অতুলনীয়া #পর্বঃ৫ #লেখিকাঃদিশা_মনি

0
112

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমা আজ এসে উপস্থিত হয়েছে তেঁজগাওয়ে। নিজের বাবার বাড়িতে। নিজেদের বাসার গলিতে প্রবেশ করতেই আবেগপ্রবণ হয়ে যায় ফাতেমা। এই গলিতেই তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সাথে রয়েছে কত পাওয়া, না পাওয়ার হিসেব। নিজের বাবা বাড়ির সামনে এসে থমকে যায় ফাতেমা। কিছুই বদলায় নি। সবটা এখনো আগের মতোই আছে। শুধু বদলে গেছে কিছু সম্পর্কের সমীকরণ। এই বাড়িতেই বড় হয়ে ওঠা দুই ভাইবোনের সম্পর্কের বন্ধন যা ছিল অটুট তা আজ একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। ফাতেমা অতীতের কথা ভেবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। অতীতের স্মৃতিগুলো মধুর এবং তিক্ততায় ভড়া। তবে তার বর্তমানের লড়াইয়ের জন্য তার এখানে আসাটা যে বড্ড জরুরি ছিল। জীবনের নতুন যে লড়াইয়ে সে নেমেছে সেখানে যে সহায় সম্বলহীন হয়ে থাকলে চলবে না।

আমরা যতই মুখে বলি না কেন, অর্থই সকল অনর্থের মূল, কিংবা money doesn’t matter. প্রকৃত অর্থে এই সমাজে টিকে থাকতে গেলে অর্থের প্রয়োজনই সবথেকে বেশি। অর্থই সমাজে সম্মান এবং ক্ষমতা এনে দেয়। তাই সবক্ষেত্রে মহান হলেও অর্থের ক্ষেত্রে মহান হতে নেই। বিশেষত তখন, যখন সেই অর্থ-সম্পদের উপর আমাদের অধিকার থাকে।

৯.
ফাতেমা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করল। তারপর সব দ্বিধা-দ্বন্দকে পাশে ঠেলে কলিং বেলে চাপ দিলো। পরপর দুবার। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজাটা খুলল। খুন্তি হাতে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো ফাতেমার ভাবি মোহনা। মোহনা ফাতেমাকে দেখে যে একদম খুশি হয়নি সেটা তার মুখ দেখে সহজেই অনুমেয়। ফাতেমা অবশ্য এটাই আশা করছিল। বাইরে দাঁড়িয়েই সে বলল,
‘আমায় ভেতরে আসতে বলবে না ভাবি?’

মোহনা কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘তুমি এখানে কেন এসেছ? কি চাই তোমার এখানে?’

ফাতেমা এমন ব্যবহারই আশা করছিল। তাই বেশি একটা অবাক হলো না। তার ভাবি যে একটুও বদলায় নি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। ফাতেমা মৃদু হেসে বলল,
‘নিজের বাড়িতে আসার জন্য কি কোন কারণ দরকার?’

মোহনা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িই মেয়েদের বাড়ি। অবশ্য তুমি সেটাও টিকিয়ে রাখতে পারো নি।’

‘বাহ, এই খবরো তোমার কাছে পৌঁছে গেছে ভাবি? তুমি তো আমার ভালোই খোঁজ রাখো।’

মোহনা মুখ বাকিয়ে বলে,
‘খোঁজ রাখতে হয় বৈকি। কারণ আমি তো জানি তোমার বোঝা এবার আমাদের ঘাড়ে এসেই চাপাতে চাইবে। তবে তোমায় আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলে রাখি, আমি বা তোমার ভাই কেউই তোমার বোঝা টানতে ইচ্ছুক নই। এমনিতেই আমাদের সংসার চলে নানা অভাব অনটনে তারপর যদি তুমি এসো জোটো তাহলে…’

ফাতেমা মোহনাকে অভয় দিয়ে বলে,
‘তুমি একদম চিন্তা করো না ভাবি। আমি এখানে থাকার জন্য কিংবা তোমাদের ঘাড়ে বোঝা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি এসেছি নিজের অধিকার আদায়ের জন্য।’

‘তোমার অধিকার মানে?’

ফাতেমা কোন জবাব দেবে তার পূর্বেই ফাহিম এসে উপস্থিত হলো। মোহনাকে বলল,
‘কে এসেছে মোহনা?’

মোহনা গম্ভীর স্বরে বলল,
‘কে আর আসবে বলো? তোমার গুণধর বোন নিজের সংসার ভেঙে এখন আমাদের সংসার ভাঙতে এসেছে।’

‘ভাবি!’

ফাহিম এগিয়ে এসে মোহনাকে বেশ রাগী সুরেই বলে,
‘তুমি ওকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন? ভেতরে আসতে দাও।’

অতঃপর নিজেই ফাতেমাকে বলে,
‘তুই ভেতরে আয়। আমরা বসে কথা বলি।’

ফাতেমার প্রতি ফাহিমের এত নরম ব্যবহার একদম সহ্য হয়না মোহনার। সে বিড়বিড় করে বলে,
‘ঢং যত।’

ফাতেমা শোনে মোহনার বলা কথাটা। তবে গায়ে মাখলো না। এখন তার ভাইয়ের সাথে কথা বলাটা বেশি জরুরি। তাই মোহনাকে পাশ কা’টিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ফাহিম সোফায় বসে ফাতেমাকেও সোফাতে বসতে বলল। ফাতেমা নিজের ভাইয়ের কথা মতো সোফায় বসল। ফাহিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফাতেমাকে বলল,
‘আমি কি তোর এতটাই পর হয়ে গেছি ফাতেমা? তোর সাথে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমি কিছু জানতেই পারলাম না। অনলাইন থেকে সবটা জানতে হলো!’

ফাতেমা স্মিত হেসে বললো,
‘আমি তোমাদের অযথা চিন্তার মধ্যে ফেলতে চাইনি ভাইয়া। আর এমনিতেও তোমাদের জানালে তোমরা কিছুই করতে পারতে না। সোহেল আমাকে অনেক বাজেভাবেই ঠকিয়েছে সাথে নয়নাও।’

ফাহিম রাগী কন্ঠে বললো,
‘কে বলেছে কিছু করতে পারতাম না? ঐ সোহেল আর নয়নাকে উচিৎ শিক্ষা দিতাম আমি।’

মোহনা তখনই সেখানে উপস্থিত হয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, ঐসবই করো তুমি। অন্যকে শিক্ষা দিতে গিয়ে নিজেই জেলের ভাত খাও৷ এসব তো তোমার বোনেরই বাড়াবাড়ির ফল৷ আমরা তো কেউ এই বিয়েটার পক্ষে ছিলাম না। তোমার বোন তো নিজের কপাল নিজে খেয়েছে।’

মোহনার কথায় আজ আর নিজেকে সামলাতে পারল না ফাহিম। নিজের মনে এতদিন জমা সব দুঃখ আজ উগলে দিত। বলতে লাগল,
‘তুমি কোন মুখে এসব কথা বলছ মোহনা? তুমি কি ভেবেছ আমি এতদিন তোমায় কিছু বলিনি জন্য আমি কিছু বুঝতে পারিনি? আমি সবই বুঝেছি। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই আমি খেয়াল করছি আমার বোনের প্রতি তোমার কিসের যেন একটা রাগ। প্রথমদিকে আমি এজন্য তোমায় বকেছি। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। আমারও এখনো মনে আছে একদিন তুমি ফাতেমার হাতে গরম পানি ঢেলে দিয়েছিলে। সেদিন আমি রাগ সামলাতে না পেরে তোমার গায়ে হাত তুলেছিলাম আর সেদিনই তুমি বি’ষ খেয়ে সুই**সাইডের চেষ্টা করো। আমি ফাতেমাকে এসব কিছুই বুঝতে দেই নি। তোমায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ওকে মিথ্যা বলেছি যে তুমি বাপের বাড়িতে চলে গেছ কিছুদিনের জন্য। এরপর তুমি সুস্থ হওয়ার পর আমি তোমাকে অনেক বুঝিয়েছি আমার বোনটার সাথে ভালো ব্যবহার করার জন্য কিন্তু তুমি তো তুমিই। বাড়িতে ফিরে তুমি ওর সাথে আরো খারাপ ব্যবহার করতে লাগলে। আমি কিছু বললেই মরার হুমকি দিতে। এত ঝামেলা আমার আর সহ্য হচ্ছিল না এইজন্য আমি ফাতেমাকে অযথা বকতাম। যাতে অন্তত তোমার রাগ কমে, তুমি একটু শান্ত হও। কিন্তু তোমার মধ্যে কোন পরিবর্তনই নেই। তোমার জন্য আমাদের ভাইবোনের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেল। যার দরুণই আমার বোনের সাথে আমার এতটাই মানসিক দূরত্ব তৈরি হলো যে ও আমার বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েও করে নিলো।’

১০.
নিজের ভাইয়ের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেল ফাতেমা। সে বুঝতেই পারে নি তার অগোচরে এত কিছু হয়ে গেছে। এখন ফাতেমা বুঝতে পারছে ফাহিমকে কতোটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এদিকে এত কথা শোনার পরও মোহনার মধ্যে কোন ভাবলেশ নেই৷ সে নিজের দাপট বজায় রেখে বলে,
‘তুমি একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, তোমার এই ডিভোর্সি বোন যেন আমাদের সংসারে এসে না উঠে। নাহলে কিন্তু আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

ফাহিম রাগান্বিত সুরে বলে,
‘তোমার কি সমস্যা ওকে নিয়ে মোহনা? আমাদের তো কোন সন্তানও নেই। শুধু তোমার আর আমার ছোট্ট সংসার। সেখানে ফাতেমা আর ওর মেয়ে এলে কি সমস্যা?’

মোহনার চোখে এবার অশ্রুবর্ষণ শুরু হয়। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখের জল মুছে বলে,
‘এভাবে আমি যে নিঃসন্তান এটা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ঠিক আছে, তুমি থাকো তোমার বোনকে নিয়ে। তোমার বোন হয়তো কিছুদিন পর তোমাকে অন্য একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়েও দিয়ে দেবে। তারপর তাকে নিয়ে সুখে সংসার করিও তুমি।’

বলেই চলে যেতে নেয় মোহনা। তখনই ফাতেমা বলে ওঠে,
‘আমি কখনোই এমনটা করব না ভাবি। আমি জানি, তুমি এই সন্দেহ থেকেই বরাবরই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যেমন ভাবছ আমি তেমন মানসিকতার নই। তোমাদের বিয়ের দিন তোমার মা আর তোমার কথোপকথন আমি শুনে নিয়েছিলাম। আমি এটা অনেক আগে থেকেই জানি যে তুমি কখনো মা হতে পারবে না। কিন্তু কখনো কি আমি এই বিষয় নিয়ে তোমায় কিছু বলেছি? তুমি যাতে কষ্ট না পাও তাই তো আমি এতদিন এই কথাটা গোপন রেখেছি। আর আমার যদি সত্যি এমন কিছু করার থাকতো আমি সেটা অনেক আগেই করতাম।’

ফাতেমার কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে যায় মোহনা। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে ফাতেমার দিকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here