#হিয়ার_মাঝে ৬০.
#মেঘা_সুবাশ্রী ®️
সময় দ্রুত প্রবাহমান। জিতু হাতের আঙ্গুলে দিন গুণছে। তার বোকা পাখির সাথে কথা বলার দু’মাস ঊনত্রিশ দিন চলছে আজ। কাল নুহাহর শেষ ব্যবহারিক পরীক্ষা। দীর্ঘ তিন মাস শেষে দু’জনের দেখা হবে। এই যেন স্বপ্নের মত। এখনো ঘোরের মাঝে আছে সে। রাত পোহালে আগামীকাল নতুন জীবনের সূচনা হবে তার। মুহূর্তগুলো অন্যরকম অনুভূতির জানান দিচ্ছে। এখন প্রকৃতিতে বসন্তের ছোঁয়া। বাতাসে ফুলের সুবাস, কোকিলের কুহু কুহু কলরব, গাছে গাছে নতুন কচি পাতার আগমনী বার্তা। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের সাথে সাথে নিজের জীবনেও নতুন কিছু ঘটবে। বারান্দার দোলনায় বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আছে সে। একটা কল দিল তার বোকা পাখিকে। মুহুর্তে রিসিভও হল। নিজের না বলা অভিব্যক্তি ব্যক্ত করল নির্দ্বিধায়।
‘কাল একটা জিনিস চাইব, নিষেধ করলেও শোনব না কিন্তু। আমি তোমার একটা হাত ধরব, আর সেই হাতের পিঠে একটা চুমু খাব কিন্তু। জানো আরও অনেক ইচ্ছে আছে। যেমন টাইট একটা হাগ দেওয়া। কিন্তু সেই ইচ্ছে না’হয় বিয়ের পরের জন্য তোলা থাক।’
এহেম লাগাম ছাড়া কথা শুনে নুবাহর অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। সে তো যারপরনাই অবাক। এ কোন ইমদাদকে দেখছে। চিনতেই পারছে না। হঠাৎই গিরগিটির মত এ লোকের আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেল কীভাবে? হুট করে বিষম খেয়ে খেল। মাথায় হাত দিয়ে বার কয়েক ঝাঁকি দিল। তারপরও কমল না। তার এমন আচরণে জিতু ফের বলে উঠল,
‘এই বোকা মেয়ে যেভাবে বিষম খাচ্ছো, মনে হচ্ছে বাসর ঘরে বসে আছি। তুমি আমাকে দেখে লজ্জায় বিষম খাচ্ছো।’
এ কথা বলেই জিতু খিলখিল করে হেসে উঠল।
লজ্জায় হাসফাস করছে নুবাহ। কথার পৃষ্ঠে কথার জবাব দিতে পারল না। এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আছে সে। অথচো জিতু হেসেই যাচ্ছে। আজ মন খুলে সে তার বোকা পাখির সাথে কথা বলছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করল মেয়েটার লজ্জামাখা মুখটা দেখতে। শুধু আজকের রাতের অপেক্ষা। কালকে সে তার বোকা পাখিকে মন ভরে দেখবে। একদম তার মুখের সামনে বসিয়ে রাখবে প্রথম এক ঘন্টা। কিন্তু আগে তার বোকা পাখির লজ্জা তো দূর করতে হবে। তাই তড়িৎ বলল,
‘শোনো বোকা মেয়ে কালকে আসার সময় কিছু হাড্ডি নিয়ে আসিও তো।”
‘হা’ড্ডি কেনো?’
‘আসলে কালকে আমার সাথে কিছু শিয়াল-কুকুর আসবে। তাদের জন্য হাড্ডি লাগবে।
এ লোকটার কথা নুবাহর মাথার উপর দিয়ে গেল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, শিয়াল-কুকুর আসবে মানে?”
জিতু ফের খিলখিল করে হেসে উঠল। জবাবে আর কিছু বলেনি। অথচ অদূরে থাকা পাঁচ জোড়া চোখ তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার হেলদোল নেই। তাতেই কি! এরা তো আসলেই শিয়াল-কুকুর।
___
হৈ হুল্লোড় আর মজা-মাস্তিতে ছুটে চলছে বন্ধুমহলের জিপ। ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা ছেড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বরিশাল শহরে প্রবেশ করেছে। মৃদু শব্দে ধেয়ে আসছে কীর্তনখোলা নদীর শো শো স্নিগ্ধ বায়ু। নদীতে ছুটে চলেছে ছোট ছোট নৌকা, স্ট্রীমার, লঞ্চ।মাঝে মাঝে বকের সারি উড়ে যাচ্ছে নদীর পাশ থেকে। রাস্তার পাশে বাহারি রকমের ফুল ফুটে আছে। লালচে কৃষ্ণচূড়া ফুলে প্রকৃতি নববধূ সেজেছে। বাতাসে সেই ফুলের সুবাসের ছড়াছড়ি। জিতু উচ্ছ্বাসের এক নিশ্বাস ছাড়ে। আজ সে বাঁধনহারা। উতলা মনের মাঝে এ শহরের বাতাস তার কাছে আজ অন্যরকম এক অনূভুতির নাম। সে আনমনে হেসে যাচ্ছে।
চিন্ময় নিজ দায়িত্বে গাড়ি ড্রাইভিং করছে। জিপ নিয়ে বরিশাল যাবে এটা তার আইডিয়া। বন্ধুমহলের ছয়জন ছেলেই আছে। এদের সবার এক দাবি জিতুকে এতদূর একা ছাড়া যাবে না। তার থেকেও বড় কথা, এরা বন্ধুমহলের কেউ একজনের প্রথম প্রেম দেখবে। কীভাবে প্রপোজ করবে, কথা বলবে, দূর থেকে হলেও তারা এসব দেখবে। শুধু দূরত্ব বজায় রেখে আঁড়ালে থাকবে। জিতুকে পাহারা দেওয়া তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এসব মিস করা যাবে না একদমই।
ড্রাইভিং সিটে চিন্ময়, জিতু বসেছে। পেছনে জিমান, সানি, রকি ও মুবিন বসেছে। দীর্ঘ নীরবতা ভেঙ্গে জিমান বলে উঠল,
‘শালার কপালটাই খারাপ। কর্ণেল বাপ আমার প্রেম করতে দিল না। কত কড়া হুকুম জারি করে রাখছে আমার উপর। প্রেম করা যাবে না। প্রেম করলে ডাইরেক্ট মেরে দিব। আহ, কি কষ্টরে ভাই! নয়ত আমিও এখন জিতুর মত বন্ধুমহল নিয়ে প্রেম করতে যাইতাম। অবশ্য আমার মত আরেক জনও আছে প্রেম না করা ছ্যাকাখোর প্রেমিক। বেচারার ওসি মামা নিজের কচি ম্যাইয়ার লগে বিয়ে ঠিক করে রাখছে। আহারে কত দুঃখ। পোলাটা একটা প্রেম করতে পারল না।’
জিমানের অতিদুঃখের কথা শুনে বাকিরা হেসে উঠল। চিন্ময় চোয়াল শক্ত করে তাকাল জিমানের দিকে। জিতু ঠিকই বলে এ ছেলের পেটে কিছুই হজম হয় না। কিন্তু মুখে তাচ্ছিল্যের সুর তুলল জিমানের উদ্দেশ্য। ‘ভালোবাসার থেকেও মাঝে মাঝে ভালো থাকাটা জরুরী। যে জিনিস ধরে রাখতে পারব না, সে জিনিস থাক না পাওয়ার মাঝে।’
বন্ধুমহলের সবাই চুপসে গেল চিন্ময়ের ভারিক্কি কথায়। কিন্তু মুবিনের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত। বুকের বা পাশে অতি সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভব হল। এ অনূভুতি যে তার জন্য ঘোরতর অন্যায়। সে চিরজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে এ অনুভূতিকে। চুপ থাকা রকি সহসাই মুখ খুলল,
‘কিন্তু এ সানলাইট যে প্রতিমাসে একটা করে গার্লফ্রেন্ড চেইঞ্জ করে। সেটার খবর কি কারও আছে। হ্লা পাশের বাসার মারিয়ার লগেও আবার লাইন মারে। বহুত গুটিবাজ পোলা।’
সানি শুনে দাঁত কেলালো। কিড়মিড় করে রকির জবাব দিল, ‘রকস্টার এরা তো আমার এফবির ফেন্ডলিস্টের ফেন্ড। মরার মত পড়ে আছে দেখে তাদের সাথে এক্টু আক্টু মজা করি। আমার আবার প্রেমটেম করার শখ নাই। অত মহান প্রেমিক আমি নই। আর প্রেম নিজের ইচ্ছায় করলেও বিয়া কিন্তু বাপ মায়ের ইচ্ছাই করমু। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, ইডেন কলেজে আজকাল কার যেনো বেশি যাওয়া লাগে। মেয়েটা বায়োলজি প্রথম বর্ষে পড়ে মনে হয়, তাই না রকস্টার? কি যেনো মেয়েটার নাম? আমার তো মনে আসছে না। একটু সবাইরে ক তো।’
রকি হুট করে ক্ষিপ্ত হয়ে সানির দিকে তেড়ে গেল। হিসহিসিয়ে বলে উঠল,
‘হারামি কোথাকার, ফালতু বকবক রাখবি। আমি কখন প্রেম করতে গেছি। মেয়েটার সাথে আচমকা দেখা হইছিল বাসস্ট্যান্ডে। তার একটা বই গাড়িতে ফেলে গেছিল। সেটাই ফেরত দিতে গেছি। তুই তিলকে তাল করবি না কিন্তু সানলাইট।’
বাকিরা মিটমিট করে হাসল। এরা দু’কাজিন সারাক্ষণ একে অপরকে খোঁচায়। নতুন কিছু নয় তাদের জন্য। রকি দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে। চোখ দিয়ে সানিকে গিলে খাচ্ছে। নিজমনে ভাবছে তুই আজ হলে যা সানলাইট, দেখবি তোরে কি করি।
রকির এমন রণমূর্তি দেখে জিমান বলে উঠল, ‘আরে রকি এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আমরা আমরাই তো। জিতুর মত তোকেও না হয় জিপে বসিয়ে নিয়ে যাব। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে কাজী অফিসেও না হয় গেলাম। কি বলিস জিতু?’
চিন্ময় চোখমুখ কুঁচকালো, ‘ইডেন কলেজের মেয়ে, অসম্ভব। আমাদের তিতুমীর কলেজে কি মেয়ের অভাব পড়ছে? রকি এখনো পানি বেশি গড়াই নাই। তাই ফিরে আয় ভাই। আর বেশিদূর আগাবি না কিন্তু।’
মুবিনও সায় দিল।
‘আর বেশিদূর না আগানোই ভালো। নয়তো পরে পস্তাবি কিন্তু।’
রকি বেকুবের মত ‘থ’ মেরে বসে আছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ালো। সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
জিতু চুপচাপ বসে সময়ের হিসাব কষে যাচ্ছে। আর কিছু মুহুর্ত বাকি তার বোকা পাখির সাথে দেখা করার। হাত ঘড়িতে সময় দুপুর ১২টা। বরিশাল সদরে প্রবেশ করেছে মাত্রই। কিছুদূর আসতেই চোখ পড়ল এক বিশাল ফুলের দোকানের দিকে। চিন্ময়কে দ্রুতই বলল গাড়ি থামাতে। গাড়ি থামাতেই জিতু বের হল বাহিরে। সড়কের ওপরে ওভারব্রিজ, ডানপাশে তাদের গাড়ি পার্ক করল। ফুলের দোকান সড়কের বামপাশে। সে লম্বা রাস্তাটা হেঁটে পাড়ি দিল। দোকানে গিয়ে নিজের হাতে পছন্দ করল ফুলগুলো। সুন্দর সাজানো এক ফুলের বুফে বানিয়ে নিল। আজ প্রথম সাক্ষাৎ, ফুল না হলে চলবে নাকি। একহাতে ফুল, অন্যহাতে মুঠোফোন। ফুলের দোকান থেকে সোজা বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে নুবাহকে মেসেজ করল।
‘এই তো এসে গেছি বোকা পাখি। এই তো আর কিছু মুহুর্ত। শুধু তোমাকে দেখার অপেক্ষায় আমার তৃষ্ণার্ত নয়নজোড়া। দীর্ঘ তিন মাসের অপেক্ষার পালা শেষ হল বলে।’
সময় যেন থমকে গিয়েছিল এক মুহুর্তের জন্য। জিতু দিগ্বিদিক শূন্য। তার চিন্তা চেতনায় শুধু এক নারীর প্রতিচ্ছবিই ভেসে বেড়াচ্ছে। তাই তো মুঠোফোন চাপতে চাপতে সড়কে পা রাখল। বন্ধুমহল শতবার ডাকল,
‘জিতু রোড ক্রস করিস না, সামনে তাকা। ট্রাক আসছে জিতু, আসিস না এখন।’
অথচ চৈতন্যহীন জিতুর কর্ণকুহরেও পৌঁছায়নি বন্ধুমহলের সেই বাক্যের প্রতিধ্বনি। যা হওয়ার ছিল না, তাই হল। আনন্দঘন মুহুর্ত যেন বিষাদে পূর্ণ হল। বন্ধুমহল থমকে রইল। ভাবনার অতীত ছিল সেই দৃশ্য। রক্তে রঞ্জিত হল সেই সড়ক। মুহুর্তের মাঝে উড়ে গেল জিতুর হাতে থাকা ফুল। ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল সড়কের মাঝ বরাবর। হাতের মুঠোফোন ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে গেল। আর অন্যদিকে সড়কের ধারে গিয়ে ছিটকে পড়েছে জিতুর নিথর দেহ।
টাইপিং করা সেই মেসেজ পৌঁছায়নি নুবাহর কাছে। তাই তো জানা হয়নি তার ইমদাদ কোথায়?
চলবে,,,,
রেসপন্স করিয়েন। রিচের অবস্থা যাচ্ছেতাই। 😓😓