#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
নয়না সোহেলের বক্ষে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর সোহেল নয়নার চুলে বি’লি কে’টে দিচ্ছে। সোহেল তখন অন্য চিন্তায় মগ্ন ছিল। নয়না সেটা খেয়াল করে সোহেলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘কি ভাবছ তুমি?’
সোহেল ভাবুক স্বরে বলে,
‘ভাবছি আমার মেয়েটার কথা। ফাতেমা যতই যাই বলুক ও কি একা ফারিয়াকে সামলাতে পারবে?’
সোহেলের কথা শুনে নয়না তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আচমকা উঠে বসে সোহেলের শার্টের কলার ধরে বলল,
‘ঐ মেয়েটার জন্য তোমার এত কিসের চিন্তা? আর এতই যদি চিন্তা থাকে তাহলে আমায় কেন বিয়ে করলে?’
‘তুমি ভুল ভাবছ নয়না। ফাতেমাকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। কিন্তু ফারিয়া তো আমার নিজের মেয়ে। তাই আমার তো ওকে নিয়ে চিন্তা হবেই।’
নয়না হঠাৎ করে সোহেলের শার্ট খুলতে শুরু করে। সোহেল কিছু বুঝতে পারে না। নয়না সোহেলের উদোম বুকে মাথা রেখে বলে,
‘ভুলে যাও ফারিয়াকে। আমাদের সংসারে আমি তোমাকে নতুন সন্তান উপহার দেব। ঐ ফাতেমার মেয়ের কথা আমার সামনে আর তুলবে না।’
‘কিন্তু..’
সোহেলকে আর কিছু বলার সুযোগ দেবে না বলে নয়না তার মুখ চেপে ধরল। অত:পর বেশ লাস্যময়ী কন্ঠে বলল,
‘এখন আর কোন কথা না বেইবি। চলো আজ আমরা আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাতটা উপভোগ করি।’
সোহেলও আর কিছু বলে না। নতুন নারী পেয়ে ভুলে যায় নিজের অতীতকে। মত্ত হয় নয়নার মাঝেই।
৩.
ফাতেমা ফারিয়াকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছাউনির নিচে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। যেকোন সময় হয়তো বৃষ্টি নামবে। ফাতেমা কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আমার জীবনের মতো হয়তো প্রকৃতিও আজ অন্ধাকারে ছেয়ে গেছে।’
ফাতেমা নিজের কোলে ঘুমন্ত ফারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘আমার জীবন যতই অন্ধকারে নিমজ্জিত হোক না কেন, আমি আমার মেয়ের গায়ে তার কোন আঁচ পড়তে দেব না৷ আমার মেয়েটা তো কোন দোষ করে নি তাই আমি ওকে কোন শাস্তিও পেতে দেব না। শাস্তি তো পাবে ঐ শয়তান দুটো৷’
বলেই ক্ষিপ্ত নয়নে সোহেলের ফ্ল্যাটের দিকে তাকালো ফাতেমা। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলল,
‘তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।’
ফাতেমা অনুভব করল বৃষ্টি পড়ছে। তাই সে ছাউনির আরো ভেতরে চলে গেল যেন তার মেয়ে না ভেজে। এরইমধ্যে তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে নামলো শ্রেয়া। গাড়ি থেকে নেমেই সে এগিয়ে গেলো ফাতেমার দিকে। ফাতেমা শ্রেয়াকে দেখে খুশি হলো। বলল,
‘তুই এসেছিস?’
‘আসতে তো আমাকে হতোই। তো বল কেন ডাকলি আমায়?’
‘গাড়িতে যেতে যেতে বলি?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
শ্রেয়ার গাড়িতে উঠে পড়লো ফাতেমা। ঘুমন্ত ফারিয়া তখনো তার কোলে। যেতে যেতে শ্রেয়াকে সব কথা খুলে বলল ফাতেমা। সব শুনে শ্রেয়ার মাথায় তো আগুন জ্বলতে লাগল। শ্রেয়ার ইচ্ছা করছিল সোহেল আর নয়নাকে খু”’ন করে দেওয়ার। শ্রেয়া রাগী কন্ঠে বলে উঠলো,
‘তুই এভাবে চুপচাপ চলে এলি কেন?তোর তো ঐ সোহেল আর নয়নার নামে মামলা করা উচিৎ ছিল। যাইহোক, এখনো দেরি হয়নি। চল আমি তোকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছি।’
ফাতেমা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
‘নাহ, এমনটা করা যাবে না। সোহেল একজন উকিল। ও কোন না কোনভাবে ঠিকই আইনের ফাক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া নয়নারও ক্ষমতা কম না। আর এভাবে ওদের বশও করা যাবে না।’
‘তাহলে তুই কি ওদের এভাবেই ছেড়ে দিবি? এত বড় অন্যায় করেও কি ওরা কোন শাস্তি পাবে না?’
‘শাস্তি তো ওর পাবেই। আমি ওদের এমন শান্তি দেব যেটা দেখে সবার আত্মা কে’পে উঠবে।’
বলেই রাগে কাপতে লাগল ফাতেমা। সে জানে তার এখন এত অস্থির হলে চলবে না। যা করতে হবে সেটা বেশ ঠাণ্ডা মাথায় করতে হবে। অধৈর্য হয়ে পড়লে কোন কাজই ঠিকঠাক হবে না।
শ্রেয়া হঠাৎ বলে ওঠে,
‘তোর এই অবস্থার জন্য কোথাও না কোথাও তুই নিজেই দায়ী। তুই পড়াশোনায় কত ভালো ছিলিস, তোর মা-বাবার কত স্বপ্ন ছিল তোকে নিয়ে। অথচ তুই সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে বিয়ে করে সংসার করতে লাগলি।’
শ্রেয়ার কথায় ফাতেমা নিজের অতীতে ডুব দেয়৷ সত্যিই কি দোষটা তারই ছিল? ফাতেমা যখন সবেমাত্র অনার্সে ভর্তি হয় তখনই তার মা-বাবা একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মা’রা যায়। এরপর তার ভাই ফাহিমই তার একমাত্র অভিভাবক ছিল। ফাহিম ফাতেমাকে আগলে রাখলো কিছুদিন। বছর দুয়েক বেশ ভালোই কাটলো৷ এরপর ফাহিম বিয়ে করল। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকই চললো৷ তবে একসময় ফাতেমা আবিষ্কার করল তার ভাবি তাকে মোটেই আর পছন্দ করছে না। তাকে বোঝা মনে করছে। ভাবির জন্য ভাইয়ের সাথেও তার দূরত্ব তৈরি হলো। এইরকমই সময়ে তার জীবনে এলো সোহেল। রোজকার অশান্তি আর সম্পর্কের জটিল সমীকরণের মধ্যে সোহেলের মধ্যেই শান্তি খুঁজে পেত ফাতেমা। অবস্থা এমন হয়ে গেছিল যে সোহেলকে ছাড়া তার কিছুই ভালো লাগত না। আর সোহেলও ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাই তো একদিন ফাতেমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ফাতেমা সোহেলকে নিয়ে নিজের ভাই-ভাবির সাথে দেখা করায়। কিন্তু সোহেলকে একদম পছন্দ হয়না ফাহিমের। কারণ সোহেল ছিল একজন অনাথ। অনাথ আশ্রমে বেড়ে উঠেছে সে। এসব জেনে ফাহিম সোহেলের সাথে ফাতেমার বিয়ে দিতে চায়নি। ফাতেমার ভাবিও ফাহিমকে উস্কানি দেয়। তবে সেই সময় ফাতেমা সোহেলকে এত ভালোবেসে ফেলেছিল যে সে জেদ ধরে বসে সোহেলকে বিয়ে করার। ফাতেমার জেদের কারণে ফাহিমের সাথে তার দূরত্ব আরো বাড়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফাহিমের স্ত্রী ভাই-বোনের মধ্যে আরো দূরত্ব সৃষ্টি করে। এমনকি যেই ফাহিম কোনদিন নিজের বোনের গায়ে ফুলের টোকাটিও লাগতে দেয়নি সেই ফাতেমার গায়ে হাত তোলে। ফাতেমা এতে চরম আঘাত পেয়েছিল৷ অবশেষে নয়না আর সোহেলের কথায় সে নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। অত:পর সোহেলকে বিয়ে করে।
৪.
অতীতের কথা গুলো ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফাতেমা। দোষটা বোধহয় তারই, আবার তার নয়। যেই সময় ফাতেমার ভাবির কারণে তার ভাইয়ের সাথে ঝামেলার সূত্রপাত হয় তখন তার কাছের বন্ধু নয়না তার আরো কাছের হয়ে যায়, সাথে সোহেলও। তাই ফাতেমা তখন তাদের কথাতেই বেশি প্রভাবিত হতো। তবে ফাতেমা আজ একটা কথা বুঝতে পারছে তার ভাই ফাহিম তার ভালোর জন্যই চেয়েছিল যেন সোহেলের সাথে তার বিয়ে না হয়। কিন্তু ভাবির জন্য ভাইয়ের সাথেও যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল সেই জন্যই বোধহয় ফাতেমার কাছে তার ভাইয়ের কথা বিষের মতো লেগেছিল। আসলে কিছু কিছু সময় কিছু বিষাক্ত মানুষের কারণে সুন্দর সম্পর্কগুলো টক্সিক হয়ে ওঠে। তেমনই ফাতেমার ভাবির কারণে তার ভাইয়ের সাথে তার মধুর সম্পর্কও বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল।
ফাতেমা এরপর আস্তে আস্তে নিজের একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত মনে করে। সোহেলের সাথে বিয়ের পর সোহেল তাকে বলেছিল পড়াশোনা ছেড়ে দিতে। সোহেলের যুক্তি ছিল সে নিজেই তো একজন উকিল। তাই তার স্ত্রীকে কষ্ট করে পড়াশোনা করে জব করতে হবে না। সে শুধু তার সংসার সামলাবে। কিন্তু ফাতেমা এমনটা চায়নি। তার মা-বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য সে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায়। সোহেল তাই হয়তো সেইসময় ইচ্ছা করেই বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। ফারিয়া ফাতেমার গর্ভে আসার পরই সন্তানের দোহাই দিয়ে ফাতেমার পড়াশোনার ইতি টেনে দেয় সোহেল। ফাতেমা কোনরকমে অনার্সটা কমপ্লিট করেছিল। তার খুব ইচ্ছা ছিল মাস্টার্স কমপ্লিট করে কোন জবের জন্য এপ্লাই করবে। কিন্তু তার সেই ইচ্ছা আর পূরব হয়না। সংসারের যাতাকলে ফেসে যায় একদম।
অতীত থেকে বেরিয়ে এসে ফাতেমা তাকায় নিজের মেয়ের দিকে। নাহ, সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে তার কোন আফসোস নেই। আফসোস শুধু একটা ব্যাপারেই একটা ভুল মানুষকে ভালোবেসে নিজের স্বপ্নের ইতি টানার। তবে ফাতেমা এবার নিজের সব ভুল শোধরানোর চেষ্টা করবে। যাতে করে নিজের মেয়েকে অন্তত একটা সুখের জীবন দিতে পারে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/