#হিয়ার_মাঝে ৫৯.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
রাতের খাবার সবার সাথে খেতে বসেছে জিতু জিমান দু’জনেই। ফরিদা খাবার দিচ্ছে। সন্ধ্যা থেকে দু’জনেই গায়েব ছিল। কিছু সময় আগে ঘরে ফিরেছে দু’জন। তা দেখে ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার তোমাদের না এক সপ্তাহ পর পরীক্ষা। আর তোমরা দু’জনে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছো। তাও এই ঠান্ডার মধ্যে।’
জিমান মেকি হাসল। ঠাট্টার স্বরে বলল,
‘কি বলছো ভাবী, ‘এখন শীতকাল। কিন্তু আমি তো ভাবলাম আরও বসন্তকাল। এর জন্য জিতুর ঠান্ডা লাগে না। তাই না জিতু।’
জিতু মুখ তুলল পরমুহূর্তেই। ফের মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘তা তো অবশ্যই! আপনার মত এরকম একটা কোকিল যদি সারাক্ষণ কাকের সাথে লেগে থাকে। তাহলে কাকের কাছেও শীতকাল বসন্তকাল লাগবে। তাই না জিমান।’
জিমান ভ্রু কুঁচকালো। বলে উঠল, ‘তুই কাক?’
পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়ল। মিটমিট করে হেসে বলল, ‘ওহহ! তুই তো কাকই। আমি ভুলেই গেছিলাম।
জারীব খাওয়া বাদ দিয়ে দু’জনকে একপলক দেখে নিল। গম্ভীর গলায় জিমানকে বলল, ‘জিমান তুই কাল সকালে বাসায় যাবি। দু’জন একসাথে থাকবি, পড়ালেখা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ আড্ডা দিবি।’ ঈশিতা স্বামীর প্রতিত্তোর করল সাথে সাথে।
‘মোটেও জিমান জিতু এমন নয়। পড়ালেখার সময় দু’জনেই খুব সিরিয়াস। শুধু শুধু শাসন করার মানে নেই।’
জারীব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিড়বিড় করল ঈশিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে। মনে হয় ভাই তার নয় তার বউয়ের। ভাইকে কিছু বলা যাবে না। আর বউ সে’তো মনে হয় পরনারী। এই কষ্টের কথা কারে বুঝাবে সে। ঈশিতা ভালোই বুঝল তাকে খোঁচা দিয়েই বলেছে। সে জারিবের পায়ে নিজের পা দিয়ে চিমটি কাটল। জারীব ককিয়ে উঠল মুহুর্তে। খাবার টেবিলে সবার দৃষ্টি তখন জারিবের দিকে। আজমল বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার! হঠাৎ করে এমন চিৎকার দিলি কেন?’ জারিব নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে খেয়ে যাচ্ছে। তার বাবার জবাবে বলল, ‘মনে হয় আব্বু, তেলাপোকা কামড় দিয়েছে।’
‘তাহলে আজকাল তেলাপোকাও কামড় দেয়।’
আজমল এই কথা বলেই মিটমিট করে হাসল। ঈশিতা ভীষণ লজ্জা পেল। এতটা শব্দ করবে জারীব সে ভাবেনি।
____
রাত বাড়ল সাথে জিতুর অস্থিরতাও। সহসাই মেসেজের টুংটাং শব্দে তার অস্থিরতা কমল হুট করে। মুচকি হাসল সে। অবশেষে সব সাজেশন এসে গেছে। এ অসাধ্য সাধন হয়েছে একমাত্র বন্ধু নামক প্রাণীটি পাশে ছিল বলে। খুশিতে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সে জিমানকে জড়িয়ে ধরল। এরকম বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল বন্ধুর উদ্দেশ্য।
জিমান তন্দ্রাঘোরে তখন। এমন করে জড়িয়ে ধরার জন্য চেঁচিয়ে উঠল জিতুকে।
‘পিচ্চি ভাবীর জামাই দয়া করে ছাড়ুন, আমি আপনার নুহাহ নয়।’
জিতু চোখ পাকালো। দ্রুতই ছাড়ল জিমানকে।কিন্তু জিমান ভাবলেশহীন। ফের বলে উঠল,
‘তুই কি ভাবছিস, তোকে ফ্রিতে সাহায্য করছি। ঠান্ডার মধ্যে সেই সন্ধ্যা থেকে প্রায় বারোটা কোচিং সেন্টারে নিয়ে গেছি তোরে। স্যারের সাথে সাজেশন নিয়ে কথা বলছি। এসব এমনি এমনি নয় বন্ধু। পিচ্চিভাবীকে বলবি তার বেষ্ট ফেন্ডকে আমাকে দিয়ে দিতে। তারপর শোধবোধ হয়ে যাবে।’
জিতু যারপরনাই অবাক। সে ভাবছিল তার বন্ধু তার জন্য খেটে মরছে। সে কতই খুশি ছিল। অথচ তার বন্ধুর মনে অন্যকিছু চলছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘মহা হারা’মী তুই।’
জিমান দাঁত কেলিয়ে হাসল। জবাব দিল দ্রুত,
‘তুই প্রেম করবি আর আমি সিঙ্গেল থাকব। দোস্ত যেখানে, আমিও সেখানে। পিচ্চি ভাবীকে বলবি তার বেষ্ট ফেন্ডের সাথে আমার লাইন করিয়ে দিতে।’
জিতু নিজের কপালে হাত ঠেকাল। হতাশার সুর বেরুলো মুখ থেকে, ‘যেখানে নিজের লাইন এখনো হই নাই, সেখানে তোকে কিভাবে লাইন করাবো। আজব!’
___
টানা দু’দিন নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে জিতু সাজেশন তৈরিতে ব্যস্ত। যেভাবেই হোক এই মেয়ের মন জয় করা চাই। পিচ্চি মেয়েদের মন নাকি নরম তুলোর মত হয়। কিন্তু এই মেয়ের মন এত কঠিন কেন? আনমনে কত কিছুই ভেবে চলেছে সে। মাথার ওপর সিলিং ফ্যানের শো শো শব্দ হচ্ছে। একধ্যানে সাজেশনের প্রশ্নপত্র তৈরিতে ব্যস্ত সে। জানালার দিকে বার দু’য়েক তাকিয়ে কাকের খুঁনসুটি দেখছে। কাকের কা কা শব্দগুচ্ছ কানে আসলেই আজকাল প্রণয়ের বর্ষণ শুরু হয়। নিজেকে তখন পাগল পাগল মনে হয়। কি এক অদ্ভুত শিহরণ! যাকে সে দেখেনি অথচ সে তাকেই অনুভব করে।
ঈশিতা অবাক হল জিতুর সহসাই এমন পরিবর্তনে। তার রুমের আশেপাশে কয়েকবার ঘুরে গেছে। যতবারই এসেছে তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লিখতেই দেখছে। নিজমনে ভাবল, হয়তো পরীক্ষার জন্য শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিমান চলে যাওয়ার পর থেকে সে ভীষণ সিরিয়াস পড়াশোনায়। তাই খাবারটাও রবি রুমের মাঝে দিয়ে যাচ্ছে। জিতুর সময় নেই নিচে গিয়ে খাওয়ার। হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু আচমকাই তার নজর পড়ল একটা বইয়ের উপর। এই বই জিতুর রুমে কেন? কিছুটা সন্দিহান সে। তাই কদম বাড়িয়ে কিঞ্চি উঁকিঝুঁকি দিল। যা দেখল তাতেই চক্ষু চড়কগাছ। জিতুর টেবিলে এস.এস.সির বই আর সাজেশন। কেমন খটকা লাগল তার কাছে। তবে পাতায় পাতায় লিখা একটা শব্দ দেখে সে থামল। ‘বোকা পাখি’ লিখাটা সব পাতা জুড়ে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল তার কাছে। তবে সে ঘাটলো না তেমন। নিশব্দে বেরিয়ে এল রুম থেকে।
সময় যেনো দ্রুতই বাড়ল। কিন্তু জিতু মরছে তার অস্থিরতায়। কিভাবে এই মেয়ের সাথে যোগাযোগ করবে। মেয়েটা আদৌ তার সাথে কথা বলবে না’কি প্রত্যাখ্যান করবে। ফের বলবে না’তো বিরক্ত করবেন না। ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেছে। ফ্যানের বাতাসেও সে কুল কুল ঘামছে। ভয় আর দ্বিধায় নিমজ্জিত। কি হবে তার? জিমান বলেছে ভয়ডরহীন কল দিয়ে দিতে। যা হবার হবে। এভাবে আরও তিনদিন কাটল। রাত হলে চোখে ঘুম আসে না তার। মলে আজকাল তার যাওয়া হয় না। কিন্তু এর মাঝে একদিন সে তার পূর্বের অর্ডার গ্রহণ করতে গিয়েছিল। সেখানে তার দু’টো হিজাব বেশ পছন্দ হয়েছে। কেন হয়েছে সে জানে না। হিজাব দুটো নিয়ে তাতেই একট্রা কাজ করতে বলল। তাহলে একদম ভিন্ন হিজাব মনে হবে। তারপর আরও কিছু টুকটাক জিনিস নিল। কিন্তু এগুলো দেবে কিভাবে? বন্ধুমহলে তার সমস্যার কথা জানালো হল। তারা আশস্ত করল আজরাতে কিছু একটা ঘটবে। রাত নামল ধরণীতলে। গত পাঁচদিনেও মেয়েটার সাথে তার কথা হয়নি। কিভাবে কি করবে সে। বেহায়ার মত কল দিয়ে বলে উঠবে, ‘কেমন আছো বোকা পাখি?’ এভাবে বললে তার প্রেম শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। নাহ একদম বলা যাবে না এভাবে।
কিন্তু গভীর রাতে ঘটল এক ঘটনা। যা ছিল তার ভাবনার অতীত। ভোর রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই চোখে পড়ল এই দৃশ্য। সে খুশি হবে না’কি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। তবে চিন্ময় জিমান দু’জনকে কল দিল। তারা কিছু করেছে কি’না। জবাবে দু’জনেই না বলে উঠল। তারা এখনও কিছু করেনি, কিন্তু করবে জানালো। তার মুখে সেই থেকে উপচে পড়ছে খুশি। বোকা মেয়ে তাকে নিজ থেকে কল দিয়েছে। বন্ধুমহলের দু’জনে কিছু না করেও। এ যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তবে এত রাতে কল! কিঞ্চিৎ ভাবালো তাদেরকে।
সেই কারণ জানতে সকাল থেকেই লাগাতার কল দিল। কিন্তু মেয়েটার ফোন বন্ধই বলে যাচ্ছে। মধ্যাহ্ন বেলায় গিয়ে জিতুর কল রিসিভ হল। অবশেষে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। বেশ কসরত করে সেদিন মেয়েটার ঠিকানাও নিল। সেই ঠিকানায় নিজের তৈরি করা সাজেশন পাঠালো তার জন্য। অবশ্য আরও একটা সাজেশন বাড়তি ছিল সেখানে। যেটা জিমান তৈরি করেছিল নুহার বান্ধুবীর জন্য। তবে সে ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে,
‘চাইলে তুমি তোমার বেষ্টফেন্ডের সাথেও এই সাজেশন শেয়ার করতে পারো। এখানে দু’টো সাজেশন আছে কিন্তু।’
সময়ের সাথে সাথে দু’জনের সম্পর্কও বেশ এগিয়ে গেল। তবে ভালোবাসি না বলেও চলল সম্পর্কের নিজস্ব গতি। একদিন বিকেলে পুরো বন্ধুমহল ঘিরে বসে আছে তাকে। দুপুরে লাঞ্চের ট্রিট উসুল করে নিয়েছে। তাও তাদের আবদার শেষ হয়নি। এখন দুপুর তিনটের অপেক্ষায় আছে সবাই। আজকে সবাই পিচ্চি ভাবির কথা শুনবে। সে অনেকবার বলেছে মেয়েটা এমনিই তার সাথে কম কথা বলে। যদি জানে আবার তার বন্ধুমহল তার কথা শুনছে। তাইলে কি আর কথা বলবে মেয়েটি। কিন্তু না সবকটা বন্ধু নাছোড়বান্দা তারা আজ নুহার কথা শুনবে শুনবেই।
জিতু ভয়ে ভয়ে কল দিল। নিজমনে দোয়া পড়ছে আজকে কল রিসিভ না করুক। কিন্তু না, তার মনের আশা পূরণ হয়নি। কল দেয়ার কয়েক সেকেন্ড পর নুহাহ কল রিসিভ করেছে। মেয়েটা আজকে মোবাইল নিয়ে বসে ছিল না’কি? এভাবে সাথে সাথে রিসিভ করল। সালাম দিয়েই প্রথম যা বলল তা শুনে জিতু শুকনো ঢোক গিলল। সে পুনরায় আবার জিজ্ঞেস করল। কি বললে বুঝিনি।
অপর পাশ থেকে এবার কপট রাগ দেখিয়ে বলল আপনি সত্যি কাল রাত ১২ টার পর কল দেননি। জিতু যারপরনাই অবাক। কিন্তু তার দিকে আটজোড়া চোখ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে তো ভুল করেও রাতে কল দেয়নি কখনো। দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
‘বিশ্বাস কর, আমি কল দিই নাই।’
মেয়েটা ফের বলে উঠল, ‘আসলে অপরিচিত বলতে আর কেউ আমার কন্টাক্ট লিস্টে নেই। আচ্ছা, এমনটা নয়ত আপনার কোন বন্ধু মজা করে কল দিছিল। হয়তো, আপনি জানেন না।’
জিতুর বন্ধুমহল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তাদের মুখের অভিব্যক্তি শূন্য। একে অপরের দিকে মুখ চাউয়া-চাউয়ি করছে। এত বড় অপবাদ তাও কিছু না করেই। জিতু নিজেই অবাক হল। সে জানে তার বন্ধুরা এমন নয়। তারপরও গলা খাঁকিয়ে জবাব দিল,
‘আমার বন্ধুরা পেটুক টাইপের একটু খাই বেশি, অন্যদের জ্বালায় বেশি এক একটা কঙ্কালের হাড্ডি হইতে পারে। তবে চরিত্র মাশা’আল্লাহ্ খারাপ না।’
চিন্ময় চেয়ার ছেড়ে মেঝের ওপর দপ করে বসে পড়ল। জিতু কি তাদের সুনাম করল নাকি অপমান করল। জুঁই, সিমি, লরিন মুখে কাপড় গুজে হাসছে। বেশ হয়েছে, আর কখনো যাবে কারো প্রেমালাফ শোনার জন্য। জিমান নিজেই বেশ অবাক। সে এই প্রথম শুনছে নুহার কথা। বাকিরা হু-হতাশ করল অনেকক্ষণ, ভেবেছে কি? আর হল কি!
___
জিতু মাগরিবের নামাজ পড়ে মাত্র বই খুলে বসল। এর মাঝেই ঈশিতার ডাক জিতু তোমার সেই ইউটিউব রেসিপি হাজির। সে ‘হা’ হয়ে বলল, এত জলদি কিভাবে পেলে। ঈশিতা মুখ ভেংচি দিল। ঠাট্টার স্বরে জবাব দিল,
‘আমার একটাই দেবর সেটাও যদি দেবদাস হয়ে যায়, তাহলে আমার কোনো জা আসবে? আর জা-বিহীন ঝগড়া করব কার সাথে? আমি চাই না আমার দেবর এত জলদি দেবদাস হয়ে যাক। তাই জামাইকে বলেছি আমার একমাত্র দেবরের জন্য তালের রস নিয়ে আসতে। আমার জামাই আবার বউয়ের কথা শুনে তাই আবদার ফেলতে পারল না। আর আমার দেবরও তার বউয়ের কথা শুনবে। এই যে তার এখন তালের রস দিয়ে মুড়ি মাখানো খেতে ইচ্ছে করছে। কি আর করা, এক বউয়ের জামায়ের আবদার আর এক জামায়ের বউ মিটিয়ে দিচ্ছে।’
জিতু নিষ্পলক ভাবীর কথা শুনলো। ভীষণ লজ্জা পেল কিন্তু ভাবীকে বুঝতে দিল না। ঈশিতা মুচকি হেসে ফের বলল,
‘এবার খেয়ে নাও, নয়ত দেরি হলে মুড়ি চুপসে যাবে।’
কথাগুলো বলে ঈশিতা রুম থেকে চলে গেল।
মুঠোফোনের অপর পাশের কথা শুনে নুবাহ পুরাই অবাক। মন খচখচ করছিল দেখে মোবাইল বালিশের নিচ থেকে নিয়েছিল মাত্রই। লোকটা দেবদাস হয়ে যাচ্ছে তার জন্য। হায় আল্লাহ! কি বলল এগুলো। সহসাই মনগহীনে এক শীতল শিহরণ বয়ে গেল। আহা! কি লজ্জা। মুখের ওপর এক হাত দিয়ে বসে আছে। আজকে পড়া হবে না আর। সে কলটা নিশব্দে কেটে দিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। মনের ভিতর এক অজানা অনূভুতি হানা দিয়েছে। কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে তার।
অন্যদিকে জিতুর দুশ্চিন্তা বাড়ল নুহাহকে বিরক্ত করা রাতের ব্যক্তিকে নিয়ে। তাই তো বরিশাল থানায় চিন্ময়ের মামার সাহায্যে জিডি করল অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে। পুলিশ সেই ব্যক্তির পুরো ডিটেইলস নিয়ে পরে চিন্ময়কে জানালো। চিন্ময় কল দিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির পুরো ডিটেইলস দিল জিতুকে। সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম বাবলু মির্জা।
____
শীতের দিনের রোদ সাধারণত মিষ্টি হয় কিন্তু এখন অসহনীয় লাগছে জিতুর কাছে। দীর্ঘ লাইন আর ভীড়ের মধ্যে আধাঘণ্টা ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। ভীড়ের মাঝে পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে অতিষ্ঠ সে। বন্ধুমহলের মধ্যে শুধু সানি এসেছে বাকিরা পৌঁছায়নি এখনো।হঠাৎ লরিন এসে জিতুদের সামনে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যেতে লাগল। সানি এটা দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘বাবার টাকাগুলো বাতাসে না উড়িয়ে যদি নিজের উদরে দিতি তাইলে যেখানে সেখানে উষ্ঠা খাইতি না হাড্ডিমন্ত্রী।’
লরিন চোয়াল শক্ত করে মুহূর্তেই জবাব দিল, ‘আচ্ছা, এজন্য তুই বাপের সব টাকা তোর উদরে ঢুকিয়ে নিজেরে আটমাসের পোহাতি বানাই রাখসছ। শালা কুমড়াপটাশ।’
জুঁই শুনে দ্রুতই জবাব দিল, কোথায় পরীক্ষার ভয়ে একটু আল্লাহকে ডাকবি তা না করে তোরা ঝগড়া করছিস। এর মধ্যে বন্ধুমহলের বাকীরাও হাজির। জুঁইয়ের কথা শুনে রকি জবাব দিল। ‘বইন দোয়া-দরুদ পড়ে একটু ফুঁ দিয়ে দেয় তো, যাতে পরীক্ষায় ভালো করি।’
তৎক্ষণাৎ সানি রকির দিকে তাকালো। দ্রুতই জবাব দিল, ‘খবরদার ফুঁ দিস না জুঁই, রকস্টার শীতের ভয়ে গত একসপ্তাহ গোসল করে নাই। এখন তুই ফুঁ দিতে গেলেই গায়ের সব দুর্গন্ধ আমাদের দিকেই আসবে।’
রকি সানিকে পিঠে আলতো করে চাপড় মেরে বিদ্রুপের হাসি দিল। ‘হারামি তুই যে শীতকালে গোসলের ভয়ে প্রতিদিন একটা করে পারফিউম ব্যবহার করিছ, সেটা পাশের বাসার মারিয়াও জানে।’
সানি তড়িৎ নিজের গালে হাত দিল। জবাবে বলল, ‘রকস্টার পারফিউম কি তুই কিনে দিসছ। রোজ একটা ইউস করার জন্য।’
বন্ধুদের এত হাসিমহল মুহুর্তেও জিতু চুপচাপ নির্বাক ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। সবার মাঝ থেকে মুবিন বলে উঠল, জিতু আমাদের পিচ্চিভাবীর কি খবর? আচমকাই এমন কথায় জিতু ইস্ততঃবোধ করল। মুখের কোণে মৃদু হাসি। জবাব দিল, ভালোই। জিমান ফিসফিস করল, শুধু ভালো আর কিছু না। চিন্ময় দীর্ঘশ্বাস টানল। আমাদের জিতু কোথায় হারালো। এতক্ষণ আমাদের সাথে থেকেও নাই। আগের মত কথা বলে না, হাসে না। সারাক্ষণ পিচ্চি ভাবীর প্রেমে মজে থাকে। লরিন চিন্ময়কে থামতে বলল, ‘ভাই আস্তে বল পাশেই হার্টের রুগী দাঁড়িয়ে আছে।’ এবার সবাই চকিতে তাকালো। হায় আল্লাহ্! মিউমি আসতেছে এদিকে। জিতু শুকনো ঢোক গিলল। এটাকে দেখলেও বিরক্ত লাগে তার। তাই বাধ্য হয়ে সবার মাঝ থেকে আঁড়াল হয়ে গেল।
মিউমি এসে বন্ধুমহলের সামনে দাঁড়াল। এদিক-ওদিক করে জিতুকে খুঁজল। সবার দিকে মুচকি হেসে বলল, ভাল আছো তোমরা। সানি মিউমির দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল, না ভালো নেই জানু। একটু বাতাস করবা, খুব গরম লাগতেছে। মিউমি কপট রাগ দেখালো। বলল, আমি কেন তোমাকে বাতাস করতে যাব? আচ্ছা, জিতু কি এখনো আসেনি।
বন্ধুমহলের সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এর মধ্যে প্রধান ফটক খুলে দেয়া হয়েছে। সবাই হুড়মুড় করে ভিতরে প্রবেশ করল।
জিতু কোনো রকম জান বাঁচিয়ে নিজের সিটে এসে বসেছে। পিছন থেকে জিমান আলতো চাপড় দিল। কীরে তুই আছিস। জিতু নিজের উপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সাথে কপালেও চাপড় মারল। কি দরকার ছিল তার মিউমিকে উপদেশ দেয়ার। ও যেই রকম ছিল সেই রকমই থাকত। জিমান আচমকাই প্রশ্ন করল। আচ্ছা, তোর জীবনে নুহাহ না আসলে তুই কি মিইমিকে সুযোগ দিতি। জিতু মুহুর্তে চোখ পাকালো। জবাব দিল বিদ্রুপের সুরে, জানিস জিমান আমার কোনো মেয়ের প্রতি ঐ ফিলটা আসে না যেটা আমি নুহার জন্য করি। আর মিউমি, সেটা তো ভুল করেও না।
‘জিতু তুমি এখানে?’
আচমকা মিউমির কথা শুনে দু’জনেই চকিতে মুখ ঘুরায়। মিউমি হাস্যজ্জ্বল মুখে জিতুর সম্মুখের সিটে বসতে বসতে বলে, ‘দেখ, কি ভাগ্য আমাদের। দুজন সামনা সামনি সিটে পড়েছি।’ জিতু বিড়বিড় করল, আর আমার দুর্ভাগ্য। মন চাইছে পরীক্ষকের চুলগুলো গিয়ে ছিঁড়ে দিয়ে আসি। আর কাউকে পাই নাই তার সামনের সিটে দেয়ার জন্য। জিমান মিটমিট করে হেসেই যাচ্ছে। বেচারা মিউমির থেকে পালাচ্ছে আর সেতো এখন তার নাকের ডগায়।
জিতু বিরক্ততে চোখমুখ কুঁচকে আছে। কি দরকার ছিল তার অত সুন্দর করে কথা বলার। ফালতু একটা মেয়ে, যা খুশি করুক তাতে তার কি? কিন্তু তাকে কে বলেছে গুড বয় হওয়ার।
একদিন মিষ্টিস্বরে মিউমিকে বলেছিল, তোমাকে ভারী মেকাপ থেকেও ন্যাচারাল লুকে বেশ সুন্দর লাগে। আর সেই সাথে চুল খোলা না রেখে যদি বেঁধে আসতে তাহলে আরও দারুণ লাগত। ব্যস! এ দু’টো কথা তার জীবনে কাল হয়ে গেল। মেয়েটা ভেবেছে, সে তাকে পছন্দ করে। তাই বলেছে এসব কথা। তারপর থেকে তার পিছনে আটার মত লেগে আছে। আর তখন থেকে মেয়েটার রাতারাতি পরিবর্তন সবাই হতবাক। তার চিরচেনা সাজসজ্জা আর পোশাক রেখে একদম নিজেকে শালীন পোশাকে আবৃত করে রেখেছে। খোলা চুলের জায়গায় হিজাব পরিধান করা। মুখে কোনো কৃত্রিম প্রলেপ নেই। একদম সাধামাটা মেয়ের মত ভার্সিটি আসে। এহেন পরিবর্তনে সে নিজেও বাকরুদ্ধ। একটা মেয়ে কিভাবে এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হতে পারে।
জিমান পিছন থেকে জিতুকে মৃদু ধাক্কা দিল। কিরে তুই বেঁচে আছিস নাকি পিচ্চি ভাবীর কাছে চলে গেছিস। সে জবাব দিল না। মিউমি জিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ছোট প্রশ্নে একটু সমস্যা আছে। পরীক্ষার সময় আমাকে একটু দেখাবে। জিতু এবার সু্যোগ পেল কিছু বলার জন্য, তা পড়ে আসো নি কেন? আর বার বার পিছনে তাকাবে না কিন্তু। স্যার দেখলে তখন আমার পেপার নিয়ে যাবে। মিউমি কিছু বলতে গিয়েও আর বলতে পারল না। অসহায় দৃষ্টিতে জিতুর দিকে তাকালো। সে শুধু কথা বলার অজুহাতে প্রশ্নের কথা বলেছে। জিতু কেনো তাকে এভাবে এড়িয়ে যায়। সে’তো জিতুর কথায় নিজেকে এত পরিবর্তন করেছে। তার উজাড় করা ভালোবাসা সে কবে বুঝবে?
পরীক্ষা শেষে জিতু জিমান দু’জনে বাইকে করে এক সাথে বেরুলো। জিমান বাইকের পিছনে বসেছে। আচমকা বলে উঠল, জানিস জিতু আমি পিচ্চি ভাবীর বান্ধুবীকে মিস করছি। আমাকে একটু কথা বলাই দিবি আমার মধুমিতার সাথে। আহ্, কতদিন দেখিনা তাকে। খুব ইচ্ছে করছে তার সাথে কথা বলতে।’
আকস্মিক জিমানের এমন উদ্ভট কথা শুনে জিতু বাইক থামালো। সে অবাক হয়ে বলল, ‘তোর মধুমিতা সেটা কবে থেকে। যেখানে আমি নিজেই এখনো আমার পাখির নাগাল পাইনি সেখানে তোর কিভাবে হয়ে গেল? আরেকবার প্রলাপ বকবি তো ব্রিজ থেকে থাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিমু লম্বুর বাচ্চা।’
জিমানের হেলদোল নেই। সে তার মতই জবাব দিল আবার। ‘জিতু ভাবছি আমরা দু’জন খালাত ভাই, বন্ধু, সহপাঠী থেকে ভায়রা ভাই হব। কিন্তু এখন ভাবছি ভবিষ্যতে বেয়াইও হয়ে যাই, কি বলিস? জিতু বাইক থেকে নেমে জিমানকে পাজাকোলে তুলে নিল। জিমান আচমকাই চিৎকার দিয়ে উঠল। কে কোথায় আছো বাঁচাও। এ শয়তান ছেলে আমার ইজ্জত লুটে নিল। জিতু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এই লম্বুর বাচ্চা কি বলে এইসব! সে হাসতে হাসতে জিমানকে রাস্তায় নামিয়ে দিল। জিমান জিতুর হাত চেপে ধরল। কীরে ছেলে হয়ে ছেলের ইজ্জত লুন্ঠন করতে চাইছিস কত খারাপ তুই। জিতু কটমট করে তাকাল। নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জিমানকে দেয় এক ঘুষি। লম্বুর বাচ্চা আর কথা খুঁজে পাস না।
জিমানও জিতুর হাত চেপে ধরল। এই লম্বুর বাচ্চা কি? ভায়রা ভাই বল পিচ্চি ভাবীর জামাই। জিতু দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল, তোরে আমি জীবনেও ভায়রা বানামু না। তুই যে হারামি আমার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিবি। জিমান করুণ সুর তুলল মুখে, ‘নাহ্ ভাই এটা বলিস না। আমাকে এত বড় ছ্যাকা দিস না। আমি তো তোর একমাত্র কলিজার বন্ধু, তাই না। জিতু জবাব না দিয়ে বলল, এখন বাইকে উঠবি না’কি তোরে রাস্তায় রেখে যামু।
জিমান উঠে বসল পেছনে। জিতু ফের নিজের গন্তব্য চলল।
চলবে,,
গতকাল দুপুর ১২ টা থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ নাই। মাঝে দু’ এক মিনিটের জন্য আসছে। এই যা। যাই হোক সবাই রেসপন্স করিয়েন। ধন্যবাদ।