হিয়ার_মাঝে ৪৯. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
360

#হিয়ার_মাঝে ৪৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

মেরুন রঙা শাড়ি গায়ে, মাথায় লম্বা ঘোমটার আদলে মুখ ঢাকা নুবাহর। গ্যাসের দু’উনুনে রান্না চলছে। এক চুলায় রুটি সেকে নিচ্ছে, অন্য চুলায় চায়ের পাতিল। ময়নার মা’ কিচেনে নেই। সে গেছে দিলারার রুমে। একা নুবাহ কিচেনে নিজের কাজে মগ্ন। ধ্যান নেই আশেপাশে কি হচ্ছে। লম্বা শাড়ির আঁচল চুলার আঁচে পড়ে লাল আগুনের শিখায় দপদপ করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা দ্রুতই শাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে অথচ নুবাহর হুঁশ নেই। নির্বিঘ্নে নিজের কাজেই ব্যস্ত। কিছুসময়ের মাঝে ড্রাইনিং টেবিলে হাঁকডাক শুরু হবে। সেই জন্যই হয়তো ব্যতিব্যস্ত মেয়ে’টা। কিন্তু নিজের সাথে কত মর্মান্তিক সর্বনাশ হতে চলেছে, তা সম্পর্কে পুরো অজ্ঞাত সে।

জিতুর সর্বাঙ্গ কাঁপন শুরু হল এমন দৃশ্যই। ভাবনার জন্য কিঞ্চিৎ সময় ক্ষেপণও করেনি। চিৎকার দিয়ে ছুটল নুবাহর দিকে। বিদ্যুৎ বেগে নুবাহর পেছনে এসে দাঁড়ালো। নিজের দু’হাত বাড়িয়ে আগে নুবাহর মাথা থেকে আঁচল সরালো। দ্রুতই হ্যাচকা টানে শাড়ি খুলে তা মেঝেতে ফেললো। আকস্মিক ঘটনায় নুবাহ তব্দা খেয়ে গেল। সটান দাঁড়িয়ে তখনও। অনাবৃত নিজেকে আবৃত করতে দ্রুতই বসল সে। জিতু বুঝল নুবাহর মনোভাব। তাই নিজের গায়ের টিশার্ট খুলে নুবাহর গায়ে পরিয়ে দিল। নুবাহ তখনও অস্থিরতায় হাসফাস করছে। নুবাহর খোপা করা লম্বা চুলগুলো খুলে দিল জিতু। বসানো থেকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে নুবাহর দিকে স্থিরদৃষ্টি দিল সে। গলার স্বরে ভীষণ আকুলতা মাখানো।

‘নুবাহ, আগুনের আঁচ তোমার অন্য কোথাও লাগেনি তো।’

নুবাহর দু’গালে হাত রেখে আপাদমস্তক ভালো করে দেখছে সে। অথচ নুবাহ বিস্ময়কর চাউনি ফেলছে জিতুর দিকে। অবিশ্বাস্য সেই চাউনি! কেমন মন পাগল করা! চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে তার এমন অব্যক্ত চাউনিতে জিতু বিরক্ত হল। কিছু বলতে মুখ খুলল মাত্রই। তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে ছুটে আসা তার বাবা, ভাইয়ের হাঁকডাক শোনা গেল। জিতু তড়িৎ নুবাহকে বুকে চেপে নিজের পিঠ পেছনে দিয়ে তাকে আঁড়াল করল। নিজের গলার স্বর উঁচু করে সর্তকবানী জারি করল দ্রুতই সবার উদ্দেশ্য,

‘একদমই এখানে কেউ আসবে না। সবাই বাইরেই থাকো।’

আজমল কিচেনরুম থেকে দূরত্ব বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছিল? তুই চিৎকার দিলি কেন?’

পাশাপাশি ফরিদাও ছুটে এলেন। কিন্তু জিতুর কড়া নিষেধে তিনিও প্রবেশ করেন নি। ময়নার মা ছুটে এসে দরজার পাশে দাঁড়ালেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ইস্ততঃবোধ করছিলেন। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘ও জিতু বাবা, কি’তা হইছি গো? এতটা’ চিল্লাইনি দিলা ক্যা?’

‘মতি খালা, ঐ খানেই দাঁড়িয়ে থাকো। ভেতরে প্রবেশ করো না। আমার বউ লজ্জা পাবে।’ জিতুর সাবধানী বার্তা তার জন্যও জারী হল।

এই একটাই বাক্যেই নুবাহর লজ্জারা যেন আচমকাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এতক্ষনের চেপে রাখা লজ্জা বেরিয়ে এল দ্রুতই। লোকটা কাউকে কিচেনে ঢুকতে দিল না। অথচ নিজে তাকে চেপে ধরে আছে বক্ষ পাঁজরে। সে নিজের নজর উঠানোর ন্যূনতম চেষ্টাও করল না। কিভাবেই করবে, সে যে এখনো জিতুর বক্ষ মাঝে লেপ্টে আছে। অযাচিতভাবে কত কিছুই ভাবছে। অথচ এই স্বামী নামক পাষাণ’টা হুট করে কখন উদয় হল বুঝতেই পারেনি। জিতু নুবাহর দু’গালে এখনো হাত ধরে আছে। এবার কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলে উঠল,

‘আমি তোমার সাথে রোমান্স করতে এসেছি নুবাহ। জিজ্ঞেস করেছি তোমার গায়ে কোথাও আগুনের আঁচ লেগেছি কি’না? কিন্তু তুমি তো দেখছি রোমান্টিক মুডে আছো। সত্যি’টা বলবে না’কি আমি নিজেই সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব।’

অক্ষিজোড়া মুহুর্তে গোল রসগোল্লার মত হয়ে গেল নুবাহর। এই জিতুকে সে একদমই বিশ্বাস করে না। এই খোলা কিচেনে যদি কিছু করে বসে। ভয়ে আৎকে উঠল। কালক্ষেপণ না করেই শেষোক্ত বাক্যে দ্রুতই আওড়ালো।
‘আসলে, তেমন কোথাও লাগেনি। সত্যিই বলছি।’
‘তুমি সিউর।’
‘হুমম।’

জিতু তাচ্ছিল্যের সুরে ফের বলে উঠল, ‘তোমরা মেয়ে’রা ঝগড়া যত সহজে করতে পারো, তত সহজে যদি মনের ভাব প্রকাশ করতে তাহলে এই অভিমান শব্দটার জন্মই হত না কখনো।’
নুবাহ অবাক হল। কিঞ্চিৎ কাঁপা স্বরে বলল,
‘মানে!’
‘থাক, এত মানে জেনে তোমার লাভ নেই।’

নুবাহর দৃষ্টি এবার কৌতুহলী হল। জিতুর রূপবদল সে আজও ধরতে অপরাগ। হুট করেই পরিবর্তন হয়ে যায়। চুপসে গেছে আগের মতই। জিতুও কথা বাড়ালো না। বাইরে এখনো শোরগোল শোনা যাচ্ছে। জিতু দরজায় উঁকি দিয়ে বলল,
‘তোমরা কষ্ট করে বাসার বাইরে যাও তো। আমি তোমাদের পরে বলছি কি হয়েছিল। এখন নুবাহকে ঘরে দিয়ে আসি।’

আজমল অনেক কিছুই ভাবলো ছেলেকে নিয়ে। ছেলের সহসাই পরিবর্তন, বউয়ের প্রতি এমন যত্ন তার বেশ ভালোই লাগল। কিন্তু সে নিজমনে ভেবে নিল হয়তো নুবাহর পা ভেঙ্গে গেছে। তাই মেয়েটাকে সে কোলে করে রুমে নিয়ে যাবে। ফরিদাও তারমত এমন কিছু ভেবে নিল। সবাই একসাথে বাইরে অপেক্ষা করছে কখন জিতু তাদের আবার ডাকবে। তারাও সত্যি’টা জানবে। জিতু গ্যাসের উনুন আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। নুবাহর একহাত ধরে তাকে পিছনে রেখে সে সামনে এগিয়ে এল। নুবাহর পরনে পেটিকোট তার উপরে জিতুর টিশার্ট। মাথার চুলগুলো খোলা রেখে লজ্জা নিবারণ করছে। তাই তো জিতু একে একে সবাইকে কিচেন রুমে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নুবাহ নিজমনে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে। এত এত লজ্জার মাঝেও জিতুর দিকে তার ঘোরলাগা দৃষ্টি। লোকটা তার জন্য জামা খুলে ফেলেছে। কেমন যেন সিনেমার নায়িকা মনে হল নিজেকে। এমনটা তো মুভিতে হয়। নায়ক এসে নায়িকাকে বাঁচিয়ে নিজের জামা খুলে পরিয়ে দেয়। নায়কের এহেন রূপে নায়িকা ফিদা হয়ে যায়। আজ তো ফের একবার সে জিতুর প্রেমে পড়ে গেল। প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া না ফেলেও সে পেয়ে গেছে।

রুমের মাঝে প্রবেশ করলো দু’জন। নুবাহ একপাশে দাঁড়িয়ে ইস্ততঃবোধ করছে। জিতু নিজের আলমিরা খুলল। সুপারমলের সেই জামবর্ণের তুঁত সিল্কের জামা’টা বের করে এগিয়ে দিল নুবাহর হাতে। পাশে চেইঞ্জিং রুমের দিকে ইশারা করল। নুবাহ নিশব্দে জিতুর হাত থেকে জামা নিয়ে চলে গেল। জামাটা গায়ে পরে কিছুসময় উঁকিঝুঁকি দিয়ে জিতুকে অবলোকন করলো। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো।
‘ভালো তো বাসেন আমায় জিতু। কিন্তু তাও বলেন না কেনো? আচ্ছা, আপনি কি আপনার এক্সকেও এমন করে ভালোবাসেন? জানেন, আমার একদমই সহ্য হয় না আপনার এক্সকে। বিশ্বাস করেন কাছে ফেলে মেরে দিতাম ঐ অসভ্য মহিলাকে।’

জিতু গলা খাঁকারি দিল নুবাহর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। নরম সুরে বলে উঠল,
‘জামা পরলে বাইরে এসো।’
নুবাহ দ্রুতই বেরিয়ে এল জিতুর ডাকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করল,
‘আমি পরে নিয়েছি।’
জিতু অপলক দৃষ্টি ফেললো নুবাহর পানে। মেয়েটাকে অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে। সত্যিই এই জামা’টা তার বউয়ের জন্যই তৈরি হয়েছে। সে কিছুটা দূরত্ব কমিয়ে নুবাহর সামনে দাঁড়ালো। বলে উঠল,
‘নিচে চল, নাস্তা করতে।’

নুবাহ ফের ইস্ততঃবোধ করল। এতদিন শাড়ি পরেছে। আচমকাই আজ জামা পরে নিচে যাবে। তার শাশুড়ী আম্মা রাগ করবে না। এখন কিভাবে কি করবে সে। জিতু কিঞ্চিৎ অবাক হল। নুবাহর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল,
‘কি হয়েছে? কি ভাবছো এত?’
‘আসলে শাড়ি না পরে নিচে যাব, আম্মু রাগ করবে না।’
‘শাড়ি পরতে হবে না আর, আজ মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছো।’
‘কিন্তু, আমার তো কিছুই হইনি।’

মুহুর্তে জিতুর দু’চোয়াল শক্ত হল। বোকা মেয়েটা কি বলে! বিপদ কখনও বলে কয়ে আসে। আজ অনেক কিছুই হতে পারতো। হয়তো চিরদিনের জন্য তার বোকা পাখিকে হারিয়ে ফেলতো। কেন যেন বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো ভাবতেই। অন্যকিছু ভাবতে পারলো না। নুবাহকে দু’হাত দিয়ে টেনে বুকের মাঝে চেপে ধরল। নুবাহ জিতুর এমন আকস্মিক ব্যবহারে চমকালো। কিন্তু প্রতিত্তোর করলো না। জিতু আষ্টেপৃষ্টে নিজের বাহুডোরে বাঁধল নুবাহকে। ফিসফিসিয়ে বলল,

‘এমন করে আর কখনও বলো না, মনে থাকবে তো।’

বুকের মাঝ থেকে সরিয়ে নুবাহর কপালে নিজের ওষ্ঠাদ্বয়ের প্রগাঢ় চুম্বন বসালো সে। ফের চিবুকে দু’হাত রেখে বলে উঠল,
‘থাক নিচে নামতে হবে না। আমি তোমার নাস্তা উপরে নিয়ে আসছি।’
নুবাহ অন্য আরেক বাক্যে মুখ ফুটে বলতে গিয়েও বলতে পারল না। শাড়ি যে শুধু শাশুড়ী মায়ের জন্য পরে তা তো নয়। জিতু যে শাড়ি পরা তার নববধূকে রোজ চোখে হারায় সে তো জানে। শাড়ি যে তার বেশ পছন্দ। তার দেয়া সেই গিফট বক্সের চিরকুটে সেই ইচ্ছের কথায় তো ছিল।

‘তোমার শাড়ির আদলে আবৃত তনয়ার গন্ধে মাতোয়ারা আমার নাসারন্ধ্র। কোমলতা ছুঁয়ে সেই শীতলতা অনুভব হয় আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র মাঝে। এতটা পাগল হই তোমায় ভেবে। এসো এক চন্দ্র রজনী, গায়ে লাল বেনারসি জড়িয়ে। আমি মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হব তোমায় দেখে। আঁচল তুলে তোমার গ্রীবাদেশে বুলাবো আমার ওষ্ঠাদ্বয়ের পরশ। তুমি লজ্জায় নত হবে। আমি বাড়াবো তোমার লজ্জার পারদ। আসবে তো আমার লজ্জার রানী। তুমি আমি দু’টি মিলে হব একাকার। সেইদিন থেকে না হয় হবে আমাদের নতুন সংসার।’

সেই চিরকুট পড়ে যা লজ্জা পেয়েছিল। তাই তো ইচ্ছে করে বলেছিল সে গিফটবক্স ফেলে দিয়েছে। কত্ত খারাপ লোক এভাবে কেউ বলে। তবে জিতুর যে শাড়ি পছন্দ সে বুঝে গিয়েছিল। তাই তো শাড়ি পরে কাজ করতে কষ্ট হলেও সে ঠিকই নিজেকে ঘুচিয়ে নেয়। তবু শাড়ি ছাড়া অন্যকিছু পরেনি। কিন্তু আজকে যা ঘটলো এরপর কি হবে তাই ভেবেই অস্থির তার মন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here