-আমাকে খাতা কলম দিন আমি সব ডিটেলসে লিখে দিচ্ছি।
-গুড।
আরহাম একজন লোককে ডেকে খাতা কলম দিয়ে যেতে বলল। খাতা কলম আসতেই মেয়েটি নিজের মতো করে লিখতে থাকলো। আরহাম শয়’তা’নি হাসি দিয়ে মেয়েটির কাজ দেখতে থাকলো। এবারের গুপ্তচরকে নিজের হাতের মুঠোয় নিতে বেশি এনার্জি অপচয় করতে হলো না।
_________________
রাতে বর্ষণ মানেই মন মুগ্ধকর একটা পরিবেশ। আর সাথে যদি হয় হৃদয় শীতল করার মতো বাতাস তাহলে তো আর কথাই নেই। প্রকৃতিও মাঝে মাঝে উদাসীন মনকে ভালো করে তোলে উত্তপ্ত চিত্তকে শান্ত করে দেয়। এই যেমন এখন মাহানুরের দুঃখী মনকে ভালো করতে লেগে পরেছে আবহাওয়া। রাত বারোটা বাজে এখন। বিকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যার দরুণ মেয়র সাহেবও আজ আসতে পারেনি। মেজাজ পুরো বিগড়ে যায় মাহানুরের সেইসময়। কাজে মন দেওয়াও কঠিন হয়ে পরেছিল তার জন্য। সন্ধ্যার পর বাসায় আসে সে। আজও তার রুমে রাবেয়া উপস্থিত ছিল।
মাহানুর বুঝে না সে না থাকাকালীনই কেনো এই মেয়ে তার রুমে আসে। কী চলে এই মেয়ের মনে! মেজাজ গরম থাকায় মাহানুর ধমক দেয় রাবেয়াকে। অনেকগুলো কথাও শোনায় তাকে। অপমানিত হয়ে রাবেয়া চলে যায়। রাতের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়েছিলো সে। তখন আবার স্টাডির কথা মনে পরলো। লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। বই মেলে বসতেই মাথায় এসে চেপে বসে আরহাম। আরহাম এখন কী করছে? রাতে কী খেয়েছে? কোথায় আছে এখন? আমাকে কী মিস করছে? এইরকম নানান প্রশ্ন বাসা বাধে তার ছোট মনে। শেষে বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো। পরিহিত টি-শার্ট টেনেটুনে ঠিক করে বেলকনিতে গেলো। কিছুক্ষন থেকে রুমে চলে আসলো।
এখন জানালা ধরে দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এক দুইটা গাড়ি যেতে দেখা যাচ্ছে। নির্জন রাস্তাঘাট। এইরকম পরিবেশে প্রিয় মানুষের হাত ধরে হাঁটতে মন্দ লাগবে না। কিন্তু তার প্রিয় মানুষ তো বৃষ্টি সহ্যই করতে পারে না। আনমনে শব্দ করে হেসে উঠলো মাহানুর। একা একাই হাসতে হাসতে নিজেকে নিজেই বলল,
-উনাকে মেজর কে বানালো তাকে দেখতে চাই আমি!
হাসতে হাসতেই আবার মুখে অন্ধকার নেমে এলো তার। ভিতরে সত্ত্বা অবচেতন মনে তাকে প্রশ্ন করলো,
-বাহ্! মেজর চৌধুরী এখন তোর প্রিয় মানুষ নাকি! বাহ্ রে মাহানুর!
মাহানুর হকচকিয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বলল,
-প্রিয় না কিন্তু অপ্রিয় ও না। আমার স্বপ্নে, কল্পনায় আসে সে।
-হুম বুঝি বুঝি। একদিন যার সাথে সংসার করতেও ইচ্ছুক ছিলি না, আর্মি নাম শুনলেই রেগে যেতি এখন সেই এক মেজরকেই মন দিয়ে বসলি! ভালোই তো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিস!
-আমি প্রেমে পরিনি।
মাহানুরের ভিতরের সত্ত্বা মুখ ভেংচি কাটলো। উপহাস স্বরে হাসলো সে। মাহানুরকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলল,
-তাহলে রাবেয়াকে নিয়ে এতো চিন্তা কেন তোর? মেঘালয়ে না আরহামকে বললি দরকার পরলে সে আরেকটা বিয়ে করতেই পারে তোর প্রবলেম নেই। রাবেয়াই নাহয় আরহামের সেকেন্ড ওয়াইফ হোক আর তোর সতীন।
-না না। চুপ তুই এটা কোনোদিনও হতে পারে না। ঐ শাকচুন্নি, ডায়নি আমার বেটার দিকে নজর দিলেই আমি ওর চোখে তুলে ফেলবো। বোন হয়ে আছে বোন হয়েই থাকবে আজীবন।
-তাহলে মেঘালয়ে যে বললি? আরহাম যদি আরেকটা বিয়ে করতে চায়?
-কেনো কেনো? আমার মধ্যে কী কোনো সমস্যা আছে যে সে আরেকটা বিয়ে করতে চাইবে? কোনদিক দিয়ে কমতি আমার! তার জন্য তো আমি রাগ, জেদও পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেবো। একদম মাটির মানুষ হয়ে যাবো।
-সে তোকে পছন্দ করে না রে বোইন। দেখিস একদিন তোকে রেখে অন্য মেয়ের কাছে চলে যাবে। আর যে তার ফিটনেস মেয়েরাও পাগল হয়ে তার পিছনে পরে যাবে!
-তাহলে ঐ লাম্বু বেটারে আমি জি’ন্দা মাটিতে গেড়ে ফেলবো। যেহেতু মাহানুরের তাকে পছন্দ হয়েছে সেহেতু সে শুধুই মাহানুরের। মন না চাইলেও এই মাহানুরের সরি তার নুরের সাথেই তাকে থাকতে হবে।
-স্বপ্ন দেখ স্বপ্ন।
-শুধু স্বপ্ন না রিয়েলও হবে দেখিস তুই। আমিই তার বাচ্চাদের একমাত্র মা হবো।
ভিতরের সত্ত্বা আশ্চর্য হয়ে বলল,
-ওমা! এতদূর চলে গিয়েছিস তুই! আমি তো তোকে ভালো মেয়ে ভাবতাম!
মাহানুর জিবে কামড় দিয়ে বসলো। মনের কথা ভুল করে মুখে এসে পরেছে তার। লজ্জা পেয়ে দুইহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল সে। এমন সময় প্রচন্ড আওয়াজ করে বিছানায় পরে থাকা মাহানুরের ফোন বেজে উঠলো। মাহানুর বড় নিঃশাস নিয়ে হেঁটে ফোনের কাছে আসলো। ফোন হাতে দিয়ে অচেনা নাম্বার দেখে কল রিসিভ করলো।
-আসসালামু ওলাইকুম।
-ওলাইকুম আসসালাম। ইস মাহানুর খান স্পিকিং?
ভরাট পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে ঐপাশের মানুষটিকে চিনতে পারলো না মাহানুর। ভাবলো হয়তো অফিসের কেউ। তাই সেও কিছুটা কঠিন স্বরেই বলে,
-ইয়েস। আপনি কে বলছে?
-ইওর বেলাভড হাসব্যান্ড, ওয়াইফি।
-আরহাম!
অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর মাহানুরের। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। ওষ্ঠজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। আরহাম স্মিত হেসে অপরপাশ থেকে বলল,
-ইয়েস ম্যাডাম। ভালো আছেন?
মাহানুর চুপ। গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না সে সত্যি আরহাম কল দিয়েছে! মাহানুরকে কিছু বলতে না দেখে আরহাম বলল,
-হ্যালো। চুপ হয়ে গেলে কেনো নুর? ঘুমের বেঘাত ঘটালাম না তো?
-কে আপনি ভাইয়া? কেনো কল দিয়েছেন আমার নাম্বারে? আপনার কোনো পরিবার স্বজন আছে নাকি! এতো রাতে অচেনা একটি মেয়েকে কল দিয়ে ডিসটার্ব করতে বিবেকে বাঁধলো না?
>>চলবে।