#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
রিতু অংক স্যারের হাসি দেখে কুঁকড়ে গেলো ভেতরে ভেতরে। লোকটা তো ওর ভাবনার বাইরে নির্লজ্জ!
তবে ওকে এমন মিইয়ে যেতে দেখে ইফাদ মজা পেলো। ওকে আরো ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য আপাদমস্তক নজর বুলালো। রিতু সেই দৃষ্টি দেখে কেঁপে ওঠলো। অংক স্যারের নির্লজ্জতা থেকে রক্ষা পেতে ছটফট শুরু করে দিলো। ইফাদ ওকে ভয় দেখানোর জন্য আগের চেয়ে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো ও কোমড়। রিতু কাঁপা গলায় বলল,
— ক কী করছেন স্যার…
— বেয়াদবি করেছো তাই শাস্তি দেব…
— দ দেখুন স্যার, আমি কিন্তু এখন আপনার ছাত্রী নই।
ইফাদ থামলো, তবে ছাড়লো না। ঠোঁট বাঁকিয়ে, ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
— একটু আগেই তো বললে আমি তোমার টিচার, তুমি আমার স্টুডেন্ট…
রিতুর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠলো ক্ষোভে।
ওর কথার জ্বালে এখন ওকেই ফাঁসানো হচ্ছে? এত খারাপ মানুষটা? রিতু অস্বস্তি ভরা গলায় বলল,
— ছাড়ুন আমাকে…
অংক স্যার একটু থামলেন। খানিক পরেই আবদারের সুরে বললো,
— ছাড়বো, যদি আমায় চুমু খাও, একটা চুমুই…
রিতু চোখমুখ কুঁচকে ফেললো,
— ছিহ! জীবনেও না।
ইফাদের ঠোঁট থেকে হাসি উবে গেলো। গম্ভীর হয়ে গেলো মুখ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিতুর গোলাপি ঠোঁটজোড়ায় চোখ বুলাতে বুলাতে বলল,
— তুমি চুমু খাবে না? তাহলে তো আমাকেই খেতে হবে..
রিতু একহাতে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে
অন্যহাতে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো,
— কিছুতেই না।
ইফাদ রুষ্ট গলায় বলল,
— উহু, তোমার কথা শুনছি না। বাসর রাত পন্ড করেছো কিচ্ছু বলিনি। তাই বলে সবদিক থেকে উপোস রাখবে তা তো হচ্ছে না। পাশে আস্ত একটা আগ্নেয়গিরি রেখে আমি শুকনো কাঠ তো নির্জীব হয়ে পড়ে থাকতে পারি না। শত হলেও তুমি আমার বউ, যে আমার পৌরুষ নিয়ে খোঁটা দিয়েছো!
রিতু এবার সত্যিই ভয় পেলো,
— কখন খোঁটা দিলাম স্যার? আমি তো কিছু বলি নি…
মেয়েটা মিথ্যে বলতেও জানে? ইফাদ তেতে ওঠলো নিমেষে,
— ভেবেছিলাম কিছু করবো না। কিন্তু বুইড়া বাঁদড় বলে মাথাটাই নষ্ট করে দিয়ে এখন বলছো তুমি কিছু বলো নি? তোমার অনুরোধ রাখার ইচ্ছেটাই তো নষ্ট হয়ে গেলো…
রিতু প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।
কিন্তু ইফাদের শক্তির কাছে সুবিধা করতে পারলো না। অংক স্যার ওর ঠোঁটে চুমু খেলো। সময় নিয়ে, গভীরভাবে। এরপর যখন ওকে ছেড়ে দিলো, রিতু
সাথে সাথেই বালিশে মুখ চেপে কেঁদে ওঠলো। ইফাদ ঠোঁট মুছতে মুছতে চমকিত গলায় বলল,
— এভাবে নড়চড় করলে চুমু খাওয়া যায়? ভালো হলো না একটুও!
রিতু মাথা তুললো। কান্নাকাটি বন্ধ করে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
— আপনি অত্যন্ত খারাপ একজন মানুষ। আমি আপনাকে ভালো ভেবেছিলাম।
— উহু! আমি আমার কর্মক্ষেত্রে প্রচন্ড স্ট্রিক্ট পার্সন, কিন্তু বাস্তব জীবনে না। বউয়ের সামনে তো আরো না।
তুমি আমার স্টুডেন্ট থাকাকালীন আমি কিন্তু তোমার দিকে সেভাবে নজর দিইনি, আর পাঁচজনের মতোই দেখেছি, সেভাবেই ট্রিট করেছি।
রিতু ফুঁসে ওঠলো,
— তাহলে আমায় বিয়ে করলেন কেন?
ইফাদ ভ্রুকুটি করে তাকালো।
— প্রেমে পড়েছিলাম তাই…
রিতু অবাক চোখে তাকালো। নাটক হচ্ছে নাকি? এই বলছে ছাত্রী থাকাবস্থায় সেভাবে নজর দেয়নি তো এই বলছে প্রেমে পড়েছিলো! মানেটা কী? ওকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখে ইফাদ অন্যরকম গলায় বলল,
— সেদিন তুমি কালো রঙের জামা পড়ে বাবার হাত
ধরে কাঁচাবাজারে ঘুরে ঘুরে পুঁটিমাছ কিনছিলে না?
এটা দেখেই তো আমার বুকের রক্ত হিম শীতল হয়ে
গেলো!
রিতু বিস্ময় নিয়ে বলল,
— আমাকে পুঁটিমাছ কিনতে দেখেই আপনার বুকের রক্ত হিমশীতল হয়ে গেলো?
— গেলো তো! এরপর আমাকে আর মা’কে দেখে কাছে এসে যখন কথা বললে না? বিলিভ মি, তখন কিন্তু আমি সব ঝাপসা দেখছিলাম। মাথা ঘুরে শরীর খুব দুর্বল লাগছিলো। শ্বাস নিতে পারছিলাম না।
রিতুর চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
— সিরিয়াসলি?
— নয়তো কী? আমি তোমায় মিথ্যে বলছি?
রিতু হাসার প্রচেষ্টা করে বলল,
— অবশ্যই…
— মোটেও না। অংকের টিচার হতে পারি কিন্তু আমার মধ্যে এখনো সততা বিদ্যমান। মুখের ওপর সত্য বলতে ভয় পাই না আমি।
রিতু কর্কশ গলায় বলল,
— আসছে সত্যবাদী যুধিষ্ঠি…
ইফাদ ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,
— ট্রাস্ট মি, সেদিন রাতেই ঘুমের মধ্যে তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম। স্বপ্নটা এতই প্রখর আর গভীর ছিলো যে সকালে ঘুম থেকে ওঠে তোমাকে পাশে না পেয়ে বিরহ যন্ত্রণায় আমার জ্বর এসে গেলো। এত ভুগলাম যে বলার বাইরে! সারা শরীর ব্যথা, মুখে রুচি নেই। কোনোভাবেই জ্বর ছাড়ে না। মা দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ডাক্তার নাড়ি পরীক্ষা করে জানালেন মনের অসুখ, এ অসুখ সারালেই জ্বর নামবে…
— জ্বরের সাথে মনের অসুখের কী সম্পর্ক?
— মনই তো সব। মন আর শরীর একে অন্যের সাথে কানেক্টেড। তাইতো জ্বরটা গাঢ় হলো। ডাক্তারের কথা শুনে মা শুনে তো ভীষণ রেগে গেলো। জিজ্ঞেস করলো কার জন্য আমার এ অবস্থা। আমি জ্বরের ঘোরেই বলে ফেললাম পুঁটিমাছওয়ালীর জন্য, শুনেই মা হেসে ফেললো। পরে তোমার বাবার সাথে যোগাযোগ করলেন এবং বিয়েটাও ঠিক করে ফেললেন। বিলিভ মি, তুমি যে আমার স্টুডেন্ট আমি কিন্তু সেটা ভেবে তোমাকে বিয়ে করিনি …
এতসব ফিরিস্তি শুনে রিতুর মন একটুও গললো না। বরংচ আরো রাগ হলো। বাজারে পুঁটিমাছ কিনতে দেখেই বুকের রক্ত হিমশীতল হয়ে গেলো? প্রেম পেয়ে গেলো? ও পুঁটিমাছওয়ালী? রিতু জ্বলন্ত চোখে তাকালো,
–গাধা পেয়েছেন আমাকে? এসব গালগল্প বলে
আমায় পটানোর ধান্ধা? শুনুন স্যার, আমি অংকে
দুর্বল হতে পারি কিন্তু বোকা নই…
— বিশ্বাস না হলে করবে না। কিন্তু আমার অনুভূতি
নিয়ে আমি একবিন্দুও মিথ্যে বলিনি। আমি সত্যিই তোমার প্রেমে পড়েছি…
রিতু কথা বাড়াতে চাইলো না। অংক স্যার ওর প্রেমে পড়ুক আর না পড়ুক ও তো পড়েনি। ওর নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ও যে একটা বিষয় আছে, সেটা
কেউ কেন ভাবলো না? রিতু মনের দুঃখে চুপচাপ অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। অশ্রুবিসর্জনে বালিশ ভিজাতে লাগলো। ওর গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ শুনে ইফাদ হাই তুলতে তুলতে বলল,
— কাঁদে না মেয়ে, কত শখের বউ তুমি জানো আমায়?
— জানতেও চাইনা।
অংক স্যার গভীর স্বরে ডাকলো,
— রিতু!
রিতু শক্ত হয়ে শুয়ে রইলো। জবাব না পেয়ে ইফাদ বলল,
— আদর আদর পাচ্ছে, কি করি বলো তো?
রিতু বাক্যহীন হলো। এই লোকটার সাথে ওর বিয়ে হয়েছে? এই লোকটার সাথে? ওর কান্নায়ও এ লোকটার মন গলছে না? এই ছিলো ওর পোড়া কপালে? নাহ! এ নির্দয়টাকে বর বলে মানবে না সে। কিছুতেই না…
— কচু খান।
— কচুতে আমার এলার্জি। একটা কি চুমু খাবে?
— আমি আপনার মতো নির্লজ্জ নই।
ইফাদ অন্যরকম কন্ঠে বলল,
— মনুষ্যজাতি যাকে চায় তাকে পেয়ে গেলে সর্ব মাত্রায় নির্লজ্জ হতে পারে। আমি তো আর এলিয়েন নই।
র’ক্তে মাং’সে গড়া টগবগে এক যুবক, তোমার প্রেমে পড়েই তো আমার এমন অবস্থা…
রিতু আর সহ্য করতে পারলো না। বিছানা থেকে নেমে আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল,
— বিলিভ মি, আমি এক্ষুনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো। এরকম ছ্যাছড়া গোছের বরের সাথে একঘরে থাকার চেয়ে গাছতলায় থাকা ভালো।
বলে ও দরজার দিকে পা বাড়াতে যাবে কিন্তু অংক স্যার ওকে আটকে দিলো। রিতু চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ইফাদও রাগী চোখে তাকালো,
— সাহস বেড়েছে? দেব ক’টা স্কেল দিয়ে?
— ক’টা কেন? একশোটা দিন। তবে একটা কথা জেনে রাখুন, আমি রিতু এখন আপনাকে আর ভয় পাই না, পাবোও না। একদম না…
— পেও না। ভয় পেতে কে বলেছে? আমি তো চাই তুমিও আমার প্রেমে পড়ো…
রিতু কাঠ গলায় বলল,
— আপনি যদি বিয়ে নিয়ে মিথ্যেটা না বলতেন,
বিয়ের পর থেকে আপনার নির্লজ্জ কাজগুলো না করতেন তাহলে হয়তো এ ব্যাপারে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখতাম। কিন্তু এখন ভাবার কোনো প্রশ্নই আসে না। কোনো চান্সই নেই…
ইফাদ ছোট ছোট চোখ করে মাথা নিচু করে রিতুর মুখোমুখি হয়ে বলল,
— আর ইউ শিওর?
রিতু হেসে উত্তর দিলো,
— জি স্যার। আমি এখন থেকে আপনি বাদে সবার প্রেমে পড়বো। কিন্তু আপনার প্রেমে কোনোদিনই ফল করবো না..
সদ্য বিয়ে করা আদুরে বউয়ের মুখে পরপুরুষের
ওপর প্রেমে পড়ার কথা শুনে ইফাদের মাথায় রাগে ভূমিকম্প বয়ে গেলো। তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা
করে বলল,
— সত্যি বলতে তোমার ফল করতে হবেও না আমার প্রেমে। আমি নিজেই ফল করে যেখানে বসে আছি সেখানে তুমি ফল না করলেও চলবে।
কঠিন গলায় কথাগুলো বলেই ইফাদ হনহন করে ওয়াশরুমে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিতু ওর যাওয়ার পানে সন্দেহী চোখে তাকিয়ে রইলো।
দরজা বন্ধ করার আগ মুহূর্তে ঠোঁটে দুর্বৃত্ত হাসি
ফুটিয়ে ইফাদ চোখ টিপে বলল,
— শুধু মাঝরাতের আদরটা দিলেই চলবে…
বলেই শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। রিতু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভেবেছিলো লোকটার জীবন তেজপাতা করে তরকারিতে দেবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই লোক ওকেই মরিচগুঁড়া বানিয়ে আয়েশ করে তরকারিতে ছাড়বে…
_____
[ছোট পর্ব, বাকিটা পরবর্তী অংশে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
#চলবে…
সবাই ফলো দিয়ে রাখুন 👉 Bindas Life ✅