#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০
রিতু মনেমনে খুব অপরাধবোধে ভুগলো। ওর
সবগুলো কথা ইফাদ ঠিকই মনে ধরে বসে আছে।
কিন্তু রিতু ইন্টেশনালি কিছু বলতে চায়নি। রাগের
মাথায়, ঝোঁকের বশে বলে ফেলেছিলো। অথচ স্যার সব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। রিতু এতটাই নিজের আচরণে লজ্জিত হলো যে ও বুঝতে পারলো না ইফাদকে কী বলবে? আর এজন্য ওদের ভেতরের দূরত্বটা কিছুতেই কমলো না, বরং ক্রমশই বাড়লো। এরমধ্যে ইফাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। চলে যাওয়ার আগের দিন রাতে ইফাদ আবারও জিজ্ঞেস করল রিতুকে,
— তুমি কিছু চাও আমার কাছে?
— নাহ তো!
— ঠিক করে ভেবে বলো।
— আমার সত্যিই কিছু চাই না।
— ওকে।
রিতু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
— আপনার আমার কাছে কিছু চাওয়ার নেই?
ইফাদ মৃদু হেসে বলল,
— যেটা চাইবো সেটা তুমি দিতে পারবে না। সেজন্য
বলবো না।
রিতু ভ্রু কুঁচকালো,
— কী এমন জিনিস যেটা আমি দিতে পারবো না?
— ভুল, দিতে পারবে বাট দেবে না। তাই বলতে
চাচ্ছি না।
ইফাদ এটুকু বলেই আচমকা রিতুকে বুকে টেনে
নিলো। রিতু প্রথমে ছটফট করলেও একটা সময় পর আর বাধা দিলো না। চুপ করে থাকলো৷ ইফাদ অনেকক্ষণ পর ওর গালে, কপালে চুমু খেলো।
এরপর ছেড়ে দিয়ে বলল,
— সরি।
বলেই ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো। রিতু ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। স্পষ্ট অনুভব করলো কথা বলার সময় ওর চোখ ছলছল করছিলো, গলায় স্বরও কাঁপছিলো।
পরদিন ইফাদকে বিদায় দিতে কাছের কিছু আত্মীয়রা এলো৷ বাবুল মিয়া, এজাজ আর ইশিতাও এলো।
যাওয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ির
সবার মুখ ভার হয়ে যাচ্ছে। নাজিয়া ইসলাম সারাটা দিন মনম’রা হয়ে কাটালেন। রিতু শ্বাশুড়ির চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলো তিনি শক্ত থাকার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন৷ রিতু অপ্রস্তুত বোধ করলো। কাছে গিয়ে বলল,
— মা, আপনি স্যারের কাছে যান…
নাজিয়া ইসলাম অদ্ভুত চোখে তাকালেন ওর দিকে। কিছুটা শক্ত গলায় বললেন,
— তুমি ওর বউ, আমি মা। এসময় পাশে থাকাটা কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
রিতু কথা খুঁজে পেলো না। আমতাআমতা
করতে লাগলো। নাজিয়া ইসলাম উত্তর না পেয়ে চলে গেলেন। রিতু শ্বাশুড়ির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
.
রাত বারোটায় ইফাদের ফ্লাইট।
সন্ধ্যা হতেই বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠলো। সব গোছগাছ সেরে, রেডি টেডি হয়ে সবার থেকে বিদায় নেবার পর ইফাদ আড়চোখে একবার রিতুকে দেখলো। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে। চেহারায় অন্যরকম বিষন্নতা। ওর মনোভাব বুঝতে পারলো না ইফাদ। মেয়েটাকে সকাল থেকে দেখেইনি সে। দূরে দূরে থেকেছে। যেন ওর থাকা না থাকায় রিতুর কোনোকিছুই যায় আসে না। ইফাদের ইচ্ছে করছিলো রিতুকে কয়েকটা থা’প্প’ড় দিতে, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এই মেয়েটাকে সে অন্যভাবে শা’স্তি দেবে। ভিন্ন শা-স্তি।
তবে এটা আদৌ শা-স্তি হবে কিনা রিতুর জন্য তা জানে না। ইফাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে রিতুকে কিছুই বললো না, শুধুমাত্র ‘আসছি’ শব্দটি ছাড়া। রিতু ভেবেছিলো ইফাদ যাবার সময় ওকে অন্তত কিছু হলেও বলবে
কিন্তু সেটা হয়নি দেখে ও ভীষণ আশ্চর্য হলো। কোনো স্বামী তার দীর্ঘ বিদায়ে বউয়ের কাছ থেকে এভাবে বিদায় নেয় জানা ছিলো না ওর। ইফাদের সাথে তৌফ আর অমি গেলো। আর কাউকে নিলো না ইফাদ। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে ওদের গাড়িটা রওয়ানা হবার পর হঠাৎই রিতুর দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই সবার অগোচরে নিজের ঘরে চলে গেলো৷ এ সমস্ত ব্যাপারটাই লক্ষ্য করলো ইশিতা। ইফাদের ওরকম মনম’রা আচরণ, বোনকে ওমন নির্লিপ্ত দেখে ভেতরে ভেতরে ওর চিন্তা এবং স’ন্দে’হ দুটোই হলো।
.
বাবুল মিয়া আর এজাজ কিছুতেই থাকলেন না, না খেয়েই তারা চলে গেলেন৷ ইশিতা রয়ে গেলো। নাজিয়া ইসলাম জোর করে রেখে দিলেন। তাছাড়া কিছু মেহমানও ছিলো বাড়িতে। সকলের জন্য রাতের খাবারের তৈরি করা হচ্ছে। নাজিয়া ইসলাম বাড়ির বড় বউ, সেই হিসেবে বেশিরভাগ দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়৷ ছেলের বিদায়ে তার মন ভালো নেই একদম। চুপচাপ অশ্রু ঝড়াচ্ছেন আর রান্না সামলাচ্ছেন। জা’য়েরা অবশ্য তার মন বুঝে তাকে বিশ্রাম নিতে বলেছিলো, তিনি শোনেন নি। রিতুর ভীষণ খারাপ লাগছিলো শ্বাশুড়ির জন্য। ও গিয়ে সান্ত্বনার সুরে বলল,
— আপনি গিয়ে রেস্ট নিন মা। আমি রান্নাটা দেখছি…
নাজিয়া ইসলাম অনেকটা শক্ত স্বরেই বললেন,
— কেন?
রিতু থতমত খেলো,
— আপনি তো কষ্ট পাচ্ছেন। তাই বলছি…
নাজিয়া জিজ্ঞেস করলেন,
— কেন তুমি পাচ্ছ না?
— জি মানে…
নাজিয়া ইসলাম হতাশার শ্বাস ফেললেন,
— তোমাকে আমি কিছুই বলবো না। নয়তো খা-রা’প শ্বাশুড়ি হয়ে যাব।
রিতু অবাক হলো,
— এভাবে কেন বলছেন মা?
— যদি আমার জায়গায় থাকতে তাহলে বুঝতে
পারতে। আমার কথা শোনে নি অথচ তুমি চাইলেই আমার ছেলেকে আটকাতে পারতে, কিন্তু তুমি সেটাও বোঝার চেষ্টা করোনি…
রিতু ভাঙা স্বরে বলল,
— আমি কী করতাম? ওনি তো হায়ার স্টাডিজের জন্য যাচ্ছেন। আমাকে আগে বলেন নি। তাহলে হয়তো…
নাজিয়া ইসলাম অভিযোগের সুরে বললেন,
— তুমি নিজে থেকে জানতে চেষ্টা করেছিল? করোনি। ইফাদ মুখ চোরা গোছের। ওর কথা সব ওর মধ্যেই থাকে। নিজে থেকে আমাদের কিছু বলে না। কষ্ট পেলেও হাসিমুখ করে বসে থাকবে। সে নিজে কষ্ট পায় কিন্তু অন্যকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে। তার উদাহরণ কিন্তু তোমাদের বিয়েটাই। তুমি যাতে বিয়ের খবরে নাওয়াখাওয়া ভুলে না যাও তাই বিয়েটাকেও তোমাকে না জানিয়ে করতে চেয়েছিলো। তুমি আমার ছেলেটাকে ভুল বুঝলে, অবশ্য তা স্বাভাবিকই…
রিতু ছলছল চোখে তাকালো। মুখে কোনো ‘রা’
নেই। শ্বাশুড়ির মুখ থেকে কথাগুলো শুনে ওর কষ্ট হচ্ছে। নাজিয়া ইসলাম ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
— শুনো মা! ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে কিছু বলি না। শখের বউ তুমি তার, আমাদেরও সবার পছন্দের। কিন্তু আজ বাধ্য হচ্ছি বলতে, যত্ন ছাড়া,
এতটা গা ছাড়া ভাব থাকলে কোনো সম্পর্কই টেকে না।
নাজিয়া ইসলাম আরকিছু বললো না। শ্বাশুড়ি কখনো ওর সাথে এত শক্তভাবে কথা বলে নি। আজ প্রথম বলেছে। রিতুর খারাপ লাগলো ভীষণ। ঘুমাতে যাওয়ার পর অদ্ভুতভাবে ইফাদকে রিতু খুব বেশি মিস করতে লাগলো। এতদিন যে মানুষটা পাশে শুয়ে ঘুমাতো
সে নেই, থাকবে না ভেবেই রিতুর বুক জ্বালাপোড়া করতে লাগলো। সেদিন রাতটা রিতুর কাটলো নিশ্চুপে চোখের জল ফেলতে ফেলতে।
পরদিন সকালটাও শুরু হলো বিষন্নতার সাথে। নাস্তা করতে গিয়ে কিছুই মুখে তুলতে পারলো না একপ্রকার। রুফি আর অমি মজা নিতে লাগলে ইফতি ওদের ধমকে ওঠলো। রিতু বিষন্ন ভঙ্গিতে দিন কাটালো। অমি জানালো ইফাদ টেক্সট করে জানিয়েছে সে সুস্থভাবেই লন্ডনে পৌঁছাতে পেরেছে৷ বাড়ির সবাই স্বস্তি পেলো খবরটায়। রাতে তৌফর ফোনে কল এলো ইফাদের। ছোট-বড় সকলের সাথেই ও ভিডিয়ো কলে কথা বললো। রিতু উৎকন্ঠিত মনে বসে রইলো। ওদের কথা শুনলো। অবাক হলো তখন, যখন দেখলো ইফাদ একবারও ওর সাথে কথা বলা দূর ওর সম্বন্ধে কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করলো না। তৌফ, অমিরাই ভাবি ভাবি করে ইফাদের মাথা খেলো, নিজে থেকেই ওরা রিতুর আপডেট জানালো। কিন্তু রিতুর মনে হলো ইফাদ তাতে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না এবং কথার মাঝখানেই ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিলো। রিতু বিশ্বাসই করতে পারছিলো না ইফাদ এরকম কিছু করেছে। এত খারাপ লাগলো ব্যাপারটায় যে ওর চোখদুটো ছলছল করে ওঠলো। এতটা নিষ্ঠুর অংক স্যার? বউকেই ভুলে গেলো?
★
দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেলো। ইশিতা আজ চলে যাবে। এই ক’টা দিন পরিস্থিতি বিবেচনা করে রিতু আর ইফাদের সম্পর্কের শীতল ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে ইশিতা। আর এতে যে নিজের বোনের অবদানই বেশি তাও বুঝেছে সে। রিতুকে একা পেতেই ইশিতা তাই বেশ চেপে ধরলো ওকে সব বলার জন্য। রিতু ভড়কে গিয়ে প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলো না কিন্তু বোনের চাপাচাপিতেই এক পর্যায়ে সব বলতে বাধ্য হলো ও। ইশিতা রেগে প্রথমে ওকে একটা চ-ড় মারলো৷ এরপর কথা শোনালো প্রচুর। এই পাঁচদিনে একবারও ইফাদ ওর সাথে কথা বলতে চায়নি। না নিজে থেকে কিছু জানতে চেয়েছে। এসব নিয়েই মন বিধস্ত হয়ে আছে রিতুর৷ তার ওপর বোনের কথাগুলো শুনে ওর বুক ভেঙেচুরে আসছে৷ ও থমথমে গলায় ইশিতাকে বলল,
— আমি বুঝি নি আপু যে স্যার এত সিরিয়াসলি নেবে সবকিছু…
ইশিতা তড়াক করে ওর গাল চেপে ধরলো,
— ওহ! তুমি তো কচি খুকি, কিছুই বোঝ না। বিবাহিতা হইয়াও স্বামী-সংসার বোঝো না, তাইনা?
রিতু কোঁকাতে কোঁকাতে বলল,
— আপু লাগছে…
— লাগুক। এতদিন জামাই তোষামোদ কইরাও
যখন তোর মতো ফিট খাওয়ানীর মন পায় নাই,
তোর লাগাই উচিৎ…
— আপু!
ইশিতা কটমট করে বলল,
— চুপ! কীসের আপু? হ্যাঁ? কীসের? ন্যাকা ষষ্ঠী কোথাকার! এই তোর কী আছে রে? কীসের জোরে
তুই এমন দেমাক দেখাস?
শ্বাশুড়ি আর বোনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে ও বড়সড় কোনো অ’প’রা’ধ করে ফেলেছে। অবশ্য অ’প’রা’ধ তো ও করেছেই৷ রিতু ধরা গলায় বলল,
— আমি এত ভেবেচিন্তে বলিনি…
ইশিতা ক্ষ্যা’পাটে সুরে বলল,
–অ্যাহ! ভেবে চিন্তে বলিনি। ন্যাকা! তুই কী ভাবোস
তুই রাজরানি? আসলেই এত ভালো বর ডিজার্ভ করোস? না। তাছাড়া যদি কম্পেয়ার করতে যাস তাইলে দেখবি তুই ওদের থেইকা কতটুকু পিছাই আছিস। সেই তোর জন্য একটা ছেলে চাকরি ছাড়লো,
দেশ ছাড়লো আর তুই সাদাসিধা সাইজা থাকোস! মিডিল ক্লাস ফ্যামিলি থেইকা ওইঠা আইসা তুই তোর বরকে কীভাবে অপমানিত করোস আমার মাথায়
আসে না….
অকাট্য সত্য কথাগুলো শুনে রিতুর লজ্জাবোধ
প্রখর হলো৷ ও মাথা নিচু করে ফেললো।
ওকে চুপ দেখে ইশিতা আবারও তেড়েমেরে বলল,
— ইফাদ যা করছে একদম ঠিক করছে। ওরই বা এত কীসের ঠ্যাকা তোরে হাতে-পায়ে ধইরা রাখবার? ও আরো ভালো অপশন পাইয়া যাইবো, তোর চেয়ে শতগুণে ভালো এমন কাউরে। তোর মতো দে’মা’গি
না থাকলে ওর কচুটিও যায়-আসবে না। অ’হং’কারী মাইয়া কোথাকার…
রিতু ভাঙা গলায় অসহায় চোখে তাকালো,
— তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আপু। সত্যিই আমি ওনাকে অসম্মান করার জন্য বলিনি!
ইশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো৷ দু-হাত মুঠোয় নিয়ে শান্ত গলায় বলল,
— শোন! বিয়ের পর স্বামীরাই সব। সেই স্বামীকে ভালোবাসতে না পারলেও অসম্মান করতে নাই। আর যে ছেলেটা তোর এত কেয়ার নিতো, চোখে হারাইতো সেই তো দিনশেষে তোর সবকিছু, তাইনা? কেন এত অবহেলা করলি? এখন যদি জে’দ কইরা ওই দেশ থেইকা একটা বউ নিয়া আসে বা ধর আর ফিরাই না আসে? তখন তুই কী করবি?
রিতু এবার আর কিছুতেই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। আচমকা শব্দ করে কেঁদে দিলো। বড়
আপু এসব কী আর কেন বলছে? অংক স্যার নিশ্চয় এরকম ছেলে না। ওকে রেখে নিশ্চয় অন্য কাউকে জীবনে জড়াবে না, কখনো না!
__________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…
সবাই রেসপন্স করবেন ❤️🖤❤️
পেইজঃ Bindas Life ✅ ফলো করে রাখুন ।