হিয়ার_মাঝে ৫৪. #মেঘা_সুবাশ্রী ®️

0
485

#হিয়ার_মাঝে ৫৪.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️

হাসপাতালের ছোট্ট কক্ষ। বেডের সাথে লাগোয়া ছোট সাইজের এক আলমিরা বক্স। পাশে রোগীর খাবারের জন্য টানানো হালকা ছোট টেবিল। আর সাথে একখানা কালো চকচকে একক সোফা। গ্লাস দ্বারা আবৃত পাঁচ তলার এই হাসপাতাল রুমে মায়ের সাথে বসে আছে চিন্ময়। মায়ের আচমকাই পেট ব্যাথা বমি শুরু হয়েছে। সন্ধ্যোবেলায় বের হবার সময়ও শরীর ভালো দেখেছে। কিন্তু হঠাৎই তার মায়ের এমন অসুস্থতা তার বোধগম্য নয়। আজকাল তিনি হুট করেই অসুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তার চেককাপ করে গেছে। এখনো রিপোর্ট আসা বাকি। তার মামা বাইরের করিডরে বসে আছে। চোখমুখে তীব্র হতাশা, কিছু একটা বলতে বড্ড হাসফাস করছে তার কাছে। কিন্তু কি সেটা তার জানা দরকার। সে তার মায়ের কম্বল আরও একটু টেনে ভালো করে মুড়িয়ে দিল। তারপর বেরুলো মামার উদ্দেশ্য।

করিডোরের বারান্দায় গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিত জানালো। তার মামা শাহাদাৎ চৌধুরী চকিতে তাকালেন। নিজের নিকটবর্তী ভাগ্নেকে দেখে মুহুর্তে মন উৎফুল্ল হল তার। কিন্তু ভিন্নকিছু চিন্তা করে ফের মনটা উদ্বিগ্ন হল। তবে সে যে অপরাগ, বলতে তো হবেই। সময় যে এসে গেছে এবার। কথার প্রসঙ্গ দীর্ঘায়িত না করে বলে উঠল,

‘তুমি কি মামার একটা কথা শুনবে, যদিও তুমি মামার অবাধ্য হওনি কখনো। তবে তোমার মায়ের কথা চিন্তা করেই এই কথা বলতে বাধ্য হলাম। নয়তো আরও কিছুদিন তোমায় সময় দিতাম।’

চিন্ময়ও সময়ক্ষেপণ করেনি। দ্রুতই জবাব দিল। ‘বলুন মামা, আমি আপনার কথা শুনতেই এসেছি।’

‘তোমার আর কুমুদের বিয়ে নিয়ে ভাবছি। আমার বোন’টা দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমি চাই তোমার মা’ ছেলের বিয়ে’টা নিজের চোখে দেখুক। তোমার কি ইচ্ছে বল চিন্ময়। ‘

চিন্ময় আৎকে উঠল। মর্মদহনে ব্যথিত হল সহসাই। বিয়ে! কুমুদের সাথে! কুমুদের প্রতি তার সামান্য অনুভূতিও নাই, আর ভালোবাসা সে’তো বহুদূর। কিভাবে এই মেয়ের সাথে সারাজীবন কাটাবে? ভাবতেই অশ্রুসিক্ত হল দু’চোখ। কিন্তু তার মামার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার মত সাহস তার নেই। কিভাবেই বা বলবে মামা এই বিয়ে আমি করবো না। সে নিশ্চুপতায় আড়ষ্ট। তার মামা ফের বলে উঠল,

‘আমি কি বিয়ের বন্দোবস্ত করবো চিন্ময়?’
জবাবহীন চিন্ময় দ্বিধার দুয়ারে আবদ্ধ। মামার কথার বিনিময়ে শুধু কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ালো। শাহাদাৎ প্রসন্ন হল। চিন্ময়ের কাঁধে হাত রেখে নিজের গলার স্বর উঁচু করলেন,
‘আমার বোন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরুক, তারপর না হয় আমরা বিয়ের আয়োজন করব।’

চিন্ময় নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আজ বড্ড অসহায় সে। তার কেনো জিতুর মত একটা পরিবার নেই। যাদের কাছে মন খুলে কথা বলা যেত। ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার মত একটা আবদার করতে পারতো অন্তত।
____

সেনা মালঞ্চের দক্ষিণা বারান্দা। মাঘ মাসের তীব্র শীতল বাতাসে বারান্দায় দন্ডায়মান জিতু। ভাবনা জুড়ে নিজের উত্থান পতন হওয়া প্রেমের দৃশ্য রোমন্থন হচ্ছে। কি থেকে কি হল! প্রকৃতির মাঝে বিলীন হওয়া প্রেম ফের নবরূপে ফেরত এল। তার কি অপরূপ মহিমা! আসলে ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা থাকলে হয়তো তা সম্ভবপর। তবে এখন চিন্তিত তমাকে নিয়ে। সে কেন দাঁড় করালো কে জানে? আর নুবাহকে গিয়ে কি বলবে? তার এত সব ভাবনার মাঝে সহসাই পিঠের উপর কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল। দু’হাত আঁকড়ে ধরে আছে পেছন থেকে কেউ একজন। বিস্মিত হল মুহুর্তে। ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্নার মৃদু শব্দও ভেসে এল। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়া ব্যক্তি কে অনুভব হতেই অধরকোণে হাসি ফুটে উঠল। শান্ত, নমনীয় স্বরে বলে উঠল,

‘কি ব্যাপার! আজ জামাইকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে। প্রেম প্রেম পাচ্ছে বুঝি।’

শব্দগুচ্ছ ধলা পাকিয়ে আছে গলার ভেতর। গলা কাঁপছে ভীষণ। নুবাহর কান্নার বেগ আরও বাড়ল। তার নোনাজলে জিতুর কালো শার্টের পিঠের অংশ ভিজে একাকার। কিন্তু মুখ ফুটে একরত্তি শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না সে। জিতু হাতের বাঁধন খুলে নুবাহকে সামনের দিকে নিয়ে এল। থুতনিতে দু’হাত রেখে ফের জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে নুবাহ? এভাবে কাঁদছো কেনো?’

নুবাহর দিশাহীন টলটলে অশ্রুসিক্ত দু’আঁখি। জিতু অবাক নয়নে তাকাল। কিন্তু মনটা বিচলিত হল তড়িৎ। নিশ্চয়ই তমা উল্টা পালটা তার বউকে কিছু বলেছে। একরাশ আকুলতা ফুটে উঠলো চোখেমুখে,
‘তুমি এভাবে কাঁদছো কেন? আমি বেঁচে আছি তো। প্লিজ এভাবে কাঁদবে না বোকা পাখি।’

মৃদু কান্নার শব্দ হুট করে উচ্চ শব্দ তুলল। নুবাহ ফের ঝাঁপিয়ে পড়ল জিতুর বক্ষ পাঁজরে। জিতু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নুবাহ শান্ত হোক। তবেই জিজ্ঞেস করবে সে কি জেনেছে। দু’জনেই বাক্যেহীন। জিতুও দৃঢ় বাঁধনে চেপে ধরল বক্ষ পাঁজরে। এভাবে কত সময় পেরুলো দু’জনেই অজ্ঞাত। ধীরে ধীরে নুবাহ শান্ত হল। ভেজানো নরম গলা তার। কান্নায় গলার স্বর অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল।

‘আপনি আমায় মনে রেখেছেন ইমদাদ? জানেন, আমি ভেবেছি আপনি আমায়,,,,।’

বাকিটুকু বলার সুযোগ হল না নুবাহর। চোখ থেকে আবারও জল গড়ালো। জিতুর বক্ষস্থল কেঁপে উঠল এহেন বাক্যেই। কি বলে বোকা মেয়ে! তাকে মনে রাখবে না। ভুলে যাওয়া এত সহজ না’কি? নিরবে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। নুবাহর মাথায় হিজাবের উপর আলতো করে চুমু খেল। নিজের বুক থেকে সরিয়ে নুবাহকে দাঁড় করালো চোখের সামনে। মেয়েটার দু’চোখ ফুলে আছে দীর্ঘ অশ্রু বর্ষণে। দু’গালে জলের ধারার ছাপ এখনো স্পষ্ট। সেই দু’চোখে তার ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া বসালো আলতোভাবে। নিজের ডানহাত উঠিয়ে সেই জলধারার বিন্দুও মুছে নিল। নুবাহর চিবুকে দু’হাত রেখে নরম, শীতল গলায় জবাব দিল সে,

‘তুমি কি ভেবেছিলে নুবাহ? আমি তোমায় ভুলে গিয়েছি। তুমি তো আমায় জীবিত দেখার আশা হলেও করেছিলে। অথচো আমি তোমায় মৃতই জেনে এসেছি গত তিন’বছর ধরে। জানো কেমন কষ্ট হত আমার। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হত রোজ। আমার নুবাহকে হারিয়ে তখন কেমন ছিলাম বোঝাতে পারবো না। আর তুমি, ভেবে নিয়েছো আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছি? কি করে সম্ভব বল, এই বোকা মেয়েটা ভুলে থাকা।’

‘আপনি আমায় মৃত ভেবেছেন কেনো? কিন্তু আমি তো বেঁচে আছি এখনো। আপনার কি হয়েছিল তখন?’

‘জানো নুবাহ, আমি তো তোমার নামটা পর্যন্ত ভুল জেনে এসেছি এতদিন। তোমার নাম নুহাহ জানতাম। না তোমার কোন ঠিকানা আমার কাছে ছিল, ঐ একটা ফোন নাম্বার ছাড়া। তাই তো এত দেরি হয়েছে তোমাকে খুঁজে পেতে। শুনতে অদ্ভুত লাগছে তাই না!

‘আপনি আমার নাম ভুল জানতেন। আমি তো ভাবতাম আপনি আমাকে ভালোবেসেই নুহাহ ডাকতেন।’
‘আফসোস তো ঐ একটা জায়গায়। কেন দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেনি তোমার নাম কি? তাহলে তোমার আমার মিলন আরও আগেই হয়ে যেত।’

‘তাহলে এখন কিভাবে জানলেন আমার নাম নুবাহ?’
জিতু মৃদু হাসলো। নুবাহকে ফের বুকে জড়ালো দৃঢ় বাঁধনে। বলে উঠল,
‘মনে আছে চট্টগ্রামের সেই রাতের কথা।’
নুবাহ কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে মাথা নাড়িয়ে জবাবে হ্যাঁ’ বলল।

জিতু ফের বলে উঠল,
‘সেদিন বরিশালের এসপি হারুনের কল ছিল। জানো, তোমাকে দেখার পর থেকে অস্থিরতায় ভুগতাম। মন কেমন উথলা হয়ে থাকত। বার বার তোমার এই চাউনি আমার দু’চোখে ভেসে বেড়াতো। না চাইতেও তোমাকে নিয়ে ভাবতাম। মাঝেমধ্যে নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন মনে হত। কিন্তু তোমার মাঝে কি ছিল আমার অজানা। তখন নিজেকে বলে বেড়াতাম তুমিই কেনো আমার নুহাহ হলে না। তোমার খোঁজে একটা মিশনে নামলাম। একবার আমার নুহাহর একটা ছবি হলেও দেখতে চাই। বিশ্বাস কর, এই খোঁজ যদি আমি তিন’বছর আগে করতাম তবে আজ এত লগ্ন অপেক্ষা করতে হত না আমাদের দু’জনের। আমি তোমার মৃ,ত্যুর সংবাদ শুনে এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম, আর সত্যতা যাচাই করার সাহসও পাইনি। কিন্তু সেদিন এসপি হারুন এমন একটা তথ্য দিল যা আমার ভেতরের সত্তা নাড়িয়ে দিল। তোমার গোপনে এমপির ছেলের সাথে বিয়ে, এমনকি অন্তঃসত্ত্বাও ছিল তুমি। এমন তথ্যে আমি মানতে পারলাম না। না বিশ্বাস করলাম।

তাই তো পরেরদিন দ্রুত ছুটে গেলাম বরিশাল। এসপি হারুনের সেখানে বিস্তারিত সবই দেখলাম নুহার সম্পর্কে। তবে সন্দেহ জাগল তখনই সুই,,সাইডের তারিখ দেখে। ৫ই মার্চ সকালে নুহার ঝুলন্ত লা,শ উদ্ধার করে পুলিশ। অথচ ৫ই মার্চ সকালেও আমি তোমার সাথে কথা বলেছি। এমনকি তুমি আমার মেসেজের উত্তরও দিয়েছো। তার উপর আরও একটা তথ্য পেলাম তা হল মেয়েটা এসএসসির সকল পরীক্ষা দেয়নি। এই একটাই তথ্যেই আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম এটা আমার নুহাহ নয়। তারপর এসপি হারুনকে তোমার তিন’বছর আগের সেই মোবাইল নাম্বার দিলাম। তোমার কললিষ্ট দেখে যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। প্রায় এক সপ্তাহ পর এসপি হারুন আমাকে কল দিল। তোমার কললিষ্ট বের করা হয়েছে। তবে মজার ব্যাপার কি জানো, সেই লিষ্টে খুব বেশি নাম্বার পাওয়া গেল না। বেশিরভাগই আমার কল ছিল। আর তোমার দেয়া সেই মেসেজ আর কলেরলিষ্ট আমার মোবাইলে। এটা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার নুহাহ কতবার আমাকে কল দিয়েছে। কিন্তু আমি তাকে একবারও কল দিতে পারেনি। তোমার মোবাইলের শেষ কল আমাকেই করা হয়েছিল। আর আমার কলই শেষ কল ছিল তোমার নাম্বারে। ৫ই মার্চ সন্ধ্যোবেলায় বন্ধ হলেও তিন’বছরের মধ্যে তোমার মোবাইল নাম্বার দ্বিতীয়বার চালু হয়নি আর। তাই খুবই কঠিন ছিল সক্রিয় মোবাইল নাম্বার খুঁজে পাওয়া। শেষে অনেক ঘাটাঘাটি করে দু’টো সক্রিয় মোবাইল নাম্বার খুঁজে পাই। প্রথমজনকে কল দিলাম তিনি কল উঠালেন না। দ্বিতীয়জনকে দিলাম তিনিও একই কাজ করলেন। পুরো দিন আমি কল করাতে ব্যস্ত থাকলাম। শেষে দ্বিতীয়জন একজন মধ্যবয়সী পুরুষ কল রিসিভ করল। আমি সালাম বিনিময় করলাম প্রথমে। উনাকে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। তারপর তোমার পুরনো মোবাইল নাম্বার’টা বলে ধীরেসুস্থে জিজ্ঞেস করলাম,

‘তিন বছর আগে এই নাম্বার একটা মেয়ে ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমানে করে না। আপনার নাম্বার তার কললিষ্টে আছে দেখেই কল দিলাম। আপনি বিরক্তবোধ করছেন না’তো? আমি কি জানতে পারি আপনি তার কি হন?’
তিনি উত্তরে বললেন, ‘কিন্তু তুমি কে? আর কোন মেয়ে ব্যবহার করত আমার এত কিছু মনে আছে।’
‘আপনি আমায় চিনবেন না কিন্তু আমার জানা’টা খুব জরুরি। প্লিজ দয়া করে বলবেন। মেয়েটা জেবুন্নাহার গার্লস স্কুলে পড়ত কিন্তু।’

লোকটা হকচকিয়ে গেল। বিস্মিতসুরে বলল,
‘আমি জেবুন্নাহার গার্লস স্কুলের ম্যাথ টিচার ওবায়দুল আলমগীর।’
তারপর লোকটা ক্ষানিকটা সময় ভাবল। ফের বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমি দেখছি কে হতে পারে।’

সময় বাড়ল সাথে নিজের অপেক্ষাও। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। কল দিলাম আবার প্রথমজনকে। বিশ্বাস কর, তখনো অনিশ্চিত ছিলাম কল রিসিভ হবে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে একজন মধ্যবয়সী নারী কল রিসিভ করল। আমি সালাম দিলাম, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ফের তোমার মোবাইল নাম্বার তাকে বলার পর জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপনি এই মেয়েটাকে চেনেন?’

তিনি তড়িৎ জবাব দিলেন, ‘তুমি কি ইমদাদ?’

চলবে,,,,,,

বলেন তো এই মধ্যবয়সী মহিলা’টা কে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here