হিয়ার_মাঝে ৫৭. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
349

#হিয়ার_মাঝে ৫৭.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

নিশুতি রজনীর গভীরতায় আচ্ছন্ন শহরবক্ষ। মাঝেমধ্যে সড়কের ছুটন্ত গাড়ির সাঁই সাঁই শব্দ ভেসে আসছে ভবনের বদ্ধ ঘরে। মধ্য জানুয়ারি মাস। মাঘ মাসের শীতের প্রকোপ বেড়েছে যান্ত্রিক শহরের বুকেও। হিম করা শীতে কম্বলের নিচে একে অপরের বক্ষপটে লেপ্টে আছে এক প্রেমিক যুগল। নিদ্রাহীন দু’জনেই পিনপতন নীরবতায় আচ্ছন্ন। তবে উশখুশ করছে নুবাহ দীর্ঘ সময় ধরে। অথচ জিতু ভাবনাবিহীন। তার অপলক দৃষ্টি নুবাহতে নিবদ্ধ।

নুবাহ নীরবতা ভঙ্গ করল শেষে, ‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?’
জিতুর জবাব তৈরিই ছিল, ‘আমার বউ দেখি। কিন্তু এই পিচ্চি মেয়েটা কখন এত বড় হয়ে গেলো, তাই ভাবছি?’

নুবাহ ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সে কখন পিচ্চি ছিল? যথেষ্ট বড়ই ছিল। এতটাও অবুঝ নয় যে, সে কিছুই বুঝে না। নিজের দু’ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দিল জিতুর,
‘আমি কখন পিচ্চি ছিলাম?’
‘তুমি পিচ্চি ছিলে না তাহলে?’
‘একদমই না।’
জিতু মুচকি হাসল। রগড় গলায় বলল,
‘তাহলে বিয়েটা তিন’বছর আগেই করা উচিৎ ছিল। এতদিনে দু’ তিনটা বাচ্চার বাপ হওয়া যেত। তাই না, বউ!’

নুবাহ যেনো আকাশ থেকে পড়ল। জিতুর ডিম তাহলে এইজন্যই তাকে পিচ্চি বলছে। কত্ত বদ লোক। মন চাইছে এর মুখ সেলাই করে দিতে। নষ্ট পুরুষ মানুষ। দাঁতে দাঁত পিষে যাচ্ছে সে। জবাব দেয়ার জন্য উত্তর খুঁজল। অথচ জিতুর চোখেমুখে তখন খুশি উপচে পড়ছে। বউকে জ্বালাতে পেরে নিজমনে বেশ প্রসন্ন হল। এবার দ্বিতীয় কাজ করার পালা। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। মুঠোফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল কাঙ্খিত নাম্বারে। কল করার কিছু সময়ের মধ্যেই রিসিভ হল। অপরপ্রান্তে জিমানের বিরক্তিকর সুর ভেসে এল।

‘কিরে এত রাতে কোন দুঃখে কল দিলি।’

জিতুর স্বর বেশ গম্ভীর। জবাবে বলল, ‘বাসর সারার আগে আশেপাশে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিস। হয়তো কোনো একজন তোদের উপর নজর রাখছে। সাবধান, তার চোখজোড়ায় তোরা নজর বন্ধী হয়ে যেতে পারিস। শুধু বন্ধু না ভায়রা ভাই ভবিষ্যৎ বেয়াই হিসেবেও তোকে সর্তক করা আমার নৈতিক দায়িত্ব ছিল। এবার তুই কি করবি কর, বাকিটা তোর মর্জি, তোর রুম, তোর ইচ্ছে। রাখছিরে।’

জিমান পড়ল বেশ বিপাকে। তাকে কেউ নজর রাখছে। কে সে? পুরো রুম চিরুনি অভিযান চালিয়েও একটা টিকটিকির দেখাও পেলো না। তমাও বেশ ভয়ে আৎকে উঠছে। সত্যিই কি কেউ নজর রাখছে। কে হতে পারে? জিমান দরজা খুলে বেরুতে চাইল। কিন্তু দরজা বাইরে থেকে লক করা। সে বেশ ধাক্কাধাক্কি করল কিছুসময়। নিজের মুঠোফোন নিয়ে কয়েক’বার জিতুকে কল দিল। কিন্তু কল রিসিভ হল না। ইচ্ছে করছিল হা’রামী বন্ধুর মাথায় গিয়ে কয়েক গা দিতে। শেষে বাধ্য হয়ে বন্ধুমহলের একে একে সবাইকে কল দিল। কিন্তু কেউ কল রিসিভ করল না। এদিকে তমা জিমানের আনন্দের রাত দুঃখে পরিণত হল। হতাশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে বসল জিমান। তৎক্ষণাৎ টুংটাং করে মেসেজ আসার শব্দ হল। সিন করতেই চোখে পড়ল ছোট্ট ক্ষুদে বার্তা।

‘সাবধান, সিসি ক্যামেরা আছে কিন্তু।’

জিতুর দেয়া মেসেজে কিঞ্চিৎ ভড়কালো সে। নিজের তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলালো পুরো রুম জুড়ে। ঘন্টাখানেক পেরুলেও কোনো কিছুই খুঁজে পেল না। ফের হতাশ হল। নিজমনে বিড়বিড় করল, সত্যিই সিসি ক্যামেরা আছে এই রুমে। কিন্তু কে লাগালো? তমা জিমান দু’জনের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সহসাই তমার মুঠোফোন টুংটাং করে এক মেসেজ বার্তার জানান দিল। খুলে দেখল জিতুর হাসিমাখা একখানা ছবি। জিমানকে দেখাতে মুহুর্তেই চোখমুখ কুঁচকালো সে। নিজমনে গালি ছুড়লো, কত্ত বড় হারামী দেখছো। শুধু শুধু এতক্ষণ তাকে ভয় দেখাল।
___

নুবাহ হতবিহ্বল নিজের স্বামীর এমন রূপ দেখে। মুঠোফোন চেপে রেখে অধরকোণে ঈষৎ হাসির আভাস। সেই তখন থেকেই মিটমিট করে হেসে যাচ্ছে। সে গর্জে উঠল।
‘এভাবে হাসছেন কেনো?’
জিতু তাকালো একপলক বউয়ের দিকে। এক হাত টেনে নিয়ে নিজের বক্ষপাঁজরে চেপে ধরল। নুবাহ হাপিত্যেশ করল কিছুসময়। দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন আচম্বিত ঝটকায়। ক্ষীণস্বরে বলে উঠল,
‘এরকম করছেন কেন? ছাড়ুন তো! দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

জিতু নুবাহর কথায় বিশেষ পাত্তা দিল না। উল্টো রসিয়ে রসিয়ে বলল,
‘বন্ধুর বাসরের বিগ্ন ঘটিয়ে নিজে বাসর করার নামই বন্ধুত্ব। বুঝলে বউ।’
নুবাহ হতবাক। ভ্রুদ্বয় কুঁচকে জবাব দিল,
‘মানে।’

জিতু জবাব দিল না। দুজনের মধ্যেকার বাঁধন আরও দৃঢ় করল। নুবাহ নিজের দু’হাত দিয়ে জিতুর চোখমুখ চেপে ধরল। বজ্রকন্ঠে বলে উঠল,
‘একদমই কাছে আসবেন না। আপনার অভিমান ভেঙ্গেছি, তার মানে এটা নয় আপনাকে ক্ষমাও করেছি। আগে আমার সব প্রশ্নের জবাব দিন। তারপর আপনাকে নিয়ে ভাববো।’

মুহুর্তে কালচে মার্বেল চোখ গোল গোল করল জিতু। কিন্তু নুবাহর হাতের মাঝে তার চক্ষুদ্বয় আবদ্ধ হয়ে আছে। বউয়ের জবাব দিতেই হবে। তাই নিজের পেশীশক্তিকে ব্যবহার করল। ধস্তাধস্তি করে বউয়ের হাতের বাঁধন থেকে নিজের চোখমুখ মুক্ত করে নিল। বুকে হাত রেখে হা’ হয়ে নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,

‘আরে বউ মেরে দিবা না’কি? আরেকটু হলে তো অক্কাই যেতাম। এভাবে কেউ বাসর ঘরে বরের চোখমুখ চেপে ধরে। কি ডাকাত বউরে! বাপরে! এত পুরাই সাংঘাতিক বউ আমার।’

নুবাহর চক্ষু চড়কগাছ। কি বলে এইসব! সে কখন শক্ত করে চেপে ধরেছে। শুধু চোখমুখে হাত রেখেছে, এই যা। তার জামাই তো মহা ধঁড়িবাজ! কিভাবে তাকে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। তার চোখমুখ কুঁচকে আছে রাগে। জবাব দিল না মেজাজ চটে যাওয়ায়। জিতু বউয়ের মনোভাব বুঝলো। নিশ্চয় রেগে গেছে তার বউ। তাই গলার স্বর নরম করল।

‘আসলে হয়েছে কি? তুমি আমার চোখমুখ চেপে ধরে আছো? এদিকে প্রশ্নও করছো। তাহলে জবাব কিভাবে দেব বলতো? তাই একটু অভিনয় করলাম আর কি? কথায় কথায় এভাবে রাগলে হবে। বাচ্চাগুলো তোমার মত রাগীনি হলে তো মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে বউ। এতজনকে কিভাবে সামলাবো?’

থ’ হয়ে আছে নুবাহ। নিরেট গলায় জবাব দিল, ‘আপনি আস্ত একটা বদলোক! সেটা কি আপনি জানেন?’
উপর নিচ করে জিতু মাথা নাড়ালো। ফের বলে উঠল, ‘তারপর,,,
‘আপনি একটা মিথ্যাবাদী।’
‘হুমম, তারপর।’
নুবাহর চোখ ছলছল। গলার স্বরও ভীষণ কাঁপছে। ফের বলে উঠল,
‘আপনি ওয়াদা ভঙ্গকারী। কথা দিয়ে কথা রাখেন না।’
‘হুমম, আর।’
‘আপনি আমাকে নুহাহ কেনো ডাকতেন?’

জিতু তড়াক করে হুঁশে এল। মনটা বিচলিত হল হঠাৎই। অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত করল নিজেকে। সেই সময়টা হুঁশহীন কেন ছিল সে? নুবাহর ছলছল করা চোখের জল মুছে দিল। মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দিনের বিশেষ মুহুর্ত। সেদিন এক বোকা মেয়ে তাকে কল দিয়েছিল। আজও চোখের সামনে স্পষ্টত মনে আছে। দ্রুতই নিজের বোকা পাখিকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিল। বলতে শুরু করল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহুর্তের কথা। স্মৃতির রোমন্থন হল ফের একবার।

অতীত,,,,

৫ই ডিসেম্বর ২০২০। শীতের সকালে ৯ টার মধ্যেই ভার্সিটিতে পা রাখতেই হল জিতুকে। সপ্তাহ গড়ালেই তাদের কেমেস্ট্রি ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। তার প্রস্তুতি স্বরূপ শেষ একবার ক্যাম্পাসে ঢু মারল। পড়াশোনা তো আগেই শেষ। আদত বন্ধুতের সাথে আড্ডা দেওয়াই মূখ্য উদ্দেশ্য তার। গায়ে কালো শার্টের সাথে ছাই রঙা প্যান্ট পরিহিত। হাতে কালো বেল্টের টাইটান ঘড়ি। একুশ বছরের টগবগে যুবক সাইকেলে চেপে ক্যাম্পাসে আগমন করল। অদূরে বন্ধুদের আড্ডা বসেছে। সেও তাদের মাঝে সামিল হল আচমকাই। তাদের দেখে কিঞ্চিৎ দূরত্বে হুরপরী নামক কৃত্রিম প্রসাধনীর আঁড়ালে এক ভূত্নীর অবস্থান। চিন্ময় দেখে চোখমুখ কুঁচকালো মূহুর্তে। জিতুকে দেখে টিপ্পনী মারল,

‘জিতু তোর হিরোইন বসে আছে। তোকেই দেখে যাচ্ছে সুন্দরী ললিতা। যা না একটু সঙ্গ দিয়ে আয়।’
সে কিছু বলার আগেই সানি দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠল,
‘আরে এতো মিউমি। আমাদের সাথেই পড়ে।’

জিতু আকাশ থেকে পড়ল মনে হয়। দু’ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘কিন্তু আজ কি কোনো বিয়ের পার্টি আছে না’কি? এত সাজগোছ কেনো এই মেয়ের? তার উপর খোলা চুল রেখে ভার্সিটি এসেছে। একদম অখাদ্য লাগছে।’

জুঁই ফোঁড়ন কাটলো, ‘এই অখাদ্য এভাবেই আসে রোজ। একদম বিরক্তিকর। আমরাও মেয়ে। ভার্সিটিতে এত সাজার মানে কি এটাই বুঝলাম না।’

চিন্ময় জুঁইয়ের জবাব দিল, ‘কারণ তোরা নিরামিষ ও আমিষ, তাই!’
জুঁই চোখ পাকালো। কিন্তু চিন্ময় ভাবলেশহীন। জিতু সবার জবাব দিল।
‘মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করবো। দেখবি মেয়েটা একদম হুজুর হয়ে গেছে। সাজ তো দূরে থাক, হিজাব ছাড়া ভার্সিটিতেই আসবে না।’
লরিন সিমি একসাথে বলে উঠল, ‘সত্যিই।’
কিন্তু মুবিন বলে উঠল, ‘কি করবি তুই?’
রকিও কিঞ্চিৎ বিচলিত। রগড় গলায় বলল, ‘ভাই পরে কিন্তু ফেঁসে যাবি। মেয়েটা কিন্তু ভীষণ ছেঁচড়ারে।’

দায়সারা ভাব জিতুর মাঝে। মুখের কোণে ঈষৎ কুটিল হাসি। বলে উঠল,
‘একদমই না, সোজা সূঁচ হয়ে যাবে দেখবি।’

মাত্রই উঠে দাঁড়ালো মিউমির উদ্দেশ্য। কিন্তু হঠাৎই জিতুর মুঠোফোন টুংটাং করে মেসেজের প্রতিধ্বনি তুলল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পকেট থেকে মুঠোফোন হাতে নিল। স্ক্রিনে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। বিকাশে পুরো ১০ হাজার টাকার একটা মেসেজ জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এটা তার পুরনো বিকাশ নাম্বার। এটাতে গত একবছর ধরে কোনো লেনদেন হয়নি। তাহলে এই টাকা আসল কোথায় থেকে? তার সন্দেহ হল। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিকাশের সেই নাম্বার ডায়াল করল। প্রথম কল রিসিভ হল না। পুনরায় আবার ডায়াল করল। তখন মধ্যবয়সী এক লোক কথা বলে উঠলেন,

জিতু সালাম বিনিময় শেষে বলে উঠল, ‘চাচাজান আসলে এই নাম্বার থেকে মাত্রই আমার ফোনে দশ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। টাকাটা কে পাঠিয়েছে বলতে পারবেন?’

লোকটা নিজেও হতবাক। কিসের টাকা, কার টাকা প্রথমে বুঝল না। তবে সকালের কাস্টমার তো একজনই ছিল। তাই খুব বেশি দেরি হল না তার ভাবতে। সাথে সাথেই বলে উঠল,
‘আসলে মুই তো একজন বিকাশ দোকানদার। এট্টুক্ষণ আগে উগগা ম্যাইয়া টাহ্যা দিয়া গেছিল। কিন্তু ক্যান জিগাইলেন? মুই কি জানবার পারি?’

জিতু কিছুসময় ভাবল, বলা কি ঠিক হবে? তবুও তাকে বলতে হবে। নয়তো টাকা ফেরত দেবে কিভাবে? ফের বলে উঠল,
‘আসলে টাকাটা যে পাঠিয়েছে, সে বোধহয় ভুল নাম্বারে বিকাশ করে ফেলেছে। দেখবেন মেয়েটা ফের আসবে টাকার খোঁজ করতে। তখন আমাকে বলবেন কল করতে। তাহলেই টাকা’টা ফেরত দিয়ে দেব।’

দোকানদার আইচ্ছা’ বলে কল কাটল।

বন্ধুমহল এত সময় ধরে জিতুর কথোপকথন শুনছিল। হুট করে সানি বলে উঠল,
‘তোর বিকাশে দশ হাজার টাকা আসছে। চল দোস্ত এগুলো দিয়ে পার্টি দিই।’

বজ্রকঠিন তার চোয়াল। জিতু ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
‘এই টাকা আমার সানলাইটের বাচ্চা, পার্টি করার হলে আমাদের টাকা দিয়ে করব। কিন্তু অন্যের টাকা দিয়ে কেন দেব। এই টাকা আমি ফেরত দেব জলদি।’

চলবে,,,,,,

এবার থেকে আপনাদের রেসপন্সের উপর নির্ভর করবে প্রতিদিন গল্প দেবো কি’না?😒😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here