#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯
রিতু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। ইফাদ ওকে ‘না’ বলছে ঠিকই কিন্তু ওর চোখমুখ তো অন্যকথা বলছে। রিতু সেই চোখের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হলো। ও কিছু মেলাতে পারলো না। ইফাদ ওকে বলল,
— আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি…
রিতু ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ছাদে গিয়ে বসে
রইলো। হঠাৎই ওর খারাপ লাগছে। কেন লাগছে
সেটা জানে না। কিন্তু ওর নিজেকেই দায়ী লাগছে।
ঘন্টা খানিক সময় পার হয়ে যাওয়ার পর ইফাদ
লক্ষ্য করলো রিতু এখনো ঘরে আসেনি। বেশ রাত হয়েছে। ও রিতুকে খুঁজতে গিয়ে ছাদে পেলো।
মেয়েটা সিমেন্টের ঢালাইয়ে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। সুন্দর মুখশ্রীতে লেপ্টে আছে দ্বিধা। ভ্রু
দুটোও কুঁচকে আছে। এই মুহূর্তে ওকে আট-দশ
বছরের বাচ্চা মেয়ের মতো লাগছে। ইফাদের বুক
থেকে ভার নেমে গেলো। রিতুর রাগ-অভিমান, চাওয়া-পাওয়া তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, মেয়েটা
তা জানে না। জানেনা, ইফাদ ওকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। কখনো বোঝাতেও পারবেনা। হুট করে
কি করে এত ভালোবেসে ফেললো জানে না ইফাদ,
শুধু জানে মেয়েটি এখন ওর জীবনের অংশ, ওর সব। ওর স্বপ্ন, ইচ্ছেগুলোও ইফাদের সব।
ঘুমন্ত রিতুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিতেই
ধড়ফড়িয়ে ওঠলো রিতু। হতচকিত হয়ে চোখ
খুলতেই ইফাদকে দেখে প্রথমে ভড়কালো।
এরপর চেঁচালো,
— মানে কী? কোলে তুলেছেন কেন?
— এত সুন্দর একটা ঘর থাকতে ছাদে ঘুমাতে হবে কেন?
— বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো টের পাইনি। আমাকে নামিয়ে দিন।
ইফাদ ওর কথা শুনলো না। একেবারে ঘরে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলো। এরপর আলো নিভিয়ে
নিজেও এসে ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। রিতু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
— হুটহাট এমন করেন, আমি আনইজি ফিল করি…
— আই ডোন্ট কেয়ার।
রিতু মুখ ফসকে বলে ফেললো,
— আপনি একটু বেশিই ব…
— কী?
রিতু আমতা আমতা করে বলল,
— ইয়ে মানে বউপাগল।
ইফাদ ওর গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
— সেটা তো বউ বুঝে না। অহেতুক দূরছাই করে।
বলে ইফাদ মৃদু হাসলো। রিতু অপ্রস্তুত বোধ করে
চোখ নামিয়ে নিলো।
— ঘুমাবো।
— এভাবেই ঘুমাও।
ইফাদের গলার স্বরে কিছু একটা ছিলো, রিতু ওকে নিষেধ করতে পারলো না। সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে ইফাদের গলা কাঁপছে৷ এরপরেও মানুষটা
ওর সাথে কিছুই হয়নি সর্বদা এমন একটা ভান
করছে। একরাশ বিষন্নতা রিতুকে ঘিরে ধরলো।
অথচ এমন হওয়ার কথা ছিলো না।
.
পরদিন অবশ্য বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেলো ইফাদের
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা। ইফাদের বাবা রউফ সাহেব ছেলের কান্ডে বেশ হতবাক হলেন। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে ফেরত আসার পর ছেলেকে কত জোর করেছেন ব্যবসায় হাত লাগাও, এখানে স্বাধীন জীবন। পরের অধীনস্থ হয়ে কেন জীবন কাটাতে হবে?
ইফাদ শোনে নি। অনেকটা শখের বসেই কলেজের চাকরিটা নিয়েছিলো সে, অন্য কোনো চাকরি এত
পছন্দ ছিলো না। সেই চাকরি ইফাদ ছেড়ে দিলো,
তাও আবার বছর না গড়াতেই? তার মনে নানা প্রশ্নের জন্ম নিলো তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। নাজিয়াও ছেলের কাজে বেশ চটেছেন। ইফতিও ঝেড়েছে ছোট ভাইকে। কিন্তু ইফাদ নির্বিকার, নিশ্চল থেকেছে। কাউকে তো সে আর বলতে পারে না যে ঝোঁকের বশবর্তী হয়েই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। কেননা, রিতু বিশেষ একটা পছন্দ করে না এই চাকরি৷ মেয়েটা হয়তো মুখে বলেনি ওকে চাকরি ছাড়তে।
কিন্তু ও তো একপ্রকার রিতুকে ভালোবেসেই এই বিসর্জনটা দিয়েছে। ইফাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নাহ!
বড্ড বাচ্চামো হয়ে গেলো ব্যাপারটা।
এদিকে ইফাদের কান্ড আর বাড়ির সবার চোটপাট দেখে ভীষণ অভিমানে বুক ভারী হলো রিতুর।
এসব যে ওর কথায় কষ্ট পেয়েই করেছে অংক স্যার,
তা কাল রাতে না বুঝলেও দিনের আলোতে ঠিকই বুঝেছে। ইফাদ আসতেই তাই ফুঁসে ওঠলো রিতু,
— আপনি কিন্তু কাজটা ঠিক করেন নি স্যার,
একদম না।
— আমি আবার কী করলাম?
— আপনি কাল রাতে আমাকে মিথ্যে বলেছেন।
আসলে আপনি আমার জন্যই চাকরিটা ছেড়েছেন।
— মোটেও না।
— আপনাকে মিথ্যে বলা মানায় না। আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলবেন না। আমি জানি…
— মিথ্যে নয়।
— আমি আপনাকে ইন্ডিকেট করে কিছু বলি নি। শুধু বলেছিলাম শিক্ষকতা করে এমন পাত্র পছন্দ নয়। তাই বলে…
ইফাদ চোখ দুটো বুজে নিজেকে সামলে নিলো,
— অহেতুক নিজেকে দোষারোপ করো না…
— আমি নিজেকে ক্ষমাও করতে পারবো না।
ইফাদ অপ্রস্তুত বোধ করলো। বিষয়টা এত জটিল হয়ে গেলো কেন? এরকমটা তো ভাবেনি। রিতু বলল,
— আপনি আসলেই নিজের জন্য সবকিছু করেন। নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেন। কারো কথা ভাবেন না।
ইফাদ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো। এত ভালোবাসার এই ফল? এত অবলীলায় শক্ত কথাগুলো রিতু কীভাবে বলে দিতে পারলো? না হয় খামখেয়ালি করে চাকরিটা সে ছেড়েই দিয়েছে। তাই বলে এত কথা শোনাবে?
— আমি সবার কথাই ভাবি রিতু।
— জি না। আপনি নিজের কথা বেশি ভাবেন। তাইতো, চাকরি ছাড়ার আগে আমাকেও বলেন নি।
— সরি।
— সরি বললেই সাত খু-ন মাফ হয়ে যায় না। সব তো চাইলেই পেয়ে যান, কারো বারণটারণ শোনার অভ্যাস নেই তো তাই নিজের খেয়ালখুশি মতো চলেন। এধরণের মেরুদন্ডহীন লোককে আমি বড্ড অপছন্দ করি।
রিতু বলেই থেমে গেলো। মুখ তুলে চেয়ে দেখলো ইফাদ জ্বলজ্বলে চোখমুখ নিয়ে ওর দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর মুখে শুধালো,
— আমি মেরুদন্ডহীন?
— সরি। আমি সেটা বলিনি।
— রাগের সময় মনের কথাগুলোই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
রিতু মাথা নিচু করে ফেললো,
— আমার ইনটেনশন তেমন ছিলো না।
— স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, মেরুদন্ডহীন! চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য থ্যাংকস আ লট রিতু। নিজেকে এতদিনে চিনতে পারলাম।
রিতু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। তখন মাথা কাজ করছিলো না। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। ইফাদ কি সিরিয়াসলি নিয়েছে কথাগুলো? রিতু এগোতে চাইলো ওর দিকে, কিন্তু হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলো ইফাদ। শক্ত গলায় বলল,
–তুমি আমাকে এত নিকৃষ্ট মানুষ ভাবলেও আমার ভালোবাসা নিকৃষ্ট নয় রিতু। তোমার সামনে আমি
যতটা সহজ থাকতে পারি, ততোটা আর কারো সঙ্গে নই। এমনকি মা-বাবার সঙ্গেও আমি এতোটা ফ্রি নই৷
রিতু অসহায় বোধ করলো। ইফাদ একটু থেমে
আবারও বলল,
— আমার মা ভীষণ বিচক্ষণ। তোমাকে দেখে
যখন আমার সবকিছু তুচ্ছ তুচ্ছ লাগছিলো আমি
কিন্তু একবারো তোমার কথা কাউকে বলিনি, এমনকি মাকেও না। অথচ মা বুঝে গেলো। মুখ ফুটে কখনো কিছু না চাওয়া এই আমার পছন্দের সবকিছুই যেমন তারা আমাকে এনে দিতো, তেমনি তোমাকেও এনে দিলো। আমি তাতে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবলেও
আমার মতো মেরুদন্ডহীন, কাপুরুষ কাউকে পেয়ে
তুমি আমাকে নিছকই নিজের দুর্ভাগ্য ভাবো। তুমি আসলে আমার থেকে বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো, এম আই রাইট?
রিতু চুপ করে রইলো। গলার ভেতর থেকে শব্দ
বেরুচ্ছে না৷ সবকিছু জট পাকিয়ে আসছে। ইফাদ এবার গর্জন করে ওঠলো,
— আমি কি ঠিক বলছি?
অংক স্যারের ধমক শুনে রিতুর গলা শুকিয়ে গেলো এবনভ ওর এই নতুন রুপ দেখে কেঁদেও ফেললো। ইফাদ আর ‘টু’ শব্দও না করে ঘর থেকে সটান
বেরিয়ে গেলো। দরজা বন্ধ করার জোরালো শব্দে কেঁপে ওঠলো রিতু।
.
সেদিনের পর ইফাদ, রিতুর খুনসুটিময় সম্পর্কটা কেমন স্থবির হয়ে পড়লো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো দরকার ছাড়া দু’জনের মধ্যে কথা তেমন হতো না অবশ্য তখনো
ইফাদ ‘হু, হ্যাঁ’ ব্যতীত বাড়তি কোনো শব্দ ব্যবহার করতো না। যারজন্য রিতু লজ্জায়, অপমানে আর কথাও বলতে যায়নি। এরমধ্যে রিতুর পরীক্ষা শুরু হয়ে রেজাল্টও বের হয়ে গেলো। এবার অবশ্য অংকে ফেল করলো না রিতু৷ যথেষ্ট ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করলো সে। এর পেছনে রয়েছিলো ইফাদের ওকে ধরে বেঁধে পড়াশোনা করানোর ক্রেডিট।
কয়েক মাস কেটে গেলো। একঘরে থেকেও দু-জনের মধ্যে যোজন যোজন মাইলের দূরত্ব তৈরি হলো।দু-জনের মধ্যে সবকিছু কেমন শীতল! এ পর্যায়ে এসে বাড়ির অনেকেই তা টের পেলো কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউ নাক গলাতে এলো না। ভাবলো স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাটি তো হয়ই, এতে তারা ঢুকবে কেন? কিন্তু অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন এ অবস্থা চলতেই লাগলো তখন নাজিয়া এসে রিতুর সাথে কথা বললেন। রিতু লজ্জিত ভঙ্গিতে জানালো তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। সামান্য কথা কাটাকাটি। নাজিয়া ওকে বুঝিয়ে বললেন সামান্য কারণে এতগুলো দিন দুজনের মধ্যে শীতল সম্পর্ক ধারণ করাটা অনুচিত। যাতে সব ঠিকঠাক করে নেয় দু’জন। এরপর তিনি ছেলের সাথেও কথা বললেন। ইফাদ মায়ের কথা শুনলো। ভালোমন্দ কিছুই বললো না তখন। এর ক’দিন পরই আচমকা ইফাদ বাড়িতে জানালো বিদেশে উচ্চা শিক্ষা গ্রহণের জন্য তার ডাক এসে গেছে। শ্রীঘ্রই সে ব্যাক করছে লন্ডনে। বাড়ির সবাই এ খবরে হতভম্ব। নাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে বললেন,
— তুই তো ব্যাচেলর, মাস্টার্স করে আসার পর
বলেছিলি আর ফিরবি না। তাহলে এখন কেন?
— ফিরেছিলাম তবে নিজেকে যোগ্য করে ফিরতে পারিনি। এবার যাবো নিজের মেরুদন্ড ঠিক করতে,
নিজেকে সুযোগ্য করে গড়ে তুলতে।
— আর রিতু?
— জিজ্ঞেস করো ও কী চায়। যেটা চায় সেটাই হবে।
— তোর বউ, তুই জিজ্ঞেস কর।
ইফাদ একপলক রিতুর দিকে তাকাতেই রিতু হনহন পা ফেলে ঘরে চলে এলো। অসহ্য লাগছে ওর। সবকিছু অসহ্য লাগছে…
ইফাদ ঘরে এসে ওকে জিজ্ঞেস করল,
— তখন চলে এলে কেন? আমি তো জিজ্ঞেস করছিলামই তুমি কী চাও?
— আমার কিছু চাই না।
— সত্যি?
— উত্তর বদলাবে না।
— ঠিক আছে।
— আপনি আমার জন্য বাড়ি ছাড়ছেন স্যার?
— উহু! নিজের জন্য।
— কেন?
— যাতে কেউ আমাকে মেরুদন্ডহীন, স্বার্থপর বলতে
না পারে।
রিতু যেন চিনতেই পারছিলো না ইফাদকে। ও স্তব্ধ
হয়ে বসে রইলো। সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে মানুষটা এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো?
কথার আঘাতটা কি বেশিই ছিলো তাহলে?
________________
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]
চলবে…