#সুখের_ঠিকানা
#শারমিন_হোসেন
#পর্ব৩৭
জারিফের এহেন লাগামহীন কথায় লজ্জায় আড়ষ্টতায় লিয়া মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হয়।জারিফ একহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে অন্যহাতে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে। লিয়ার দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করে।লিয়া তৎক্ষনাৎ এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে বিছানা থেকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নামতে নামতে জড়তা নিয়েই বলল,
“আরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?বসুন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
লিয়া বেড ছেড়ে নেমে দু কদম যেতেই হাতে টান পরে।জারিফ লিয়ার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে নেয়।লিয়া মোচড়ামুচড়ি করতে করতে একবার দরজার দিকে চাইল। ফ্যানের বাতাসে লিয়ার কপালের উপর ছোটছোট কিছু চুল এসে পড়ছে।জারিফ ঠোঁট গোল করে ফু দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। উফ্!এই ছোট্ট কাজটা করতে জারিফের কি যে ভালো লাগে।লিয়ার মোচড়ামুচড়ি দেখে জারিফ শক্ত করে লিয়ার কোমড় জড়িয়ে ধরল। জারিফের চোখে মুখে দুষ্টুমিরা ভর করেছে।জারিফ লিয়ার লজ্জা পাওয়া ফেসটা দেখে ইনজয় করছে। উফ্!এই মূহুর্তটা জারিফের কাছে খুবই চমৎকার লাগছে।জারিফ লিয়াকে আরেকটু লজ্জায় ফেলতে টিপ্পনি কে’টে বলল,
“বারবার দরজার দিকে তাকিয়ে শুধুশুধু লজ্জা পাওয়ার মানে হয় না।আমাদেরকে কেউ ডিস্টার্ব করতে আসবে না।বাসায় তোমার আম্মু ছাড়া আর কেউ আপাতত নেই।আর শ্বাশুড়ি মা জানে মেয়ে জামাই রুমে আছে।সো ভুলেও এদিকে পা রাখবেন না।তাই লজ্জা পাওয়া বাদ দাও।বরের সাথে মুহূর্তগুলো কিভাবে স্পেশাল করবে তাই ভাবো।”
লিয়ার কণ্ঠনালী দিয়ে কোনো শব্দই যেনো বের হচ্ছে না।গলাটা শুকিয়ে আসছে।লিয়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ছটফট করতে থাকে।জারিফ একটু সময় নিয়ে ফের বলল,
“কিহলো মিসেস জারিফ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালাই পালাই করছে কেনো? মিসেস জারিফ এতোটা ভিতু আমার জানা ছিলো না।ভ’য় পাচ্ছে নাকি লজ্জা?কোনটা?ভ’য় বা লজ্জা যেটাই হোক না কেনো।আমি দুইটাই ভাঙ্গাতে চাই।ভ’য় কে জয় করে লজ্জাকে হরণ করতে চাই।যদি অনুমতি পাই।”
লিয়া আমতা আমতা করে বলল,”ভ’য় বা লজ্জা কোনোটাই নয়।তাই এসব ভাঙ্গানোর প্রশ্নই উঠছে না।আর পালানোর কি আছে?আমি তো ফ্রেশ হতে যাচ্ছি, হুঁ।”
জারিফ মৃদু হাসল।বলল,”ওহ্!তাই নাকি?তবে আজকে তোমাকে অন্যরকম লাগছে।ঘুমঘুম চোখমুখে তোমাকে মারাত্মক সুন্দর লাগছিলো। এখনো লাগছে।ওড়না ছাড়া তোমাকে একটু বেশিই হট লাগছে।”
গায়ে ওড়না নেই লিয়ার এতক্ষণে খেয়াল হলো। সচরাচর রুমের মধ্যে একা থাকলে ওড়নাটা অবহেলায় বিছানার একপাশে, চেয়ারে বা অন্যথায় পরে থাকে। এখনও অমনি বিছানার বালিশের পাশে আছে ওড়নাটা।লিয়ার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। লিয়া একহাত দিয়ে পিঠের উপর থাকা চুলগুলো কাঁধের উপর দিয়ে সামনে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।জারিফ দুষ্টুমির স্বরে ফের বলল,
“তোমার এলোমেলো ঘুমন্ত অবস্থার ছবি আমি আমার ফোনের ক্যামেরায় বন্দি করেছি।উফ্ফ!আমার চোখে এখনো ভাসছে। বুকের ভেতর কেমন জানি মা’তা’ল মা’তাল বাতাস বইছে।কোনো নেশা না করেই নে’শা ধরে গিয়েছে।বুকের ভেতর ভয়ংকর রকমের প্রেম পিপাসা পাচ্ছে।”
লিয়া দাঁত কিড়মিড় করে বলল,”রাখেন তো আপনার প্রেম ট্রেম।আপনার দুষ্টু সত্তাকে কন্ট্রোল করেন। সাথে মুখটাকেও।সে দিনদিন খুবই লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে।”
“ছবিগুলোতে তোমাকে সত্যিই মারাত্মক হ
কথার মাঝেই লিয়া একহাত দিয়ে জারিফের মুখটা চেপে ধরল।লিয়া ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলল,”এ্যা!আপনি এসব কখন করলেন?এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়।একজনের ঘুমের সুযোগ নিয়ে।আবার তার অনুমতি ব্যতীত এসব কিছু। ছিঃ ছিঃ এটা কিন্তু কোনো ভদ্র সভ্য লোকের কাজ নয়।তাই বলছি দ্রুত ছবিগুলো ডিলেট করে দিন।অভস্যতা বাদ দিন।”
জারিফ স্মিত হাসল। লিয়ার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,”উই আর ম্যারিড লিয়া।এটা সিমপেল ব্যাপার।তাই অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।আর বউয়ের মুখ নিঃসৃত অসভ্য শব্দটা শুনলে অন্যরকম ফিলিংস আসে।যা তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না।”
লিয়া শান্ত হয়ে রইল। কিয়ৎকাল পরে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল,”ছাড়ুন! ফ্রেশ হয়ে আপনার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি।কি খাবেন বলুন? চা অর কফি?কোনটা?”
“কোনটাই খেতে ইচ্ছে করছে না।কারন তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।তোমাকে পাশে পাওয়ার সময়টা খুবই কম হয় আমার জন্য। এইটুকু সময় তোমার সঙ্গ নিয়ে আমি স্যাটিসফাইড নই।আরো বেশি সময় ধরে তোমাকে কাছে পেতে চাই। আমি আজকে বাড়িতে গিয়ে মা’য়ের সাথে কথা বলবো।এই শুক্রবারেই বাবা মা’কে তোমাদের বাসায় পাঠাব।তোমাকে আমার ছোট্ট কুঁড়েঘরে নেওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করতে।আমার সুখের নীড়ে তোমাকে খুব শীঘ্রই নিতে চাই।আর ওয়েট করতে মোটেই রাজি নই আমি।তোমাকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার দিনদিন তীব্রতর হচ্ছে।তোমাকে ছাড়া একদম ভালো লাগছে না।আর আমি ভেবেছি আমার বিয়েতে আমার কলিগদেরকে ইনভাইট করবো। তার মাধ্যমেই সবাই জানবে তোমার আমার সম্পর্কের কথা।”
লিয়া বিনিময় স্মিত হাসল।জারিফ ফের কণ্ঠে শীতলতা ঢেলে বলল,”ভার্সিটিতে আজকে আমার উপর ভীষণ ক্ষেপে ছিলে।পুরো ক্লাস টাইম তোমাকে নোটিস করেছি। একবারও আমার দিকে তাকালে না। রা’গে গালটা কমলার মতো ফুলে রেখেছিলে।সেই মুহূর্তে তোমাকে দারুণ লাগছিলো।তোমার টসটসে গোলাপী দুইগাল রা’গলে পরে আকর্ষণীয় লাগে। সেইসময় তো আমার ইচ্ছে করছিলো টুপ করে তোমাকে খেয়ে ফেলতে।”
লিয়া বড়বড় চোখ করে জারিফের দিকে চাইল।জারিফ লিয়ার ফর্সা গালে চুমু খেলো।লিয়া কপাল কুচকালো।জারিফ লিয়ার নাকে নাক ঘষে নিয়ে ফের বলল,
“লাঞ্চের টাইম আমার উপরের সমস্ত রা’গ তো নিরীহ চেয়ারটার উপর ঝাড়লে।আমি তো ভাবলাম নে চেয়ারটা বোধহয় শেষ।এবার জরিমানাটা আমাকেই দিতে হবে।”
জারিফ মজার ছলে শেষের কথাটা বলল।লিয়া ত্যাড়া করে বলল,”বউয়ের জন্য নাহয় জরিমানা দিতেন। সমস্যা কোথায়?অন্য নারীকে নিয়ে লাঞ্চ করতে পারেন।বিল দিতে পারেন।আর বউয়ের জন্য এতটুকু তো কিছুই মনে হওয়ার কথা নয়।”
“বউয়ের জন্য তো দরকার পড়লে হৃদপিন্ডটাও দিয়ে দিতে পারি। সেখানে এটা তো তুড়ি বাজানোর মতোও বিষয় না। আচ্ছা লিয়া যাগগে এসব কথা বাদ দাও।এবার বলো আমার উপর আর রেগে নেই তো।”
লিয়া জারিফের শার্টের কলারে হাত রাখল। ঠিক করতে করতে বলল,”কেউ যখন বাসায় আসে।কারো কাছে আসে। তারপরেও রা’গ করে থাকাটা ঠিক হবে না।কারন আপনি যেহেতু আসছেন আপনার সম্পুর্নটা নিয়েই আসছেন। অর্ধেক মন রেখে আর অর্ধেক মন নিয়ে এরকম নয়।আপনি আপনার সম্পূর্ণ মনটা নিয়েই আমার কাছে আসছেন।এরপরেও যদি আমি রে’গে থাকি।তাহলে নিজেকেই আমার রং মনে হবে।এটা অবশ্য অনলি আমার থিওরি।অন্যদের কথা জানিনা।”
“বাহ্! দারুণ ইউনিক থিওরি তোমার!তবে চমৎকার!আমি এপপ্রিসিয়েট করছি তোমাকে এবং তোমার থিওরিকে।”
লিয়া জারিফের বুকের উপর মাথাটা রাখল।কোমল গলায় বলল,”আর আমি আপনাকে চিনি তো।তাই শুধুশুধু ভুল বুঝে রা’গ করে থাকা বড্ড বো’কা’মি হবে।তবে কোনো মেয়েই তার ব্যক্তিগত পুরুষকে অন্য মেয়ের সাথে সয্য করতে পারে না।আমিও তাদের ব্যতিক্রম নই।ঠিক আমিও পারিনা।আর কখনো পারবও না।এমনিতেই সকাল থেকেই আপনার উপর অভিমান জমেছিলো।তারপরে আপনাকে কবিতা ম্যামের সাথে দেখে ভীষণ রা’গ হয়েছিলো।”
জারিফ লিয়ার চুলের মধ্যে একহাত বুলিয়ে বলল,
“এখনো কি রা’গ টা আছে , ম্যাম?”
লিয়া নিঃশব্দে হাসল।লিয়া একটু ত্যাড়া করে ফের বলল,”উঁহু!তবে এরকম বুঝি রোজরোজ কবিতা ম্যামের সাথে লাঞ্চ করেন?”
“আরে না।আজকেই ফাস্ট।”
কথাটা বলতে বলতে জারিফ লিয়ার মাথাটা কাঁধ থেকে তুলল।লিয়ার কাঁধের উপর দিয়ে দুইহাত রাখল। সুগভীর শান্ত নজড়জোড়া লিয়ার মায়াবী চোখে রেখে বলল,”তোমাকে তো লাঞ্চে কল দিলাম।আবার মেসেজ দিলাম।তুমি তো আসলে না।আর কবিতার সাথে আজ হঠাৎ টাইমিং টা হয়ে গিয়েছে এতটুকুই।আমি আ্যজাম করেছিলাম তুমি এটা নিয়ে অভিমান করে থাকবে।আর আমার আ্যজামটা সঠিকই হলো।আমি তো তোমাকে চিনি।ভালো করে না ভেবে তুমি রিয়াক্ট করবে।নিজে কষ্ট পাবে আর আমাকেও কষ্ট দিবে।তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না তখন নিজেকে এলোমেলো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো তখনই ছুটে আসি। অবশেষে মিথ্যে অজুহাত দিয়ে বউয়ের অভিমান ভাঙ্গাতে আসলাম।না এসে থাকতে পারলাম না। শ্বাশুড়ি মা কে বলেছি তার মেয়েকে পড়াতে আসছি।এখন যদি কেউ দেখে তবে বলবে কেমন পড়া বুঝাচ্ছে।”
লিয়া ঠোঁট চওড়া করে হাসল।বলল,”তা দারুণ বোঝাচ্ছে।”
জারিফ আফসোসের স্বরে বলল,”তা বুঝাতে দিচ্ছো আর কই?একবার সুযোগ দাও বুঝিয়ে দ
জারিফের কথার মাঝেই লিয়া দরজার দিকে তাকিয়ে মিছেমিছি বলল,”ঐযে আম্মু আসছে।”
জারিফ লিয়াকে ছেড়ে দেয়।লিয়া শব্দ করে হাসতে থাকে।একহাতে মুখ চেপে ধরে লিয়া হাসছে।লিয়ার ফা’জ’লা’মো বুঝতে জারিফের কয়েক সেকেন্ড লাগল।জারিফ একহাতে মাথার পিছনের চুল চুলকিয়ে মৃদু হাসল।জারিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লিয়া হাসতে হাসতেই ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।লিয়া বুঝতে পেরেছিলো জারিফ লাগামহীন কথাবার্তা বলবে। জারিফকে থামিয়ে দিতেই দুষ্টু বুদ্ধি করে।লিয়া চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে বের হয়ে জারিফকে রুমের কোথায় দেখতে পায়না।ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়াতেই একটু দূরে জারিফকে দেখতে পায়।লিয়া বলল,
“শুনুন?”
“হুম।বলো।”
জারিফ অন্যদিকে হয়েই ছোট করে বলল।লিয়া মৃদুস্বরে বলল,
“চা না কফি।কিছুই তো বললেন না। বিকেলে ঘুম থেকে জেগে কফি খাওয়া আমার অভ্যাস। তবে শুধু অভ্যাস না বলে পছন্দই বলতে পারি।তাই বলছি আমার পছন্দের কফিই আপনার জন্য আনলাম।”
জারিফ ঘাড় ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলল,”ওকে ম্যাম।তবে তাড়াতাড়ি করো সন্ধ্যা হয়ে আসছে।বাসায় যাবো।”
লিয়া বিনিময় মৃদু হাসল। অতঃপর লিয়া কিচেনে যায়। কিচেনে গিয়ে রাজিয়া সুলতানাকে দেখতে পায়। পেঁয়াজ কুচি করছেন। লিয়া একবার বেসিনের দিকে তাকিয়ে ফের মা’য়ের দিকে চাইল।রাজিয়া সুলতানা লিয়াকে দেখে বললেন,”লিয়া জারিফকে নাস্তা দিয়ে আয়। ফ্রিজ থেকে পায়েস বের করে রেখেছি দেখ।আর আপাতত এখন মুগলাই বানিয়েছি। একটু সাজিয়ে নে কেমন।”
রাজিয়া সুলতানা ছু’ড়ি দিয়ে পেঁয়াজগুলো সুন্দর করে কুঁচি করছেন। পাশে দাঁড়ানো লিয়ার চোখে একটু ঝাঁঝ লাগল।লিয়া একহাতে চোখ ডলতে ডলতে বলল,”ও আম্মু!এতো সব কি করছো বলতো?এইযে দেখছি গোশ,মাছ বের করে রেখেছো।এসব কি এখন রান্না করবে নাকি?”
“রান্না না করলে এমনি এমনি বের করে রেখেছি নাকি? অদ্ভুত প্রশ্ন আমার মেয়ের।”
কথাটা বলে রাজিয়া সুলতানা স্মিত হাসলেন। লিয়া ঠোঁট উল্টে বলল,”যার জন্য রান্না করছো সে তো মনে হয় না ডিনার অব্দি থাকবে।তোমার জামাই তাড়া দিচ্ছে।এই তো আমাকে বলল সন্ধ্যার আগেই চলে যাবে।তাই বলছি বাদ দাও।এত কিছু এখন করার দরকার নেই।তোমার জামাই ডিনার পর্যন্ত থাকবে না,আমি শিওর।”
রাজিয়া সুলতানা মেয়ের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,”তুই বলেছিস ডিনার করার কথা?”
লিয়া তড়িৎ দুদিকে মাথা ঘুরিয়ে না সূচক উত্তর দেয়।রাজিয়া সুলতানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।ফের বললেন,
“জারিফ যখন তাড়া দিলো তখন তো সৌজন্যমূলকও বলতে পারতি।সব কিছু কি তোকে বলে বলে দিতে হবে নাকি? অদ্ভুত!যা নাস্তা দে।আর ডিনার করে যেতে বল। না করলে আমার কথা বলবি।”
লিয়া কফি বানাতে লাগল।ঘাড় নাড়িয়ে ঠোঁটে উল্টে বলল,”ঠিক আছে।”
লিয়া নাস্তার ট্রে হাতে রুমে আসল।জারিফ লিয়ার পড়ার টেবিলের চেয়ারটা একটু টেনে বসে আছে। লিয়ার নোট খাতাটা মেলে কিছু দেখছে।লিয়া ট্রে টা ছোট কাঁচের টেবিলের উপর রাখল।জারিফের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,”কি দেখছেন?আমার হ্যান্ড রাইটিং?আপনার মতো অতো সুন্দর নয়।তবে চলনসই।এসব পরে দেখবেন আগে নাস্তা করুন।”
জারিফ ঘাড় ফিরলো।লিয়ার মুখশ্রীতে স্থির সুগভীর শান্ত চাহনিতে চেয়ে বলল,”কে বলেছে চলনসই?তুমি ভুল বললে।জারিফের বউয়ের সব কিছুই বেস্ট।”
লিয়া মৃদু হাসল।ফের জারিফকে নাস্তা করার কথা বললে জারিফ বলে,”এখন অন্য কিছুই খেতে পারবো না।জোর করো না, প্লিজ। কফিটা দাও।ভার্সিটি থেকে বাসায় গিয়ে খাবার খেয়েছি। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়েছি।মা’কে লাঞ্চ করার কথা বললেও মা রোজকার মতো জোর করে খাবার খেতে দেয়।মা’য়ের কথা বাইরে থেকে কি খেয়েছি না খেয়েছি।তাই এখন অল্প করে হলেও খেতে হবে।”
লিয়া মৃদু হেসে বলল,”আর এদিকে আমার আম্মু তো কমন একটা কথা বলবে,তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেমন খেয়েছিস?তাই বেশি কথা বলা বাদ দিয়ে খেয়ে নে।মাঝে মাঝে খাবার মেখে এনে জোর করে খাইয়ে দেয়।”
লিয়া কফির মগটা জারিফের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে টুলটা এনে বসল।জারিফ কফির মগে ঠোঁট ডুবায়।কপাল কুঁচকে বলল,”কফি তুমি বানিয়েছো?”
“কেনো?ভালো হয়নি বুঝি?”
“আমি একবারো সেটা বলেছি?”
“নাহ্।মানে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন তাই ভাবলাম।আর হুম আমি বানিয়েছি।”
জারিফ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,”একদম পার্ফেক্ট হয়েছে। দারুণ হয়েছে।”
লিয়া ভাবল জারিফ একটু বেশিই বলছে হয়তো।তবে লিয়া নিজেও জানে একেবারে বাজে হয় না কফি বানানো। মোটামুটি পর্যায়ে হয় আরকি।আর জারিফ খুশি করার জন্য একটু বাড়িয়ে বলেছে হয়ত।তবে প্রিয়জনকে খুশি করার জন্য এরকম বাড়িয়ে বলে প্রশংসা করতে কয়জনই বা পারে।লিয়ার কাছে বিষয়টা বেশ ভালোই লাগল।অন্যরকম মুগ্ধতা খুঁজে পায় লিয়া জারিফের আচরণে।যা সত্যিই লিয়াকে ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ করে।লিয়া হঠাৎ জারিফকে বলল,
“রাতে ডিনার করে যাবেন। আম্মু রান্না করছে।”
জারিফ ইতস্তত কণ্ঠে বলল,”আজকে ডিনার না করলে হয় না।অন্যদিন করবো।আজ বাইরে কাজ আছে একটু।”
লিয়া কাঠকাঠ গলায় জবাবে বলল,”উঁহু!চলবে না। আপনার শ্বাশুড়ি মা অলরেডি রান্না শুরু করে দিয়েছে।এখন আপনি না খেয়ে চলে গেলে বিষয়টা কেমন হয়।উমম!তবে কাজের কথা যখন বলছেন। সেইজন্য বলছি, আটটার আগেই যাবেন।কেমন?”
জারিফ বলল,”ওকে।”
সন্ধ্যার পর জারিফ ড্রয়িংরুমে বসে রাহবারের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। অতঃপর এনামুল খাঁন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসেন।জারিফের সাথে ভালোমন্দ এটাসেটা কথা বলেন।জারিফও ভদ্রতার সহিত নম্র কণ্ঠে কুশলাদি বিনিময় করে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও এটাসেটা হোয়াইট টক চলতে থাকে কিছুক্ষণ।
.
ডাইনিং এ খাবার রেডি করে লিয়া জারিফকে ডাকতে যায়।জারিফ সৌজন্যতার খাতিরে এনামুল খাঁনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আঙ্কেল আপনিও চলুন।”
এনামুল খাঁন অমায়িক হেসে বললেন,”না বাবা।তুমি খেয়ে নাও।আমার মেডিসিন আছে।টাইম মেইনটেইন করে খাবার খেতে হয়।যাও তুমি খেয়ে নাও।”
অবশেষে জারিফ ডায়নিং এ যায়। ডায়নিং এ গিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে জারিফ লিয়াকে বলল,”এত আগেই খাবার খাওয়া।তারপরে একা একা বসে খেতে ভালো লাগছে না।রাহবার কে ডেকে আনো।একসাথে খাবে।”
লিয়া কপাল কুচকালো। এরমধ্যে রাজিয়া সুলতানা আদূরে গলায় বললেন,”জারিফ তুমি শুরু করো বাবা।আমি রাহবার কে ডেকে দিচ্ছি।আর এই লিয়া তুইও বস।”
লিয়া ভ্রু যুগল কুঁচকে আমতা আমতা করে বলল,”আ আমি
এরমধ্যে জারিফ চোখ দিয়ে ইশারা করল। অবশেষে লিয়া থেমে যায়।একটা চেয়ার টেনে বসে পরল।জারিফ,লিয়া, রাহবার একসাথে খাবার খায়।খাবার শেষ করে জারিফ সবার থেকে বিদায় নেয়। লিয়া মেইন দরজা অব্দি আসে।জারিফ দরজা পার হয়ে এক পা গিয়ে ফের পিছন ঘুরে দাঁড়ায়। লিয়া একহাতে কাঠের ভারি দরজাটা ধরে আছে। উদ্দেশ্য জারিফ চোখের আড়াল হলেই লক করে ভেতরে যাবে।জারিফ লিয়ার দিকে একটু এগিয়ে এসে মোটা স্বরে বলল,
“তোমাকে সব কিছু বলে বলে দিতে হবে নাকি?নিজে থেকে কিছুই বোঝনা?নাকি না বোঝার এক্টিং করে থাকো? কোনটা?”
জারিফের এহেন কথায় লিয়া থতমত খেলো।একটু চমকাল।অবাক হলো।লিয়া সরু চাহনিতে চেয়ে প্রশ্ন করে উঠল,”মানে?কী বলতে চাইছেন? কিসের এক্টিং?”
জারিফ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”বর বিদায় নিচ্ছে।কিভাবে বিদায় দিতে হয়। জানো না?আদূর স্বরুপ দুই চারটে চুমু দিবে। জড়িয়ে ধরে চোখের নোনা জলে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিবে। তোমাকে কান্না করতে হবে না।তোমার চোখের পানি আবার আমার সয্য হবে না। কিন্তু চুমুটা তো দিতেই পারো।”
লিয়া লাজুক হাসল। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল,”ধ্যাত!আপনার শুধু আজেবাজে কথা।”
জারিফ হাতে থাকা ফোনের দিকে একবার তাকাল। অতঃপর লিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,”দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিদায় দাও।”
কথাটা বলে জারিফ লিয়ার দিকে গালটা বাড়িয়ে দেয়।এক আঙ্গুল গালে ধরে ইশারা করে।লিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল।এই বান্দা আচ্ছা একটা পাবলিক। একদম নাছোড়বান্দা একটা এসব কিছু মনেমনে আওড়ায় লিয়া। কিয়ৎকাল পরে মুখটা এগিয়ে নিয়ে জারিফের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িওয়ালা গালে টুপ করে চুমু দেয়। তড়িৎ মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল,
“এবার হ্যাপি তো?”
লিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই জারিফ লিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।আচমকা ঘটনায় লিয়া অপ্রস্তুত হয়।মিনিট খানেক পর জারিফ লিয়ার ঠোঁট ছেড়ে দেয়।এক আঙ্গুল দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,
“কড়া মিষ্টি ছাড়া চলে।তুমিই বলো?”
লিয়া বড় করে শ্বাস টেনে নেয়।মোটামোটা চোখ করে জারিফের দিকে চাইল। লিয়া কিছু বলার আগেই জারিফ মুচকি হেসে বলল,”টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ।”
জারিফের দিকে তাকিয়ে লিয়া আর বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না।বিনিময় একটা মুচকি হাসি উপহার দিলো। অতঃপর কোমল গলায় বলল,”দেখেশুনে ড্রাইভ করবেন। আল্লাহ হাফেজ।”
.
ঘড়ির কাঁটায় রাত্রি নয়টা বাজে।তাসনিম কিচেনে। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজা।রুটি বানাচ্ছে।যে কেউ তাসনিমকে দেখলে বলবে সংসারি একটা মেয়ে।আর এমনিতেও সংসার লাইফটাকে দারুণ উপভোগ করে তাসনিম। মেডিকেলের ক্লাস, রাউন্ড,ফাইল রিফ্রেশ সব ব্যস্ততার মাঝেও বাসায় এসে টুকিটাকি কাজ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে করে। বিরক্ত হয় না।শ্বাশুড়ি নামক নতুন পাওয়া মা’কে শ্বাশুড়ি কম নিজের মা’য়ের নজরে দেখে।আতিকা বেগমও তাসনিমকে খুব স্নেহ করেন। গরমে তাসনিমের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। তাসনিম একহাতে কপালের ঘামটুকু মুছে নিলো।এমন সময় কর্ণগোচর হলো,
“এই তাসনিম তুমি এখন কি করছো?”
আতিকা বেগম কথাটা বলতে বলতে কয়েক কদম এগিয়ে আসলেন। রান্নারুম থেকে খটখট আওয়াজ আসছিলো। কিসের শব্দ হচ্ছে সেটাই দেখতে আসেন আতিকা বেগম।এখন তাসনিমকে এখানে দেখে একটু অবাক হলেন।তাসনিম ঘাড় ঘুরিয়ে হাসি হাসি মুখশ্রী করে চাইল।আতিকা বেগম কপালে ভাঁজ ফেললেন।ভারী গলায় বললেন,”এই গরমের মধ্যে তুমি কিচেনে এখন এসব করছো? দুপুরের রান্না করা খাবার তো আছেই।”
তাসনিম কোমল স্বরে বলল,”আসলে আম্মু।আপনি তো রাতে রুটি খান।রোজ রুটি আপনি বা কাজের মেয়েটাই বানায়।আজকে আপনার হেডেক হচ্ছে শুনে ভাবলাম আমিই বানাই।বুয়াও তো আজ নেই।তাই।”
আতিকা বেগম মুগ্ধ নয়নে চাইলেন। কণ্ঠে শীতলতা নিয়ে ঠোঁট আওড়ালেন,”সারাদিন পর মেডিকেল থেকে বাসায় ফিরে।কোথায় রেস্ট নিবে।তা না করে তুমি আমার জন্য এই অতিষ্ঠ,অসয্য গরমের মধ্যে কিচেনে রুটি বানাতে আসছো।আমার কিন্তু এবার নিজেরই খা’রাপ লাগছে।একদিন রুটি না খেলে কিছুই হবে না।তোমার তো পড়াশোনাও আছে। সংসারের জন্য তোমার পড়াশোনার,তোমার ক্যারিয়ারের ক্ষ’তি হোক এটা কখনোই চাই না। তুমি রুমে যাও আমি করছি।”
তাসনিম মুখটা মলিন করল। রাশভারী স্বরে বলল,”আম্মু।আমি পারব তো বলছি।এই সামান্য কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনায় কোনো ক্ষ’তি হবে না।আমি বলছি তো।”
তাসনিমের কথা শুনে আতিকা বেগম হেসে ফেললেন।তাসনিম এখন কাজটা কমপ্লিট করার আগে কিচ্ছুতেই রুমে যাবে না তা ভালোই বুঝতে পারলেন আতিকা বেগম।তাই অহেতুক কথা না বাড়িয়ে একরাশ মায়া জড়িয়ে নিয়ে মায়াময় স্বরে বললেন,”আচ্ছা ঠিক আছে।দাও দু’জন মিলে করি।তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।আমি রুটিগুলো বানিয়ে দেই তুমি ছেঁকে নাও।”
অবশেষে তাসনিম ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি দেয়।আতিকা বেগম রুটি বানাতে বানাতে বললেন,”আমি ভেবেছি এই মাসেই ঢাকায় ফিরে যাবো।তোমার সংসারটা এ কয়দিনে গুছিয়ে দিয়েছি।এবার তুমি সব সুন্দর করে একাই সামলে নিতে পারবে।তাই মনেহয় এবার চলে যেতে পারব। তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”
মুহুর্তেই তাসনিমের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে। তাসনিম আতিকা বেগমের দিকে চেয়ে ম্লান স্বরে বলল,”তুমি চলে যাবে আম্মু। কেনো যাবে?আমি কোনো বেয়াদবি করেছি নিশ্চয়?আর হয়তো অজান্তেই তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।তাই হয়তো তুমি এরকম বলছো।”
“পা’গলী মেয়ে।এসব কেনো ভাবছো?আসলে আমার স্বামীর ভিটা ছাড়া অন্য কোথাও মন টেকে না। মানুষটা নেই। অথচ তার স্মৃতি পড়ে আছে বাড়িটার আনাচে কানাচে, প্রতিটা বাতাসে।তাই ঐ বাড়ি ছাড়া কোথাও থাকতে অভ্যস্ত নই।”
তাসনিম ঠোঁট উল্টে বলল,”এখানে তো তোমার ছেলে আছে।তাকে বাবার সব থেকে বড় স্মৃতি হিসেবে নিয়ে। ছেলের কাছেই থেকে যাওনা। তোমার ছেলে তো আমাকে সব সময় বলে,আর তোমাকে একা ওখানে থাকতে দিবে না।এতদিন কেউ ছিলো না।বাসায় যার সাথে গল্প করে সময় কাটাবে।এখন আমি আছি তো।তাই তুমি ফিরে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দাও।আর আমরা সবাই মিলে ছুটিতে বাড়িতে ঘুরতে যাবো।”
তাসনিমের এত সুন্দর আকুতি নিয়ে বলা কথাগুলো আতিকা বেগম সরাসরি নাকোচ করতে পারলেন না।তবে সরাসরি হ্যা বা না কিছুই না বলে নিশ্চুপ রইলেন। তাসনিম ঠোঁট উল্টিয়ে ফের বলল,”আম্মু কিছুই বলছো না যে।এইযে দেখো তোমার ছেলে এতো রাত করে বাসায় ফেরে ।এতবড় একটা ফ্লাটে আমি একলা থাকি কিকরে?ভূতে আমার ভীষণ ভ’য়।একা থাকলে ভূত পেৎ এর ভ’য়ে আমি ঠিক আ্যটাক করে বসবো, হ্যা।তাই আমার কথা ভেবে হলেও তোমাকে থাকতে হবে।”
শেষের কথাগুলো অভিনয়ের সুরে বলল তাসনিম।আতিকা বেগম ঠোঁট টিপে হাসলেন। তাসনিম বাচ্চাদের মতো আবদার করে ফের বলল,”এবার হ্যা বলো তো আম্মু।তুমি না থাকার পর ভূতেরা এসে কিভাবে নৃত্য করে আমাকে ভ’য় দেখাবে। সেটা তো আমার দু’চোখেতে ভাসছে ।আর আমার সারা শরীর সেই ভ’য়ে হিম শীতল হয়ে আসছে।এখন ফটাফট বলে ফেলো তাসনিম তোমার ভয় পাওয়ার দরকার নেই।আমি আছি তো।আমি থাকবো আল্লাহর রহমতে।আর আমি থাকতে ভূতেরা ভ’য় দেখাবে আমার ছেলের বউকে। নেভার।”
আতিকা বেগম তাসনিমের এমন এক্টিং দেখে হাসতে থাকেন। তাসনিমের কাঁধে হালকা করে চা’প’ড় দিয়ে বললেন,”এই মেয়ে এতো কথা জানে আমি তো জানতামই না।এক নিমিষেই মনটা ভালো করে দিলি। সন্ধ্যা থেকেই কেমন জানি শরীরটা ভালো লাগছিলো না।শরীরের সাথে মনের সম্পর্কও ব্যাপক।মনটাও খা’রাপ ছিলো।তবে এখন তোর কথাশুনে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে।সাথে শরীরটাও বেশ ভালো লাগছে। আমার ভালো থাকার মেডিসিন তুই আর আমার ছেলে।তাই তোদেরকে ছাড়া আর কোথাও যাচ্ছি না।”
তাসনিম আতিকা বেগমকে ফট করে জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা রাখল। খুশিতে চোখ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।আতিকা বেগম তাসনিমের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আমার পা’গলি মেয়েটা।তোদের কথা মতো থেকে গেলাম।তবে আমারো একটা আবদার থাকল।আমার ছোট্ট একটা ভাই-বোন চাই।যাদের সাথে খেলে সময় গুলো পার করবো।”
তাসনিম এবার একটু লজ্জা পেলো। লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরে নিশ্চুপ রইল। এরমধ্যে কিছু পুড়া পুড়া গন্ধ নাকে আসতেই আতিকা বেগম নাক টেনে নিয়ে বললেন,”এই রে রুটি টা গেলো পুরে।”
তাসনিম দ্রুত জিহ্বায় কামুড় দেয়।আতিকা বেগম চুলাটা দ্রুত অফ করে দিলেন।রুটির একপিঠ একদম পুড়ে গিয়েছে।এই দেখে আতিকা বেগম শব্দ করে হেসে ফেললেন।সাথে তাসনিমও একহাতে মাথা চুলকিয়ে হাসতে থাকে।তাসনিমের কপালে আটা লেগে যায়।এটা নজরে আসতেই আতিকা বেগম নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে তাসনিমের কপাল থেকে মুছে দেন।
রাত এগারোটা বাজতে চলছে।তাসনিম ড্রয়িংরুমের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।সোফার সাথে হাত ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথাটা রেখে ঝিমুচ্ছে।একটু আগে আতিকা বেগমকে এক প্রকার জোর করে বলে কয়ে খাবার খেতে রাজি করিয়েছে।ছেলে,বৌমা ছাড়া একা একা সহজেই খেতে রাজি ছিলেন না। তাসনিম আলিফকে ফোন দিয়ে আতিকা বেগমের সাথে কথা বলিয়ে দেয়।আলিফও ফোনে মা’কে খাবার খেয়ে ঔষধ নিতে বলে।আলিফ তাসনিমকেও খাবার খেয়ে নিতে বলেছিলো।তবে তাসনিম এখনো না খেয়ে আলিফের জন্য ওয়েট করছে। কলিংবেলের শব্দ হওয়ায় তাসনিম ধড়ফড়িয়ে উঠল। কেবলই চোখটা লেগে গিয়েছিল। অতঃপর তাসনিম উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলে আলিফকে দেখে ঘুমঘুম চোখে মৃদু হাসল।আলিফ একহাতে টাইয়ের নাটটা ঢিল করতে করতে দু কদম এগিয়ে আসল।তাসনিম বড় করে হামি দেয়। এটা দেখে আলিফ কিঞ্চিৎ হাসল। একহাতে তাসনিমের কোমড় পেঁচিয়ে ধরল।অন্য হাত দিয়ে দরজটা লক করল। শান্ত গলায় বলল,
“এখানে বসেই অপেক্ষা করছিলে বুঝি?”
“হু।এত দেরি হলো আপনার?”
“আম্মু কিকরে?ঘুমিয়ে পড়েছে কি?খাবার খেয়ে মেডিসিন নিয়েছে কি?”
“আম্মু একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।আমি আম্মুর রুমেই ছিলাম।হ্যা আমি নিজেই মেডিসিন দিয়েছিলাম।রুমে চলুন ফ্রেশ হয়ে নিয়ে খাবার খাবেন।আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
আলিফ তাসনিমের কপালে প্রগাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
“আমার বউয়ের তো দেখছি সব দিকেই ভালোই নজর আছে।সব দিক নিয়েই সমান ভাবে।গুড। ক্লান্ত ছিলাম।তবে তোমাকে দেখার পর থেকে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছে।তোমাকে দেখে এখন মন মেজাজ সবটাই ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে।সকল ক্লান্তি,অবসাদও নিমিষেই চলে গেছে।”
তাসনিম আলিফের শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,”ক্ষুধা পেয়েছে প্রচন্ড।সো ফাস্ট ফ্রেশ হয়ে নিন।খাবার খাবো।”
আলিফ একহাতে তাসনিমের পেটে স্লাইড করতে করতে বলল,”তোমাকে না তখন ফোনে খাবার খেয়ে নিতে বললাম।আমার আসতে লেট হবে বলেই তো বলেছিলাম। তারপরেও এভাবে না খেয়ে বসে আছো। এটা কিন্তু ঠিক নয়।”
আলিফের স্পর্শে তাসনিমের শরীরটা কম্পিত হলো।তাসনিম আলিফের হাতের উপর একহাত রাখল। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,”এভাবে দাঁড়িয়ে সময় লস করছেন।এটাও কিন্তু ঠিক নয়।”
আলিফ হেসে ফেলল। তাসনিমের ঠোঁটে কিস করে।চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,”সারাদিনের ক্লান্তিটা এখন পুরোপুরি কে’টে গেলো।এখন তো চাঙ্গা লাগছে খুব।এই তোমার কাছে জাদু আছে বোধহয়।তোমার স্পর্শে আসলেই আমার সবকিছু অটোমেটিক ভালো লাগতে থাকে।আমার ভালো থাকার মেডিসিন তুমি।”
একটু সময় নিয়ে আলিফ ফের বলল,”যাই ফ্রেশ হয়ে নেই।এখানে সারারাত শেষ করলে নিজেরই লস।এমনিতেই অর্ধেক রাত লস হয়ে গিয়েছে।তোমাকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তিতে টানা লম্বা একটা ঘুম খুব করে প্রয়োজন।”
“আপনার পোশাক বেডের উপর রাখা আছে।আপনি ফ্রেশ হয়ে আসেন।আমি ততক্ষণে খাবার রেডি করি।”
“ওকে। সুইটহার্ট।”
.
কয়েকদিন পর,,
লিয়া জারিফের বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে।তবে এখনো বিশদিনের মতো বাকি আছে।লিয়ার ছোট চাচ্চু ছুটি নিয়ে আসবে।এদিকে নীলের বাবাও ছুটিতে আসতে পারবে।সবার দিক বিবেচনা করে সামনের মাসে দিন ঠিক করা হয়েছে।লিয়া আর অরিন ভার্সিটিতে আসছে।করিডোর দিয়ে যাচ্ছে।এমন সময় পুরুষালী কন্ঠস্বর আসল,
“কেমন আছো তোমরা?”
দু’জনে ঘাড় ঘুরিয়ে ফারহানকে দেখতে পায়। অরিন তো মহাখুশি হলো।স্যার আজ নিজে থেকেই কথা বলছে দেখে।লিয়া অবাক হয়না।কারন এর আগেও অরিন স্যারকে দেখে এটাসেটা গল্প জুড়ে দেয়। তাই সেই হিসেবে স্যার নিজে থেকে কথা বলতেই পারে।সালাম দিয়ে লিয়া মৃদুস্বরে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।স্যার আপনি কেমন আছেন?”
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।তা তোমাদের সাথে কিছু কথা ছিলো। মানে এভাবে নয়। লাঞ্চে যদি ক্যান্টিনে আসতে তাহলে ভালো হতো।”
লিয়া ভাবল।কি কথা থাকতে পারে?তবে তোমাদের যেহেতু বলল। তারমানে?লিয়া ভেবেও কিছু মেলাতে পারল না। অরিনের তো খুশিতে মনে লাড্ডু ফুটেছে।আকাশ কুসুম স্বপ্নও দেখতে শুরু করে দিয়েছে।ফারহান মূলত লিয়াকে বলতে চেয়েছিলো।তবে টিচার হয়ে শুধু লিয়াকে দেখা করার কথা বলতে ইতস্তত বোধ করে।আর এদের দু’জন কে দেখে সবার মানিক জোড়ের মতো লাগে।একসাথে সব সময় থাকে। তাই ফারহান তোমাদেরকে বলে।অরিন এক্সাইটেড হয়ে বলল,
“ওকে স্যার।ব্যাপার না।”
ফারহান আর কিছু না বলে চলে যায়। লাঞ্চ টাইমের জন্য অধীর আগ্রহে থাকে।
চলবে,,,