সুখের_ঠিকানা #শারমিন_হোসেন #পর্ব৩৪

0
251

#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৪

নিস্তব্ধ রজনী। রাত্রি সাড়ে বারোটা বাজে।বাড়ির সবাই এতক্ষণে হয়তো গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত আছে।লিয়া হাতে থাকা ফোনটা চেপে ধরলো।ঘনঘন পলক ফেললো। এতক্ষণে লিয়ার ঘুমের রেশ কে’টে গিয়েছে।লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তুলি আর ইভাকে দেখে নিলো। দেখে মনে হচ্ছে দু’জনে প্রশান্তির সাথে বিভোরে ঘুমোচ্ছে।লিয়া তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। অবশেষে ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।বিছানা থেকে নিঃশব্দে পা ঝুলিয়ে বসলো। কিয়ৎকাল পরেই উঠে দাঁড়াবে তখন ওড়নায় টান পরে। লিয়া হকচকিয়ে উঠে।চুরি করে ধরা পড়লে মানুষের মুখায়ব যেমন হয়। ঠিক তেমনি লজ্জিত মুখায়ব হয় লিয়ার।লিয়ার গলা শুকিয়ে আসে।লিয়া ভাবে, ইশশ্!এইরে তুলি নিশ্চয় জেগে গিয়েছে।এখন তো বাইরে যাওয়া কোনোভাবেই পসিবেল হবে না।সাথে তুলি নিশ্চয় এটাসেটা প্রশ্ন করবে।সাথে তো ওর ফ্রিতে সন্দেহ থাকবেই।লিয়া মনেমনে এসব ভাবতে থাকে।তবে তুলি বা কারো কোনো টু শব্দ না পেয়ে লিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো।লিয়ার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে তুলি আগের মতোই ঘুমাচ্ছে। তাহলে টান লাগলো কিসে? লিয়া অনুসন্ধানী চোখে চাইলো।রুমে জ্বলে থাকা ডিম লাইটের আলোয় দৃশ্যমান হয়,লিয়ার ওড়নাটা তুলির পিঠের নিচে পরে আছে। উফ্! সেইজন্য টান লেগেছে।লিয়া এবার বেকায়দায় পড়লো।তুলির গাঁয়ের নিচ থেকে ওড়নার অংশটা বের করবে কিকরে?টান দিলে যদি জেগে যায়।লিয়া বিরক্তিকর ফেস করে একহাতে আস্তে করে টান দেয়।তুলি একটু নড়লো।লিয়ার এবার আশংকা হলো তুলি জেগে উঠার।ধ্যাত! ওড়নাটাকে ঠিক তুলির গাঁয়ের নিচেই পড়তে হলো। ভাল্লাগে না! সবসময় কোনো কাজ ভালোভাবে হবে না। একটা না একটা সমস্যা বেঁধেই থাকবে।লিয়া দাঁত কটমট করে বিড়বিড় করে এসব বলতে থাকে। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে অন্য একটা ওড়না বের করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। সন্তর্পণে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুম পেরিয়ে মেইন দরজা খোলে।দরজা খুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় পিছন দিক ঘুরে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে জারিফ। করিডোরে জ্বলে থাকা আলোয় জারিফকে চিনতে এক সেকেন্ডও দেরি হয়না লিয়ার। লিয়া দরজাটা ভিড়িয়ে রেখে এক পা দু পা ফেলে এগিয়ে আসে। জারিফের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।জারিফ একপলক লিয়াকে দেখে নিয়ে ফোনটা পকেটে পুরতে থাকে। লিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“হ্যাপি? এবার হ্যাপি?না আসলে তো রা’গ করে থাকতেন।”

জারিফ লিয়ার দিকে ঝুকলো।লিয়ার কাঁধের উপর দিয়ে একহাত সামনের দেয়ালে রাখলো।লিয়ার কপালের উপর থাকা এলোমেলো চুলগুলো ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেয়।লিয়ার মুখশ্রীতে সুগভীর চাহনিতে চেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

“নিউটনের তৃতীয় সূত্রে, প্রত্যক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। কিন্তু সেই হিসেবে আমার ক্ষেত্রে এই সূত্র ভুল হচ্ছে।কারন আমি যে গতিতে তোমাকে ভালোবাসা প্রদর্শন করি। তুমি সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখাও না।”

লিয়া কপাল কুঁচকে তড়িৎ বলে উঠলো,”হোয়াট?এরকম বলছেন কেনো?”

জারিফ নির্বিকার চিত্তে বলল,”এইযে তুমি দায়সারা ভাবে আসছো।আমি বলেছি।তাই তুমি কথাটা রাখতে আসছো।ভালোবাসা,টান মহব্বত থেকে তো আর আসোনি।”

লিয়া এবার বিষয়টা টের পায়।না আসলে আপনি রা’গ করতেন এই কথাটা বলায় জারিফের হয়তো অভিমান জমেছে।লিয়া মৃদুস্বরে বলল,”আপনি ভুল ভাবছেন।আমি ওভাবে বলিনি।আসলে নতুন জায়গা।আসতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো।আর কি যেনো বলছিলেন?ও হ্যা মনে পড়েছে।আপনি যেভাবে ভালোবাসা প্রদর্শন করেন।আমি সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাইনি।তাই বলছিলেন তো?রাইট?”

জারিফ তৎক্ষনাৎ মাথা উপর নিচ করে হ্যা সম্মতি দেয়।লিয়া দুইহাতে জারিফের টিশার্টের কলার ধরে।নিজের দিকে আরো খানিকটা জারিফকে ঝুঁকে নেয়।ভ্রু বাঁকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,”এইযে মিস্টার?আপনি কতদিন থেকে ভালোবাসা প্রদর্শন করছেন,হ্যা? কয়দিন হলো আমাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন?বড়জোড় তিনমাস খানেক হবে হয়তো।আর আমি?আমি তো এরও আগে থেকে আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি।আপনাকে ফাস্ট দেখার পর থেকেই আপনাকে নিয়ে আমি ছোট ছোট স্বপ্ন বুনতে থাকি।আপনাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে আপনার ভাবনায় নিজেকে ডুবে ফেলি। আপনার ইগনোর আমার সয্য হতো না। ভীষণ কষ্ট হতো বুকের ভেতর ।তবুও নির্বাক ছিলাম।আর আপনি। আপনি কিনা দুদিন হতে না হতেই অভিযোগ পত্র তুলে ধরছেন।এই হলো পুরুষ জাতির ভালোবাসা। দুদিনেই তারা অস্থির হয়ে যায়।”

জারিফ মুচকি হেসে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। দুষ্টুমির স্বরে বলল,”অস্থির কি আর সাধে হই?সুন্দরী পিচ্চি বউ যার আছে।সেই বুঝবে এই অস্থিরতার কারণ।তার উপরে বউ দূরে থাকে।বলা তো যায়না কখন কার নজর লেগে যায়।সেই টেনশনে সারারাত ঠিকঠাক ঘুমোতে পারিনা।বউ পাশে থাকলে।বুকে থাকলে হয়তো টেনশনটা কমতো।আর প্রশান্তিতে ঘুমোতেও পারতাম।বরের নিদ্রা হারাম করে, নিজে তো ঠিকই আরামে ঘুমাচ্ছো।”

লিয়া দুইহাতে জারিফের গলা জড়িয়ে ধরে ।অবাক হওয়ার অভিনয় করে ঠোঁট টিপে বলল,”বাহবা!তাই নাকি? জানতাম না আমার জন্য কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে।আমি কারো নিদ্রাহীনতার কারণ।”

“ইয়েস!অফ কোর্স।তুমি আমার নিদ্রাহীনতার কারন।”

লিয়া জারিফের বুকে মাথা রাখলো। কণ্ঠে একরাশ কোমলতা নিয়ে বলল,”কারণ যখন আমিই।তাহলে তো প্রবলেমটা আমাকেই সলভ করতে হয়।আমাকে পাশে পেলে কারো যদি প্রশান্তির ঘুম আসে।সে যদি দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকতে পারে।তাহলে নাহয় আমিও রাজি তারপাশে থাকতে।আপনি সন্ধ্যায় আমার মতামত শুনতে চেয়েছিলেন।এটাই আমার মতামত।সময়ের ব্যবধান দূরে ঠেলে দিলাম। আপনার চাওয়াকে সানন্দে প্রায়োরিটি দিলাম। নিজেকে আপনার তরে সঁপে দিতে কোনো বাঁধা নেই আমার।”

জারিফ খুশিতে লিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।জারিফের ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির বিস্তৃত হাঁসির ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে জারিফ লিয়াকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর জারিফ শান্ত কণ্ঠে বলল,”থেংকিউ। থেংকিউ সো মাচ্ ইয়া হাবিবী।”

লিয়া বিনিময় মিষ্টি হাসলো।জারিফ ইশারা করে বলল,”চলো। আজকের রাতটা স্মরণীয় করে রাখি।সারারাত না ঘুমিয়ে চন্দ্র বিলাসে মত্ত হই।আর স্পেশাল টাইম স্পেন্ট করি।”

লিয়া চোখের পলক ফেললো। চমৎকার হাসলো।জারিফের সাথে লিফটের সামনে দাঁড়ালো।লিফট বন্ধ দেখে জারিফ কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে বলল,
“বাড়িওয়ালা নিশ্চয় খুব কিপটে।রাতে লিফট বন্ধ করে রাখে দেখছি। উফ্!কি আর করার। সিঁড়ি বেয়ে চলো।”

শেষের কথাটা লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল।লিয়া জারিফকে শুধায়,”আপনি না তখন ফোনে বললেন ছাদে।তখন কিভাবে গ

লিয়ার কথার মাঝেই জারিফ বলল,”আমি সিঁড়ি দিয়েই গিয়েছিলাম।”

লিয়া ঠোঁট উল্টে বলল,”ওহ্।”

একটু থেমে ফের লিয়া বলল,”এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?নাকি বাড়িওয়ালাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে লিফট চালু করতে বলার প্লান করছেন? বাড়িওয়ালা যখন জিজ্ঞেস করবে,এত রাতে কি দরকার?তখন কি বলবেন শুনি?”

কথাটা শেষ করে লিয়া নিঃশব্দে হাসলো।জারিফ মুগ্ধ হয়ে নিষ্পলক চাহুনিতে লিয়ার হাসি দেখলো।জারিফ সহসা প্রত্যুত্তরে বলে উঠল,”বলবো আমার বউয়ের সাথে চন্দ্র বিলাস করবো।সো ছাদে যাওয়া এসেনশিয়াল।আর সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে আমার বউয়ের কষ্ট হবে।তাই লিফটা আজকের জন্য এইসময় চালু করে আমাকে বাধিত করুন।”

লিয়া একহাতে মুখচেপে ধরে হাসতে থাকে। কোনো রকমে হাসিটা থামিয়ে লিয়া ঠোঁট আওড়ালো,
“ফা’জ’লা’মো কথাবার্তা রাখুন। কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়েই যেতে হবে।তাই আজেবাজে বকে টাইম ওয়েস্ট না করে চলুন।”

জারিফ আচমকা লিয়াকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,”জারিফ থাকতে তার বউকে কষ্ট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে না।আর নাতো লিফটের প্রয়োজন পড়বে।জারিফ একাই এনাফ।তার বউয়ের জন্য।”

নিজেকে শুণ্যে আবিষ্কার করতেই লিয়া হতভম্ব হয়।লিয়া দুইহাতে জারিফের গলা জড়িয়ে ধরে।চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে।লিয়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,”এই নামান, প্লিজ।পরে যাবো তো।”

মনেহয়না কথাটা জারিফের কর্ণে প্রবেশ করেছে।লিয়ার কথার উপর কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে জারিফ।লিয়াকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ছয়তলায় ফ্ল্যাটটা।আর বিল্ডিং টা আটতলা।জারিফ ধুপধাপ পা ফেলে প্রতিটা সিঁড়ি অতিক্রম করছে। খানিকটা যেয়ে জারিফ মজার ছলে বলল,”তোমাকে যতটা থিন দেখা যায় ‌।তবে ওয়েট তো দেখছি ভালোই আছে।আমার হাত লেগে আসছে দেখছি।”

“এই আপনি আমাকে ইনডাইরেক্টলি মোটা বললেন কিন্তু।”

“ওয়েট কত তোমার?”

“কোলে তুলেছেন।গেইস করুন?”

“উমম! ফোর্টি ফাইভ থেকে ফিফটি কেজি হবে হয়তো।”

“ভালোই তো অনুমান করতে পারেন দেখছি। ফোর্টি এইট কেজি।যা আমার হাইট অনুপাতে একটু কমই,হু।”

কিছু ভেবে লিয়ার কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পরে।লিয়া ছোট ছোট করে চাইলো।ফের শুধালো,”এই আপনার অনুমান এতটা কাছাকাছি গেলো কিভাবে?হ্যা। আপনি এর আগে আরো কাউকে কোলে টোলে নিয়েছেন বোধহয়।সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন।তাইনা?”

মেয়ে মানুষ নাকি সব সময় দুইলাইন বেশি বোঝে।কথাটা সত্যি কিনা জারিফ জানে না। ‌তবে লিয়ার কথাবার্তা শুনলে সেই সময় জারিফের মনেহয় কথাটা লিয়ার ক্ষেত্রে একদম এপ্রুপেইট। এরমধ্যে ছাদের গেইট পার হয়ে জারিফ লিয়াকে আস্তে করে নামিয়ে দেয়।জারিফ ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।দুই আঙ্গুলের সাহায্যে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলল।লিয়া কপাল কুঁচকে ফের বলল,

“উত্তর দিলেন না যে? তারমানে আমার ধারনা সত্যি।আমাকে কোলে তুলার আগে মিস্টার আয়মান জারিফ এভেলএভেল মেয়েকে কোলে তুলেছে।”

জারিফ ধমক দিয়ে বলল,”থামবে। কখন থেকে বাচ্চাদের মতো এক-ই কথা বলে যাচ্ছো।বিয়ের আগে অন্য কোনো মেয়েকে অনিচ্ছাকৃতভাবে টাস করে থাকা মেয়েও তুমি।বুঝলে?আর সেখানে কাউকে কোলে নেওয়া ইম্পসিবল। ক্লিয়ার?”

লিয়া ভাব নিয়ে বলল,”আই নো।তারপরেও মাঝেমাঝে একটু বাজিয়ে দেখতে হয়।ছেলে মানুষের আবার ছুকছুকানি স্বভাব একটু বেশিই নাকি থাকে।”

“ছুকছুকানি।এইসব ওয়ার্ড তুমি আমার উপর এ্যাপ্লাই করো।কোথায় ভাবলাম একটু স্পেশাল টাইম স্পেন্ট করবো।এদিকে তুমি তো আছো সবকিছু স্পয়েল করতে।মেজাজ খা’রাপ করতে তোমার জুড়ি নেই।”

লিয়া দুইহাত বুকে গুঁজে স্ট্রেইট দাঁড়ালো। ঠোঁট উল্টে বলল,”সবাই ঘুমিয়ে আছে। সেখানে আমরা দু’জন নিশাচর প্রাণীর মতো জেগে আছি।তাও আবার ছাদে।”

জারিফ কিছু না বলে সামনে এগিয়ে যায়।শান বাঁধানো পাকা করা বসার জায়গায় জারিফ গিয়ে বসলো। অগত্যা লিয়াও পিছপিছ গিয়ে বসলো।আকাশে হাজার হাজার তাঁরার মেলা বসেছে। তারই মাঝে আকাশের বুকে মস্ত বড় চাঁদটা রুপালি আলো ছড়াচ্ছে। চাঁদের আলোয় চারিদিক মৃদু আলোকিত।চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।হালকা বাতাস বইছে।মৃদু ঠান্ডা বাতাসে লিয়ার সমস্ত শরীরটা শিহরিত হলো।জারিফ আচমকা লিয়ার কোলের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।লিয়ার কাছে মূহূর্তটা বেশ ইনজয়েবল লাগছে।লিয়ার হাতটা আপনাআপনি জারিফের চুলের মাঝে যায়।লিয়া একহাতে জারিফের ঘন স্লিকি চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করতে থাকে। দু’জনের মধ্যে নীরবতা বইছে। দু’জনের কাছেই সময়টা খুব স্পেশাল লাগছে। মিষ্টি রাত সাথে চাঁদের জোসনা। দুইজন মানব মানবীকে সিক্ত করছে মিষ্টি চাঁদের জোসনা।ক্ষনে ক্ষনে গা ছুয়ে দিচ্ছে চাঁদের মিষ্টি আলো। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চতুর্দিক।জোসনা মাখা মিষ্টি রাত।দূর থেকে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার গান। উফ্! সব মিলিয়ে চমৎকার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রিয় মানুষের সাথে এই চমৎকার পরিবেশে সময় কাটাতে লিয়ার মন্দ লাগছে না। বরং অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে।মনে হচ্ছে সময়টা এভাবেই থেমে থাক।এই জোসনা রাত।দুজনে খুব কাছাকাছি অবস্থান।সব কিছু এমনই থমকে থাক।কি দরকার ভালো সময়গুলোর বয়ে যাওয়ার?তবে সময় সে তো তার আপন গতিতে চলে।

জারিফ হঠাৎ আদূরে স্বরে বলল,”লিয়া?”

লিয়া তৎক্ষনাৎ মৃদু আওয়াজে বলে উঠলো,”হুম।”

জারিফ স্বাভাবিকভাবে বলল,”আমি চাইনা আমার জন্য তোমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হোক। সংসার করতে গিয়ে যদি পড়াশোনার উপর ইফেক্ট করে তাহলে বলবো, প্রবলেম নেই আমি ওয়েট করবো।তুমি তোমার মতো করে লেখাপড়া চালিয়ে যাও।এভাবেই চলবে।”

লিয়া বলল,”সংসার করেও পড়াশোনা করা যায়।আর আপনাকে পাশে পেলে ক্ষতি নয় বরং আমার উপকারই হবে।আপনাকে গাইড হিসেবে পাবো।”

জারিফ শব্দহীন হাসলো।দুইহাতে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে । কিয়ৎক্ষন পরে জারিফ শীতল কণ্ঠে ফের বলল,”আমি ভেবেছি নতুন করে আমাদের বিয়ের প্রোগ্রাম করবো।হলুদ, মেহেন্দি,বিয়ে,বৌভাত সব বড় করে করবো। সবাইকে ইনভাইট করবো।সবাইকে জানিয়ে তোমাকে উঠিয়ে নিবো।বিয়ের প্রতিটা বিষয় ইনজয় করবো।”

লিয়া মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করতে থাকে।এভাবে এটাসেটা গল্প করতে করতে অনেক সময় কে’টে যায়। একপর্যায়ে জারিফ শোয়া থেকে উঠে বসলো।বলল,”তোমার কোলে মাথা রেখে আমার তো চোখ জুড়ে প্রশান্তির ঘুম নামতে চাইছে।”

“তাহলে উঠলেন কেনো?ঘুমান।”

“আমি শান্তি করে ঘুমাবো আর তুমি এভাবে বসে থাকবে।সেই শান্তির ঘুম আমার চাই না।চলো বাসায় যাই।গিয়ে ঘুমাবে।”

লিয়া আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নামতে থাকে। সিঁড়িতে পা দেওয়ার সময় জারিফ মজা করে বলে,”কোলে নিতে হবে?”

লিয়া মৃদু হেসে বলে,”ধ্যাত। লাগবে না।”

জারিফের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে জারিফ চলে যায়।লিয়াও রুমে যায়।তুলি ঘুমের মধ্যে নড়ে লিয়ার বালিশে চলে এসেছে প্রায়।এটা দেখে লিয়া হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বিছানার কিনারায় অল্প যায়গা আছে।লিয়া কোনোমতে সেই জায়গায় কাৎ হয়ে শোয়।এই তুলি আরেকটু নড়লে লিয়া সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে ঘুমের মধ্যে নির্ঘাত ফ্লোরে পড়বে।এই ভ’য়ে লিয়া সহজে দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না।লিয়া উঠে বসলো।দুইহাতের সাহায্যে তুলিকে খানিকটা সরিয়ে দেয়। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।চোখ বন্ধ করে।সাথে সাথেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসে লিয়ার দুচোখে।
.
তাসনিম হালকা গোলাপি কালারের শাড়ি পড়েছে। ড্রয়িংরুমের সোফায় তুলি আর ইভার সাথে বসে গল্প করছে।লিয়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।তাসনিমের আর্লি ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস।ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই তাসনিম ঘুম থেকে জাগে।নতুন জীবনের নতুন একটা ভোরের সূচনা হয় তাসনিমের। দারুণ অনুভূতি ছিলো।সাথে ছিলো একরাশ লজ্জা।ঘুম ভেঙ্গে স্বামী নামক পরম আপনজনের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ পায় নিজেকে। আলিফের বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। কিছু সময় রুমে কাটায়।সাতটা বাজতেই বাইরে আসে। কিচেনে আতিকা বেগমকে দেখতে পায়। সেখানে সাহায্য করতে গেলে আতিকা বেগম ঘোর আপত্তি করে।নিজের সংসার সব কাজ করবে। সমস্যা নেই।তাই বলে আজ প্রথম দিন। ‌আজকে কিছু করা যাবে না।ধীরে ধীরে রয়েসয়ে করবে। অতঃপর তাসনিম ড্রয়িংরুমের দিকে আসতেই ইভাকে দেখতে পায়। এরমধ্যে তুলিও আসে।ওদের দুজনের সাথে গল্প করতে থাকে। এরমধ্যে আলিফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়।জারিফকে ডেকে নিয়ে বাইরে যায়।

ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর পেরিয়েছে।লিয়া ঘুম থেকে জেগে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পরে। ফ্রেশ হওয়া সত্ত্বেও লিয়ার চোখে এখনো ঘুম পাচ্ছে।নতুন জায়গা দেখে লিয়া উঠে পড়েছে। নিজের বাসা হলে যে পরিমাণ ঘুম এখনো পাচ্ছে নিশ্চিত দশটার দিকে উঠতো।তুলি লিয়ার দিকে সরু চাহনিতে চাইলো।কপাল কুঁচকে ফিসফিসিয়ে বলল,”কি ব্যাপার লিয়া এতো দেরি হলো ঘুম থেকে উঠতে। নরমালি তুইতো এতো দেরি করে উঠিস না।সকাল সকালই তো উঠিস।যাদের আজ দেরি করে উঠার কথা তারা সকাল সকালই উঠলো।মাঝখানে তুই নিউ রিলিটিভের বাসায় এসে কিনা আটটা পার করে ঘুম থেকে জাগলি।”

লিয়া একহাতে একটা কুশন কোলের উপর রাখলো।ভ্রু যুগল কুঁচকে হামি দিতে দিতে বলল,”আজানের একটু আগেই ঘুমিয়েছি। পর্যাপ্ত ঘুম হয়নি।তাই এখনো ঘুম পাচ্ছে।”

তুলি বড়বড় চোখ করে চাইলো।তুলির এভাবে তাকানোতে লিয়া থতমত খায়।লিয়া কিছু বলার আগেই তুলি বিস্মিত কণ্ঠে বলল,”আজানের আগে ঘুমিয়েছিস।সারারাত কি করলি?কোথায় চু’রি করতে গিয়েছিলি,হ্যা?যে সারারাত না ঘুমিয়ে চো’রেদের মতো ভোর রাতে বাড়ি ফিরে আজানের সময় ঘুমিয়েছিস?”

লিয়ার শুকনো কাঁশি উঠে।লিয়া খুকখুক করে কাঁশতে থাকে। তাসনিম বসা থেকে লিয়ার পাশে উঠে এসে দাঁড়ায়।একহাত লিয়ার পিঠে রাখে। লিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে সোজা হয়ে বসলো। তাসনিম তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,”আহ্!তুলি।কি তখন থেকে এক-ই কথা বলছিস।ও এখন উঠেছে তাতে সমস্যা কোথায়?আর নতুন জায়গা রাতে হয়তো ঠিকঠাক ঘুমোতে পারেনি।”

লিয়া মনেমনে খুব করে চাইছে দ্রুত প্রসঙ্গটা পাল্টাতে। উফ্!কিকরে তুলিকে বলবে?রাতে বরের সাথে খোলা আকাশের নিচে বসে চন্দ্র বিলাস করেছে।সাথে মিষ্টি মধুর গল্প স্বল্প। এরমধ্যে আতিকা বেগম ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকেন।লিয়া যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

ভালোভাবে রিসেপশন শেষ হয়। লিয়া তুলি সেদিনই বাসায় ফেরে। দাদুবাড়িতে আরো তিন-চারদিন থাকার পর লিয়ারা ওদের বাসায় আসে।লিয়া এডমিশনের প্রিপারেশনের জন্য কোচিং এ ভর্তি হয়। পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করে। জারিফের সাথে রোজ ফোনে কথা হয়।দেখতে দেখতে ভর্তি পরীক্ষার দিন আসে।পরীক্ষার রেজাল্টও দেয়।লিয়া জারিফদের ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। এগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টিতে।জারিফ প্লান্ট প্যাথলজির লেকচারার। আলিফের বিয়ের পর জারিফের সাথে লিয়ার দেখা হয়নি। রেজাল্ট দেওয়ার দিন জারিফ লিয়াদের বাসায় মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো।জারিফের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষা নিয়ে জারিফ নিজেও ব্যস্ত। জারিফ বলেছে,লিয়ার ফাস্ট ইয়ারে থাকাকালীনই বিয়ের প্রোগ্রাম করা হবে।কয়েকমাস ক্লাস করুক তারপর।
.
কে’টে গিয়েছে কয়েক মাস।আজকে লিয়া প্রথম ভার্সিটিতে যাবে। যদিও ক্লাস গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার জন্য লিয়া প্রথম সপ্তাহ থেকে যেতে পারেনি। আজকে যাবে।লিয়া শাওয়ার নিয়ে একদম রেডি হয়ে ডায়নিং এ আসে।রাজিয়া সুলতানা লিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। লিয়া ব্রেডে জেল জড়িয়ে নিয়ে হালকা করে বাইট দেয়।রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে শুধালেন,

“লিয়া আজকে প্রথম ক্লাস ভার্সিটিতে ।জারিফ কি এসে নিয়ে যাবে?না মানে এক-ই যায়গা তাই বলছি আরকি।”

লিয়া খাবার চিবাতে চিবাতে বলল,”নাহ্।বলেছিলো।তা আমি নিষেধ করেছি।ওনার এক্সাম চলছে।আজকে তো একটা এক্সাম আছে।আজ বাদে আর একটা এক্সাম আছে বোধহয়।”

রাজিয়া সুলতানা ছোটো করে বললেন,”ওহ্।”

একটু সময় নিয়ে ফের বললেন,”আচ্ছা আমি ড্রাইভারকে ফোন করে আসতে বলি।”

লিয়া ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়। প্রথম দিন ভার্সিটিতে যাবে।কেমন জানি আনইজি লাগছে লিয়ার।লিয়া আকাশী কালারের সুতি থ্রি পিস পড়েছে।উপরে সোনালী সুতি দিয়ে দারুন কারুকার্য করা। লম্বা ঘন চুলগুলো খোলা রেখে দেয়।মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে।
.
লিয়া ক্লাসে বসে আছে। পাশে একটা মেয়ে বসে আছে।নাম অরিন।সে কি কথা বলে! উফ্!দশমিনিট বসতে না বসতেই চৌদ্দ গুষ্টির কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।সাথে লিয়াকে প্রশ্ন করছে।গত সপ্তাহে কেনো আসেনি?অরিনের এটাসেটা বকবকানিতে লিয়ার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।মাথা ধরিয়ে ফেললো এই মেয়ে। লিয়া ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে আছে।অরিন খুশিতে গদগদ হয়ে এক্সাইটেড হয়ে বলল,

“জানো।একটু আগে করিডোর দিয়ে আসতে পথে শুনলাম।আজকে নাকি একটা নিউ টিচার ফাস্ট ক্লাসে আসবে।আমি তো ভীষণ এক্সাইটেড টিচারটা দেখতে কেমন হবে? ক্রাশ টাশ খেয়ে বসবো কিনা।আয়হায়!এসব ভেবে এখনই তো আমার লজ্জা লাগছে।আমি বারবার প্রে করছি।টিচারটা যেনো আ্যনম্যারিড হয় আর দেখতে যেনো হ্যান্ডসাম হয়।অবশ্য টিচারের নাম শুনেই আমি ক্রাশ খেয়ে বসে আছি।ওয়াও!কিতনা সুন্দর নাম।”

লিয়া থমথমে মুখাবয়ব করে আছে।এইতো মিনিট পনের হবে এই মেয়ের সাথে আলাপ হয়েছে।আর সে কিনা একদম পেটের কথা উগড়ে দিচ্ছে। উফ্!ভাবা যায়। লিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই নতুন টিচার ক্লাসে ঢোকে।নতুন টিচারকে চিনতে লিয়ার থার্টি সেকেন্ডের মতো সময় লাগে।লিয়া মস্তিষ্কে চাপ দিতেই ফেসটা ম্যাচ হয়।লিয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে।নতুন টিচারের গায়ে পিৎ কালারের শার্ট।কালো প্যান্টের সাথে ইনকরে পরা।দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম। অধিকাংশ মেয়েরা হা করে তাকিয়ে আছে।আর লিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here