#হিয়ার_মাঝে ৫৫.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
অপরিচিত ব্যক্তির মুখে পরিচিত নাম। এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মত। খুশিতে ডগমগিয়ে উঠল জিতু। দু’চোখ ছলছল কিন্তু হৃদকাননে যেনো এক নব বসন্তের ছোঁয়া। কিন্তু এ খুশি তার স্থায়ী হল না বেশিক্ষণ। যখন দ্বিতীয় বাক্যে শুনল মধ্যবয়সী মহিলার মুখে।
‘কিন্তু ইমদাদ তুমি বড্ড দেরি করে ফেলেছো। আমার মেয়েটা দিনরাত তোমার অপেক্ষা করেছে। অথচ তুমি এত দেরি করে কেনো এলে? আরও কিছুদিন আগে কেনো এলে না?’
জিতু নির্বাক। বলার ভাষা যেনো গুলিয়ে ফেলেছে। আমতা আমতা করল তখন,
‘কিন্তু নুহার কি হয়েছে? আমি কি একবার দেখা করতে পারব তার সাথে।’
‘নাহ, তা আর সম্ভব নয়। তার বিয়ে হয়ে গেছে দিন পনেরো আগে। এখন শ্বশুর বাড়িতে আছে।’
‘কিন্তু একবার আমি তাকে দেখতে চাই? দূর থেকে দেখব। প্লিজ, একবার দিবেন আমাকে সুযোগ’টা।’
‘সময় বড্ড প্রবাহমান। এই বাক্যে বোধহয় তুমি ভুলেই গেছো। প্রায় তিন’বছর। কম সময় তো হয়নি। এতদিন কেনো আসোনি? আমার মেয়েটা তো কম অপেক্ষা করেনি। একটা খোঁজও নাও নি তার। এখন মেয়েটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে তার নতুন সংসারে। আর তাকে বিরক্ত করো না। কোন এক দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাও।’
ফের কিছু বলার জন্য উদ্বত হল জিতু। কিন্তু তার আগেই ওপাশের কল’টা খচ করে কেটে গেলো। সত্যিই তো সে বড্ড দেরি করে ফেলেছে। মন তার তিক্ততায় মূর্ছিত হল আরও একবার। চোখ দু’টো আপনা আপনি মুদিত হল। আচমকাই সেই চোখে ভেসে উঠল মার্বেলের ন্যায় নিকষ কালো দু’আঁখি। যার স্নিগ্ধ কোমল মুখাবয়ব দেখে মুহুর্তগুলো তার থমকে আছে কোথাও। আধবোজা দু’চোখ যখন খুলল সামনে এক স্কুল পড়ুয়া মেয়েকে দেখল। যার গায়ের হিজাবটা তার বোকা পাখিকে দেওয়া সেই হিজাবের একটা। এই হিজাব বাজারে পাওয়া অসম্ভব। তাই সময়ক্ষেপণ না করে সেই মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কোথায় পেয়েছো এই হিজাব?’
হিজাব! নুবাহ বেশ অবাক হল। জিতুর দিকে তাকালো চকিতে নয়নে। ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘হিজাব, কোন হিজাবটা? আপনার দেয়া আমার মেরুন রঙা হিজাবটা হারিয়ে গেছে। কোথাও খুঁজে পাইনি। সেই হিজাবটা না’তো!’
জিতু হ্যাঁ বলে কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। তারপর বলে উঠল,
‘জানো মেয়েটা আমতা আমতা করল প্রথমে। পরে বলল বান্ধুবীর হিজাব। আমি তাকে নতুন একটা হিজাব দিয়ে তোমার সেই হিজাবটা নিয়ে নিয়েছি। বান্ধুবীর বাড়ির সন্ধানে মিরপুর ১০ এ পর্যন্ত গিয়েছে। অথচ এই মেয়ে আমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছে। এত কাছে গিয়েও আবার হারিয়ে ফেললাম তোমাকে। ঠিক সেদিন বিকেল বেলায় ম্যাথ টিচার ওবায়দুল আলমগীর আমাকে কল দিলেন। তার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ। তিনি আমাকে প্রথমে তুমি করে বললেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি যেই মেয়ের সন্ধান করছো তাকে কিভাবে চেনো?’
আমি আনন্দের সহিত জবাব দিলাম, ‘আমার বিকাশ নাম্বারে ভুল করে তার দশ হাজার টাকা চলে এসেছিল। এরপর আমি সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিই। মেয়েটা তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তাই ওকে ম্যাথে সাহায্যে করেছিলাম। এভাবে তার সাথে পরিচয় হয়েছিল।’
‘আমি ভুল না হলে তুমি কি সেই অনলাইন টিউটর? যে নিশাত নুবাহকে অংকের নতুন ফর্মুলা শিখিয়েছিল?’
আমি তখন মূর্ছিত হলাম। ফের বলে উঠলাম,
‘আপনি ওর কি নাম বললেন?’
‘নিশাত নুবাহ। কেনো তুমি ওর নাম জানো না।’
দিগ্বিদিক শূন্য আমি। স্যারের কল রেখে দিলাম। ফের মধ্যবয়সী মহিলাকে কল দিলাম। তিনি এবার খুব বিরক্ত নিয়ে কল রিসিভ করলেন। বলে উঠলেন,
‘হঠাৎই তোমার এত প্রেম কোত্থেকে আসল শুনি।’
‘ওর পুরো নাম কি?’
‘কেনো? নামই জানো না তার। ভারী অদ্ভুত প্রেমিক তুমি! এতদিন পর নাম জিজ্ঞেস করছো?
‘ওর নাম কি নিশাত নুবাহ।’
‘হুমম, আর কিছু?’
‘আপনি রুবি খালামনি?’
রুবি যেনো আকাশ থেকে পড়ল। তাকে কিভাবে চিনলো। বিস্মিত গলার সুর,
‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি আমার নাম কিভাবে জানলে?’
‘আমি নিজের পরিচয় দিয়ে সবকিছু খুলে বললাম। খালামনি কেঁদে দিলেন খুশিতে। তোমার সাথে হওয়া অতীতের সব ঘটনায় খুলে বললেন আমাকে। আমার খুব কষ্ট লাগলো তা শুনে। তারপর বললেন তিতুমীর কলেজে ভর্তি হওয়ার কারণ। আমাকে খুঁজতে ম্যাথ বিভাগে তোমার কেন এত বেশি বিচরণ ছিল। তখন আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হল। তবে এই জল কষ্টের নয় বরং আনন্দের। আমি দ্রুতই ছুটে এলাম বাড়িতে। তোমার রুমে গিয়ে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তোমার দেখা নেই তখন। অযাচিত মনে তোমার টেবিলে রাখা এক কোণে ডায়েরির দিকে নজর পড়ল। ভাবনাহীন সেই ডায়েরি হাতে তুলে নিলাম। ডায়েরির পাতায় পাতায় তোমার অভিমান মেশানো।
‘ইমদাদ এত কাছে তুমি, চাইলে তো ছোঁয়া যায়। তবু বাড়ায়নি হাত, তুমি চাও নি বলে। দৈবক্রমে আমার বিচরণ তোমার কুঠিরে। না হোক পরিচয় বিনিময়, থেকে যাবো নিরবে। এত কাছাকাছি, তবু দূরত্ব শত ক্রোশ মাইলের।’
‘তোমার হারিয়ে যাওয়া বোকা পাখি’
ডায়েরির পাতায় আমার চোখ আটকে গেল। দিব্যি আমাকে চিনতে পেরেও তুমি এড়িয়ে যাচ্ছো। জানো ডায়েরি পড়ে মনে হল, কেন আমি এটা পড়লাম। অন্তত তোমার অনুভূতি জানা হত না আমার। অজান্তেই তোমাকে কাছে টেনে নিতাম। কিন্তু সেদিন হুট করে আমার কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ বাড়ল। তোমাকে পাওয়ার যে তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে এসেছিলাম, তা যেনো মুহুর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। কেমন যেন আমারও অভিমান জমল তোমার উপর। এত কাছে তবু ছোঁয়ার নেই সাধ্যি! কেন এই দূরত্ব বাড়ালে? একবার কি বলতে পারতে না, জিজ্ঞেস করে দেখতে আমাকে?
নুবাহ নাক ফুলালো। তীব্র অভিমান চোখেমুখে ফুটে উঠল।
‘তাই বুঝি সেদিন থেকে আপনি আমাকে রাতে আর বুকে নেননি।’
‘কে বলেছে আমি তোমাকে বুকে নেয়নি।’
‘ওটা তো ঘুমের ঘোরে নিতেন।’
‘কে বলেছে ঘুমের ঘোরে নিয়েছি।’
‘তাহলে!’
জিতু মিটমিট করে হাসল। নুবাহর কপালে ওষ্ঠদ্বয়ের গাঢ় চুম্বন বসালো। তার দু’গালে নিজের দু’হাত রেখে বলে উঠল,
‘বিচ্ছেদ, সম্পর্কে দূরত্ব বাড়াতে পারে কিন্তু ভালোবাসা নয়। এই যে আমার বোকা পাখি না জেনেও তোমাকে বুকে জড়িয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলতাম। তুমি কি বুঝতে না। কিন্তু জানো তুমি আমার বোকা পাখি জেনে সেই প্রশান্তির শ্বাস আরও দ্বিগুণ ফেলেছি। কত রাত তোমার ঐ ঘুমন্ত মুখ দেখে পার করেছি। বক্ষপিঞ্জরের মাঝে দৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ করেছি। ঘুমের ঘোরে থাকা এই বোকা মেয়ে বুঝি টের পায়নি একটুও।’
‘টের পেয়েছি তো! কিন্তু আমি তো ভাবতাম, আপনি ঘুমের ঘোরে আমাকে বুকে নিতেন।’
‘তাই নাকি!’
‘হু।’
‘আচ্ছা, তাহলে এবার থেকে ঘুমের ঘোরের সুবিধা নিতে হবে। তুমি না বুঝার ভান করবে আর আমি ঘুমের ঘোরের ভান করব। চলবে।’
লজ্জায় দু’চোখ নিচু করলো নুবাহ। জিতুর দু’হাত তখনও তার দু’গালে রাখা। কিন্তু জিতুর অপলক দৃষ্টি নুবাহতে নিবদ্ধ। সে কিছু বলতে দু’ঠোঁট নাড়ালো মাত্রই। নুবাহর চোখ ছলছল। ভেজানো গলায় হুট করে বলে উঠল,
‘আপনার সেদিন কি হয়েছিল? আপনি কেনো আসেন নি?’
জিতু চুপসে গেল মুহুর্তে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো এতক্ষণ। কিভাবে বলবে সত্যি’টা। মেয়েটা ভয় পাবে না’তো আবার? কয়েক মুহুর্তের জন্য নুবাহকে জড়িয়ে ধরলো। মুখের কোণে সেই দীর্ঘায়িত কষ্টের ছাপ আর নিতে চাইলো না। এবার থেকে যা হবে সুখের, ভালোবাসার আর আনন্দের। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলার জন্য উদ্বত হতেই তার মুঠোফোন কর্কশধ্বনি তুললো। স্ক্রিনে জিমানের নামটা জ্বলজ্বল করছে। তড়িঘড়ি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে জিমানের আতঙ্কিত গলার স্বর ভেসে এল।
‘চিন্ময়ের কি হয়েছে জানিস?’
জিতু চমকালো। দ্রুতই জবাব দিল,
‘না’তো! কেন কি হয়েছে?
‘বুঝতে পারছি না। দু’ঘন্টা ধরেই গায়েব। কিন্তু সানি বলল সে বাইকে করে কোথাও গেছে বোধহয়।’
‘কল দিয়ে দেখ। আচ্ছা, নয়তো আমি দিয়ে দেখছি।’
‘আমি অনেকবার কল দিলাম, কিন্তু রিসিভ হল না।’
জিতুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। আচমকাই চিন্ময় কোথায় গায়েব হয়ে গেল? হুট করে গায়েব হওয়ার মত ছেলে সে নয়। কিন্তু গেলো তো গেলো কোথায় গেলো? নুবাহর এক হাত চেপে রুম থেকে বেরিয়ে এল দু’জন। গলার স্বরে তীব্র উৎকন্ঠা জিতুর। বলে উঠল,
‘নুবাহ তোমাকে ফ্রি হয়ে সব বলব। এখন চল হলরুমে। চিন্ময় গত দু’ঘন্টা ধরে গায়েব। ওকে খুঁজতে হবে আগে।’
নুবাহও বিচলিত।
‘কি হয়েছে চিন্ময় ভাইয়ার?’
‘জানি না। খুঁজতে হবে আগে।’
নুবাহকে তমার সাথে বসিয়ে জিতু বের হয়ে এল সেখান থেকে। নিচের হলরুমে বন্ধুমহলের সবাই উপস্থিত। সবার চোখমুখে উৎকন্ঠার ছাপ। জিতু পাশে দাঁড়াতে সানি বলে উঠল,
‘আমি চিন্ময়কে দ্রুতই বেরুতে দেখেছি।’
জিতু বলার আগে মুবিন দৃঢ়গলায় জবাব দিল, ‘তো যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করলি না কেন কোথায় যাচ্ছে?’
‘আসলে,,, তখন!’
‘আসলে তখন কি? ফের মুবিন জবাব দিল।
‘হৃদি ছিল সেখানে।’
জিতুসহ সবার চোখ তখন হৃদির দিকে। জিতু কপাল কুঁচকালো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘তো হৃদি থাকলে কি হয়েছে?’
সানি এবার জবাবহীন। কিন্তু বন্ধুমহলের সন্দিহান দৃষ্টি তখন হৃদির উপর। হৃদি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি করেছে? এভাবে কেনো দেখছে সবাই?
চলবে,,,,,,