প্রিয়তম #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৮

0
189

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

রিতু যদিও বড় গলা করে ইফাদকে বলেছিলো সে পড়ালেখা করব না, মূর্খ থাকবে। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজের এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। বাবুল মিয়া এসব জানতে পেরে আসার সময় কড়া করে বলে দিয়েছেন মেয়ে যদি পড়ালেখা না করে তাহলে তিনি আর কখনো মেয়ের মুখ দেখা তো দূর কথাও বলবেন না। ইশিতাও বেশ কথা শুনিয়েছে ওকে। বাধ্য হয়েই রিতু শেষপর্যন্ত বাবাকে কথা দিয়েছে সে পড়াশোনা করবে এবং ভালো ফলাফল করার চেষ্টাও করবে। আর এই কথাগুলো যে অংক স্যারই বাবার কানে তুলেছে এটা বুঝতে পেরে বাবার অগোচরে সে ইফাদকে চোখ রাঙ্গাছিলো বারবার। ইফাদ তখন এমন একটা ভান করেছে যেন সে বুঝতেই পারছে না বাবা-মেয়ের মধ্যে কি নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। যেন এসবে তার কোনো হাতই নেই। কিন্তু রিতু জানে, বাবাকে বিচার দেওয়ার মতো মহান কাজটি এই লোকটা ছাড়া আর কেউ করেনি। এ নিয়ে দু’জনের মাঝে একচোট কথা কাটাকাটিও হয়ে গেলো।
.

পড়াশোনায় বেশ গ্যাপ পড়ে যাওয়ায় সেগুলো কভার করার জন্য ইফাদ বেশ কড়াকড়িভাবেই রিতুকে পড়াশোনার জালে আটকেছে। ম্যাথের সাবজেক্টগুলো বেশ জোর দিয়ে পড়াচ্ছে নিজে। পড়ানোর সময় ভীষণ স্ট্রিক্ট একজন টিচার সে। একটু ভুলচুক বা অমনোযোগী হলেই স্কেলের বারি পড়ে হাতের তালুতে। রিতু তখন প্রতিবাদ করতে পারে না৷ চুপচাপ মুখ বুজে সব সহ্য করে৷ কেননা ইফাদ তখন মোটেও হাজব্যান্ড মুডে থাকেনা। থাকে টিচার মুডে। গম্ভীর, রাগী বলতে গেলে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষের রুপে। কিন্তু পড়ানো শেষ হলেই আবার দেখা যায় তার অন্যরুপ। তখন আদর-যত্ন করে মাথায় তুলে রাখে সে বউকে। কপালে চুমু এঁকে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, মাথা ম্যাসাজ করে দেয়। বকাবকি করে, ঠেসেঠুসে খাবারও খাওয়ায়। অভাবনীয় বউপাগল সে। একদিন তো হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়া এক ছেলে ক্লাসমেটের সঙ্গে দূর থেকে রিতুকে কথা বলতে দেখে ফেলেছিলো ইফাদ। এরপর সারা রাস্তা হাসফাস করে বাড়ি ফিরে টানা তিনদিন জ্বর। রিতু হতভম্ব! সামন্য কারণে জ্বরাজ্বরির মতো ভয়ানক অবস্থা হয় এই লোকের? ইফাদও নিজের দশা দেখে তখন বেশ অপ্রস্তুত হয়েছিলো। সেই থেকে রিতু ছেলে ক্লাসমেটদের সঙ্গে খুব একটা কথাবার্তা বলে না। পাছে আবার হার্ট অ্যাটাক করে বসে ওর বরটা! মাঝেমধ্যে ইফাদের ওপর রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলে রিতু। এতদিনে ও এটা বুঝে গেছে যে বউয়ের সামনে ইফাদ যতটা মনখোলা বা সহজ, বাড়ির অন্যদের সাথে ততটা সহজ-স্বাভাবিক নয় একদমই। এই মানুষটার নানান রুপ। তার সামনে এক রুপ, পরিবারের সদস্যদের সামনে আরেক রুপ আর নিজের পেশায় সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ।
.

কলেজে ক্লাস করতে গেলে রিতু অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য একটা ইফাদকে দেখতে পায়। আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে ক্লাস নিচ্ছে, পড়াচ্ছে। ওকে দেখলে ভুল করেও বউ পাগল টাইপ আচরণ করে না। তবে ঠিকই চোখেচোখে রাখে। এতে রিতুর অস্বস্তি হলেও কিছু বলে না। তবে মাঝেমাঝে কোনো মেয়ে ক্লাসমেট যখন ইফাদের আশেপাশে ঘেঁষে বা পড়া বুঝতে যায় অথবা ইফাদকে নিয়ে প্রশংসার ঝুলি খুলে বসে ওর সামনে, তখন রিতুর বেশ বিরক্ত লাগে। রাগ হয়, ভেতরটা ফেটে পড়ে। অন্যের সুদর্শন বরকে দেখে গিলে ফেলা টাইপ লুক কেন দেয় এটা নিয়ে বেশ বিরক্ত হয় ও। এদের মাথাব্যথা দেখে ইচ্ছে করে মেয়েগুলোর মাথা ফা’টিয়ে তাদের র’ক্ত দিয়ে গোসল করতে। তখন বহু কষ্টে নিজেকে সামলায় রিতু। তবে একটা সময় পর ওদের বিয়ের ব্যাপারটা যখন পুরো কলেজে জানাজানি হয়ে গেলো তখন সবাই একটা ধাক্কার মতো খেলো। কেউ তো বিশ্বাসই করতে
পারলো না যে অংক স্যারের মতো একজন হ্যান্ডসাম, ডিসেন্ট ম্যান ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চার, ফেল্টুস রিতুকে কীভাবে বিয়ে করতে পেরেছে! এ নিয়েও ক’দিন নানান কাহিনী ছড়াছড়ি হলো। যেগুলোর বেশিরভাগই ভিত্তিহীন। রিতুরই ক’জন ক্লাসমেট ওকে আড়ালে-আবডালে লোভী, স্বার্থপর, সুবিধাবাদী বলে অনেকের কাছেই গালগল্প বানালো। এমনকি গরিব ঘরের পান ব্যবসায়ীর মেয়ে হয়ে রুপ দেখিয়ে বড়লোক ঘরের ছেলে পটিয়ে নিয়েছে এসব বলতেও কোনো দ্বিধাবোধ করলো না তারা। এই কুৎসিত অপবাদ গুলো শুনে রিতুর মাথা ঝিমঝিম করে ওঠলো। শত কুৎসিত কথাও ও আমলে নেয় নি, কিন্তু চরিত্র আর বাবাকে টানায় রিতু শেষপর্যন্ত চুপ থাকতে পারলো না। ও ভীষণ রেগে গেলো। যারা এসব বাজে কথা রটিয়েছে তাদের সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হলো। মেয়েগুলো স্বীকারই করলো না এসব ওরা বলেছে, উল্টে বললো স্যারের বউ হওয়ায় ও নাকি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ঝগড়া লাগতে এসেছে। রিতু শেষমেশ ওদের সাথে ঝগড়ায় টিকতে পারলো না। এতটাই কষ্ট পেলো যে কলেজ থেকে সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো ও। নাজিয়া, ইফতি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে রিতু কিছুই বলতে পারলো না। একটা বাহানা দিয়ে ব্যাপারটা আড়াল করলো। কলেজেই রিতুর বান্ধবী মিলু, বৃষ্টির থেকে ঝামেলার বিষয়ে অবগত হয়েছিলো ইফাদ। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে কান্নাকাটির ব্যাপারটা শুনে ইফাদ যখন রিতুকে জিজ্ঞেস করল তখন রিতু মুখে কুলুপ এঁটে রইলো, কিছুতেই কারণ বলতে চাইলো না। কিন্তু ইফাদের জবরদস্তির পর বাধ্য হলো সব বলতে। ইফাদ এসব শুনে রেগে গেলেও রিতুর মন বুঝতে পেরে মৃদু হেসে ওকে কাছে টানলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— আমার বউকে কাঁদানো? একদম ভালো কাজ করেনি ওরা।
রিতু ভেজা গলায় বলল,
— ওরা যা খুশি তাই অপবাদ দেবে আর আপনি এসবের বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নেবেন না? আমার বাবাকে পর্যন্ত টেনেছে…
ইফাদ অভিমানী রিতুকে দেখলো। কান্নাকাটিতে লাল হয়ে আছে ওর মুখ। ইফাদ দৃঢ় গলায় বলল,
— অবশ্যই নেব। যারা যারা তোমাকে এসব বাজে কথা বলেছে তাদের শাস্তি দেব। ওয়ার্ন করে দেব সবাইকে যাতে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি না করে। আমি কাকে, কী কারণে বিয়ে করবো না করবো সেটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার। ওদের কথায় তো আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেব না।
— আপনার পার্সোনাল ব্যাপার এখন পাবলিক হয়ে গেছে স্যার। আপনি ওদের শাস্তি দিলেও ওরা ভাববে আমি ক্ষমতা দেখাচ্ছি৷ তখন উলটো সবাই আমাকেই খারাপ বলবে। একে-অন্যের কাছে বলাবলি করবে, হাসবে।
— তাহলে কী করা উচিৎ আমার? মা’রবো ধরে ওদের?
— জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি।
ইফাদ নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করলো। নরম
গলায় বলল,
— কে কি বললো, করলো এসমস্ত কিছু ডা’জেন্ট
ম্যাটার রিতু। সব কথা সিরিয়াসলি
নিলে হয় না। তুমি বুদ্ধিমতি। এসব ছোটখাটো, গুরুত্বহীন ব্যপার নিয়ে কান্নাকাটি করে বোকার
পরিচয় দিচ্ছো মেয়ে। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো…
— কেউ তো কথাগুলো আপনার সামনে বলছে না, ইনিয়েবিনিয়ে আমাকে কেন্দ্র করেই বলছে। আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন না স্যার। এজন্যই আমি
আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি, শুধু বাবার জন্য!

ইফাদ চুপ করে শুনলো। নিজের খারাপ লাগাটা
প্রকাশ করলো না। ভেতরেই রেখে দিলো। এই কথাটা রিতু চেতনে-অবচেতনে প্রায়ই বলে, তখন হাসিঠাট্টা করে কথাগুলো উড়িয়ে দিলেও এক ধরণের অপরাধবোধ হয় ওর। ইফাদ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ওর গালে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলল,
— বিয়েটা তো হয়ে গেছে, তাইনা? এবার সবটা মেনে নিয়ে ভালো থাকতে হবে, রাখতে হবে তো সবাইকে। অবুঝের মতো করে না।
রিতুর এবার রাগ হলো,
— আপনাকে আমার আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মনে হচ্ছে…
ওর গাল থেকে সরে গেলো ইফাদের হাত। হতভম্ব
হয়ে তাকালো,
— স্বার্থপর? আত্মকেন্দ্রিক? আমি?
রিতু উত্তর দিলো না। বরংচ দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে
ফেললো। ইফাদ ব্যহত ভঙ্গিতে থম মেরে বসে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রিতু ওকে আর যা-ই হোক
আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর কী করে ভাবতে পারলো?

এরপর ক’দিন রিতু কলেজে গেলো না। ইফাদের
সাথেও ‘হু হা’ ছাড়া বিশেষ কোনো কথা হলো না। তবে বেশিদিন না এসেও থাকতে পারলো না৷ রেজিষ্ট্রেশন কার্ড আনার জন্য ওকে যেতেই হলো। গিয়ে অবাক হলো। যাদের সাথে ওর ঝগড়া হয়েছিলো তারা কেউই ওকে দেখে কিছু বললো না, এড়িয়ে গেলো। এরপর মিলু আর বৃষ্টির থেকেই আচানক খবরটা শুনলো রিতু। অংক স্যার নাকি হঠাৎই তার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কারণ জানা যায়নি। খবর শুনে রিতু হতভম্ব! অংক স্যার কেন চাকরি ছেড়েছে? কই ওকে তো কিছু বলেনি! রিতু ভেবে পেলো না। মিলুরা কতক্ষণ রিতুকেই চাপাচাপি করলো তবে একসময় থেমে গেলো। ওদের মনে হলো বরের চাকরি ছাড়ার খবরটা রিতু তো পেয়েছেই ওদের থেকে। তাহলে ও কী করে রিজন জানবে! বাড়ি ফিরে শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে রিতু নিশ্চিত হলো ইফাদের চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা
বাড়ির কেউ জানে না। রাতে ইফাদ ফিরলে রয়েসয়ে রিতু ওকে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনি চাকরিটা ছেড়েছেন? এটা সত্যি?
এতক্ষণ প্রিন্সিপালের সাথে ছিলো ইফাদ। প্রিন্সিপাল স্যার ওকে বোঝাচ্ছিলো এত ভালো একটা চাকরি সে কেন ছাড়বে? এটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইফাদ তাকে ব্যক্তিগত রিজন দেখিয়েছে ঠিকই কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার ওর ওপর ভীষণই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এসব নিয়ে অনেকক্ষণ আলাপচারিতা করে মাথা ধরে আছে ইফাদের। রিতুর কথা শুনে সে চোখ খুলে তাকালো। কিছুটা অপ্রতিভ দেখালো ওকে,
— তোমাকে কে বললো?
— কলেজে গিয়েছিলাম, তখনই শুনলাম।
— ওহ!
— আমার কথার উত্তর দিলেন না যে…
— উত্তর দেওয়ার মতো জবাব নেই তাই।
— বাড়ির কেউ জানে না, আমাকেও বলেননি। এটা
কি ঠিক?
ইফাদ অন্যরকম গলায় বলল,
— এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছুও নয় যে সবাইকে জানাতে হবে। সরি টু সে, আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেবে?

রিতু ওর গলার স্বর শুনে ভড়কালো। এমন টোনে
ইফাদ কখনো কথা বলেনি ওর সাথে। ও আর
কথা বাড়ানোর সাহস করলো না। বসে বসে ভাবতে
লাগলো ইফাদ কেন চাকরি ছেড়েছে। ওর জন্য?
সেদিন ওরকম বললো বলে? মনে হতেই ওর চোখমুখ
বিবর্ণ রুপ ধারণ করলো। অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন
করলো ইফাদকে,
— আপনি নিশ্চয় আমার জন্য চাকরি ছাড়েন নি?
নিশ্চয় আমার কথা সিরিয়াসলি নেন নি? তাইনা?
ইফাদ চোখ বন্ধ অবস্থাতেই অনেকক্ষণ পর জবাব দিলো,
— না।

________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here