প্রিয়তম #লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-১৫

0
309

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

জন্মদিনের দাওয়াত খেয়ে বাড়ির সবাই তাড়াতাড়িই ফিরল। রুফি, নাবিলা এসেই রিতুর ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। দেখতে চাইছিলো ইফাদের এমন সারপ্রাইজ পেয়ে রিতুর অবস্থা ঠিক কী! বোনদের আনাগোনাটা চোখে পড়তেই ইফাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। এরপর উঠে দরজা খুলে পর্দা সরাতেই রুফি আর নাবিলা হকচকিয়ে গেল। ধরা পড়ে ওদের মুখ চুপসে গেল। ইফাদ ‘এখানে কী?’ জিজ্ঞেস করতেই ওরা দু’জন একে-অপরের দিকে তাকালো। এরপর আমতাআমতা করে পগারপার হলো। রিতু হেসে ফেলতেই ইফাদ মুখ কালো করে তাকালো। ও সাথে সাথেই চুপ হয়ে গেল। ইফাদ সেটা দেখে রেগে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। রিতু কিছু বললো না। বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে বসে ওদের কান্ড দেখছিল। ওর মজা লাগছিলো তবে ইফাদের খোঁচা মারা আচরণও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো ওর।

কিছুক্ষণ পর নাজিয়া ইসলাম রিতুর ঘরে এলেন অপ্রস্তুত হয়ে। ইফাদকে না পেয়ে রিতুর কাছে এসে বসলেন। ভালোমন্দ জিজ্ঞস করলেন। এরপর রিতুর হাতদুটো মুঠোয় নিয়ে তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন,
— আমরা কেউ কিছু জানতাম না। পাগলটা হুট করে চলে এসেছে। তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু
ইফাদ না করলো। ওর বাবা বকাঝকাও করেছে। বুঝতেই পারছো ব্যাপারটা। তুমি কী আমাদের উপর রাগ করেছো?
রিতু হাসলো,
— না মা।
— ইফতির ভাসুরের ছেলেটার সন্ধ্যায় জন্মদিন ছিলো। আমি যেতে চাইনি একা বাড়িতে তোমায় ফেলে। ইফাদ জোর করে পাঠালো। বলেও যেতে দেয়নি তোমাকে।
ও ঘরে এসেছিলো? তোমার সাথে কথা বলেছে তো
ভালো করে?
— জি বলেছে। রেগে, রেগে।
নাজিয়া ইসলাম হাসার প্রচেষ্টা করে বললেন,
— এখন যে ওর কী হয়েছে! দাম্পত্য জীবনে এক-আধটু কথা কাটাকাটি আমাদেরও হয়। কিন্তু তাই বলে এমন করে কেউ? বুঝিয়েছি আমি আর ওর বাবা মিলে। কী জানি ওর মাথায় কি চলছে…
রিতু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল,
— বাদ দিন মা। ফিরেছে এটাই অনেক।
নাজিয়া ইসলাম ওর কথায় সায় জানিয়ে বললেন,
— সেটাই৷ ফুলির মা ফোন করে বলল ওকেও নাকি
বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তুমি খাওয়ার আগের ঔষধ
নিয়েছো তো?
— জি নিয়েছি, ওনিই দেখিয়ে দিলেন।
নাজিয়া ইসলামের ভ্রু কুঁচকে গেল,
— বুঝলো কী করে?
— প্রেসক্রিপশন দেখে।

.

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ইফাদ ঘরে এসে
চুপচাপ বসে রইলো। রিতু ফোন ঘাঁটছিলো আধশোয়া হয়ে। ইফাদ আসায় ফোনটা বন্ধ করে বেড সাইড টেবিলের উপর রাখলো৷ এদিকে ইফাদের ভেতরটা উসখুস করছে রিতুকে জিজ্ঞেস করতে কেন সে ইফাদের নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছে, কোন সাহসে? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারছে না। রিতু ওর ভাবভঙ্গি দেখে নিজেই জিজ্ঞেস করল,
— কিছু হয়েছে?
— আসলে…
— কী?
ইফাদ ইতস্তত করে বলল,
— তোমার পায়ের ব্যথা কমেছে?
রিতু একটু বিস্মিত হলো,
— জি। আপনি এটা বলার জন্যই অস্থির হচ্ছিলেন?
— উহু না হু…

ইফাদ অন্যমনস্ক হয়ে কথাটা বলল। রিতু বুঝতে পারলো ইফাদ কথা কাটাচ্ছে। ওকে বলতে চাইছে না, এড়িয়ে যাচ্ছে। তাই ও আর কথা বাড়ালো না৷ এমনিতেই ওর উপর অভিমান জমিয়ে সে ক’ক’টেল হয়ে আছে। বেশি প্রশ্ন করলে না আবার ফেটে পড়ে! এদিকে রিতু ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ইফাদ ওর ফোনটা হাতে নিলো। ফোনটাতে লক খুব সোজা। ইফাদ জানে সেটা। ও চুপিসারে ব্লকলিস্ট থেকে নিজের নাম্বারটা আনব্লক করে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লো।

.

বাবুল মিয়া আর ইশিতা এসেছে ইফাদের আসার খবর শুনে। রিতুকেও দেখতে এসেছে তারা। শ্বশুরের সাথে ইফাদ ভালো ব্যবহারই করলো। দু’জনের কথা বলার ভঙ্গি দেখে রিতুর মনে হলো তাদের দু’জনের মধ্যে যেন কতদিনের পরিচয়, কত ভাব! যেন নিয়মিত যোগাযোগ চালু আছে তাদের। ও তাই ইশিতাকে জিজ্ঞেস করল কথাটা। ইশিতা খ্যাকখ্যাক করে জানালো ইফাদ বাবুল মিয়ার সাথে নিয়মিতই যোগাযোগ করে। শুনে রিতু আশ্চর্যান্বিত হলেও ব্যাপারটা ওর বেশ লাগলো। অংক স্যারটা তাহলে সব জারিজুরি ওর সাথেই দেখাচ্ছে!

জারিজুরি দেখালেও ইফাদ অবশ্য ওর সব ধরণের খেয়াল রাখছে। প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দেয়, ধরে ধরে হাঁটানোর চেষ্টা করে, হাতটাও নড়াচড়া করাতে সাহায্য করে। দু’দিন তেল দিয়ে চুলও বেঁধে দিয়েছে। যাবতীয় সব খেয়াল রাখছে। ফুলির মাকে বলে দিয়েছে রিতুর সব খেয়াল ও নিজেই রাখবে, হেল্পিং হ্যান্ডের প্রয়োজন নেই। কথাটা রিতুর কানে এসেছে। ও ইফাদকে বোঝার চেষ্টা করছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না। লোকটা ঘন ঘন নিজের রুপ পাল্টায়। কখনো চুপ করে তাকিয়ে থাকবে এমনভাবে যেন কত ভালোবাসে ওকে, কখনো আবার এমনভাবে তাকায় যেন সব দোষ রিতুর। তাই ও আর বেশিকিছু বলে না।
স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। ইফাদের সাথে ওর
আর বিবাদে জড়াতে ইচ্ছে করে না।

এরমধ্যে কিছুদিন কেটে গেলো। রিতুর পায়ের ব্যথাটা এখন আর নেই। হাতের প্লাস্টার খোলা হয়েছে গতকাল। আর আজ বিকেল থেকে রিতু লক্ষ্য করছে একটা মেইল চেক করার পর থেকে ইফাদের মন মেজাজ অত্যাধিক খারাপ। দু’বার তো অমিকে ধমক পর্যন্ত দিয়েছে। অমি বেচারা ভাইয়ের মুখ ঝামটা খেয়ে মুখ কালো করে সটকে পড়েছে। এরপর ইফাদও কোথায় যেন চলে গেল। রিতু ওকে কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পেলো না।

এরপর রাতের বেলা। ইফাদ তখনো ফেরেনি। রিতু একটু মোবাইলটা হাতে নিয়ে বান্ধবীর ম্যাসেজের রিপ্লাই করছিলো। তখনি ইফাদ ফিরল। ঘরে এসে রিতুকে ফোনে মগ্ন দেখে ওর মন খারাপ হলো।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— ঘুমাওনি এখনো?
রিতু হকচকিয়ে ওঠল। মুখ তুলে তাকাতেই দেখল ইফাদকে। এরপর ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
— আপনি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।
— আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? হ্যাঁ আমি তো তা-ই… আমাকেই তো ভয় পাবে। আমি আর কে হই তোমার?
যা খুশি করো আমি কিছু বলবো না…
রিতু বিস্মিত গলায় বলল,
— আপনি শুধু শুধুই রেগে যাচ্ছেন৷ ঘুম আসছিলো না তাই ফোন দেখছিলাম। আপনি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করায় চমকে গেছি…
ইফাদ হুট করেই শান্ত হয়ে গেল। ওর নিজের প্রতিই রাগ হলো এমন বিহেভ করায়। কি যে হচ্ছে!
— ফোন ঘাঁটলে ঘুম আসবে কী করে?
রিতু বলল,
— আচ্ছা রেখে দিচ্ছি…
ইফাদ বলল,
— রাখতে হবে না। আমার উপস্থিতিতে তোমার বোধহয় সমস্যা হয় এ ঘরে। আমি তাহলে তৌফ ‘র সাথে শুয়ে পড়ছি।
রিতু এবার কিছুটা বিরক্ত হলো,
— আপনি ডাবল মিনিং বের করছেন কেন? আমি কি সেটা বুঝিয়েছি?
ইফাদ চুপ করে রইল। রিতু কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— নিন, এদিকে আসুন। শুয়ে পড়ুন এখানে…
ও একটু সরে গিয়ে ইফাদকে শোয়ার জায়গা করে দিল। ইফাদ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। রিতু আবারও বলল,
— আপনি নিশ্চয় ক্লান্ত? ঝগড়াঝাটি, মান-অভিমান
সব কালকের জন্য তুলে রাখুন। এখন শুয়ে পড়ুন।
ইফাদ আর খিটখিটে মেজাজ দেখাতে পারল না।
রিতুর কথা শুনলো বাধ্য লোকের মতো৷ শুয়ে
পড়তেই রিতু জিজ্ঞেস করল,
— খেয়েছেন?
— ক্ষিধে নেই।
— তাহলে আলোটা নিভিয়ে দিন। আলো থাকলে আমার ঘুম আসে না।
ইফাদ বলল,
— তোমার সমস্যা হতে পারে। ঘুমের মধ্যে হাতে লেগেটেগে যাবে…
— লাগবে না।

ইফাদ আলোটা নিভিয়ে দিলো। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই কাচের জানালা দিয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে হলুদ আলো কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে
ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। ইফাদ চোখের উপর হাত রেখে শুয়ে আছে। রিতু অনেকক্ষণ পর বলল,
— আমার উপর এখনো রেগে আছেন?
ইফাদ ভার গলায় বলল,
— বলেছি তো, আমি কারো উপর রাগ করি না।
— কেন করেন না?
— জানি না।
— আচ্ছা বলুন তো, সত্য বলা ভালো নাকি মিথ্যা?
— এটা কেমন প্রশ্ন?
— আমি ফেল্টুস ছাত্রী। গুছিয়ে প্রশ্ন বানাতে জানি না…
ইফাদ ছোট করে বলল,
— সত্য ভালো।
— মিথ্যার পরিণাম কী?
— খুব খারাপ।
— আমি কি কখনো আপনাকে মিথ্যে বলেছি?
— না।
— আমি কি ভালো মেয়ে?
ইফাদ এবার চুপ করে রইল। উত্তর না পেয়ে রিতু এবার চটে গেলো। ইফাদের একটা আঙুল মুচ’ড়ে ধরে বলল,
— অ্যাই বলুন আমি কি খারাপ মেয়ে? হু?
ইফাদ ঘাবড়ে গেলো আচমকা। হাতে ব্যথা পেলো।কঁকিয়ে উঠে বলল,
— হুম খারাপ। প্রচন্ড খারাপ…
— কী খারাপ কাজ করেছি আমি?
ইফাদ চট করেই উঠে বসল। এরপর বলল,
— তুমি আমাকে শুধু কষ্ট দাও, দিচ্ছো…
রিতু বলল,
— আর আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন না আপনি?
— তুমি কষ্ট পাও?
— না। আমি কাঠ পুতুল।
— মজা করো না। আমার মন ভালো নেই…
— আমি মজা করছি না। সারাদিন পেঁচার মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনার সমস্যাটা জানতে চাচ্ছি। কী হয়েছে বলুন আমাকে…
ইফাদ যেন গলে গেলো। রিতুর কাছে ধরা না দেওয়ার, সস্তা না হওয়ার প্রতিজ্ঞা মুহূর্তেই ভুলে গিয়ে ওকে হুট করে জড়িয়ে ধরল। এরপর ভাঙা গলায় বলল,
— তিন সপ্তাহের জন্য এসেছিলাম। পরে আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়েছি। আমাকে অতি শ্রীঘ্রই চলে যেতে হবে। তুমি তো এখনো কিছু বললে না…
রিতু সরল গলায় বলল,
— চলে যাবেন? যান তাহলে। আমার কিছু বলার
ছিলো নাকি!
ইফাদ ওকে ছেড়ে দিলো৷ অনেকটা আর্ত গলায় চেঁচালো,
— রিতুওওওও…
— প্রথমদিন এসেই নাকি আপনি ছাদে গিয়ে
কান্নাকাটি করেছিলেন? বউ রেখে এসেছেন নাকি
ওই দেশে?
— মোটেও না।
বলে ইফাদ হতবাক নয়নে তাকালো। পরক্ষণেই লজ্জিতবোধ করলো। ও তো সেদিন রিতুর অবস্থা দেখে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল। তাই সবার আড়ালে ছাদে গিয়ে একটু কেঁদেছে৷ এই খবর রিতু কোথায় পেল? ও বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— তোমাকে কে বলল?
— যেই বলুক! ভেউ ভেউ করে কাঁদার মানে কী?
ইফাদ এবার আরো শক্ত করে ধরলো রিতুকে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। রিতুর দম বন্ধ লাগছিলো। ও ইফাদের হাতে চিমটি কাটতেই ও বলল,
— একটু কাঁদছিলাম। কী করব?
কান্না পাচ্ছিল!
— একটু কাঁদছিলেন? তৌফ, অমি, রাজি ওরা সবাই দেখেছে আপনি ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলেন…
ইফাদ এবার রেগে গেল,
— মোটেও ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলাম না। আর কাঁদলেও কী? কাউকে কৈফিয়ত দেব না।
— ওকে। তাহলে ছাড়ুন আমাকে…
রিতু জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে
ঘুরে শুয়ে পড়লো৷ ইফাদ ওর কাছে ঘেঁষে বলল,
— তোমার জন্য একটু কাঁদছিলাম। অ্যাই মেয়ে…
রিতু অনেক কষ্টে হাসি আটকালো। এরপর বলল,
— আপনি নাকি বাবার কাছ থেকে সেদিন চ’ড়ও খেয়েছেন?
মানসম্মান সব শেষ! রিতু এই কথাটাও জানে? কে বলেছে ওকে এসব? ইফাদ রেগেমেগে এবার বিছানা থেকে উঠে গেল। তপ্ত মেজাজে বারান্দায় গিয়ে বসে রইল। রিতু এবার মুখ চেপে হেসে ফেলল।

____________

[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে…

রেসপন্স করবেন সবাই ফলো দিয়ে রাখুন Bindas Life

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here