#হিয়ার_মাঝে ৫০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
মধ্যাহ্নের শেষ প্রহর। কিঞ্চিৎ উষ্ণ শীতের প্রভাকর জানালার ফাঁক গলিয়ে ঝুলানো পর্দায় লুটোপুঁটিতে ব্যস্ত। মৃদু বাতায়নে আবির মাখানো সেই পর্দা ঈষৎ দোদুল্যমান। তাতে অবশ্য নুবাহর ধ্যান নেই এই মুহুর্তে। সে আছে তার জাগতিক মহা ভাবনায়। বিছানায় মেলে রাখা বিশাল কাপড়ের ব্যাগ। কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যত্রতত্র। অনাদরে পড়ে আছে সাথে দু’টি লেহেঙ্গা। একটি হলুদ, অন্যটি গাঢ় সবুজ। জিমানের হলুদে পরবে কোনটা? সে থেকেই চিন্তার সাগরে সাতরে বেড়াচ্ছে। ভাবনার সমুদ্র নেহাৎ জিতুর করা কান্ডের জন্যই উদয় হয়েছে। সকালে তার জন্য খাবার নিয়ে এসে নিজ হাতে খাইয়ে দিল। সে খেতে চাইলো না। কটাক্ষ করে উল্টো বলে বেড়িয়েছি।
‘নুবাহ তুমি আমার এক্সের মত হও। জানো, সে কখনো কিছুতে না করেনি। উল্টো খাওয়ার জন্য কতশত বায়না নিয়ে বসতো। কোন রেষ্টুরেন্টে বসবে, কি খাবে তা নিয়ে থাকত তার লম্বা তালিকা। আর একটা তুমি, শুকনো পাটকাঠি। একটু গুলুমুলু হলেই তো পারতে। আমার কষ্টও কম হত।’
খাইয়ে দিয়ে আলমিরা থেকে কাপড়ের বড় ভারী ব্যাগ বের করে আনে। সেই ব্যাগে ছিল সম্পূর্ণ তার কাপড়। সাজ-পোশাক থেকে শুরু করে ব্যবহৃত কাপড়ও আছে। সাথে তার জন্য কেনা সদ্য নতুন আইফোন। সেটা বের করে দ্রুতই তার হাতে গুঁজে দেয়। প্যাকেট খোলা ছিল আগেই। হাতে দিয়ে ফের বলে উঠল,
‘আমি সব সেট করে রেখেছি। মোবাইল বেচারা এখন অজ্ঞান। তবে শুধু তোমার হাতের আঙ্গুল বসিয়ে চাপ দিলেই সে আবার জ্ঞান ফিরে পাবে। ওয়ালপেপারে খুব সুন্দর দেখে আমার একখানা ছবি সেট করে দিয়েছি। আমার কথা মনে হলেই মোবাইলের দিকে তাকাবে। চাইলে ডজন খানেক চুমুও খেতে পারবে বিন্দাস। কেউ দেখবে না, আমিও না।’
মুখ কিড়মিড়িয়ে সে জবাব দিয়েছিল তখন, ‘চুমু খাবো কেনো, আজব!’
জিতুর মুখের কোণে দুষ্ট হাসি। জবাবও দিল দ্রুত, ‘কিন্তু আমি তো খাই, রোজই খাই। জানো সেই স্বাদ। তুমিও খেয়ে দেখতে পারো।’
কয়েক বাক্যে বলেই মুখ টিপে হাসলো। কত্ত বড় বদলোক। ভাবা যায়। ফের ব্যাগ থেকে হলুদে পরার জন্য দু’জোড়া কাপড় বের করল। যাওয়ার আগে ফের সেই এক্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। জোরালো গলায় বলল,
‘নুবাহ তুমি হলুদ’টা পরবে না কিন্তু। আজ তো আমার এক্সও আসবে হলুদ অনুষ্ঠানে। সেও হলুদ রাঙা পরি সাজবে নিশ্চয়। তার মত একই সাজ-পোশাক পরতে যেওনা। তুমি বরং সবুজ’টা পরে যেও।’
সেই থেকে ক্রোদের দাবানলে পুড়ছে সে। জিতুর এক্স হলুদ পরবে বলেই সে হলুদ পরবে না, তা মানতে নারাজ। তবে এবার দীর্ঘায়িত ভাবনার ছেদ ঘটালো। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল, এই হলুদটাই পরবে সে। দেখিয়েই ছাড়বে জিতুকে। তার এক্সের থেকেও দ্বিগুণ সুন্দর করে সাজবে। একদম হলুদ পরি হয়ে যাবে। তখন দেখবে জিতুর ভোঁতা মুখ।
রেশম কাপড়ের হলুদ লেহেঙ্গায় সম্পূর্ণ সোনালি সূঁতো বুনন করা। তার সাথে মেলানো সব গহনাদি আর সাজসরঞ্জামও। সে একে একে সব নিজের গায়ে জড়ালো। লেহেঙ্গার ওড়না কাঁধের একপাশে পিন বাঁধিয়ে কোমর সমান সামনে অর্ধেক রাখল, বাকিটা পিঠের দিকে শাড়ির লম্বা আঁচলের মত রেখে তা কোমরের মাঝে আবার পিন দিয়ে বেঁধে নিল। সোনালী রঙা হিজাব বাঁধল মাথায়। তার উপর একপাশে বড় ঝুমকোলতার মত টিকলি পরল। সাজ শেষ হতেই ইনশিয়ার আগমন হল। তার দিকে হা’ হয়ে বলে উঠল,
‘চাথীআম্মু, তুমি তুমি তুন্দর পুউরী।’
নুবাহ হাসল। গাল টেনে বলল, ‘তুমিও তো সুন্দর জামা পরেছো, তুমিও হলুদ পরী।
ইনশিয়া খিলখিল করে হাসল। আরও কাছে এসে নুবাহর এক হাত টেনে ধরল।
‘চাথীআম্মু, দাদু নিতে ডাকে তো।’
ইনশিয়ার একহাত ধরে নিচে নামল নুবাহ। নিচে ফরিদা, আজমল ও ঈশিতাসহ সবাই নুবাহর জন্য অপেক্ষারত। সে নামতেই ফরিদার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী দেখা গেল। নুবাহকে দেখে নিজমনে বিড়বিড় করল,
‘মাশা’আল্লাহ! মাশা’আল্লাহ!’
নিজের ছেলের বলা সেই কথাগুলো মনের কোণে ভেসে উঠল তখন। কেমন অনুরোধের সুরে তার কাছে আকুতি জানালো।
‘আম্মু, নুবাহকে আর শাড়ি পরতে নিষেধ করিও। আজ তো মরতে মরতে বেঁচে গেছে। জানো আমি যখন নিষেধ করলাম। উল্টো কি বললো, আম্মু রাগ করবে না শাড়ি না পরলে। তুমি বললেই শুনবে। আমার কথা মানবে না একদমই।’
ফরিদার অধরকোণে প্রসন্ন হাসি। ছেলেটা এবার ঠিক হলেই হল। এর চেয়ে বড় পাওয়া কি আর তার!
. . .
গোধূলির আবির মাখানো পড়ন্ত বিকেল বেলা।সন্ধ্যের কালচে আঁধার ধরণীতে এলো বলেই।কিন্তু ত্রিশ মিনিটের গন্তব্য এক ঘন্টায় শেষ করে সেনা মালঞ্চের সামনে দাঁড়ালো নুবাহদের গাড়ি। কৃত্রিম আলোকসজ্জায় সজ্জিত প্রধান ফটক। ভেতরের সরু লম্বাপথটুকু পেরিয়ে বিশাল উঠানের মত জায়গার মাঝে কৃত্রিম জলের ফোয়ারা। সরু রাস্তা ছোট ছোট বাতি দ্বারা সজ্জিত জলের ফোয়ারা পর্যন্ত। রঙিন বাতি দ্বারা সজ্জিত সেনা মালঞ্চের দু’তলার বিশাল ভবন। ভেতরে পা রাখতেই সেনা মালঞ্চের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নজর কাড়ল নুবাহর। ইনশিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কবে ভেতরে প্রবেশ করবে। সবার আগে চিৎকার চেঁচামেচি করেই যাচ্ছে। ঈশিতার হাত ছেড়ে দাদার হাতে হাত রেখেছে। আধো বুলিতে আওড়িয়ে যাচ্ছে বার বার,
‘আমি আমি ছবার আগে পৌঁতে ফাস্ত হব। তুমবা পাববা না।’
নুবাহ সবার শেষে নিজেকে রেখে কিঞ্চিৎ আঁড়াল করেছে। নতুন বউ তার উপর যদি জিতুর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে ঘটল ভিন্ন এক ঘটনা। আচমকাই তার উপর ফুলের বৃষ্টি। সে চমকে উপরে তাকালো। বন্ধুমহলের সবাই ফুলের ঢালা হাতে দাঁড়ানো। শুধু একজন মানুষ নেই এখানে। জিতুর ডিম কোথায়? ফুলের বর্ষণে লজ্জানত হলেও মুখের কোণে মুচকি হাসি। সামনে কদম বাড়াতেই চোখে পড়ল তার দিকে একটা ক্যামেরা তাক করে রাখা। সে বেশ ঘাবড়ালো। পাশে থাকা ইনশিয়া সেই খুশি। তার মাথায় ফুল পড়ছে। সে বার বার চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
‘বেসি বেসি ফুল মারো না। আমি আমি মোজা পাই না। দুন্দর লাগে তো।’
সবার মাঝ থেকে চিন্ময় জবাব দিল, ‘পাকনা বুড়ি, তোমার বিয়ের দিন আরও বেশি দেবো।’
ইনশিয়া দাদার হাত ধরে বলে উঠল, ‘দাদাভাই আমি বিয়ে তব্বো। ফুল দিবো তো চাত্তু।’
আজমলসহ বাকি’রা হেসে উঠল। ঈশিতা ব্যঙ্গ করে বলে উঠল,
‘তোর কর্ণেল দাদার কাজ করার জন্য রেখে যামু।’
ইনশিয়া রাগান্বিত হল। মায়ের জবাব দিল দ্রুতই। ‘আমি কাত তব্বো না, বিয়ে তব্বো।’
‘কাজের বেটি হিসেবে দিয়ে যামু জিমানের বাপেরে। বিয়ে করে কি করবি।’
ইনশিয়া চেঁচিয়ে উঠল। দু’পা মেঝেতে রেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমি কাত তব্বো না।’
আজমল দ্রুত নাতনীকে কোলে তুলে নিলেন। কিন্তু ইনশিয়া চেঁচিয়েই যাচ্ছে। নুবাহ সবার সাথে ভেতরে প্রবেশ তো করল। কিন্তু মন তার বেয়াদব জামাইকে খুঁজে যাচ্ছে। বন্ধুমহলের সবাই উপস্থিত শুধু তার বেয়াদব জামাই’টা নেই। হৈ হুল্লোড় আর হৈচৈ তে মেতে আছে সবাই। হলের মাঝখানে মঞ্চ। সেখানে ফুল আর হলুদ রঙা পর্দার তৈরি বর বউয়ের আসন। বন্ধুমহল কি কাজ করছে কে জানে। ভীষণ ব্যস্ত দেখালো। পাশে তাদের জন্য অন্য আরেকটি মঞ্চ, যেখানে বন্ধুমহল পারফর্ম করবে। জিতুও পারফর্ম করবে হয়তো। সেজন্য বোধহয় ব্যস্ত আছে। কিন্তু আছে কোথায়? নজর বুলালো চারপাশে। জিমিকে দেখল হলুদের সাজে একদম হলুদিয়া পাখি লাগছে। তার কাছে দৌঁড়ে এল। জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ভাবী ভালো আছো? কতদিন পর তোমার সাথে দেখা হল? চল উপরে, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
হলের ভেতরে চলন্ত লিফট উপরে উঠার জন্য। জিমির সাথে উপরে উঠল। সাথে ঈশিতা, ফরিদাও উপরে উঠল। তাদের একরুমে বসানো হল বিশ্রামের জন্য। নুবাহর মন বসতে চাইছে না। শুধু জিতুকে খুঁজে যাচ্ছে। তার উপর তার এক্সকে দেখার জন্য উতলা হয়ে আছে। মেয়েটাকে কেমন লাগছে তার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশে ফের চোখ বুলালো কিন্তু যা কয়জনই চোখে পড়ল সবাই হলুদ পরেছে। তাহলে জিতুর এক্স কে? রুম থেকে বের হয়ে দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। জহুরি দৃষ্টি বুলাচ্ছে আশেপাশে। আচমকাই এমন একজনকে দেখল আৎকে উঠলো। তার শাশুড়ী মা’ তাকে ডেকে পরিচয় করালো।
‘নুবাহ ও তোমার মামাতো জা’ হয়। আমার ছোট ভাইয়ের বড় ছেলে জহির। তার বউ সে। জিতুর জন্য তুমিও বিয়েতে যাওনি। তাই আর দেখাও হয়নি। সালাম দাও।’
নুবাহ চোখ পিটপিট করে তাকালো। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। গলার মাঝে শব্দগুচ্ছ দমবন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু তার দৃষ্টি পুরোপুরি লিমাতেই আবদ্ধ। লিমাও কেমন খৈ হারানো মাছের মত তাকিয়ে আছে। তার নিজেরই ধারণার বাইরে নিশাতের সাথে দেখা হবে আবার। তবে মনের মাঝে রাগের পাহাড় জমে আছে। ইচ্ছে করছে এখনিই সব উগলে দিতে। কিন্তু নতুন অতিথির সাথে নতুন বউ সে। তাই চাইলেও মুখ নিঃসৃত কোন বাক্যে আওড়াতে পারলো না। নুবাহ সম্মানসূচক কিঞ্চিৎ হাসল।
পায়ের কদম আরও নিকটবর্তী করে লিমার পাশে এসে সালাম দিল। লিমাও সালাম নিল। দু’জনের মনে সংশয়। কারো ক্রোধের আর কারো মনে ঈর্ষার। নুবাহ ক্ষীণস্বরে বিদ্রুপের সুর তুললো মুখে।
‘পৃথিবী’টা বড্ড গোল আরও একবার প্রমাণিত।’
লিমার মুখেও শ্রীহীন এক বাক্যে। কেমন অদ্ভুত শোনালো তার কাছে।
‘গোল তো হবেই, যতই অপরাধী অপরাধ করুক, তাকে যে ধরা দিতেই হবে। পালিয়ে কতদিন বাঁচা যায়।’
‘কে পালিয়েছে?’
‘তুই।’
‘আমি কেন পালাবো?’
‘মনে হয় সদ্যোজাত নিষ্পাপ শিশু। কিছুই জানে না।’
‘হুমম নিষ্পাপ শিশুই আমি। কিছুই জানি না।’
‘চরিত্র হনন করেও তোর কত তেজ।’
‘কার চরিত্র কেমন সেটা স্কুলের সবাই জানত।’
লিমার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। জবাবে বলল,
‘আর তোর চরিত্র কেমন পুরো বরিশাল জেনে গেছিল। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে মহল্লার ফুটপাত।’
নুবাহ স্তব্ধ নির্বাক। আজও কেন সেই অতীত তার পিছু ছাড়ে না। উত্তর জানা থাকলেও দেয়ার ইচ্ছে নেই বিন্দুমাত্র। লিমার সামনে থেকে বাঁচতে নিজেকে গুটিয়ে নিল। দোতলা ছেড়ে নিচে নামল অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। সন্ধ্যা গড়িয়েছে বেশ সময় হল। রাতের কালচে আঁধার হতেই বউয়ের আগমন ঘটল হলের মাঝে। বর-বউ একই মঞ্চে বসবে। তাদের হলুদ বিয়ে দু’টো অনুষ্ঠানই একসাথে হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ লোক সমাগমে পূর্ণ হল বউয়ের আগমনে। বন্ধুমহল ফের ফুল নিয়ে হাজির। পাশে দাঁড়ানো ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। জিমি তাকে দেখে ডাকল।
‘ভাবী এসো। তুমিও ফুলের বর্ষণ করবে।’
সে দাঁড়াতেই খেয়াল করল তারপাশে লিমাও আছে। তার হাতেও ফুলের ডালা। দু’জনেই ফুল ছিটাতেই প্রস্তুত। কিন্তু বউয়ের আগমনে নুবাহ লিমা দু’জনেই বাকরূদ্ধ।
চলবে,,
আজকাল আপনাদের রেসপন্স একদম কমে গেছে। লাইক, কমেন্টও করেন না অনেকেই। তাই গল্প লিখার আগ্রহও হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। 😓😓