অতুলনীয়া #পর্বঃ৯ #লেখিকাঃদিশা_মনি

0
179

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমা উদাস মনে বসে আছে। শ্রেয়া, শাবানা বেগম দুজনেও তার এই উদাস অবস্থা দেখে বিচলিত। ফাতেমা তাদের সব খুলে বলেছেন। তারা নিজেদের সাধ্যমতো ফাতেমাকে শান্তনা দিচ্ছেন তবে ফাতেমার মধ্যে ভয় কিছুতেই যাচ্ছে না। সে যতোই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন মেয়ে হলো তার দূর্বলতার যায়গা। আর তাই যে কোন কিছুর মূল্যে সে নিজের মেয়েকে কাছছাড়া করতে চায়না। মেয়েকে ছাড়া থাকতে হবে এটা ভাবলেও বুক কেপে ওঠে। ফাতেমার এইরূপ ভাবনার মাঝেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠে। শাবানা বেগম দরজা খুলে এক অপরিচিত পুরুষকে দেখে বলেন,
‘কে আপনি?’

ফাহিম নম্র কন্ঠে বলল,
‘আমি ফাতেমার বড় ভাই ফাহিম।’

শ্রেয়া দরজার কাছে এসে বলল,
‘আপনি এসেছেন! আসুন ভেতরে আসুন। আম্মু আমিই ওনাকে ডেকে পাঠিয়েছি। ফাতেমার এখন যা অবস্থা তাতে ওর কাছের মানুষের মেন্টাল সাপোর্টের প্রয়োজন।’

শাবানা বেগম শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘একদম ঠিক কাজ করেছিস তুই। বাবা, তুমি ভেতরে যাও। তোমার বোনটার যে এখন তোমাকে ভীষণ দরকার।’

ফাহিম শ্রেয়াদের বাসায় প্রবেশ করে ফাতেমার সামনে গেল। ফাতেমা কান্না করে করে চোখ ফুলিয়ে তুলেছিল। ফাহিম বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ফাতেমা মুখ তুলে নিজের ভাইকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
‘ভাইয়া, ওরা কি আমার মেয়েটাকে আমার থেকে কেড়ে নেবে?’

‘তুই কোন চিন্তা করিস না বোন। আমি তোর ভাই আছে তোর কাছে। আমি এই শহরের বেস্ট লইয়্যার হায়ার করব তোর জন্য। তোর মেয়ে তোর কাছেই থাকবে। অন্য কেউ তার উপর অধিকার দাখিল করতে পারবে না।’

ফাতেমা এবার অনেকটাই নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। এমন সময় ফারিয়া ঘুম থেকে উঠে বসার রুমে চলে আসে। ফাতেমার পাশে একজন অচেনা মানুষকে বসে থাকতে দেখে বলে,
‘আম্মু উনি কে?’

ফাহিম বা ফাতেমা অবাক হয়না। ফাতেমার সাথে সোহেলের বিয়ের পর ফাহিমের সাথে তাদের আর কোন যোগাযোগই ছিল না। তাই ফারিয়াও নিজের মামার বাড়ির কাউকে চেনে না। ফাতেমা ফারিয়াকে নিজের কাছে ডাকে। ফাহিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
‘উনি হলেন তোমার মামা। মামাকে সালাম দাও।’

ফারিয়া কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ফাহিমের দিকে। মায়ের কাছ থেকে নিজের মামার বাড়ির গল্প শুনেছিল। যতবারই ফাতেমা তাকে মামার ব্যাপারে বলত ততবারই ফাতেমার চোখ ভিজে যেত। ছোট্ট ফারিয়া বুঝতে পারত তার মা তার মামাকে খুব মিস করে। এইজন্য তো সবসময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত যেন তার মায়ের সব দুঃখ দূর হয়ে যায়। ফারিয়া মিষ্টি হেসে ফাহিমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘আসসালামু আলাইকুম, মামা। কেমন আছেন আপনি?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তোমাকে দেখে তো আরো ভালো হয়ে গেলাম মামনি। তুমি একদম ফাতেমার মতোই হয়েছ। ফাতেমাও ছোট বেলায় তোমার মতোই এমন গুলুমুলু ছিল।’

বলেই ফারিয়ার গাল টিপে দেয়। ফারিয়া লজ্জা পেয়ে যায়। ফাহিম ফাতেমাকে বলে,
‘তুই তোর মেয়েকে তো ভালোই শিক্ষা দিয়েছিস। কি সুন্দর আমায় সালাম দিলো।’

ফাতেমার বুক হাহাকার করে ওঠে। সে বলে,
‘এজন্যই তো ভয় হয় ভাইয়া। আমার মেয়েটাকে আমি কিছুতেই তো শয়তানদের হাতে তুলে দেব না।’

‘তোকে তুলে দিতে হবে না। ব্যস, অনেক হয়েছে। এবার তো আমি ঐ সোহেল আর নয়নাকে দেখে নেব। পেয়েছে টা কি ওরা?’

বলেই সে রাগে কাপতে থাকে। তারপর নিজের চেনাজানা একজন উকিলকে ফোন করে। তার সাথে কথা বলে এই কেসের ব্যাপারে। অতঃপর কথা শেষে ফাতেমার মাথায় ভরসার হাত দিয়ে বলে,
‘চিন্তা করিস না ফাতেমা। জয় তোরই হবে৷ উনি আমায় বললেন, জর্জ ফারিয়ার কাছে জানতে চাইবেন ও কার কাছে থাকতে চায়। আর ওর মর্জিই শেষ কথা হবে। তাই তুই নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।’

ফাতেমা একটু শান্তি পায়। তবে ভয় পুরোপুরি দূর হয়না। না জানি সোহেল আর নয়না কি ফন্দি আটছে।

১৭.
আজ কোর্টের হেয়ারিং এর ডেট ডাকা হয়েছে। ফাতেমা, ফাহিম, শ্রেয়া, সোহেল নয়না সবাই তাই সঠিক সময়ে কোট চত্বরে হাজির হয়েছে। ফাতেমা ফারিয়াকে নিজের কোলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ফাহিম তো সোহেলকে দেখে রাগে ফুসছিল। ইচ্ছা করছিল দৌড় গিয়ে ওকে মে*রে শেষ করে দিতে। শুধুমাত্র ওর জন্য ফাতেমার জীবনে আজ এত দূর্ভোগ নেমে এসেছে। তবে সে কোর্টে কোন ঝামেলা করতে চায় না জন্য অনেক কষ্টে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে। এরমধ্যে ফাহিমের ঠিক করা উকিল মিস্টার আফজাল হোসেন চলে এলেন। তিনি আসতেই ফাহিম তার সাথে কেস সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিল। আফজাল হোসেন ফাতেমার কাছে এসে বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না। এই কেস আমরাই জিতব ইনশাআল্লাহ।’

ফাতেমা স্মিত হাসে। সকলেই কোর্টের দিকে পা বাড়ায়। ফাতেমা ফারিয়াকে কোলে করে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় হঠাৎ নয়না তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘নিজের মেয়েকে এখন যত খুশি আগলে রাখ, তবে আর কোন লাভ হবে না। আজকের পর থেকে তুই আর নিজের মেয়েকে স্পর্শও করতে পারবি না।’

ফাতেমা নয়নার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। সেই দৃষ্টিতেই ভস্ম হয়ে যায় নয়না। আর কথা না বাড়িয়ে কোর্টে প্রবেশ করে।

১৮.
কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। যথাসময়ে জজ সাহেব এসে নিজের আসন গ্রহণ করেন। অতঃপর বিচারকার্য শুরু করেন। সোহেল যেহেতু নিজে একজন আইনজীবী তাই এই কেসটা সে নিজের হয়ে নিজেই লড়ছে। জজ সাহেব প্রথমে কেস সম্পর্কে তথ্য জেনে নিলেন।

মূলত সোহেল ও ফাতেমার দাম্পত্য সম্পর্ক ছিল তবে এখন যেহেতু তাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে তাই এখন তাদের সন্তান কার কাছে থাকবে সেই নিয়েই মূল ঝামেলা।

প্রথমেই জজ সাহেব আফজাল হোসেনকে বলার সুযোগ দেন। তিনি বলেন,
‘হুজুর, মিস্টার সোহেল ইসলাম একজন দুশ্চরিত্র প্রতারক ব্যক্তি। উনি তো প্রথমে নিজের স্ত্রী-সন্তানকে ঠকিয়ে অন্য একজন মহিলাকে বিয়ে করেছেন। এখন আবার ওনার সন্তানের কাস্টডিও চাইছেন। এটা ভীষণ হাস্যকর! এমন একজন দুশ্চরিত্র পুরুষের কাছে একটা ছোট বাচ্চার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা সহজেই অনুমেয়।’

তখনই সোহেল উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন,
‘অবজেকশন হুজুর, উনি কিন্তু কোন প্রমাণ ছাড়া আমার নামে বদনাম করছেন। এতে আমার সম্মানহানি হচ্ছে।’

‘অবজেকশন ওভাররুট। মিস্টার হোসেন আপনি নিজের বয়ান কন্টিনিউ করুন।’

আফজাল হোসেন সব ঘটনা খুলে বলেন। সোহেল তখন ফুসছিল শুধু নিজের কুকীর্তির কথা এভাবে শুনে। সব শুনে জজ সাহেব বলেন,
‘এই ধরণের মামলায় সাধারণত বাচ্চাদের চাওয়াকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই, আমি ফারিয়া জান্নাতকে কোর্টে উপস্থিত হবার আদেশ জানাচ্ছি।’

ফাতেমা ফারিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে বলে,
‘যাও মা, জজ সাহেব যা জানতে চাইবে তার একদম ঠিক ঠিক উত্তর দেবে।’

ফারিয়া জজ সাহেবের সামনে যান। তিনি ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন,
‘তুমি কার কাছে থাকতে চাও ফারিয়া? নিজের মায়ের কাছে না বাবার কাছে?’

ফারিয়া একবার সোহেল তো আরেকবার ফাতেমার দিকে তাকিয়ে নিদ্বিধায় বলে,
‘আমি আমার মায়ের কাছে থাকতে চাই। আমি ঘৃণা করি আমার বাবাকে।’

জজ সাহেবের যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। তিনি বলেন,
‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও।’

ফারিয়া চলে যেতেই তিনি বলেন,
‘এই ধরনের মামলায় যেহেতু বাচ্চার কথাই শেষ কথা তাই..’

তিনি নিজের কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই নয়না উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘সরি ফর ইন্টারফেয়ারেন্স। হুজুর, আমি জানি এই ধরণের কেসে বাচ্চার কথাই কোর্ট আমলে নেয় কিন্তু ব্যাপারটা যখন বাচ্চার মগজধোলাই এর তখন তো ভিন্ন বিষয়।’

‘আপনার যা বলার কাঠগড়ায় এসে বলুন।’

নয়না কাঠগোড়ায় যায়। অত:পর কোরানের শপথ করে। এরপর জর্জ সাহেব তাকে তার কথা পরিস্কার করতে বললেই সে বলে,
‘মায়ের কাছে থাকা বাচ্চার জন্য হিতকর নয় এটা জানার পর নিশ্চয়ই আপনি বাচ্চাকে মায়ের কাছে থাকতে বলবেন না?’

জজ সাহেব বলেন,
‘এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় যে মায়ের কাছে থাকার জন্য বাচ্চার কোন রিস্ক থাকে সেক্ষেত্রে কোর্টকে সবকিছু পুনঃবিবেচনা করতে হবে।’

নয়না হাসে। এটাই তো সে চেয়েছিল। তারপর সোহেলকে ইশারা করে বলে,
‘আমি যেই প্রমাণগুলো এনেছিলাম সেগুলো জজ সাহেবকে দাও। তাহলে উনি সঠিক বিচার করতে পারবেন।’

সোহেল নয়নার কথামতো তাই করে। কিছু ফাইল জজ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দেন। যেগুলো দেখে জজ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here