#হিয়ার_মাঝে ৪৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
মিরপুরের ব্যস্ত সড়ক। পাশে সরু গলি। দীর্ঘ সময় ধরে সেই গলির সামনে দন্ডায়মান জিতু। হিজাবী মেয়েটা সেই যে ভেতরে প্রবেশ করল আর ফেরত এল না। যাওয়ার সময় তাকে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল,
‘ভাইয়া গলির রাস্তা। আপনার গাড়ি ভেতরে প্রবেশ করবে না। আপনি এখানেই থাকেন। আমার বান্ধুবীকে ডেকে এক্ষুনি আসছি।’
সেই যে গেল, আর এল না। ঘড়ির কাটায় চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। এদিক সেদিক তাকাল সে। কিন্তু মেয়েটার আর খোঁজ নেই। তাড়াহুড়োয় মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানা হয়নি, না কোন ঠিকানা নেওয়া হয়েছে। কি বোকা সে! নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এখন। নুহাহর এত কাছে এসেও তাকে আবার হারিয়ে ফেলল। মর্মদহনে ব্যথিত হল অন্তঃকরণ, সাথে ভারী নিশ্বাসের উঠানামা চলছে। গলির দীর্ঘ রাস্তা ঘুরেফিরে ক্লান্ত। মেয়েটি কেন এভাবে তার ছলনা করল, বুঝে উঠল না। সে’তো শুধু একবার নুহাহকে দেখে চলে যেত। কাছ থেকে না হোক, দূর থেকে শ্রেয়। তবে কেন এত নির্দয়তা হল তার সাথে? বড্ড বেশি দেরি করেছে বলে? চোখের কোণ বেয়ে ফের বিন্দু জল গড়ালো। হতাশার ছাপ শুভ্র মুখশ্রীতে ফুটে উঠল। তিক্ত বেদনায় জর্জরিত হয়ে রাস্তার ধারে রাখা গাড়িতে গিয়ে উঠল।
জিতু গাড়ি নিয়ে প্রস্থান করতেই মেয়েটি বের হল গলির ভেতর থেকে। ভয়ে এত সময় চুপসে ছিল। এই হিজাবের জন্য তার চুরি ধরা পড়ে যেত। হৃদির কাছেও সারাজীবন নিজের বন্ধুত্ব খোয়াতে হত। তার বাসায় গিয়ে একদিন সে বালিশের নিচে হিজাব’টা পড়ে থাকতে দেখেছিল। রেশম কাপড়ের এত দামী হিজাব হৃদিকে পড়তে দেখেনি কখনও। তবুও জিজ্ঞেস করেছিল, এটা কার হিজাব? সে জবাবে বলল, ‘তার নয় এটা, তার খালাতো বোনের।’
তাই তো চুপিসারে নিজের ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিল। আজকে প্রথমবার পরল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত হিজাব প্রদানকারীর খপ্পরেই পরলো আজ। সর্বনাশ হতে হতে বাঁচল, শুধু তার বুদ্ধির জোরে। অধরকোণে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। এখন নিজের বাড়িতে ফিরতে ফের বনানীর বাসে উঠতে হবে। কি যে এক যন্ত্রণা!
. . .
সময় গড়ালো নিজের মতই। দিন গড়িয়ে রাত নামল ধরণী বক্ষে। বিমূঢ়তায় আচ্ছন্ন নুবাহ খাটের পাশে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে আছে। ভার্সিটি থেকে ফিরেছে প্রায় ছয় ঘন্টা হতে চলল। দুপুরে ঘটে যাওয়া তিক্ত ঘটনা এখনো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চাপ দিচ্ছে। এই ঘটনা যে ভোলার মত নয়। সে যে কত কিছুই ভেবে রেখেছিল। তমার সাথে দেখা হলে তার তিন বছরের জমানো কষ্টগুলো আগে শেয়ার করবে। কাকতালীয় ভাবে তার অদেখা প্রেমিক পুরুষের সাথেই বিয়ে হয়েছে। তাকে নিজের স্বামীরূপে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও জানা হয়নি ইমদাদ তাকে আদৌও মনে রেখেছে কি’না? প্রথমদিন ভার্সিটিতে পা’ রাখতেই তার স্বামী নামক সেই পুরুষ তাকে বেশ রুক্ষস্বরে কথা বলেছে। কিন্তু সেদিন সে তোয়াক্কা না করে মুগ্ধতায় ডুবে ছিল সেই পুরুষের। দাঁড়িভর্তি শুভ্র মুখশ্রীতে ক্ষণে ক্ষণে চোখ বুলিয়েছে। তার অবুঝ মন কেন যেন ইশারায় ফিসফিস করল, এই জিতুই তোর ইমদাদ হবে হয়তো, নুবাহ। কিন্তু সেই ইশারা না বুঝে সে চিরুনি অভিযান চালিয়ে গেল। ম্যাথ বিভাগের সব ইমদাদকে খুঁজল। কিন্তু অবুঝ মন তাদেরকে তার একান্তই সেই অদেখা টিচার মানতে নারাজ হল। যুক্তি তর্কে জিতু ভুল করেও তার ইমদাদ হয় না। কারণ সে বলেছিল, তিতুমীর কলেজ, ম্যাথ বিভাগ। তার উপর ছা-পোষা মানুষ সে। অথচ সত্যিকার অর্থে সে কেমিস্ট্রি বিভাগের, ধনী পরিবারের ছেলে। তারপরও সে জিতুর ওপর নিজের জহুরি নজর রাখল। কে এই জিতু? মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে জিতুর কথাগুলো শ্রবণ করত। তার আচরণ, কথা বলার ধরন দেখে সন্দেহের বীজ বুনেছিল সেই প্রথম থেকেই। কিন্তু সঠিকভাবে বলতে পারল না, এটাই তার ইমদাদ। এভাবেই সময় বাড়লো। জিতু তাকে গ্রিডি গার্ল বলেও সম্মোধন করল। সেদিন বুক ফেটে আর্তনাদ করতে ইচ্ছে করলো তার। জিতুর প্রতিটি বাক্যে বক্ষ ভেদ করে তার অন্তঃকরণে আঘাত হানল। নিজেকে বিষাক্ত বিষ মনে হল। তার ইমদাদ এভাবে কথা বলতে পারে না। সে তখনও সন্দিহান। জিতুই তার ইমদাদ তো?
কিন্তু তার সন্দেহের বীজ আরও গাঢ় হল, যেদিন সুপারমলে কাঠের উপর খোদাই করা নেইমপ্লেট দেখল। মাঝারি সাইজের একটা নেইমপ্লেট। সেখানে জ্বলজ্বল করল এক নাম।
‘ইয়াফি ইমদাদ
সিও অব লেডিস ডিপার্টমেন্ট।’
আর ঐ নামের মালিক ছিল স্বয়ং জিতুই। কত সিনেম্যাটিক ভাবে সে ইমদাদকে খুঁজে পেয়েছে। অথচ সেইদিনের সেই আনন্দটুকু আজও কারো সাথে শেয়ার করা হয়নি। সে ভেবেছিল জিতুও হয়তো তার জন্য পাগল প্রায়। প্রথম দর্শনে না হোক পরের দর্শনে ঠিক তাকে চিনে ফেলবে। আর তাকে নিয়ে প্রলাপ বকবে,
‘বোকা পাখি, আমি তো ঠিক বুঝে গিয়েছি। শুধু তোমাকে একটু পরীক্ষা করছিলাম আর কি?’
এইটুকু ভাবতেই দীর্ঘশ্বাসে বক্ষস্থল ভারী হল। তার জীবনে সেই মুহুর্ত আজও আসেনি। হয়তো আর আসবেও না। কিন্তু তমাকে দেখে সেই মর্ম যাতনা কিছুটা লাগব হয়েছিল। ভেবেছিল, এই বুঝি তার প্রিয় বন্ধুকে পেয়ে নিজের চেপে রাখা কষ্ট উগলে দেবে। কিন্তু বিধিবাম, তমার আচরণ ছিল ভীষণ রূঢ়তায় পূর্ণ। হয়তো অভিমানে পাথর জমে গেছে মেয়ে’টা। তাই তো তিন বছর পর প্রথম দর্শনেই বলে উঠল,
‘কে আপনি? এভাবে অপরিচিত মানুষকে জড়িয়ে ধরছেন। ভদ্রতা জানেন না না’কি?’
তৎক্ষণাৎ বির্তক ক্লাবের সবাই কোতুহলী নজর বুলালো তার দিকে। পাশে বসা মেয়েগুলোও কেমন তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল। তমার আচরণে সে নির্বাক, হতভম্ব। গলার স্বরও যেন বাঁধা পড়ল কোন এক অদৃশ্য টানে। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়ালো থুতনিতে। কিন্তু অধর জুড়ে তার শুকনো হাসি। আলগোছে নেত্রকোণের জল মুছে বলল,
‘আসলে সত্যি অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। জানেন, আপনার মত দেখতে হুবহু একইরকম আমার একজন প্রিয় বান্ধুবী আছে। প্রথম দেখায় আমি আপনাকে আমার প্রিয় বান্ধুবী ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো আর আমার প্রিয় বান্ধুবী নন, সে হয়তো অন্যকেউ। দুঃখিত বোন, ক্ষমা করবেন।’
সে আর দাঁড়ায়নি তখন। তমার দিকে একবার হতাশার দৃষ্টি বুলিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসল। সবাই বার’কয়েক জিজ্ঞেস করলেও, সে সত্যি’টা বলতে পারল না। শুধু মাথা নাড়ালো। অস্পষ্টসুরে বলল, ‘আমার প্রিয় বান্ধুবীর মত দেখতে সে, আর কিছুই না। তাসনিহার মত অনেকেই অবাক হল। তবে বন্ধুমহলে চলল চরম উত্তেজনা তাকে নিয়ে। সবার মধ্যে জিমানের চক্ষুদ্বয় ছিল বেশ অস্থির। একবার তমার দিকে আর একবার তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। বির্তক শেষ হতেই বন্ধুমহল তাকে অজস্র প্রশ্ন ছুঁড়ল। সবার মধ্যে জিমানই সবচেয়ে উৎসুক। তাকে বার’কয়েক আওড়াল,
‘ভাবী, আপনি মেয়েটাকে চেনেন?’
বিনিময়ে সে নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ভারিক্কি গলায় বলে উঠল,
‘হয়তো খুব আপনজন, আবার নয়তো না।’
জিমান হতাশ হল এমন আচরণে। তবে তার ফোনে টুংটাং শব্দ করে ক্ষুদে বার্তার বহর শোনা গেল। নুবাহকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার বাহানায় ফের প্রশ্ন ছুঁড়ল। ‘মেয়ে’টা কে হয় আপনার?’ সে একই জবাব দিল। জিমান ফের হতাশ হল। মুঠোফোনের ওপারে কারো সাথে কথা বলল বেশ রুক্ষভাষায়। কেমন যেনো আগুনের ফুলকি ছুঁড়ল,
‘সত্যিটা নাই বল, কিন্তু তাই বলে এভাবে অপমান করবে। যতই রাগ অভিমান থাকুক তোমার মাঝে। এটা বড্ড অন্যায় করেছো। তুমি জানো সে কি হয় তোমার? পরের বার ক্ষমা চেয়ে নিবে।’
নুবাহ পুরোই অবাকের চরম পর্যায়ে। কাকে এভাবে ধমক ছুঁড়ছে জিমান। এমন অযাচিত কিছু চিন্তায় করতে পারল না। তাই ব্যগ্রকন্ঠে বলল,
‘জিমান ভাইয়া, কাকে এমন ধমক দিচ্ছেন?’
‘হবে একজন, তাকে ধমক দিচ্ছি।’
সে আর ঘাটালো তখন। কিন্তু কেমন যেনো অদ্ভুত লাগল জিমানের ব্যাপার’টা। কাকে এত ধমক দিল। তবে এত কিছু হল, তার স্বামী নামক পাষাণের দেখা মেলেনি এখনো। কোথায় আছে তার জানা নেই। আজকাল তার মুখ দর্শন হয় না বললেই চলে। একই রুমের, দু’টো দেয়ালের ব্যবধান শুধু, অথচ মনের দিক থেকে হাজার ক্রোশ মাইলের দূরত্ব তাদের মাঝে। ফের হতাশ হল। নিজের ভাবনায় এতটায় মগ্ন সে, নিচ থেকে তার শাশুড়ীর ডাক কর্ণদ্বয়ে পৌঁছালো না। রবি এসে বলল,
‘ছোট ভাবীজান, আপনেরে খালাম্মা ডাকে।’
রবির ডাকে নুবাহর ধ্যানভগ্ন হতেই ছুটল নিচের দিকে। জ্ঞানশূন্য সে তড়িঘড়ি ছুটতে গিয়ে কাপড়ের সাথে পা’ বেজে গিয়ে উঁচু সিঁড়ি থেকে দু’য়েক কদম ছিটকে পড়ল। তবে কারো বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে আবদ্ধ হল দ্রুতই। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই জিতুর শুভ্র মুখশ্রীতে ক্রোধানল দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হল। কোপিত গলায় বলে উঠল,
‘ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত এত লাফাচ্ছো কেন? আর একটু হলেই তো এখনই অক্কা পেতে।’
‘অক্কা পেলে তো আপনার জন্য সুবিধে হবে।’ নুবাহও জবাব দিল রুক্ষভাষায়।
‘এক হালি বাচ্চার বাপ হওয়ার আগে তো আপনাকে মরতে দিচ্ছি না মিসেস ইমদাদ।’
নুবাহ দ্রুতই দৃষ্টি নত করল। নিজমনে গালি ছুঁড়ল, বদলোক সারাদিন বউয়ের খবর নাই। এখন আসছে দরদ দেখাতে। ভেংচি কেটে হাত ছাড়াতে চাইল। জিতু জহুরি চোখ বুলালো নুবাহর উপর। দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠল। নিজের এক আঙুল নুবাহর ঠোঁটের মধ্যে রেখে বলল,
‘এই ঠোঁটদু’টো দিয়ে গাল ভেংচি কাটছেন তো। ঠিক আছে কাটুন। এর জন্য কড়ায় গন্ডায় শাস্তি উসুল করবো। একটু অপেক্ষা করুন, ম্যাডাম।’
চলবে,,,