হিয়ার_মাঝে ৫৬. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
534

#হিয়ার_মাঝে ৫৬.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

লজ্জায় অবনত মস্তকে তমার পাশে বসল নুবাহ। দু’হাত কচলে যাচ্ছে গ্রাউনের ওড়না ধরে। মনটা তার জামাইয়ের কাছে ছুটে যাচ্ছে বার বার। অবাধ্য মনের সময় জ্ঞান নেই একদমই। শুধু জামাই জামাই করে বেয়াদব মন। ফোৎ করে নিরবে শ্বাস ছাড়ল সে। তমা জহুরি নজরে দেখল প্রিয় বান্ধুবীকে। ফোড়ন কাটলো দীর্ঘশ্বাস টেনে।

‘বেশ লম্বা সময় কাটালি। তা কি করলি এতক্ষন তোর ফুল জামাইয়ের সাথে?’
নুবাহ কিঞ্চিৎ মাথা তুলে তাকালো। নিজেও রগড় গলায় জবাব দিল,
‘তুই যা করবি, আমিও তাই করে এসেছি।’
‘আমি কি করবো আবার?’
‘সেটা তুই ভালো জানিস, কি করবি জামাইয়ের সাথে।’

তমা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হা হয়ে আছে মুখ। নতুন বউ হয়ে পড়েছে বিপাকে। সবাহ কমবেশি নজর তার দিকেই তাক করে আছে। তাই আর বেশি ঘাটালো না। কিন্তু সে এখনো বিস্মিত। মাত্র কয়েক মিনিটে এই মেয়ের রূপ বদল। সত্যি অবিশ্বাস্য! এ তো সত্যি জামাই পাগল! আবারও প্রমাণিত। কিন্তু নুবাহ ভাবলেশহীন। সে তমার নিকট আরও ঘেঁষে বসল। তার একহাত চেপে মুখের কোণে কৃতজ্ঞতার সুর তুলল সে।

‘ধন্যবাদ তমা এত বড় উপকার করার জন্য। তুই না বললে হয়তো আজও জানা হত না।’

তমা মৃদু হাসল। যাই হোক তাহলে সে কারো কাজে এসেছে। সেও একহাত চেপে ধরল নুবাহর। মজার স্বরে বলে উঠল,
‘সব মিটমাট হয়ে গেছে তোমাদের।’
নুবাহর মুখে লাজুক হাসি। তমা যা বোঝার বুঝে গেছে। ভালোই হল দু’জনের মান-অভিমান ভাঙ্গলো তাহলে।

হলরুমে সবার মুখে চিন্তার ভাঁজ। হৃদি কিছু না বললেও সানি জবাব দিল তার।
‘আসলে চিন্ময় কোথাও যেনো যাচ্ছিল। কিন্তু হৃদি জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যাচ্ছে। তাই আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। এটাই আসল কারণ, আর কিছু না।’
জিতু জিমান দু’জনের কেউই বিশ্বাস করল না। এই কথা জিতুর কাছে পুরোই অর্ধসত্য মনে হল। সে হৃদিকে ডাকল।
‘হৃদি এদিকে এসো তো।’
সেও বাক্যে বিনিময় ছাড়া এগিয়ে এল সবার সামনে। জিতু প্রশ্ন ছুঁড়লো তার উদ্দেশ্য।
‘সত্যি করে বলতো, চিন্ময়ের সাথে কি কথা হয়েছে।’

হৃদি সানির মতই বলে উঠল, ‘সানি ভাই যেটা বললো সেটাই সত্যি। আমি চিন্ময় ভাইকে এটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু সে’তো উত্তর দিলোই না। উল্টো আমাকে,, বাকী কথা শেষ করার আগেই প্রবেশমুখে চিন্ময়কে আসতে দেখল। হৃদি মুহুর্তে চুপসে গেল। আর যাই হোক সে আর এ লোকের ছায়াও মাড়াবে না। না মানে একদমই না। সে আর হলরুমেই দাঁড়ালো না। সাথে নীলাভকে নিয়ে দোতলার দিকে পা বাড়ালো। উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল হৃদির কান্ডে। কিন্তু চিন্ময়কে দেখতে পেয়ে সব ভুলে তার দিকে বাকিরা এগিয়ে এল। মুবিন সামান্য এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল,

‘কোথায় গেলি এভাবে কাউকে কিছু না বলে।’

চিন্ময় মুখে কৃত্রিম হাসি ফোটালো। ফোৎ করে নিশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
‘আরে মামা কল দিছিলো। কতদিন পর বাড়ি ফিরলো, তাই তো ছুটে গেলাম। আচ্ছা, এই প্রসঙ্গ বাদ দেয় তো। জিমানের বাসর ঘর সাজিয়ে সব রেডি করে তবেই এসেছি কিন্তু। তোদের আর কষ্ট করতে হবে না। শুধু বউ-বরকে নিয়ে গাড়ি করে যাবি।’

জিতুসহ বাকী’রা হা হয়ে আছে। এই ছেলে এতক্ষন হাওয়া হয়ে ছিল তাহলে কি বাসর ঘর সাজাতে। জিতু কিছু একটা বলতে উদ্বত হল তার আগেই চিন্ময় বামহাত তুলে থামিয়ে দিল। ‘থাক আর এত ধন্যবাদ দিতে হবে না। আজ পকেট ফাঁকা হবে জিমানের। সো, তুই আজ দূরে যা। এমনিতেই তোর কাছে বকেয়া আছে আমার। আগে সেটা শোধ কর।’

জিতু বিদ্রুপের সুর তুলল,
‘তাই না’কি! তা বকেয়ার পরিমাণ কত শুনি?’
চিন্ময় কিঞ্চিৎ অবাক হল।
‘তাহলে পরিশোধ করবি।’
জিতু নিজের শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে উত্তর দিল,
‘হুমম, করবো তো, একদম সুদে আসলে।’
চিন্ময় শুকনো ঢোক গিলল। ফের রগড় গলায় জবাব দিল,
‘থাক লাগবে না। তোর টাকা তোর কাছেই থাক।’
___

ফুলেল সজ্জিত রুম। দরজার চৌকাঠে দন্ডায়মান জিমান। তমাকে আগেই ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। চৌকাঠে ফিতা টেনে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধুমহল। সবার আগে উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়েছে চিন্ময়। লরিনের হাতে ফুল দিয়ে ঢাকা ছোট্ট কাঁচের বাটি। সেখানে রাখা কয়েকখানা চিরকুট। জিমান নিজমনে ইয়া নাফসি পড়ছে। কি যে হবে তার সাথে কে জানে? অস্থির মনে একখানা চিরকুট তুলে নিল। চিরকুট মেলে ধরতেই দু’টো শব্দ স্পষ্টত চোখে পড়ল। ‘পঞ্চাশ হাজার’ লিখা দেখেই সে কিঞ্চিৎ ভড়কালো। নিজমনে গালিও ছুঁড়ল, এরা বন্ধু নাকি কসাই। সে দরদাম করল, এত টাকা হবে না। আরও কমাতে হবে। এতেই কর্কশ ধ্বনি তুলল সানি,
‘হ্লা কিপটা, এই টাকাও দরদাম করতে হবে।’

জিমান কিছু বলার আগে চিন্ময় চেঁচালো,
‘জলদি টাকাটা দিয়ে দেয়, আমরা ঘুমামু। সারাদিন কত্ত কাজ করছি বিশ্রাম পাই নাই একটুও।’
জিমান দায়সারা ভাবে জবাব দিল।
‘ত্রিশ আছে, নিলে নেয়। নয়তো আমি গেলাম। আজকে রুমেই যামু না দরকার হলে।’
সহসাই জিতুর অধরকোণে দুষ্টু হাসি। সেও টিপ্পনী মারল,
‘যা, আল্লাহ হাফেজ। আমরা না হয় এখানে নিচে বিছানা করে ঘুমাই। তুই তো আর ঘুমাবি না। ভাবির সাথে না হয় মেয়েরা থাকবে।’

জিমান ভালোই বুঝলো নিজের জালে নিজেই ফেঁসেছে। মুখের কোণে হতাশার সুর। এরকম বন্ধু থাকলে শত্রুর দরকার হবে না কখনো। এরা তার প্রথম রাত এভাবেই নষ্ট করতে চায়। কত্ত হারামি! বাকবিতন্ডায় জড়িয়েও লাভ হল না। এবার কিছুটা নরম সুরে জবাব দিল।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে পঁয়ত্রিশ দিচ্ছি। আর টাকা নাই। এই মুহুর্তে আমি ফতুর। বিয়ে করে বউ আনতেই আমার সব টাকা হাওয়া, বিশ্বাস কর।’

বন্ধুমহলের মুখে কুটিল হাসি। আজ জিমানের কোনো কথায় শোনা হবে না। এর মাঝে সানি তার বিখ্যাত ডায়লগ বলে উঠল,
‘না বিবি না বাচ্চা
না বাপ বড় না মাইয়া
The whole thing is that কি ভাইয়া
সবচেয়ে বড় রুপাইয়া।’

রকিও তার সুর তুললো, ‘টাকা দাও বউ নাও,
বউ নিয়ে বাসর মিটাও।’

সবার মধ্যে থেকেও মুবিন যেন অসহায়। সে চুপচাপ বন্ধুদের কার্যক্রম দেখছে। তার যে খুব খারাপ লাগছে তা কিন্তু নয়। তবে মনটা বড্ড আফসোসে পুড়ছে। তার জীবনে এমন রঙিন দিন কি আদৌ আসবে। হয়তো আসবে, নয়তো না। কিন্তু জিমান ফের হতাশ হল। শেষবারের জন্য বলে উঠল,
‘আটত্রিশ আছে, এটা নিয়ে বের হ। এবার আমাকে কিড,ন্যাপ করলেও এর থেকে একটাকাও বেশি বের হবে না। আর না মানলে তোরাই থাক, আমিই গেলাম।’

বন্ধুমহল অবশেষে হার মানলো। যতই হোক নিজের বন্ধু বলে কথা। সানি রকি ফিতা খুলে দিল। জুঁই সিমি লরিন’রা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে অভিবাদন জানালো। জিমানের নতুন জীবনে পা রাখার জন্য তাকে স্বাগতম জানিয়ে বন্ধুমহল বের হয়ে এল তার রুম থেকে। তবে আসার আগে তাদের দেয়া বিশেষ উপহার দিতে ভুললো না তারা। জিমান অবাক হল বেশ। জিতু গোলাপি রঙের বড়ো একটা কার্টুন দিল। সাথে দার্জিলিং হানিমুন প্যাকেজ। রকি একটা জগ দিল, রাতে পানি খাওয়ার জন্য। মুবিন দিল ল্যাম্পলাইট। চিন্ময় দিল ইয়ারফোন আর একটা কোলবালিশ। বউয়ের বকবক শুনতে ইচ্ছে না হলে কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকবে। কোলবালিশ হচ্ছে ঝগড়া হলে মাঝখানে দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। মশা যাতে রাতে বিরক্ত না করে সেই জন্য সানি দিল প্রাকৃতিক টনিক। মশা তাড়াতে দিল তুলশী গাছ, এই গাছ মশা তাড়াবে সাথে ঘুমও ভালো হবে তাদের। সিমি দিল ঝুলন্ত দোলনা। সেখানে বসে নবদম্পতি চন্দ্রবিলাশ করতে পারবে। লরিন দিল রাতে পরার জন্য কাপল নাইট ড্রেস। জুঁই দিল মিস্টার এন্ড মিসেস লিখা কাপল কপিসেট, সাথে বড় একটা প্লেট। একসাথে খাবার খাওয়ার জন্য।

এতকিছু দেখে জিমান তমা দু’জনেই হতবাক। তমা কিছু না বললেও জিমানের মুখে দুষ্টু হাসি।
‘তা ম্যাডাম, হানিমুনের জন্য দার্জিলিং যেতে প্রস্তুত তো।’
তমা লজ্জানত হয়ে আছে। প্রতিত্তোর করল না। জিমান ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো।
‘ম্যাডাম কি লজ্জা পাচ্ছেন? মুখটা একটা উপরে তুলুন। দেখি তো আপনি কেমন লজ্জা পাচ্ছেন?’

তমা ইস্ততঃবোধ করছিল এতক্ষণ। কিন্তু শেষে না পেরে জিমানের এমন বেফাঁস কথার জবাব দিল। লাজুক রাঙানো হাসিতে বলে উঠল,
‘জিমান, আপনি কিন্তু ভারী বদ হয়ে গেছেন। ইচ্ছে করেই কিন্তু জ্বালাচ্ছেন আমাকে।’
‘এই রাতের জন্য এত দীর্ঘ অপেক্ষা করেছি। একটু তো জ্বালাবোই, ম্যাডাম।’
‘যাহ, অসভ্য লোক।’
‘বিয়ের পর সভ্য হয়ে থাকার মানেই নেই, বুঝলেন ম্যাডাম।’
কথাটা বলেই জিমান চোখ মারল। তমা ফের লজ্জানত হল।
___

হৃদি নীলাভ নুবাহসহ এতক্ষণ অন্যরুমেই বসে ছিল। এদের ডাকলেও এরা কেউ যায়নি বন্ধুমহলের মাঝে। হৃদি নীলাভ দু’জনেই বসে গল্প করছে। কিন্তু নুবাহ আছে তার জাগতিক ভাবনায়। এদের গল্পের মাঝে দরজায় টোকা পড়ল। নীলাভ গিয়ে দরজা খুললো। দেখলো সামনে জিতু দাঁড়ানো। তবে তাদের থেকে সামান্য দূরত্বে বন্ধুমহল দাঁড়ানো। জুঁই সিমি লরিন তিনজনেই রুমে প্রবেশ করল। তারা এই রুমেই ঘুমাবে। সাথে নীলাভ হৃদিকেও থাকতে বলল। কিন্তু তারা দু’জনে জিমির সাথে থাকবে। সে দু’জনকে আগেই বলেছে তার সাথে থাকার জন্য। জুঁইরাও মেনে নিল তাদের কথা। জিতু এসে হৃদি নীলাভকে দু’হাজার করে চার’হাজার টাকা দিল। হৃদি হা’ হয়ে আছে। এগুলো কিসের টাকা। জিতু বলে উঠল,
‘এগুলো বরের পকেট ফাঁকা করা টাকার ভাগ পাচ্ছো। নিয়ে নাও।’

নীলাভ নিতে চাইল না। কিন্তু জিতুর অনুরোধে নিতে বাধ্য হল। দু’জনেই টাকা নিয়ে বের হয়ে গেল। পাশে দাঁড়ানো ছিল চিন্ময়। হৃদি চোখ তুলেও তাকালো না। হনহন করে চলে গেল নিজ গন্তব্যে। চিন্ময় এটা নিয়ে মাথা ঘামালো তেমন। তার মনে এখন রাজ্যের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মা কখন সুস্থ হবে। আর সুস্থ হলেই বুঝি সে বরের আসনে বসবে। কি হবে তার সাথে। সত্যিই সে কুমুদকে বিয়ে করবে? দু’হাজার করে বন্ধুমহলের সবাইকে বন্টন করে দেওয়া হল। চার’হাজার টাকা নুবাহকে দেওয়া হল। সে হা’ হয়ে আছে। ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠল,

‘এত টাকা কেন? সবাই তো দু’হাজার পেয়েছে।’

জিতু মুচকি হাসল। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল, ‘দু’হাজার তোমার, আর দু’হাজার তোমার বরের। রেখে দাও। দু’টোই তোমার।’

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here