#হিয়ার_মাঝে ৪৮.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
রাতের খাবার শেষ করে নুবাহ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু চৌকাঠে পা রাখতেই চক্ষু চড়কগাছ। দরজা লক করা। লক করল কে? নব বার’কয়েক ঘুরালো। কিন্তু তাতে কিছুই হল না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। এখন ঘুমাবে কোথায়? তার এত উদ্বিগ্নতার মাঝে সহসাই জিতুর হাঁকডাক শোনা গেল।
‘নুবাহ এদিকে আসো তো।’
কিঞ্চিৎ বিস্মিত হল। এই লোক এখন তাকে ডাকছে কেন? সবার আগে খেয়ে নিজের রুমে এসেছে আরও দশ মিনিট আগে। সে এতক্ষন কিচেনে ছিল। তাই আসতে দেরি হল। এখন আবার তার কি কাজ? দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে জিতুর রুমে প্রবেশ করল। বিছানায় অর্ধনগ্ন জিতুর গৌরবর্ণ কায়া। পরনে শুধু সর্টস, উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নুবাহ প্রবেশ করতেই তাকে হুকুম জারি করল।
‘নুবাহ, আমার পিঠ মালিশ করে দাও তো। এরপর পুরো কাঁধ থেকে শুরু করে পা’ পর্যন্ত মালিশ করবে।’
নুবাহ পুরো থ’। এর আবার কি হল? আচমকা তাকে মালিশ করতে বলছে। তার উপর তার রুম লক করা। সে পাশে বসতে বসতে বলল,
‘আমার রুম লক করা কেন?’
‘তোমার রুম, কোনটা?’
‘এত ডং কোত্থেকে আসে আপনার?’
‘ডং, সেটা তো তুমি করছো?’
‘মানে কি?’
‘ভন্ড মহিলা।’
নুবাহ দাঁতে দাঁত পিষলো। এগুলো কোন ধরনের কথা-বার্তা। সে ভন্ডামীর কি করেছে। মালিশ না করেই চুপ করে বসে আছে। ইচ্ছে করছে জিতুর পিঠ নয়, ঐ ঘাড় মটকে দিতে। বেদ্দব পুরুষ লোক। জিতু ঘাড় না ঘুরিয়ে আড়চোখে সামনের আয়নায় একবার নুবাহকে দেখে নিল। ফের বলে উঠল,
‘সর্যিই, আসলে আমার এক্সকে গালি দিতে গিয়ে তোমাকে দিয়ে ফেলেছি। ঐ প্রতারক মহিলার কথা মনে পড়লেই মুখ থেকে অযাচিত এসব ভুজুংভাজুং কথা চলে আসে। তুমি আবার মনে কিছু নিও না, ঠিক আছে। এখন মালিশ করে দাও তো, বউ।’
নুবাহর রাগ যেনো হুট করে আকাশ ছুঁলো। এক তো তার সামনে এক্সের কথা ভাবছে। আবার তাকে গালি দিয়ে বলছে এক্সকে গালি দিচ্ছে। কত্ত বদলোক! নিশ্চুপ ঠাঁই বসে রাগে হিসহিস করছে। জিতু ফের একবার আয়নায় সাপের মত ফোঁসফোঁস করা বউয়ের উপর নজর বুলালো। টিপ্পনী মেরে বলল,
‘জানো নুবাহ, আমার এক্স রাগলে সাপের মত ফোঁস ফোঁস করে। ঐ ভন্ড মহিলা এত বছর ধরে জ্বালিয়েছে। তাও ওর স্বাদ মেটেনি। এখন কথায় কথায় আমাকে গালিও ছুঁড়ে। তাও কি সব গালি দেয়, যদি তুমি শুনতা। যত সব আস্তাগফিরু’আল্লাহ মার্কা গালি।’
নুবাহর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। জিতুর লাগাম ছাড়া এসব কথায় তার মেজাজ চটলো বেজায়। কর্কশ গলায় বলল,
‘আপনার এক্স আপনাকে গালি দিত না’কি অন্যকিছু করত, সেটা আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?’
আক্ষেপের সুর তুললো মুখে। জিতু ফের বলে উঠল, ‘ঐ ভন্ড, প্রতারক মহিলা অন্যকিছু জানলেই তো বলতো। জানে শুধু বিড়বিড় করে তাকে গালি দিতে আর সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে।’
নিরুত্তর নুবাহ চুপ করে আছে। আচমকাই মন’টা খারাপ হয়ে গেল। জিতু তার এক্সকে নিয়ে ভাবে এখনো। অথচো বউ বসে আছে, তার সেটা মাথায়ই নেই। কি অদ্ভুত তাই না! চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। জিতু আবারও আড়চোখে দেখল বউয়ের নিষ্প্রভ মুখশ্রী। মন’টা তারও বিষিয়ে গেল। কিন্তু বউকে এইটুকু শাস্তি সে দিবেই। ভন্ড মহিলা এতদিন তার পাশে থেকে, তার বুকে ঘুমিয়েও নিজের মনের কথা প্রকাশ করল না। কেন করল না? তাহলে তো তাকে এত হয়রানি হতে হত না। মলিন গলায় বলল,
‘জানো নুবাহ, ঐ ভন্ড মহিলা কথায় কথায় কেঁদে দিত। তাও মনের কথা বলত না।’
নুবাহর সহ্য হল না আর। বিছানা ছেড়ে উঠল। জিতুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘আমার রুমের চাবি দিন। আমি জানি চাবি আপনার কাছেই আছে।’
‘কোনটা তোমার রুম?’
‘যেনো আপনি জানেন না।’
‘আমি তো জানি, এটাই তোমার রুম।’
‘কিন্তু, এটা আমার রুম নয়।’
‘কিন্তু, ঐইটাও তোমার রুম নয়। ঐইটা আমার বাচ্চাদের রুম, বাচ্চার মায়ের না। তাই চুপচাপ বিছানায় উঠে পড়ো।’
নুবাহ নির্বাক। আজকে এত তোড়জোড় কেন তাকে নিয়ে। কই এতদিন ধরে তো তাকে নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। সে আছে না’কি নেই? এখন এত অধিকার দেখাচ্ছে কেন? খুব করে বলতে ইচ্ছে হল। এক্সের সাথে দেখা করে ভীমরতি হয়েছে না’কি? কিন্তু মুখ থেকে টু শব্দও বের হল না। তার এমন ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা দেখে জিতু কপাল কুঁচকালো। রগড় গলায় বলল,
‘কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছে আছে না’কি?’
প্রতিত্তোর করল না নুবাহ। আজকের জিতুকে ভীষণ অন্যরকম লাগছে তার। হুট করে এত পরিবর্তন কেমন অদ্ভুত ঠেকছে। তার ভাবনায় জল ঢেলে জিতু ফের বলে উঠল,
‘ঘুমানোর দরকার নেই। আমাকে মালিশ করে দাও তো। কালকে আবার লম্বুর গায়ে হলুদ। কত কাজ করতে হবে।’
নুবাহ এবারও প্রতিত্তোর করল না। রাগে হিসহিস করছে। তার এমন নিশ্চুপতা দেখে জিতু কিঞ্চিৎ মাথা তুললো। নুবাহর আপাদমস্তক দেখে বলে উঠল,
‘তুমিও আমার এক্সের মত ফোঁস ফোঁস করছো? কামড় দিবা না’কি? দিলেও দাও, সমস্যা নাই। আমি লাভ বাইট বলে চালিয়ে দেব।’
নুবাহর রাগ থরথর করে বাড়লো। গলার স্বর উঁচু করল এবার।
‘আমার রুমের চাবি দিন। আমি এখান থেকে চলে যাব। আপনি আপনার এক্স নিয়ে থাকুন।’
‘আশ্চর্য তো! আমিও তো চাইছি আমার এক্স নিয়ে থাকতে। কিন্তু তোমার যন্ত্রণায় কি আর পারছি।’
‘তো ঘুমান না, আমাকে রেহায় দিন।’
‘আচ্ছা যাও, তোমাকে রেহায় দিলাম। তুমি বিছানায় ঘুমাও, আমি সোফায় গেলাম।’
‘আমি সোফার কথা বলিনি।’
‘দুঃখিত, আমার জীবন থেকে রেহায় দিচ্ছি না। যতই এক্স ওয়াই জেড থাকুক।’
কথায় কথা বাড়বে। তাই নুবাহ কথা বাড়ালো না আর। বিছানার এককোণে কম্বল টেনে জবুথবু হয়ে শুয়ে পড়ল। মনটা বড্ড তিক্ত। কেন জিতু এমন ব্যবহার করছে। তার কষ্ট হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। ভালো তাকে নাই বা বাসুক, তাই বলে এভাবে অনর্গল নিজের এক্সের কথা বলে যাবে। চোখের কোণ থেকে নোনাজল গড়ালো। অতি সন্তপর্ণে নিজের কান্না লুকালো। আর কত কষ্ট দেবে এই জিতু। অথচ জিতু উচ্চশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো নুবাহর দিকে,
‘আচ্ছা নুবাহ, ঐ ভন্ড মহিলাকে কীভাবে শাস্তি দেয়া যায় বল তো? আমার না একটা পরিকল্পনা আছে। আমার কিউট একটা গুলুমুলু আব্বু হবে। তাকে কোলে নিয়ে হাঁটবো আর ঐ মহিলা জ্বলেপুড়ে মরবে। কেমন হবে বল তো?’
নুবাহর গা জ্বলে গেল। চেঁচিয়ে উঠল তিরিক্ষি গলায়, ‘আপনার লজ্জ্বা করে না বউয়ের সামনে নিজের এক্স নিয়ে কথা বলতে।’
‘না, একদমই লজ্জা করে না। চাইলে তুমিও বলতে পারও, আমি নিষেধ করেছি না’কি?’
‘ছিঃ! জঘন্য পুরুষ আপনি।’
‘তুমি তো সতিসাবিত্রী, তাহলেই চলবে।’
নুবাহ অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। জিতু ফের বলে উঠল, ‘মাথা’টা একটু টিপে দেবে। ভীষণ মাথা ধরেছে।’
‘পারলে আপনার কপাল কেন গলাটায় টিপে দিতাম।’
জিতু আর কথা বাড়ালো না। বউ তার চেতে গেছে। আর চেতানো যাবে না। জিমানকে মেসেজ দিল। কিরে লম্বুর বাচ্চা, তোর বউ মুখ খুলছে। মুহুর্তে টুংটাং করে মেসেজের শব্দ হল। জিমানের উত্তর এল দ্রুতই,
‘না’রে বউ চেতে আছে। উল্টো হুমকি দিছে বাসর রাতে ঢুকতে দেবে না। ভাবা যায়। এখন নিজের জান নিয়েই টানাটানি।’
জিতু অবাক হল। সব মেয়ে কি একই টাইপের। কথায় কথায় চেতে যায়। হাপিত্যেশ করল দীর্ঘ সময়। সোফার মাঝে এপাশ ওপাশ করে শেষে ঘুমের অতলে ডুব দিল।
. . .
সকালের আলো ফুটতেই নুবাহর দেখা নেই। জিতু অবাক হল। বউ তার বিছানা ছেড়ে কোথায় গেল। প্রথমে ভাবল ওয়াশরুমে হয়তো। কিন্তু ভুল ভাঙলো দীর্ঘ সময় পেরুলেও তার দেখা না পেয়ে। শেষে ফ্রেশ হয়ে দ্রুত নিচে নামল। ঘড়ির কাটায় তখন সকাল ৬টা। ড্রয়িংরুম পুরো ফাঁকা। কিচেন রুম থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। সে নৈশব্দে কিচেন রুমের দিকে পা বাড়ালো। মায়ের রুমের দিকে উঁকি দিল একপলক। তখন তার মা’ কোরআন পড়ছে। আর বাবা বাইরে হাঁটছেন। তার দাদুর নাস্তা নিয়ে ময়নার মা’ তাড়াহুড়ো করছে। বাড়ির ছোট কর্তী ইনশিয়া রবির সাথে মিলে বাগানের গাছে পানি দিচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে দাদাকে নকল করে দৌঁড়াচ্ছে। সকালের এই দৃশ্য তার কাছে বেশ দারুণ লাগে। কিচেন রুমে প্রবেশের আগে একবার ঘরের বাইরে পা রাখল। বাইরের করিডোর বেশ বড়। দাদা নাতনী সেখানেই দৌঁড়ঝাপ করছে। সে বের হয়ে তার বাবাকে সালাম দিল প্রথমে। আজমল কিঞ্চিৎ অবাক হল ছেলেকে দেখে। কিন্তু প্রকাশ করল না। ছেলের সালাম নিয়ে বলল,
‘তারপর বল, কেমন চলছে তোমার সংসারজীবন? ‘
জিতু মুখে কিছু না বলে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। ভেজানো গলায় বলল,
‘আব্বু, তোমায় কি বলে ধন্যবাদ দেব বল। তুমি তো তোমার ছেলের কলিজা’টা উপহার দিলে। এত বড় উপহার, আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ আব্বু। এই খুশির কোনো বর্ণনা হয় না। না কোনো ধন্যবাদ হয়। তবু হাজারও শুকরিয়া আব্বু।’
আজমলও ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। পিঠের উপর চাপড়িয়ে বলল,
‘বাবার উপহার পছন্দ হয়েছে এতেই খুশি আমি। সুখী হও, দোয়া করি বাবা।’
ইনশিয়া এসে চাচার পাশে দাঁড়ালো। আধো বুলিতে বলে উঠল,
‘চাত্তু, তুমি দৌধাবা। আমা মত পাববা না, আমি অনেক অনেক দোদে দৌধাই তো।’
জিতু হাসল। গাল টেনে বলল,
‘পাকনা বুড়ি, ওকে চ্যালেঞ্জ একসেপ্টেড।’
দু’জন মিলে দৌঁড় প্রতিযোগিতা শুরু করল। জিতু ইনশিয়ার সাথে দৌড় দিয়ে পারে না। সে অনেক জোরে দৌড় দিয়ে তাকে হারিয়ে দেয়। এতেই ইনশিয়া সেই খুশি। খিলখিল করে হেসে উঠল। চাচার কাছে এসে ফের বলে উঠল,
‘চাত্তু, তুমি তো আমার সাতে পারো না। আমি ফাস্ট।’
দুই আঙুল তুলে দাদা আর চাচাকে দেখিয়েই যাচ্ছে। এর মাঝেই জারিবও আসল তাদের মাঝে। বাবার উপস্থিতি পেয়ে ইনশিয়া বেশ খুশি হল। বাবাকে দেখে বলল,
‘পাপাহ, দিখো আমি চাত্তুকে হারিয়ে দিয়েতি। চাত্তু ফাস্ট হইনি। আমি ফাস্ট হইতি।’
জারিবও হাসল মেয়ের কথায়। তবে তার চোখ ইনশিয়ার থেকে সরে জিতুর হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে পড়ল। ঠিক কতদিন পর এভাবে হাসতে দেখছে তার ভাইকে। নিজমনে খুশিই হল। জিতু ফের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিচেনের সামনে আসতেই এমন এক দৃশ্যের সম্মুখীন হল যা তার কল্পনার অতীত। জিতু আৎকে উঠলো ভয়ে। চিৎকার দিয়ে বলল,
‘নুবাহ।’
চলবে,,,,,