তবে_ভালোবাসো_কী ২ #Mehek_Enayya(লেখিকা) পর্ব ৩৪

1
568

#তবে_ভালোবাসো_কী ২
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
পর্ব ৩৪

প্রতিদিনের মতো আজও ক্লাসের জন্য লেট হয়ে গিয়েছে মাহানুর। সিয়াম আর মুহিব অলরেডি ক্লাসে চলে গিয়েছে। মাহানুর কোনোদিক না তাকিয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠে। বারান্দা একদম ফাঁকা। সবাই যার যার ক্লাসে। আশেপাশে না তাকিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে ছোটার সময় আচমকা সামনের জনের সাথে ভীষণ জোরে ধাক্কা খেয়ে জমিনে পরে গেলো মাহানুর। চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে উঠলো,
-ওমা গো!মরে গেলাম রে বাবা!
যার সাথে ধাক্কা খেয়েছে তারও হাতের কাগজপত্র সকল জিনিস নিচে পরে গিয়েছে। চশমা ঠিক করে রাগী দৃষ্টিতে মাহানুরের দিকে তাকালো। মাহানুর আঁখিজোড়া খুলতেই সামনে গতকালের স্যারকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কোমরের ব্যাথা যেনো ভুলে গেলো মুহূর্তেই। কোমরে হাত দিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না তবুও চটজলদি নিচে পরা স্যারের যাবতীয় জিনিস তুলে নিলো। হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে ভয়াত কণ্ঠে বলল,
-এক্সট্রিমলি সরি স্যার। আমাকে মাফ করে দিন।
স্যার চমকিত হয়ে মাহানুরের হাত থেকে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে নিলো। আগাগোড়া পরোক্ষ করে বললেন,
-আর ইউ ওকে?
-ইয়াহ ইয়াহ। আই এম ফাইন স্যার।
আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। কোমর ধরে স্যারের আগেই নিজের ক্লাসে চলে গেলো। সিয়ামদের পাশে যেয়ে বসে বড় বড় নিঃশাস নিতে থাকলো। মুহিব অবাক কণ্ঠে বলল,
-কিরে কোথা থেকে আসলি তুই?
-তোর বাড়ির পিছন থেকে।
বিরক্তকর কণ্ঠস্বর মাহানুরের। সিয়াম বলল,
-আমরা ভেবেছিলাম আজ তুই আসবি না।
-আসবো না! গতকাল ঐ শা’লা’রনাতি যে ইজ্জত দিয়েছিলো তারপর আবার বন্ধ দেবো আমি!
-যাক নতুন স্যার একটা তাহলে ভালো কাজ করেছে।
-জানিস তোরা আসার সময়ও বাঘের মুখে পরেছিলাম আমি।
সিয়াম, মুহিব বুঝলো না মাহানুর কোন বাঘের কথা বলছে। দুইজনই বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে মাহানুরের দিকে। মাহানুর দুইটার মাথার চাপড় দিয়ে বলল,
-আরেহ ম’গারদল, আমি নতুন ইংরেজি প্রফেসরের কথা বলছি! নাম যেনো কী ধলা বিলাইয়ের?
-সারাফাত শেখ।
-ওমা! নাম কী রাজকীয়! এইরকম একটা সুন্দর নাম তোদের ছেলের রাখবো আমি।
মুহিব লাজুক হাসি দিলো মাহানুরের কথা শুনে। সিয়াম মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। মাহানুর হেসে মুহিবের মাথায় আবারও চাপড় মেরে বলল,
-শা’লায় মেয়েদের মতো কথায় কথায় শুধু লজ্জা পায়! বলি কী আয় তোকে মেয়েই বানিয়ে দেই।
-সর যা পাগল ছেড়ি।
তাঁদের কথার মাঝেই ক্লাসে উপস্থিত হয় স্যার। মাহানুর ভুল করেও মাথা ওপরে তুলে তাকালো না। স্যার নিজের মতো করে পড়াচ্ছে আর তারা তিনজন বইয়ের আড়ালে নিজেদের মতো কথা বলছে। সিয়াম কথায় কথায় বলে,
-বেপার কী আজ মাহানুরকে এতো হাসিখুশি লাগছে!
-সিক্রেট বেপার তোরা বুঝবি না।
-বাবা রে!
-আয় আমরা চট্টগ্রাম যাই।
মুহিব বইয়ে মুখ ডুবেছিলো মাহানুরের কথায় তার দিকে তাকালো। সিয়ামের উদাসীন মুখে দেখা মিললো একরাশ হাসির ছড়াছড়ি। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-সত্যি যাবি দোস্ত?
মাহানুর হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। মুহিব তাঁদের কথায় ফোড়ন কেটে বলল,
-তাহলে তোর অফিস কে করবে? ভুতে?
-উহুম।
-মানে?
-আমি আর অফিসে যাবো না।
-যাবি না মানে? বুঝিয়ে বল ভাই?
উদ্বিগ্ কণ্ঠস্বর সিয়ামের। মাহানুর বেঞ্চে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বলল,
-অনেক ভেবে ডিসিশন নিয়েছি অফিসে যাবো না আমি। সংসার, পড়াশোনা আবার অফিস অনেক কঠিন হয়ে পরে আমার জন্য। তারপর তোদের ভাইয়াও গতকাল বলল এতো পেশার নিতে না আগে পড়াশোনা পরে সব। তাই আজ অফিসে গিয়ে বাবা, বড়বাবাকে বলবো এই কথা।
-ওওওওহো!তোদের ভাইয়া! তাই তো বলি এতো খুশি খুশি কেন!
-একদম বাজে বকলে লাথি খাবি।
মুহিত আর সিয়াম একসাথে হাসতে লাগলো। স্যার যে পড়াচ্ছে সেদিকে তাঁদের একটুও মনোযোগ নেই। সিয়াম খানিকটা সিরিয়াস হয়ে বলল,
-তো চট্টগ্রাম ফাইনাল?
-হুম। আমি একটু সিউর হয়ে তোদের ফোনে বলবো। সব ঠিক থাকলে আগামীকালই রওনা হবো।
-আচ্ছা। আমি তো প্রথমেই ঐ শাকচুন্নির চুলের মুঠি ধরে ঘুরাবো! কিভাবে পারলো আমাদের ছেড়ে চলে যেতে!
-আমিও পাটনার হিসেবে তোর সাথে আছি ফিকার নট সিয়াম ভাই।

ক্লাস শেষ হতেই তিনজন একসাথে বেরিয়ে আসলো। উঠানে আসতেই রোদের উত্তাপে মুখ জ্বলে গেলো মাহানুরের। ত্বরিত বলল,
-ভাই ক্যাম্পাসে চল রোদে মুখ গেলো আমার।
-আচ্ছা।
ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে মাহানুরের দেখা হয় রাফিনের সাথে। সে মাহানুরকে দেখে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে মাহানুর দৌড়ে তার স্মুখীন যেয়ে দাঁড়ালো। কোমরে একহাত ঠেকিয়ে বলল,
-কিরে ভাই তুই আমাকে দেখলেই এতো পালাই পালাই করিস কেনো? আগে না আমার সাথে ফ্ল্যার্টিং করতি!
-পথ ছাড়ো বোইন।
-আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দে?
-তুমি আমার বোনের মতো তোমার সাথে কিসের ফ্ল্যার্টিং! আগে যা করেছি তার জন্য মাফ করে দিও।
আশ্চর্যে গোল হয়ে গেলো মাহানুরের আঁখিজোড়া। রাফিন সুযোগ বুঝে সেখান থেকে পালালো। মুহিব কপাল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-এরে বাবা ঐ শা’লায় আবার পাগল টাগল হয়ে গেলো না তো?
-কে জানে!

তিনজন একসাথে চেয়ারে বসে কিছু খাবার অর্ডার দিলো। মাহানুর ফোন বের করে ফেইসবুক লগইন করলো। নিউসফিডে প্রথমেই তার নজর পরলো কাঙ্ক্ষিত একটি পোস্টে। সুনহেরা আর আয়াস ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়েছে। মাহানুর মনে মনে খুশি হলো। যাক ওদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে তাহলে! সিয়াম আর মুহিব নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সিয়ামের বাবাও বড় একজন বিজনেসম্যান। প্রভাবশালী পরিবার থেকে বেলং করে সে। তিন বোনের ছোট ভাই যার দরুন ভীষণ আদরের সে। বাসায় তার বিয়ের কথা চলছে। এমন কী মেয়েও দেখছে। কিন্তু সিয়াম এখন একটুও বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়। মাত্রই তো জীবন শুরু হলো এখনই কিসের বিয়ে! মাহানুর সবটা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
-বিয়ে করে ফেল দোস্ত। আমরাও একটু এনজয় করতে পারবো।
-দুর বা’ল। এখন আমি কোনোরকম পেরা নিতে চাচ্ছি না বোইন। তোকে যদি মম ফোন করে আমার বিষয় কিছু জিগ্যেস করে ভালোভাবে উত্তর দিবি বলে দিলাম।
-হিহিহিহি। আমি তো আন্টিকে বলবো তার ছেলে একজনকে পছন্দ করে তাই বিয়ে করতে চায় না।
-তোর পা ধরি তাও এইসব বলিস না ভাই।
-আরেহ! আই আমার জোকিং! আচ্ছা তোরা থাক আমি অফিসে যাই।
-হুম। টাটা।
______________________
এক্সাম শেষে মেডিকেলের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সুনহেরা। বার বার হাতের ঘড়িতে চোখ বুলাচ্ছে। আজ সকালে আয়াসের সাথে মেডিকেলে এসেছিলো সে। কিছু কাজে বাসায় চলে গিয়েছিলো আয়াস। কথা ছিল ছুটির পর তাকে নিতে আসবে অথচ এখনো খবর নেই বান্দার। বিরক্ত হয়ে এদিকসেদিক ঘুরতে থাকলো সে। আচমকা একটি গাড়ি এসে সুনহেরার ঠিক সামনে থেমে গেলো। ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলো সুনহেরা। আয়াস উইন্ডো দিয়ে মাথা বের করে মুচকি হেসে বলল,
-যাওয়া যাক মিসেস?
সুনহেরা বুকে ফুঁ দিয়ে তেড়ে আসলো। কঠিন কণ্ঠে আঙুল তুলে বলল,
-এখনোই তো ভয়ে আমার প্রাণ চলে যেত! আপনি কী আমাকে মেরে আরেকটা বিয়ের পরিকল্পনা করছেন?
-মোটেও না।
সুনহেরা দরজা খুলে আয়াসের পাশে বসলো। গরমে হাঁসফাঁস করছে সে। আয়াস সেটা দেখে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো। সুনহেরার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলো,
-এক্সাম কেমন হলো?
-অনেক ভালো। আপনি জানেন আমি যা যা পরেছিলাম সেগুলোই এসেছে।
কথা বলার সময় খুশিতে চোখ মুখ জ্বল জ্বল করছিলো সুনহেরার। আয়াস স্মিত হাসলো। সুনহেরা পানি খেতে খেতে বলল,
-ড্রাইভার আঙ্কেল আসেনি?
-না। ভাবলাম আজ আমি ড্রাইভ করি।
-ওওও!
আয়াস গাড়ি স্টার্ট দেয়। সুনহেরা সিটে মাথা এলিয়ে নিঃশব্দে আয়াসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো। সবসময়ের মতোই ফিটফাট। কেনো জানি লোকটাকে দেখলেই একটা ডক্টর ডক্টর ফিলিং হয় সুনহেরার। সবসময়ই পেন্ট আর ইং করা হাল্কা রঙের ফুল হাঁটাআলা শার্ট। গলার ঐখানটায় একটা বোতাম খোলা শুধু। পিওর ভদ্র ছেলে! মাঝারি সাইজের চুলগুলো সেট করা। মোটামুটি ফর্সা, লম্বা মুখের গড়ন। চাপ দাঁড়ি তার মধ্যে কালো মনি যুক্ত ছোট ছোট নেত্র। আর চোখে তো সবসময়ের মতো চশমা আছেই ডাক্তার সাহেবের! তবে আজ যেটা সুনহেরা বিশেষ ভাবে খেয়াল করলো সেটা হলো আয়াসের গালে ছোট লাল রঙের একটা তিল আছে। সাধারণত খুব কম মানুষদেরই লাল রঙের তিল হয়। সুনহেরার মন চাইলো সেই তিলটায় টুপ করে একটা কামড় দিয়ে দিতে।
নিজের ভাবনায় নিজেই আহাম্মকের মতো লজ্জায় নেতিয়ে গেলো সুনহেরা।
আয়াস আড়চোখে সেটা খেয়াল করে বলল,
-আপনি কী কোনোভাবে লজ্জা পাচ্ছেন নাকি গরমে লাল হচ্ছেন?
-আআমি! ওহ হহহ্যাঁ হয়তো গরমে। যে গরম পরেছে বাবা!
-তবুও গতরাতে বৃষ্টি হওয়ায় গরম একটু কমই।

গতরাতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আরো লজ্জায় ফেলল বেচারি সুনহেরাকে। রাতের সকল ঘটনা চিত্রের মতো সুনহেরার চোখের পাতায় ধরা দিলো। আয়াস তাকে কিস করেছিলো! তার শরীরে টাচ করেছিলো! না আর ভাবতে পারছে না সে। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে জানালার বাহিরে তাকালো। লজ্জামাখা রূপ আয়াসকে দেখাতে একদমই ইচ্ছুক না সে। আয়াস ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। শান্ত স্বরে বলল,
-ওহ গুডনিউস শুনেছেন নিশ্চই?
-কী?
-আমি চাচা হচ্ছি আর আপনি চাচী।
-সত্যি! ভাবির বাবু হবে?
-হ্যাঁ।
-ওয়াও! আমি ঐ বাবুকে কোলে নিতে পারবো। অনেক মজা করবো তার সাথে। কত সেই হবে না আয়াস?
আয়াস সুনহেরার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিতে ভুলে গেলো। হাসলে সুনহেরাকে একটু বেশিই কিউট লাগে বোধহয়! সুনহেরা নাক ফুলিয়ে বলল,
-কী হলো? শুনছেন?
-হ্যাঁ হ্যাঁ। সেই হবে।
-আমি বুঝি না কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আপনি? রাস্তার বাহিরে ঐ ফুলগুলো দেখছিলেন নাকি?
চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো সুনহেরা। আয়াস অন্যমনস্ক হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে ফেলল,
-আমার পাশে ফুল থাকতে আমি কেনো নির্বোধের মতো দূরের ফুল দেখতে যাবো!
-কী বললেন?
না বুঝে জিগ্যেস করলো সুনহেরা। আয়াস শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। রাস্তার ঐপাশে অনেকগুলো ফুলের দোকান। গলা ঝেরে বলল,
-ফুল নিবেন?
সুনহেরা মুখ বাঁকালো। অন্যপাশ ফিরে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
-একজন মেয়েকে কখন ফুল দেওয়ার জন্য জিগ্যেস করতে হয় না। হুট্ করে দিয়ে তাকে সারপ্রাইসড করতে হয়।
মেয়েরা কথায় কথায় কেনো অভিমান করে সেটা বুঝে উঠতে পারে না আয়াস। গাড়ি কিনারে থামিয়ে বের হয় সে। লাল আর সাদা রঙ মিশ্রিত একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে ফিরে আসে। গাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। সুনহেরা মুচকি মুচকি হাসছে। আয়াস ফুলগুলো তার দিকে এগিয়ে দিয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-আমার ফুলের জন্য তার পছন্দের ফুল।
সুনহেরার গাল লাল টমেটো হয়ে গেলো। হাত বাড়িয়ে ফুল নিয়ে উৎসুক হয়ে জিগ্যেস করলো,
-সাদা গোলাপ আমার পছন্দ কে বলল?
-আপনার ভাবি।
-ওহ আচ্ছা। সত্যি আমাকে আপনার কাছে ফুলের মতো লাগে? আমি তো জানি শুধু প্রেমিকদের কাছেই তার প্রেমিকাকে ফুলের মতো লাগে!
আয়াসের মনের কথা জানতে এইরকম প্রশ্ন করলো সুনহেরা। আয়াস ভালোভাবেই বুঝে গেলো সুনহেরার মনোভাব। তাই সে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল,
-একজন পুরুষের কাছে সব নারী কিন্তু ফুল সমতুল্য হয় না। তারা শুধু তাঁদের বিশেষ নারীদেরকেই ফুলের সাথে তুলনা করে। যেমন আমার জীবনে তিনটি ফুল। এখন সেই তিনজন কে কে সেটা একটু কষ্ট করে বুঝে নিন।
সুনহেরা আর কিছু বলল না। কোলে ফুলগুলো রেখে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। মুখে মিটমিট হাসি তার। আয়াস আপন মনে ড্রাইভ করতে থাকলো।

ঘাটে পা ডুবিয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে অহনা। শরীরে ভেজা জামাকাপড় আটসাট হয়ে লেগে রয়েছে। তার র’ক্তলাল দৃষ্টি ঐ দূরে পানিতে নিবদ্ধ। সকালের সেই ব্যক্তিটা আর কেউ নয় বরং আরহাম ছিল। মানুষটিকে চিনতে পেয়ে একপ্রকার ছুটে যায় সে। মাক্স পরিহিত মানুষটির মুখ না চিনলেও শরীর দেখেই সে চিনে ফেলেছে।এগিয়ে গিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
-আরহাম ভাইয়া আপনি!
আরহাম নিজেও যেনো স্বস্তি পেলো অহনাকে দেখে। বন্ধুর কথা ভেবে শেষবারের মতো অহনার সাথে একবার কথা বলতে চেয়েছিলো সে। অনেক খোঁজার পর অহনাদের বাসায় এসে পৌঁছালো। অহনার মা খানিকক্ষণ ভেবে বললেন,
-তুমি হানিফের বন্ধু আরহাম না?
-জি।
অহনা ত্বরিত মাকে বলল,
-মা উনি শুধু হানিফ ভাইয়ার বন্ধু নন মাহানুরের হাসব্যান্ডও। ভাইয়া ভিতরে আসুন।
অহনার মা অবাক চোখে আরহামকে দেখলো। বেশ খাতির যত্ন করে ভিতরে নিয়ে গেলো তাকে। অহনার মা আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখলো না। আরহাম যেনো হিমশিম খেয়ে গেলো। তাড়া দেখিয়ে বলল,
-আন্টি এতো কিছুর প্রয়োজন নেই। আমি কিছুসময় অহনার সাথে কথা বলেই চলে যাবো।
-বললেই হলো নাকি! মাহানুর আমার মেয়ের মতো আর তুমি হলে আমার মেয়ের জামাই এভাবেই চলে যেতে দেবো নাকি!
অহনার বাবা এসে আরহামের সাথে সাক্ষাৎ করলো। কথায় কথায় অহনার মা জেনে গেলো আরহাম রিদের বন্ধুও হয়। আরহাম সকালের নাস্তা করেই বের হয়েছে তাই এতো খাবার দেখে তার মুখ শুকিয়ে গেলো। জোরাজোরিতে শুধুই শরবতের গ্লাস তুলে নিলো। অহনা আরহামের পাশে বসা। এটাসেটা নেওয়ার জন্য জোর করছে।
-মাহানুর আমাকে বলেছিলো আপনি যে চট্টগ্রাম চলে এসেছেন। রাস্তা চিনে কিভাবে আসলেন ভাইয়া?
-তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ শালিকা আমাদের প্রথম মিটের কথা। তারপরও একটু কষ্ট হয়েছে।
অহনা শব্দ করে হেসে উঠলো। আরহামও স্মিত হাসলো। হাসতে হাসতে অহনা বলল,
-আমাদের প্রথম দেখার কথা কিভাবে ভুলতে পারি! জিরাফ আর জংলীবিল্লির প্রথম সাক্ষাৎ!
-তুমিও শেষমেষ জিরাফ বললে অহনা! তোমার থেকে এটা আশা করিনি একদম।
-আচ্ছা সরি সরি ভাইয়া।
-ইটস ওকে। বাই দা ওয়ে তোমার বান্ধবী এখন আর জংলীবিল্লি নেই। আদর্শ গৃহিনী হয়ে গিয়েছে।
-বাবাহ! অনেকদিন ধরে দেখি না আপনার বউকে।
-ঢাকায় কবে যাবে?
অহনা চোরা চোখে আশেপাশে তাকালো। কথা ঘুরিয়ে বলল,
-ভাইয়া আসেন আপনাকে আমাদের ক্ষেতে নিয়ে যাই। এমনেও এই ঝোপের মতো ঘরে নিশ্চই আপনার দমবন্ধ লাগছে!
-এইরকম খোলামেলা বাড়িতে শুধুই শান্তি লাগতে পারে আর কিছু নয় বোন।
-যাক আসুন ভাইয়া।
অহনার সাথে হাঁটতে হাঁটতে ক্ষেতে আসে আরহাম। দূরদূরন্তে শুধুই গাছপালা আর বিশাল বড় মাঠ। জায়গায় জায়গায় মাছ চাষ করার জন্য পুকুর আর বিভিন্ন ধরণের সবজি। শীতল বাতাসে মন তাঁজা হয়ে গেলো আরহামের। অহনা বলল,
-ভাইয়া বাসায় আবার কবে যাবেন?
-যদি সুস্থস্ববল বেঁচে থাকি কয়েকমাস লাগবে বাসায় যেতে যেতে। তুমি বলো কবে ঢাকায় যাচ্ছ?
-আমি তো আর যাবো না ভাইয়া।
-কেনো নিজেকে শুধুই কষ্ট দিচ্ছ অহনা?
অহনা কোনো উত্তর দিলো না। থমথমে মুখে আরহামের দিকে তাকালো। আরহাম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-আমার দুইজন ছোট বোন আছে। আমি তোমাকেও তাঁদের মতোই দেখি অহনা। সবাইকে কী প্রমান করতে চাও ভীষণ ভালো আছো রিদকে ছাড়া? রিদ নামক কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন নেই তোমার?
-তার জীবনে আমার প্রয়োজন নেই তাহলে আমার জীবনে কেনো তার প্রয়োজন হবে ভাইয়া?
-কে বলেছে ওর জীবনে তোমার প্রয়োজন নেই বোকা মেয়ে?
অহনা আজ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। আরহামের ভীষণ মায়া হলো। হাত বাড়াতে নিলে গ্রামের মানুষদের কথা ভেবে আবার নিজেকে গুটিয়ে নিলো।
-আমি যে এতদিন ধরে এসেছি একবারও সে কোনোভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে? আমি কেমন আছি জানার চেষ্টা করেছে? করেনি তো। অথচ বেহায়া আমি রোজ ওর জন্য কান্না করি একবার তো কলও করেছিলাম ওর কণ্ঠস্বর শুনতে।
-ওর মনে তোমার জন্য কী আছে সেটা জানি না তবে রিদ ভালো নেই অহনা। এখানে আসার পর থেকে রাতে কল দিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে যাতে একবার হলেও তোমাকে দেখে যাই। ছন্নছাড়া রিদ নিজেকে পরিবর্তন করছে শুধুই তোমার জন্য অহনা। পরিবার ত্যাগ করেছে সেটাও তোমাকে পাওয়ার জন্যেই। ও আমাকে আস্থা দিয়ে বলে দেখিস মামাহ অহনা একদিন আসবে। তাইতো আমি জব করে আমাদের ছোট সংসার টুকটাক সাজাচ্ছি।
অহনার গাল বেয়ে পানি ঝরছে। আরহাম এবার অহনার মাথায় হাত রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-তোমার তাও দুঃখে সঙ্গ দেওয়ার জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব আছে রিদ একদমই একা। তুমি ছাড়া রিদ শূন্য। তাছাড়াও তোমার পড়াশোনাও আছে। এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করো না মেয়ে।
-নষ্ট তো হয়েই গিয়েছে ভাইয়া।
-কিছুই নষ্ট হয়নি। আমি কয়েকদিনের মধ্যে দেশের বাহিরে যাবো কবে আসবো জানি না। আজ বড় ভাই হয়ে বলছি প্লিজ ঢাকায় চলে যাও অহনা। দরকার পরলে চলো আমি তোমাকে দিয়ে আসবো।
-আপনার মতো একজন বড় ভাই পেয়ে আমি ভীষণ লাকি। কিন্তু ক্ষমা করবেন আমি এবার আপনার কথা রাখতে পারবো না আরহাম ভাই।
আরহাম দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। স্মিত হেসে বলল,
-ঠিক আছে। কিছুদিন এখানে থাকো আর যা করবে শান্ত মাথায় ভেবেচিন্তে করবে। আমাকে কোনোরকম দরকার হলে অবশ্যই কল করবে।
-আচ্ছা।
-আমি এখন আসি তাহলে।
-মাত্রই তো এলেন ভাইয়া! আরো কিছুক্ষন থেকে যান।
-আমার লেট হয়ে যাচ্ছে বোন। অন্য একদিন আসবো। নিজের খেয়াল রেখো।
-জি। আপনিও নিজের যত্ন নেবেন ভাইয়া।
-হুম।
___________________
ডিনার করে ছাদে এসেছে মাহানুর। আজ প্রথমই এই বাড়ির ছাদে আসলো সে। এতো পরিছন্ন আর সুন্দর হবে তার কল্পনায়ও ছিল না। বসার জায়গাও আছে। শুধুই একটা দোলনার কমতি। জয়া বেগম বিকেলে তার এক অসুস্থ বোনের বাসায় গিয়েছেন তাকে দেখতে। সন্ধ্যার দিকে ফোন করে বললেন সে এক দুইদিন সেখানে থাকবেন। যেহেতু বাসায় রাবেয়া, শিবু আর রুমকি আছে তাই মাহানুরও তাকে বলল যতদিন মন চায় থেকে আসতে। কিন্তু এখন ভীষণ একা অনুভব হচ্ছে তার। আরহাম থাকলে কত ভালো হতো তার সাথে ইচ্ছে মতো ঝগড়া করা যেত। মনে মনে ভাবলো মাহানুর।
দুপুরে অফিসে গিয়েছিলো। বাবা আর বড়বাবাকে সবটা খুলে বললে তারা মাহানুরের কথায় সম্মতি দেন। অতঃপর জোর করে আসীনের কাঁধেই সকল দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। এখন মাহানুর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে আর নিজের স্বামী সংসার সামলাবে। কিন্তু আপসোস স্বামীই তো কাছে নেই! ডিনার করার সময় মাহানুর আজ একটা জিনিস খেয়াল করলো। শিবুর পরিবার নেই রাবেয়ারও নেই। যদি ওদের দুইজনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তো মন্দ হয় না।
এখন অতি আগ্রহী হয়ে আরহামের কলের অপেক্ষা করছে। তার সাথে একটু তেড়া তেড়া কথা বললে যদি মুড ভালো হয় তার। কে জানে আজ কল দেয় কী না!

সম্পূর্ণ সাদা রঙের জামা পরে ভুতের মতো হাঁটছে সে। ক্ষণে ক্ষণে ফোনের স্ক্রিনে নজর বুলাচ্ছে। মাহানুরের এবার মন চাইলো নিজেই আরহামের নাম্বারে কল দিতে। কিন্তু একটা অদৃশ্য বাধার জন্য দিতে পারছে না। বারোটা পঞ্চাশ বেজে গিয়েছে। মাহানুরের স্বাভাবিক মুখ ভঙ্গি ধীরে ধীরে মলিন হয়ে গেলো। কেমন দমবন্ধকর অনুভূতি অনুভব হচ্ছে তার। দুনিয়ার সকল মানুষের কষ্ট যেনো সৃষ্টিকর্তা আজ তাকে দিয়ে দিয়েছে। গলা বার বার শুকিয়ে আসছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করার পর যখন সেটা আর হয় না তখন যে অনুভূতিটা হয় সেটা শরীরের আঘাতের থেকেও বেশি পীড়া দেয়। কান্নারা আঁখিজোড়ায় এসে ভীড় করছে। যেকোনো সময়েই মাহানুরের দুই নয়ন অশ্রুতে ডুবে যাবে। মাহানুর হাত মুঠি করে নিজেকে শান্ত করছে। সান্তনা দিচ্ছে। তারপরও অস্থির মন আজ কোনো সান্তনা মানতে নারাজ। একদম শেষ সময়ে যখন মাহানুর মনোবল হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পরবে তখনই শব্দ করে হাতের ফোন বেজে উঠলো। ছলছল নয়নে স্ক্রিনে নাম্বার দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। টপটপ করে গড়িয়ে পরতে থাকলো অশ্রু। কল রিসিভ করে অপরপাশের জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোঁপাতে ফোঁপাতে একনাগাড়ে বলতে থাকলো।
-আপনি একটা খারাপ লোক। একটা স্বার্থপর লোক। অন্যের ফিলিংসের কোনো দাম নেই আপনার কাছে। আমার কোনো মেজর হাসব্যান্ড চাই না। একদম চাই না। যে আমাকে সময় দিবে, আমার সাথে থাকবে আমার ঐরকম হাসব্যান্ড চাই। দূরত্ব আমার একটুও চাই না আরহাম।

>>>চলবে।
(আসসালামু ওলাইকুম। গল্পের সামনে অনেক বেশি রোমান্টিক কিছু সিন আসতে পারে। অনেকেই আছেন যারা বেশি রোমান্স পছন্দ করেননা তাঁদের জন্য আগেই বলে দিলাম। আজকের পর্ব কেমন হয়েছে সবাই মন্তব্যের মাধ্যমে জানাবেন। ধন্যবাদ।)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here