#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ফাতেমার বলা কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মোহনা। অতঃপর কিছুটা অপরাধী চোখ নিয়ে তাকায় ফাহিমের দিকে। ফাহিমের মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তার মানে কি ফাহিম সব আগে থেকেই জানে?! মোহনার মনে থাকা প্রশ্নটা সে বাইরে প্রকাশ করতে পারছিল না। তাই ফাহিমই বলে ফেলে,
‘আমি অনেক আগে থেকেই কথাটা জানি মোহনা। ২ বছর আগে তোমার বাবা যখন মৃত্যুশয্যায় ছিল তখন তিনি আমাকে সবটা জানিয়েছিলেন। ইভেন, আমার কাছেও ক্ষমাও চেয়েছেন সবটা গোপন রাখার জন্য। মৃত্যুর আগে আমাকে সবটা বলে তিনি দায়মুক্ত হতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি আমায় অনুরোধ করেছিলেন, তোমার হাতটা যেন আমি না ছাড়ি কখনো। আমিও ছাড়তে চাইনি। বিশ্বাস করো, তোমার সন্তান না হওয়া নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই৷ আমার আফসোস শুধু এটা নিয়ে যে তুমি কত অবলীলায় আমার থেকে এতগুলো দিন এই সত্য লুকিয়ে গেলে। আগে জানালে হয়তো আমাকে বাবা হওয়ার মিথ্যা স্বপ্নে বিভোর থাকতে হতো না।’
মোহনা নিশ্চুপ, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার কিছুই বলার মুখ নেই ফাহিমের সামনে। ফাতেমার দিকেও তাকানোর মুখ তার নেই। মোহনা আজ জানে আর কোন কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। তার লুকানো সত্য অনেক আগেই প্রকাশিত হয়ে গেছে। এই মানুষ দুটো অনেক আগে সব জেনেছে কিন্তু কখনো তাকে টের পেতে দেয়নি। আর সে কি করেছে? এই দুজনকে চরম অপমান করেছে। মোহনা নিজের কাজেই ছোট হয়ে গেল।
মনে পড়ে গেল অতীতের দিনগুলো। মোহনার বিয়ের আগে জরায়ুতে একটা টিউমার হয়েছিল যার কারণে তার জরায়ু কে’টে বাদ দিতে হয়৷ যার দরুণ সে মা হওয়ার সক্ষমতা হারায়। এই কথা জানার পর ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে সে। মোহনার বিয়ের বয়স হওয়ার পর আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনরা চাপ দিতে থাকে। মোহনার পরিবারও তার জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করে দেয়। কিন্তু মোহনার বিয়েতে ভীষণ ভয় ছিল। যদি তার সত্যটা জেনে বিয়েটা আটকে যায়! অথবা বিয়ের পর ডিভোর্স হয়, তখন কি হবে? এজন্য অনেক ভেবেচিন্তে সে তার মা-বাবাকে জানায় তার এই সমস্যার কথা গোপন রেখে বিয়ে ঠিক করতে এবং পারলে কোন অনাথ ছেলের সাথে তার বিয়ে দিতে। কারণ এতে করে কোন পারিবারিক চাপ থাকবে না। স্বামীকে কোনরকমে ম্যানেজ করলেই হলো। মোহনার এমন দাবি তার মা মানলেও মোহনার বাবা অমত জানায়। তখন মোহনা আত্মহ— হুমকি দিয়ে নিজের বাবাকে রাজি করায়।
মোহনার বাবা অনেক খুঁজে ফাহিমের সন্ধান পান। ফাহিমের কিছু বছর আগেই মা-বাবা দূর্ঘটনায় মা*রা গেছে। পরিবার বলতে আছে শুধু একটা বোন। যেও বিয়ের পর আলাদা হয়ে যাবে। তাই তিনি ফাহিমের সাথেই নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন সব সত্য গোপন রেখে। অতঃপর বিয়েটা হয়েও যায়। বিয়ের পর মোহনার ফাতেমাকে সহ্য হতো না। কারণ তার মনে হতো ফাতেমা হয়তো একসময় তার সংসার ভাঙার কারণ হবে। মোহনার এই ধারণার পেছনের কারণ ছিল তার বিধবা ফুফু একসময় তার মাকে ভীষণ জ্বালাতো কারণ মোহনার মায়ের কোন ছেলে সন্তান হয়নি। তারা দুই বোন ছিল। এমনকি তিনি তার মায়ের মগজধোলাই করে মোহনার বাবার দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যদিওবা মোহনার বাবার অনিচ্ছার কারণে সফল হন নি। নিজের প্রতি হীন্যমনতা এবং অতীতের কথাগুলো ভেবে মোহনার ভীষণ ভয় হয়। তার উপর ফাহিম ফাতেমাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো, ফাতেমা ছিল তার চোখের মনি। তাই মোহনার ফাতেমাকে ঘিরে ভয় তৈরি হয়। যদি তার সন্তান না হওয়ার কারণে ফাতেমা তার সংসার ভেঙে দিতে চায়। এই ভয় দেখেই ফাতেমার সাথে যাবতীয় দূর্ব্যবহার করে মোহনা। তাছাড়া মোহনার মাও তাকে উস্কানি দিত এসব করার কারণ তার মনেও ভয় ছিল।
১১.
অতীতের কথাগুলো ভেবে মোহনার এখন ভীষণ কান্না পায়। ফাহিম, ফাতেমার সামনে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। তাই ত্রস্ত পায়ে ঘরের ভিতরে চলে যায়। ফাহিম একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘মোহনা আজীবন ভুল ধারণা বয়ে নিয়ে বেড়িয়ে নিজের অজান্তেই সব শেষ করে দিলো। ওর ভেতরের ভয়টাই ওকে এতটা কুটিল করে তুলল।’
ফাতেমা বলল,
‘এসব কথা বাদ দাও ভাইয়া৷ যা হবার হয়ে গেছে। এখন তো আর কিছু বদলাবে না।’
‘এসব কথা বাদ দিলেও ঐ সোহেল আর নয়নাকে এত সহজে আমি ছেড়ে দিতে পারব না ফাতেমা। তুই এখনো ওদের নামে মামলা করিস নি কেন?’
‘কারণ ওদেরকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই।’
‘জানিনা, তোর মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছে। যাইহোক, তোর ভাই এখনো বেঁচে আছে। তাই তোকে আশ্রয়হীন হয়ে ঘুরতে হবে না। তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আজই আমার বাড়িতে শিফট কর।’
‘এটা হয়না ভাইয়া। আমার উপস্থিতি ভাবিকে কষ্ট দিতে পারে। আমি এমনটা চাইনা। ভাবি যতদিন না মন থেকে আমায় মেনে নিবে ততদিন আমি এখানে আসতে পারব না। তুমি এই বিষয়টা নিয়ে জোর করো না। আমি নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছি। আমি আজ এখানে এসেছি অন্য একটা কারণে।’
‘কি কারণ বল?’
‘আসলে ভাইয়া আমি আবার আমার পড়াশোনাটা শুরু করতে চাইছি, তাছাড়া ফারিয়ার যাবতীয় খরচ তো আছেই। মেয়েটা বড় হচ্ছে তো। এজন্য আমার টাকার প্রয়োজন। তাই..’
‘তোকে এত চিন্তা করতে হবে না। আমি তোর সব দায়িত্ব নেব।’
‘কিন্তু ভাইয়া..’
‘কোন কিন্তু না। তোর ভাবি এমনি বলেছে আমার অভাব, অনটনের সংসার। আসলে মোটেই এমন কিছু না। আমি যা আয় করি তাতে দুজনে খেয়ে পড়েও অধিকাংশ টাকা বেঁচে থাকে। এমনকি তোর বা তোর মেয়ের দায়িত্ব নিলেও আমার অনেক সাশ্রয় হবে। তাছাড়া এত টাকা সাশ্রয় করে কি হবে বল? আমার তো কোন সন্তান নেই যার জন্য এসব রেখে যাব।’
আফসোস নিয়ে কথাটা বলে ফাহিম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বলে,
‘তুই আপাতত এখানে আসতে না চাইলে না আসিস। তবে আমি তোর আর তোর মেয়ের সব দায়িত্ব নেব এটাতে তুই না করতে পারবি না। আর হ্যাঁ, বাবা শহরের পাশে কিছু জমি তোর নামে রেখে গেছিল। সেগুলো আমি তোকে বুঝিয়ে দিতে চাই। তোরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। এছাড়া এই বাড়ির কিছু শেয়ারও তুই পাবি।’
ফাতেমা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। এই ভাইকেই না সে কতটা ভুল বুঝেছিল।
১২.
ফাতেমা ফাহিমের বাসা থেকে সবেমাত্র বেরিয়েছিল তখনই তার ফোনে ফারিয়ার স্কুল থেকে কল আসে। ফাতেমা ফোনটা রিসিভ করতেই ফারিয়ার স্কুলের প্রিন্সিপাল তাকে বলে,
‘আপনি ফারিয়া তাসনিমের মা ফাতেমা খাতুন বলছেন তো?’
‘জ্বি, ফারিয়ার কি কোন সমস্যা হয়েছে?’
উদ্বেগ নিয়ে কথাটা বলে ফাতেমা। বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসে,
‘আপনি ইমিডিয়েটলি স্কুলে আসুন। ফারিয়ার ব্যাপারে কিছু কথা বলার ছিল।’
ফাতেমা আর অপেক্ষা না করে দ্রুত ফারিয়ার স্কুলের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। ফারিয়ার স্কুলে পৌঁছে প্রিন্সিপালের রুমের বাইরে গিয়ে সেখানে আগে থেকেই সোহেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে যায়৷ সোহেল ফাতেমার দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলতে এলে ফাতেমা ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেয়। প্রিন্সিপালের রুমে নক করে বলে,
‘মে আই কাম ইন ম্যাম?’
‘ইয়েস, কাম।’
ফাতেমা রুমে প্রবেশ করতেই প্রিন্সিপাল ইশারা করে বলে,
‘সিট।’
ফাতেমা বসার পরই সোহেলও সেখানে চলে আসে। প্রিন্সিপাল সোহেলকে ফাতেমার পাশে বসতে বলতেই ফাতেমা প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,
‘এই লোকটার পাশে আমি বসতে পারব না ম্যাম। আর আপনি এরপর থেকে কোন গার্ডিয়ান কলে ওনাকে ডেকে পাঠাবেন না। কারণ ওনার সাথে আমার বা আমার মেয়ের আর কোন সম্পর্ক নেই। আমিই এখন আমার মেয়ের একমাত্র গার্ডিয়ান।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/