প্রিয়তম #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-২

0
245

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

রিতু ভেবেছিলো ফোনে একবার কথা বলবে অংক স্যারের সাথে। কেন ওর সাথে এমন একটা মিথ্যা বললো তা জানতে চাইবে। কিন্তু বাবুল মিয়া দিলেন না। তার এক কথা, ভদ্র বাড়ির মেয়েরা বিয়ের আগে বরের সাথে কথাবার্তা বলে না। রিতু বাবার নাটক বেশ বুঝতে পারলো, ও আর কথা বাড়ালো না এ বিষয়ে। বাবা যা চাইছে তাই হোক! তবে বিয়ে নিয়ে বাড়িতে ছোটখাটো একটা হাঙ্গামা হয়ে গেলো। খালা, ফুফুরা সবাই বাবুল মিয়া আর ইশিতার কান্ডে বেশ রাগ করলো। তবুও ভাইয়ের সিদ্ধান্ত বলে কথা, কেউ প্রতিবাদ করে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। সবাই মুখভার করে বিয়ের কাজকর্মে হাত লাগালো। রিতু তাদের কত আদরের! অথচ বিয়েটা হচ্ছে কি-না ওরই অমতে?

বিকেলের দিকে বরপক্ষ আসার কথা। কাজিনরা
মিলে রিতুকে বউ সাজিয়ে দিলো। ফর্সা গায়ে লাল বেনারসিতে ওকে অপ্সরীর মতো সুন্দর দেখাচ্ছিলো। কিন্তু বউ সাজার পর রিতুর এত অসহ্য লাগছিলো,
ও ইচ্ছে করেই বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলো রিতু জানে না, ছোটফুফুর
মেয়ে মুনি এসে জানালো, অংক স্যার এসে গেছে। সাথে তার কাজিন, বন্ধুদেরও নিয়ে এসেছে। রিতু যারপরনাই হতবাক হলো। ভেবেছিলো ঘরোয়া ভাবে বিয়ে যখন হয়তো হাতেগোনা চার-পাঁচজন মানুষ আসবে। তাই বলে কাজিন, বন্ধুবান্ধবও নিয়ে আসবে? ওরা কী ঘরোয়া বিয়ের সংজ্ঞা ভুলে গেছে? বিয়ে কর‍তে এসেছে একপল্টন হাভাতে নিয়ে? এই দুর্মূল্যের বাজারে বাবা ঠিকঠাক আপ্যায়ন করতে পারবে এদের? স্যারের প্রতি অকারণেই ওর রাগটা চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়তেই থাকলো!
একটু পরই বড়ফুফু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
— রিতু রে, তোর জামাই তো ভারী সুন্দর!
রিতু শক্ত হয়ে বসে রইলো। ফুফু ওর পাশে বসে
বকবক শুরু করলেন,
— তোর জামাই তো এক আচানক কাম করছে…
বড়ফুফুর চোখ চকচক করছে আনন্দে। রিতু কৌতূহলী হওয়ার ভান করে জানতে চাইলো,
— কী?
— খাওনে শট পড়ছে দেইখা নিজেই রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়া সব ব্যবস্থা কইরা ফালাইলো…
রিতু ভ্রু কুঁচকে ফেললো। খাবারের ব্যবস্থা করেছে মানে? এগুলো করে কি বোঝাতে চাচ্ছে মুখোশধারী শ’য়’তানটা? হাত করা হচ্ছে ওর বাড়ির মানুষ গুলোকে? ছিহ! রিতু ক্ষোভ নিয়ে বললো,
— সঙ্গে করে ওরা এতগুলো লোক নিয়ে এলে খাবারে তো কম পড়বেই…
বড়ফুফু মেজাজ খারাপ করে বললেন,
— আরে ভাইজানে নাকি নিজেই বলছে। ছোট মাইয়ার বিয়া দিতাছে ছোটখাটো আয়োজনে, বরপক্ষের পঞ্চাশজন তো খাওয়াইবোই! কিন্তু তোর শ্বশুরবাড়ির কেউ রাজি ছিলো না। ওরা চাইছিলো ঘরের মানুষরাই আইয়া বউ নিয়া যাইবো। তোর বাপের বাড়াবাড়ির কারণে পরে আমাগো দুইবাড়ি মিলাইয়া পায়ত্রিশ জনের আয়োজন করা হয়ছিলো। কিন্তু তোর ফুফা, খালু-মামা আর হর্তাকর্তা রা’ক্ষ’স’রা মিল্লাই সব
সাবাড় কইরা দশজনের খাওনে টান ফালাই দিসে। লজ্জার কথা হইলো, এইসব আবার কেমনে জানি নতুন জামাইর কানে গেছে। তোর বাপেরে সে আরকিছু করতে দেয় নাই। হে নিজেই আবার সব রেস্টুরেন্টে অর্ডার করছে। আহারে বিয়া করতো আইসা বেচারা কত হেনস্তার শিকার! এরপরেও মুখে টাইন্না হাসি
ধইরা রাখছে…
রিতু চোখ বড়বড় করে ফেললো। বড়ফুফু গদগদ
কন্ঠে বললেন,
— রিতু মা রে, তোর জামাই ভাইগ্য খুবি ভালা, সুখী
হবি তুই। আমার মতো কিপটা, ল্যাদামার্কা জামাই পাস নাই। পাইসোস একটা ব্যাটার ব্যাটা। খরুইচ্চা পোলা…
বড়ফুফুর চোখ ছলছল করে ওঠলো। রিতু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই ঠকবাজ অংক স্যারটা আবার হিপনোটিজমও জানে নাকি? যেই ফুফু কয়েক ঘন্টা আগেও চিল্লাচিল্লি করে বলছিলো অংক স্যারের পা’ছা’য় লা’থি মেরে বের করে দেবে, সেই ফুফুর সুর এভাবে পালটে গেলো? এমনও হয়? ওকে বোঝারও আর কেউ রইলো না? রিতুর গলা ধরে এলো। অতি সন্তপর্ণে ও কান্না আটকালো!
.

বিয়ে পড়ানোর সময় রিতুকে ঘিরে ধরলো ইফাদের
বড় বোন ইফতি, কাজিন আর তাদের বাচ্চাকাচ্চারা। বাচ্চাগুলো ‘মামী, মামী’ বলে হৈহৈ জুড়ে দিলো।
বাকিরা সবাই ওর সৌন্দর্য দেখে প্রশংসায় মত্ত হলো। রিতুর কান ঝালাপালা করতে লাগলো সবার বকবকানিতে। কাজী নিজের বয়ান শেষ করে ওকে ‘কবুল’ বলতে বলতেই রিতু অসহায় মুখ করে বোনের দিকে তাকালো। ইশিতা ওর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল,
–মুখ শুকনা কইরা বইসা না থাইকা ‘কবুল’ বইলা
উদ্ধার কর…
— আপু তুমি এত নিষ্ঠুর?
ইশিতা দুর্বৃত্ত হেসে বলল,
— আমার বিয়েতেও আমি কান্নাকাটি করছিলাম, তখন তুই কী ব্যবহার করছিলি মনে আছে? এরপরেও যে আমি তোর পাশে আছি, এইটাই তোর ভাগ্য…
— আপু!
ইশিতা এবার বিরক্ত হলো,
— নাটক না কইরা তাড়াতাড়ি ‘কবুল’ ক। তোর দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবিতে কে জানি বোরহানি ফেলে দিসে। বেচারা রাগ কইরা এখনো কিছু খায় নাই, সেইদিকটাও তো দেখতে হইবো নাকি আমার…
নে বল…
স্বামীর জন্য এত দরদ? এদিকে ছোটবোনের জীবন নিয়ে মজার খেলা? রিতু রাগে, দুঃখে একসাথে তিনবার কবুল বলে দিলো। কাজী সাহেব ‘আলহামদুলিল্লাহ বিয়ে সম্পূর্ণ’ বলে দোয়াপাঠ করে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন৷ এদিকে কবুল’ বলার পর রিতু কতক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। অংক স্যার এখন তার বর! ভেবেই কান্না পেলো। একসময় এই লোকটার কাছে কতভাবেই না অপমানিত হতে হয়েছে ওকে। আর আজ? তার স্ত্রী হিসেবেই কাগজে স্বাক্ষর করতে হলো? এসব ভেবে ও যখন ঘরে বসে ফুঁসছিলো তখনি ইশিতা আর মুনি এসে বর-কনের কাপল ছবি তোলার জন্য ওকে এসে জোর করে বসার ঘরে নিয়ে গেলো। বর-কনে সাজে দু’জনের প্রথম দেখা হলো তখনি। মুনি গিয়ে ওকে বসিয়ে দিলো ইফাদের পাশে। রিতু আড়ষ্ট বোধ করলো। আড়চোখে তাকিয়ে
দেখলো ঠকবাজটা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে
একদম ফাটিয়ে দেওয়া লুক নিয়ে বিয়ে করতে
এসেছে। রিতু অভিভূত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। ইফাদ ওকে দেখে সৌজন্যমূলক ভাবে তাকালো। এমন একটা ভান করলো যেন ওদের এই প্রথম দেখা হয়েছে! রিতুর রাগে গা, পিত্তি জ্বলে গেলো। কিন্তু ভেতরের আগুনটা দুমড়েমুচড়ে নিজের ভেতরেই জ্বালিয়ে রাখলো। ইফাদ ওকে এরকম উসখুস করতে দেখে একফাঁকে জিজ্ঞেস করলো,
— টয়লেট যাবে রিতু?
রিতু এমনিতেই রেগে ছিলো। আচমকা এ কথা শুনে ওর মুখ হা হয়ে গেলো। থতমত খেয়ে বলল,
— মানে?
— যেভাবে হাতের ছালচামড়া ওঠাচ্ছো ভাবলাম বুঝি…
রিতুর চোখমুখ লাল হয়ে গেলো রাগে। মজা করছে
ওর সাথে? এই লোকের সাথে কি ওর মজার সম্পর্ক? ইফাদ আবারও নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমাকে মিথ্যে বলে বিয়ে করে নেওয়ায় তুমি কী চমকে গেছো?
রিতুর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো, আমি এতটাই চমকে গেছি যে তোর জীবনটা কীভাবে তেজপাতা বানিয়ে তরকারিতে দেবো সেই মতলব করছি। কিন্তু ও নিজেকে সংযত করলো।
ছবি তোলার সময় ইফাদ ওকে মুগ্ধ গলায় বলল,
— তুমি খুব সুন্দর রিতু …
রিতু মনে মনে বলল,
— তাইতো লোভে পড়েছিস শালা…

বিদায়ের সময় দুইফুফু মিলে রিতুর গলা জড়িয়ে বিলাপ করে কান্নাকাটি শুরু করলো। রিতু ভড়কে গেলো। ও ঠিক করেছিলো কাঁদবে না। কিন্তু ফুফুদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে একসময় নিজেও কেঁদে ফেললো। ইশিতা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
— তোর সাজগোজ নষ্ট হয়ে যাবে, আর কাঁদিস না পাগলি…
— আপু আমি যাবো না…
খালা বললেন,
— যাইতেই হয় রে, ওইডাই এহন থেইকা তোর বাড়ি…
রিতু কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— যাবো না, ম’রে গেলেও না। আমি নিজের বাড়িতেই থাকবো। দেখি কে আমায় নিয়ে যায়…
ইফাদ এসে ওর হাত ধরে শক্ত গলায় বলল,
— বিয়ে করেছি কী বউকে রেখে যেতে? নো ওয়ে। এক্ষুনি বউ নিয়ে যাবো আমি…
রিতু ওর হাত ছাড়িয়ে এবার আরো জোরে কাঁদতে লাগলো,
— যাবো না আমি কোথাও। আমি বাবার কাছে থাকবো। বাবা কোথায়? আপু বাবাকে ডাকো…
বাবুল মিয়া মেহমানদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।
মেয়ে কাঁদছে, শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইছে না শুনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। রিতু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–তুমি ওদের যেতে বলো বাবা। আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাবো না, কিছুতেই না…
বাবুল মিয়ার বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে। সেদিনের একরত্তি মেয়ে, আজ তার বিয়েও হয়ে গেলো!
তিনি অসহায় চোখে ইফাদের দিকে তাকালেন। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ইফাদ রিতুকে পাজাকোলা করে তুলে নিলো। রিতু আচমকা এরকম কান্ডে ভয় পেয়ে ইফাদের পাঞ্জাবীর কলার শক্ত করে ধরে চোখ বুজে ফেললো। পরক্ষণে চোখ খুলতেই কোলে তোলার ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো। ইফাদ ওর কাজে তেমন পাত্তা না দিয়ে
বাবুল মিয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
— সরি, বউ রেখে যেতে পারছি না। তবে চিন্তা করবেন না আপনার মেয়েকে আমি সুখে রাখবো। দোয়া করবেন আমাদের জন্য। আসছি আংকেল…
বাবুল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়ে এখন অন্য বাড়ির বউ, তার এখানে আর কিছুই বলার নেই।
ইফাদ রিতুকে ওভাবে নিয়েই গাড়িতে বসলো।
বাড়ির সবাই ওদেরকে বিদায় দিলো৷ ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করলো।তবে কিছুদূর যেতেই উন্নয়নের শহরে জ্যামে আটকা পড়লো ওদের গাড়ি। রিতু কষ্টে, দুঃখে তখনো হাপুস নয়নে কাঁদছে, সাজগোজের বেহাল দশা। কাজল লেপ্টে গেছে চোখের নিম্নাংশে। ইফাদ ওকে সান্ত্বনামূলক কিছু বলতে যাবে এরমধ্যেই রিতু নিজের নখ বসিয়ে দিলো ওর হাতে। ইফাদ ব্যথা পেলেও চুপচাপ হাত সরিয়ে নিলো। এরপর রিতুর একদম কাছে গিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে স্বাভাবিক গলায় বলল,
— এভাবে কাঁদলে প্রেমে পড়ে যাবো তো। তখন
তোমার গালে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসলেও তুমি কিন্তু
কিছু বলতে পারবে না ডার্লিং!
সাথে সাথেই রিতুর চোখ বড়বড় হয়ে গেলো।
কান্নাকাটি থেমে গেলো। বউ বানিয়ে শান্তি হয়নি?
এখন ওর সাথে লু’চ্চা’মি করার হুমকি দিচ্ছে এই
অংক স্যার? ছিহ!

______

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here