#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব২১
গোধূলি লগ্ন।পশ্চিম আকাশের বুকে সূর্য ঢলে পড়ছে। সন্ধ্যা নামনাম ভাব। কনে বিদায় পর্ব চলছে।বিদায় মূহূর্তে পরিবেশটা কেমন জানি ভারি হয়ে উঠেছে।রোজের বাবা রোজকে রুপমের হাতে তুলে দিয়ে একহাতে চোখের কোণে জমা পানিটুকু মুছে নিলেন। উপদেশ মূলক কিছু কথা রুপমকে বলতেই ওনার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসে। প্রত্যেকটা বাবার কাছেই তার কন্যা সন্তান তার কাছে রাজকন্যা।নতুন পরিবেশে নতুন মানুষের সাথে কিভাবে মানিয়ে চলবে।এই নিয়ে বাবা মায়ের দুশ্চিন্তা থেকেই যায়।রোজ বাবাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কান্না করতে থাকে।রোজের বাবা মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে এটাসেটা বলে সান্ত্বনা দেয়।বিদায়ক্ষণে বাবা মেয়ের এইদৃশ্য দেখে লিয়ার মুখটা মলিন হয়ে যায়।নিজের বাবার কথা মনে হতে থাকে। অজান্তেই দুচোখে পানি চলে আসে।এমন সময় পুরুষালী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই লিয়া হকচকিয়ে উঠলো।
“আসসালামুয়ালাইকুম ভাবী।রোজ ভাবীর বিদায় দেখে ভাবী কি নিজের বিদায় ইমাজিন করছেন।সেইজন্য মুখটা মলিন হয়ে আছে।”
লিয়া চকিতে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ডান সাইডে ঘুরায়।লিয়ার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।লিয়া বিস্ময়কর চাহনিতে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকে।মানুষটাকে চিন্তে লিয়ার একমিনিটও সময় লাগে না।লিয়া ভাবে,এটা তো জারিফের ফ্রেন্ড। কিযেনো নাম।শুনেছি তো।উমম! মনে পড়েছে রোহান।তবে লিয়ার বোধগম্য হচ্ছে না।রোহান ভাবী বলে সম্বোধন করলো কিজন্য?লিয়ার মাথার মধ্যে এই একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে।লিয়া যেনো কোনো জটিল সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত।লিয়া ভাবছে,ভাবী বলছে কোন দিক দিয়ে? অদ্ভুত!!তবে কি উনি আমার আর জারিফের বিয়ের বিষয়টা কোনোভাবে জানতে পেরেছে?কিভাবে জানলো? আশ্চর্য!!জারিফ বলেছে?লিয়ার ভাবনার মাঝেই রোহান হাতে থাকা কোল্ড ড্রিংকস টা লিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“প্রচন্ড গরম পড়ছে।নিন ভাবী কোল্ড ড্রিংকস খান।”
ফের একই সম্বোধনে লিয়ার বিস্ময় যেনো কমার থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যায়।লিয়া অবাক হয়েই ক্ষীণ আওয়াজে ঠোঁট আওড়ালো,,”নো থ্যাংকস।”
এরমধ্যে রুপন্তী এসে লিয়াকে উদ্দেশ্য করে তাড়া দিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো,,”এই লিয়া চল।সবাই তো গাড়িতে উঠে পড়ছে।চল এবার।”
লিয়া আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে রোহানকে পাশ কাটিয়ে গাড়ির কাছে যায়।গাড়ির সামনে দেখতে পায় রুপম গাড়ির সামনে।জারিফ রুপমকে হাগ করে বললো,,”কনগ্রাচুলেশন দোস্ত।বেস্ট লাক ইউর কনজুগেল লাইফ।আই উইশ ইউর ফিউচার লাইফ ফুল ফিল উথদ জয়।খুব ইনজয় করলাম।আমাদের জন্যও দোয়া করিস, যেনো আমরাও সামাজিক জীবনে পদার্পণ করতে পারি।নতুন জীবন সুখের হোক এই কামনা করি। অবিরাম প্রশান্তিতে ভরে উঠুক তোর নিউ লাইফ।আবারো শুভ কামনা জানাই।”
রুপম হাসিমুখে বলল,,”থেংকিউ।”
জারিফ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা একটু নুইয়ে জড়তা নিয়ে বলল,,” রুপম আজকে আমাকে বাসায় যেতে হবে।সরি আজকে থাকতে না পারার জন্য।কিছু কাজ পেন্ডিং আছে। ইমার্জেন্সি সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। প্লিজ, মাইন্ড করিস না।কালকে রিসেপশনে দেখা হবে।”
রুপম তড়িৎ বলে উঠলো,,”আরে ব্যাপার না। ঠিক আছে।”
রুপম একটু থেমে পাশে থাকা রুপন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,”রুপু গাড়িতে উঠ।রুপু তুই সামনে বস।আর লিয়া রোজের পাশে গিয়ে বসো।”
লিয়া খানিকটা দোটানায় আছে।কি করবে বুঝতে পারছে না।জারিফের কথামতো জারিফের সাথেই যাবে?নাকি রুপন্তীদের সাথেই?এই নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে।একবার জারিফের মুখশ্রীতে চাইলো।আবার কিছু ভেবে বর বউ এর গাড়ির দিকেই পা বাড়াল।এমন সময় লিয়ার হাতে টান পড়ে।আচমকা হাতে টান পড়ায় লিয়া দাঁড়িয়ে পড়ে।মাথাটা ঘুরিয়ে দেখতে পায়।জারিফ একহাতে লিয়ার হাত ধরে রেখেছে।লিয়া কিছু বলার আগেই জারিফ রুপমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,
“রুপম লিয়া আমার সাথে যাবে।লিয়ার তো সামনের সপ্তাহেই এক্সাম। ওর নাকি অনেক কিছুই এখনো বাদ আছে।রিভিশন দেওয়া বাদ আছে।সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে।পড়া মিস যাচ্ছে। লিয়াকে আমি বাসায় ড্রপ করে দিবো।”
জারিফের এহেন কথাবার্তায় লিয়া আশ্চর্যের চরম লেবেলে পৌঁছে যায়।লিয়া অবাক হয়ে মনেমনে আওড়ায়,কি সুন্দর সাজিয়ে মন মতো বলছে। আজব!আমি কখন ওনাকে এসব বললাম।
জারিফ লিয়ার দিকে তাকিয়ে জোর করে হাসার চেষ্টা করে ঠোঁট আওড়ালো,,”চলো। যাওয়া যাক।”
রুপম রুপন্তী দুজনেই অবাক।জারিফ এখনো লিয়ার হাতটা ধরে আছে। রুপন্তী সেদিকে একবার চাইলো আবার লিয়ার দিকে। রুপন্তীর চোখেমুখে প্রশ্নের ঝুড়ি ঝুলছে।তবে প্রশ্ন করার মতো স্কোপ পাচ্ছে না।তাই চুপচাপ দর্শক হয়ে ড্যাবড্যাব করে শুধু চেয়ে আছে। রুপম বিস্ময়কর চাহনিতে চেয়ে অবাক গলায় জারিফকে শুধালো,,”তুই লিয়াকে ড্রপ করবি?ঠিক বলছিস?”
জারিফ স্বাভাবিকভাবে সুন্দর করে এককথায় বলল,,”হ্যা।”
রুপমের চোখেও একই প্রশ্ন।তবে আশেপাশে লোকজনের জন্য প্রশ্নটা করে উঠতে পারছে না।জারিফ রুপমের মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝতে পারে কি বলতে চাইছে। জারিফ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,,
“রোহানের থেকে জেনে নিস।রোহান সবটা জানে।এই রোহান রুপমকে সবটা বলিস। দোস্ত ভাবী গাড়িতে একা আছে।এসব ভাবা বাদ দিয়ে যা গাড়িতে উঠ। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে অলরেডি।”
তখন আসার সময় গাড়িতে জারিফ রোহান কে শর্টকাটে সবটা বলেছে। লিয়া আর ওর বিয়ের কথা।জারিফ রিলাইজড করতে পারে,যত সময় যাবে রোহান লিয়ার উপর তত দুর্বল হয়ে পড়বে।তাই সময় থাকতে থাকতে সত্যিটা বলে দেয়াই বেটার।বিয়ে হলো এমন একটা পবিত্র বন্ধন।যেখানে সৃষ্টিকর্তা অটোমেটিকলি দুজন নর ও নারীর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করেন।জারিফ নিজেও এখনো জানেনা লিয়াকে ভালোবাসে কিনা?বা লিয়ার প্রতি কোনো আ্যফেকশন তৈরি হয়েছে কিনা?তারপরেও লিয়া কে নিয়ে রোহানের পাগলামি।লিয়াকে নিয়ে ভালোলাগার কথা এসব রোহানের মুখে শুনতে জারিফের মোটেও ভালো লাগছিলো না।জারিফ প্রচন্ড জেলাস ফিল করছিলো।না চাইতেও অটোমেটিকলি রা’গ ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছিলো।তাই জারিফ রোহানকে সরাসরি সবটা বলে দেয়।তবে আজকাল জারিফের মনমস্তিষ্ক জারিফের অবাধ্য হয়েছে।কেনো জানি মনমস্তিষ্ক হুট করেই লিয়ার কথা স্মরণ করায়। লিয়ার কথা স্মরণ হতেই মনে হয় খুব কাছের কেউ। অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা আছে দুজনে।অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা আছে লিয়ার সাথে।লিয়ার কথা ভাবলেই অজানা অনুভূতি হয় হৃদয় কুঠরিতে।
জারিফ ফের লিয়ার দিকে সুগভীর শান্ত নজরে চাইলো। কন্ঠে একরাশ শীতলতা নিয়ে বললো,,”লিয়া।চলো।লেটস গো।”
লিয়া যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না।কথা যেনো কন্ঠনালী ভেদ করে বেরিয়ে আসছেই না।লিয়া অবাক চোখে চেয়েই জারিফের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।কয়েকপা এসে গাড়ির সামনে আসতেই জারিফ লিয়ার হাতটা ছেড়ে দেয়।গাড়ির ডোর খুলে লিয়ার দিকে চেয়ে ইশারা করে শান্ত কন্ঠে বলল,,”কিহলো এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?উঠো।”
লিয়া কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে।লিয়ার গলায় কয়েকটা প্রশ্নরা জট পাকিয়েছে।তবে জড়তার জন্য লিয়া বলতে পারছে না। লিয়া দুইহাতের তালু ডলতে থাকে।জারিফ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।একপলক লিয়ার দিকে চাইলো।লিয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চায় আবার কোনো কারনে হয়তো বলতেও পারছে না। হেজিটেশন ফিল করছে হয়তো। স্ট্রায়িংয়ে হাত রেখে দক্ষতার সহিত ড্রাইভ করছে জারিফ।শান্ত নজরজোড়া পিচের রাস্তায় থাকলেও পাশে বসা লিয়ার দিকে মনোযোগ।লিয়া গাড়িতে বসে উসখুস করছে।দুজনের মাঝেই নিরবতা চলছে।নিরাবতা ভেঙ্গে জারিফ নরম গলায় লিয়াকে শুধায়,,
“কিছু বলবে? হেজিটেশন না রেখে যা বলার বলে ফেলো।আনসার দেওয়ার জন্য আ’ম রেডি।”
লিয়া তড়িৎ জারিফের মুখপানে চাইলো। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো। লিয়া এবার জমে রাখা প্রশ্নগুলোকে কন্ঠনালী ভেদ করে ঠোঁট প্রসারিত করে আমতা আমতা করে বলেই ফেললো,,”ইয়ে মানে আপনার বন্ধু আমাকে ভাবী বললো কেনো?না মানে আপনি কি বলেছেন?আর সবার সামনে ওভাবে বললেন।মিথ্যে কেনো বললেন?আমি কখন আপনাকে ওসব বললাম? আশ্চর্য!!”
জারিফের দৃষ্টি সামনে।জারিফ মৃদু হাসলো।জারিফের শব্দহীন হাসিটা লিয়ার কাছে খুব চমৎকার লাগলো। ইশশ্!কি সুন্দর দুর্দান্ত মারাত্মক হাসি। যেকোনো মেয়ে দেখলেই এই হাসিতে নির্ঘাত ঘায়েল হয়ে যাবে ।এইযে লিয়া ড্যাবড্যাব করে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জারিফের মুখায়বে। উত্তরের কথা লিয়া বেমালুম ভুলে বসে আছে।লিয়া তো জারিফকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে আছে।জারিফ দৃষ্টি সামনে রেখেই ঠোঁটের কোণে বিস্তৃত হাঁসি নিয়ে মৃদুস্বরে ঠোঁট আওড়ালো,,”বুঝেছি বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে তোমার পেট ভরেনি।তাইতো এখন চোখ দিয়ে আমাকে
“মোটেই না।আপনি ভুল ভাবছেন।আমি তো আমার প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় আছি। এছাড়া কিছুই না।”
জারিফের কথা শেষ করতে না দিয়ে লিয়া কথার মাঝেই ব্যাঘাত ঘটিয়ে চঞ্চল কন্ঠে একনাগাড়ে কথাগুলো বলল।জোর করে কথাগুলো বললেও লিয়া ভিতরে ভিতরে লজ্জা আর অস্বস্তিতে নুইয়ে পড়ছে।সত্যিই তো ড্যাবড্যাব করে জারিফের দিকে তাকিয়ে ছিলো।কি লজ্জাকর অবস্থা। উফফ!মানুষটার দৃষ্টি পিচের রাস্তায়। অথচ কিকরে বুঝলো লিয়া তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে?আবার লজ্জায় ফেলতে এহেন কথা।যা শুনে লজ্জায় লিয়ার মাটির তলায় লুকোতে ইচ্ছে করছে।জারিফ ঘাড় ঘুরিয়ে লিয়ার দিকে একপল তাকালো। অতঃপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। কন্ঠে গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললো,,
“আমার বন্ধুর ভাবী ডাক তোমার পছন্দ হয়নি।নাকি আমার বন্ধুর মতো তুমিও অন্যকিছু ভাবছিলে। কোনটা?”
জারিফের শেষের কথা লিয়া বুঝতে পারলো না।লিয়া অবাক হয়ে ফের প্রশ্ন করে উঠলো,,”বুঝলাম না।অন্যকিছু মানে?কি বলতে চাইছেন?”
“যাকগে বাদ দাও এসব।আর কিযেনো বলছিলে।উম!ও মিথ্যে কেনো বললাম।তাইতো? মাঝে মাঝে এরকম হোয়াইট লাই বলা যায়।যে মিথ্যায় অন্যর যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।আর কাউকে সেভ রাখা,কারো ভালোর জন্য দুই একটা হোয়াইট লাই বলা যেতেই পারে।”
একটু থেমে ফের বললো,,”আর তুমি।যার কিনা আজ বাদে কাল বোর্ড এক্সাম। পড়াশোনার কোনো প্যারা নেই।চিলমুডে বিয়ে খেয়ে বেড়াচ্ছো।”
ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজে।জারিফের গাড়ি এসে লিয়াদের কোয়ার্টার এর সামনে থামে।লিয়া সিট বেল্ট খুলতে থাকে।জারিফ গাড়ির দরজার লকড খুলে দেয়। লিয়া খুলে নেমে পড়ে।লিয়া ঘুরে জারিফের জানালার পাশে এসে সৌজন্যতার খাতিরে ভদ্রভাবে নম্রস্বরে বললো,,”ভেতরে আসুন। আম্মুর সাথে দেখা করে যাবেন।”
জারিফ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,,”আজ নয়।এখন তো রাত হয়ে গিয়েছে। এখন ফাস্ট বাসায় যেতে হবে। বললাম তো তোমাকে আজ রাতের মধ্যে খাতাগুলো দেখে শেষ করতে হবে।”
লিয়া ছোটো করে বলে,,”ইটস্ ওকে। আসি।”
আসি বলে লিয়া যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।কয়েক পা এগিয়ে যেতেই শান্ত গলার মোহনীয় ডাকটা শ্রবণেন্দ্রিয়ে বারি খেতেই লিয়ার পা থেমে যায়।লিয়ার মনটা শিহরিত হয়ে উঠলো।জারিফ দুইহাত স্টেয়ারিংয়ের উপর রেখে জানালা দিয়ে লিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,
“লিয়া।”
নিজের নামটা আজ নতুন জারিফের মুখে শুনছে এমন নয়।তবে এযাবৎ কালের ডাক আর আজকের ডাকের মাঝে যেনো আকাশ পাতাল ফারাক ছিলো লিয়ার কাছে। ছোট্ট করে এই ডাকটা আজ অদ্ভুত শোনালো লিয়ার কাছে। নিউরনে সাড়া জাগাতেই লিয়ার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো।লিয়া একটু সময় নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জারিফের দিকে চাইলো।জারিফের সাথে চোখাচোখি হলো।লিয়া দৃষ্টি নুইয়ে নেয়।জারিফ স্মিত হেসে বললো,,
“সরি।তোমাকে ওভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে আসাতে। প্লিজ রা’গ করো না। আমাদের ফ্যামেলি কনজারভটিভ। ওভাবে গার্ডিয়ান ছাড়া একলা অত লোকজনের মাঝে থাকা এটা আমি নিজেও লাইক করি না।আমার আচরণে কষ্ট পেলে,এ্যগেইন সরি।আর তোমার সামনে এক্সাম পড়াশোনায় কন্সানট্রেট করো।মাথা থেকে সব রা’গের ভূত,জিদ ঝেড়ে ফেলো,কেমন।
একটু থেমে,,”আন্টি আঙ্কেল কে আমার সালাম দিও।
বায়।টেক কেয়ার।”
লিয়া মাথাটা তুলে জারিফের দিকে শান্ত চাহনিতে চাইলো। কোমল স্বরে বললো,,”ব্যাপার না।ঠিক আছে।থ্যাংকস।বায়।”
লিয়া উপরে উঠে একহাতে কলিং বেল চেপে মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকতেই রাজিয়া সুলতানা দরজা খুলেন।দরজা খুলে লিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হন।দরজার সামনে দাঁড়িয়েই অবাক গলায় শুধালেন,,”কি ব্যাপার লিয়া এইসময় তুই?এখন কিকরে আসলি?তোর না কালকে আমাদের সাথে আশার কথা।তবে এখন?আর রাতে কার সাথে এসেছিস? আশ্চর্য হচ্ছি লিয়া তোর সাহস দেখে।একাএকাই চলে এসেছিস নিশ্চয় তাও এই রাতের বেলা।”
রাজিয়া সুলতানা শেষের কথাগুলো বেশ শক্ত গলায় বললো।সাথে ওনার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে।লিয়ার থেকে উত্তরের আশায় থাকে।লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো।একহাত কপালে রেখে বললো,,
“ওহ্! আম্মু।থামবে এবার একটু।আরে আমাকে আগে বলতে দিবে তো।তা না। উফ্!”
রাজিয়া সুলতানা ফের শক্ত কন্ঠে ঠোঁট আওড়ালেন,,
“কি বলবি শুনি?যখন যা মন চায় তাই তো করে বেড়াচ্ছিস।দিনদিন তোর এই অধঃপতন দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না।”
লিয়া চোখ বন্ধ করলো।মৃদু শ্বাস টেনে নিয়ে ঠোঁট আওড়িয়ে বলল,,”আমি একা আসিনি।তোমার জামাই দিয়ে গিয়েছে আমাকে। বিশ্বাস না হলে ফোন দিয়ে শুনে নিও।”
রাজিয়া সুলতানা কপাল কুঁচকে ঠোঁট আওড়িয়ে বললেন,,”জামাই।কোন জামাই?কার কথা বলছিস?বুঝতে পারছি না।”
লিয়া এবার বি’রক্ত হলো। ঠোঁট চেপে বলল,,”আম্মু।তোমার কয়টা মেয়ে আছে বলোতো?আমি ছাড়া তোমার আরো এক বা একাধিক মেয়ে আছে নাকি?”
রাজিয়া সুলতানা এবার বিষয়টা খানিকটা বুঝতে পারলেন। বললেন,,”জারিফ।জারিফের সাথে তোর দেখা হলো কিভাবে?”
“উনার ফ্রেন্ড রুপম ভাইয়া।”
“ওহ্! বুঝলাম।তা আজকেই আসলি যে।শরীর খা’রাপ করছে কি?নাকি কোনো সমস্যা হয়েছে।”
শেষের কথাটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন। লিয়া এবার একটু থতমত খেয়ে বসে।মা-কে কি বলবে?বুঝতে পারছে না। লিয়া মায়ের প্রশ্ন সুক্ষ্মভাবে এড়িতে যেতে বলে,,
”কোনো সমস্যা বা শরীর খা’রাপ কোনোটাই না।এমনি ভালো লাগছিলো না। ওহ্! আম্মু এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি।তোমার মতলবটা কী?আমায় বলো তো দেখি।ভিতরে যেতে দেবে না নাকি?”
মেয়ের কথাশুনে রাজিয়া সুলতানা মৃদু হাসলেন।দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন।লিয়া ভেতরে যেতে যেতে ফের বললো,,”ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুম প্রয়োজন।”
রাজিয়া সুলতানা দরজা লকড করে দেন। মনেমনে আওড়ায়,জারিফ পৌঁছে দিয়েছে লিয়াকে।তবে কি ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছে? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।যাতে ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়।আর পাঁচ জনের মতো স্বাভাবিক লাইফ লিড করতে পারে।
.
জারিফ বাসায় গিয়ে বেল চাপতেই জারা এসে দরজা খুলে দেয়।ভেতরে যাওয়ার সময় ড্রয়িংরুমে দুজনকে দেখে কপালে খানিকটা ভাঁজের সৃষ্টি হয়।জারিফ কার্টেসির খাতিরে দাঁড়িয়ে যায়।সালাম দিয়ে বলে,,
“ফুপ্পি কেমন আছো?কখন আসছো?”
কল্পনা বেগম আর উনার একমাত্র মেয়ে কথা সোফায় পাশাপাশি বসে।অপর পাশে জাহানারা বেগম।নীল সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে। কল্পনা বেগম মৃদু হাসলেন।হাসি মুখেই বললেন,,
“আমি ভালো আছি বাবা।তা ফুপ্পি সেই বিকেলে আসছে।তোর তো দেখাই নেই।কথা এসে থেকে তোর কথা বারবার ভাবীকে জিগ্গেস করছে। বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলি নাকি?”
জারিফ ছোট করে বলে,,”হুম।”
কথা পায়ের উপর পা তুলে হাঁটুতে দুইহাত রেখে বসে ছিলো।জারিফকে উদ্দেশ্য করে কোমল স্বরে ঠোঁট মেলে বললো,,”ভাইয়া কেমন আছো?”
জারিফ একশব্দে বললো,,”ওয়েল।”
কল্পনা বেগম ভরাট গলায় বলতে শুরু করলেন,”জানিস জারিফ কথা তো আনন্দ মোহন কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। ইংলিশে চান্স পেয়েছে।কথা মেসে থাকতে চেয়েছিলো।আমি ভাইকে ফোন করে বললাম,ভাই কথার জন্য একটা ভালো দেখে মেস দেখে দাও তো। পরিবেশটা যেনো ভালো হয়।ওমা!আমি বলার সাথে সাথেই ভাই কি বলে উঠলো,কথা মেসে উঠবে কেনো?আমাদের এখানে থাকবে।জানিসই তো ভাইয়ের কথা আমি কখনো ফেলতে পারিনা।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাইয়ের কথামতো কথা কে এখানে থাকতে রাজি করালাম। কথা তো রাজি হচ্ছিলোই না।অনেক করে বলার পর মেয়ে আমার রাজি হলো।মেয়ের এককথা লোকে কি বলবে,মামুর বাড়িতে থাকলে। আমিও অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম একা একটা মেয়েছেলে মেসে না থাকাই ভালো।তাইতো জোর করে বলে কয়ে কথাকে এখানে নিয়ে এনেছি।আর ভাবলাম নীলও একই কলেজে পড়ে।আপাতত প্রথম প্রথম নীল নিয়ে গিয়ে সবকিছু দেখেশুনে দিবে।”
নীল আড়চোখে কথার দিকে চাইলো। দাঁত কিড়বিড় করে মনেমনে আওড়ালো,, উফ্!বড় আব্বুকে ফোন করে বলতে গিয়েছে।বড় আব্বু তো সৌজন্যতার খাতিরে এখানে থাকার কথা বলবেই।তাই বলে ঢ্যাং ঢ্যাং করে থাকতে চলে আসবে।আর আমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই এই ন্যাকারানিকে নিয়ে কলেজে যাবো। উফ্!আর কেউ না জানলেও আমি ভালো করেই জানি। ব্রো এর বিয়ের কথাশুনে ন্যাকারানি রা’গ করে বিয়ে খেতে আসেনি।এখন যে কোনো মতলবে এসেছে আমি শিওর।
জারিফ কল্পনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে নম্রস্বরে বললো,,”ভালো করেছো। ফুপ্পি আমি খুব ক্লান্ত।পড়ে কথা বলবো,কেমন।”
যাওয়ার সময় জারিফ জাহানারা বেগমকে ডেকে বললেন,,”মা চারুকে দিয়ে এক মগ কফি দিও তো।”
জাহানারা বেগম”ঠিক আছে” বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় কথা চঞ্চল গলায় বলে উঠলো,,”বড় মামী তুমি বসে থাকো। রেস্ট করো।আমি কফি বানিয়ে দিয়ে আসছি।”
জাহানারা বেগম সরু চোখে কথার মুখপানে চাইলেন।কিছুটা বিস্ময়কর কন্ঠে বললেন,,”তুমি?”
কথা উঠে দাঁড়ায়।মাথা নাড়ায় যার অর্থ হ্যা। এরমধ্যে নীল ফোন স্ক্রল করতে করতে ফোড়ন কে’টে বললো,,”তুমি কফি বানাবে?চিনি আর লবণের মধ্যে কোনটা চিনি আর কোনটা লবণ চিনতে পারবে তো?”
নীলের কথা শুনে কথার ভীষণ রা’গ হয়।এইছেলে ইঁতুড়ে স্বভাবের তা জানা আছে কথার।কথা এক আঙ্গুল নাকের সাথে ঘষে নেয়। স্পষ্ট রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,”নীল তোমার এরকম কেনো মনে হলো?সুগার এন্ড সল্ট এর ডিফারেন্স আমি করতো পারবো না,হু।”
নীল সোজা হয়ে বসলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,,
”আমার তো মনেহয় তুমি স্যাডো, ফাউন্ডেশন, আইলানার,উম!এককথায় সাজগোজের যা কিছু আছে সেসব ছাড়া অন্যকিছু তেমন চেনোই না।বলতে গেলে সাজগোজ ছাড়া এর বাইরের জগৎ এর সাথে তোমার কোনো সম্পর্কই নেই।”
কথা কাঁদো কাঁদো ফেস করে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,,”বড় মামী নীলকে চুপ করতো বলো, না।ও কিন্তু বেশি বেশি বলছে,হুম।”
জাহানারা বেগম ধমকের সুরে বললেন,,”আহ্!নীল হচ্ছে কি?থামবি।আর কথা মামনি তোমাকে এই গরমের মধ্যে কিচেনে যেতে হবে না।আমি কফি বানাচ্ছি।তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না।তুমি পড়াশোনার জন্য আসছো।মন দিয়ে পড়াশোনা করো।”
কথাটা বলে জাহানারা বেগম কিচেনে চলে যান।কথা কটমট চোখে নীলের দিকে তাকালো।নীল সেদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো, কখনো একগ্লাস পানি ভরে খেতে যাকে দেখেনি।সে কিনা আগ বাড়িয়ে বলছে কফি বানাবে।ভাবা যায় উফ্! ফুপ্পি তো একমেয়ে বলে বেশি আদর দিয়ে একটা ন্যাকার গোডাউন বানিয়েছে নিজের মেয়েকে।
.
আজকে শুক্রবার।কাল বাদে পরশু রবিবার থেকে লিয়ার পরীক্ষা শুরু। পশ্চিম আকাশ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে।দূরে আকাশের বুকে একঝাঁক পাখি ডানা মেলে চলছে।হয়তো তাদের নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া উঠা কফির মগে চুমুক দেয় লিয়া।লিয়া আশায় আছে আজ না হোক কাল একবার অন্তত জারিফ ফোন করবে।অল দ্যা বেস্ট জানাবে। পরীক্ষা নিয়ে কিছু সুন্দর সুন্দর উপদেশ বাণী আওড়াবে। ইশশ্!লিয়ার এই ভাবনাটা এখনো পূরণ হচ্ছে না জন্য লিয়ার মনটা ভীষণ ভীষণ খা’রাপ লাগছে। আত্মীয়-স্বজনের প্রায় সবাই ফোন করে এটাসেটা উপদেশ দিচ্ছে।অথচ যার একটা কলের জন্য চাতক পাখির মতো লিয়া অপেক্ষা করছে।তার কল আসার নাম গন্ধও নেই।কাল অব্দি সময় আছে। এরমধ্যে কাংখিত ব্যক্তির কল আসবে কি?এই একসপ্তাহে জারিফকে আরো বেশি করে খুব করে মনে পড়ছে লিয়ার।লিয়া ভাবে ওনার কি আমার কথা মনে পড়ে না?হয়তো বা না।কারন মনে পড়লে একবার না একবার তো অন্তত একটা কল দিতে পারতো।লিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই রুমে থাকা ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো।লিয়া কফির মগ হাতেই রুমে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।রিসিভ করে ফোনের ওপাশ থেকে লিয়া যা শুনলো।তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।লিয়ার হাত থেকে কফির মগটা শব্দ করে পড়ে যায়।ভারি মগটা কয়েক টুকরো হয়ে ফ্লোরে ছিটে পড়ে।লিয়ার পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছে।
চলবে,,,
(আমি অসুস্থ। গরমে সাইনুসাইটিস এর সমস্যা বাড়ায় প্রায় সময় হেডেক হচ্ছে।যার ফলে ঠিকঠাক লিখায় মনোনিবেশ করতে পারছি না।জানিনা পর্বটা কেমন হয়েছে।আমার নিজেরই মনমতো হয়নি।যাইহোক,ভালো-মন্দ মন্তব্য করবেন।হ্যাপি রিডিং।)