#অর্ধ_নক্ষত্র ।২৬।
#লেখনীতে_Aiza_Islam_Hayati
বিয়ে বাড়ি বলে কথা হরেক রকমের ফুলে সজ্জিত তো হবেই।তা হোক নকল বিয়ে বা আসল,লাল গোলাপ ফুলে সজ্জিত করা হয়েছে পুরো ফ্লাট।সাধারণ ফ্লাট’টি ফুলে আচ্ছাদিত করে দিয়েছে আকাশ।সবই আরশমান এর হুকুম।বাড়িতে আরশমান এর ভাড়া করা সেই মধ্য বয়স্ক মহিলা ও আকাশ সহ তার দলের কয়েকজন যুবকদের দিয়ে পরিপূর্ণ ব্যাস্ত বিয়ে বাড়ি হয়ে উঠেছে।
জুনায়না সকাল থেকে এই অব্দি ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরলো।ঘড়িতে এখন তিনটে বেজে ত্রিশ মিনিট।নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আঞ্জুমান এসে জুনায়না’র সম্মুখে দাড়ালো নম্র স্বরে বলল,”আচ্ছা মা তোর কী সত্যি মনে হয় এইসব করলে প্রশান্ত বাবা তোকে মেনে নিবে।”
জুনায়না হাঁসলো মা কে জড়িয়ে ধরলো বলল,”কেনো মেনে নিবে না।আমি জানি প্রশান্ত আমাকে ভালবাসে।আর ভালোবাসার মানুষ’কে যতই হোক অন্যের হতে দিবে কখনোই।”
“কিন্তু আমার মন যে কু’ ডাকছে।বোধ হচ্ছে অন্য কিছু হবে।তুই এইসব পাগলামি বন্ধ কর।”
জুনায়না মা কে ছেড়ে দিলো মায়ের গালে হাত রেখে বলল,”আমি এখন তৈরি হবো,তুমি আমাকে তৈরি করবে না মা?”
আঞ্জুমান হাসলেন বললেন,”অবশ্যই তৈরি করবো।”
.
আঞ্জুমান জুনায়নাকে নিয়ে বসলো নিজের হাতে বধূ বেসে সাজাতে আরম্ভ করলো।কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে তৈরি করলো মেয়েকে।মেরুন রঙ্গা সেই শাড়িটি জড়িয়ে দিলো গায়ে, চুলে বেনি করে গেঁথে দিলো গোলাপ ফুল,মাথায় মেরুন রঙ্গা এক চুঁনড়ি দিয়ে দিলো।মুখাবয়বে প্রসাধনীর অল্প ব্যবহার,শুধুই ঠোঁটে মেরুন রঙ্গা এক লিপস্টিকের ছোঁয়া।
দরজার সম্মুখ থেকে মেয়েলী কণ্ঠে ভেসে এলো,”মাশাল্লাহ জুনায়না।”
জুনায়না ফিরে চাইলো,সে মুচকি হাসলো।দরজার সম্মুখে মেহরা ও জাহরা মুখে হাত দিয়ে অবাক চাহনিতে চেয়ে আছে জুনায়নার দিকে।
পিছন থেকে ফাইজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,”মামনি আর সাজিও না,নাহয় আসাদ নকল বিয়ে ছেড়ে আসল বিয়ে সেরে ওকে নিয়ে ভাগবে।”
আঞ্জুমান হাঁসলো।হাঁসি ঠাট্টায় মেতে উঠল আঞ্জুমান সহ ছেলে মেয়েরা।এত শত কথার মধ্যেই জুনায়না বলল,”ফাইজ প্রশান্ত কোথায়? এখনও আসছে না যে?আমি আসার আগে ফোন করেছিলাম।ফোন তুললো না।”
ফাইজ পকেট থেকে ফোন বের করে বলে,”ওয়েট আমি ওকে ফোন করে দেখছি।”
ফাইজ ফোন করলো বারকয়েক ফোন ধরলো না প্রশান্ত।জুনায়না নিজের ফোন বের করে নিজেই ফোন করলো প্রশান্তকে।এখন ফোন বন্ধ বলছে প্রশান্ত’র।জুনায়না মুহূর্তের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠলো দাড়িয়ে পড়ল অস্থির কণ্ঠে বলল,”ফাইজ প্রশান্তর ফোন বন্ধ বলছে।”
ফাইজ চাইলো জুনায়নার অস্থির মুখ খানায়।শান্তনা দিয়ে বলল,”তুই অস্থির হইস না জুনায়না।আমি দেখছি।”
জুনায়না মাথার থেকে এক টানে চুঁনড়ি খুলে ফেললো।শাড়ি সামলে বড় বড় কদম ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,”আমি যাচ্ছি।”
আঞ্জুমান অস্থির কণ্ঠে বললেন,”আরেহ মা এইভাবে কোথায় যাচ্ছিস?”
মেহরা জুনায়নাকে যাওয়া থেকে বাঁধা দিলো।পিছু ডাকলো বারকয়েক।জুনায়না শুনলো না।ফাইজ কপাল হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলে,”এমন ভাবে গিয়েছে যেনো আজ প্রশান্ত’র শেষ দিন।একটা মাত্র শান্ত বাচ্চাদের মত প্রশান্ত আমাদের,যদি মেরে দেয় কি হবে আমাদের!”,বলে পিছন ছুটলো ফাইজ, আওড়াতে আওড়াতে গেলো,”আমাকে নিয়ে জা ভাই।”
মেহরা জাহরার দিকে ফিরে বলে,”জাহরা তুই এইখানেই থাক।আমি ফাইজ এর সঙ্গে যাচ্ছি।”
.
জুনায়না বড় সড়কে এসে রিকশা খুঁজলো।সে পেলো না রিকশা।গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই রিকশা চালকদের পাওয়া যায় না।মনে হয় তখন রিকশা নামক কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই এই পৃথিবীতে।
জুনায়নার হাতে থাকা ফোন শব্দ তুলে বেজে উঠলো,জুনায়না ফোনের স্ক্রিনের দিকে চেয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললো।প্রশান্ত ভিডিও কল করছে।জুনায়না কলটি রিসিভ করলো।কণ্ঠে অত্যাধিক অস্থিরতা নিয়ে জুনায়না বলল,”তুই ফোন কেনো ধরছিলি না?কোথায় তুই প্রশান্ত?”
ওইপাশে থাকা প্রশান্ত শান্ত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলো এলোমেলো চুলে,অস্থিরতা মাখা মুখখানায়,তার দেয়া সেই মেরুন রঙ্গা শাড়িতে বধূ সাজে এক রুপসীকে।
জুনায়না ভ্রু কুঁচকে ফেললো প্রশান্তর পিছনে থাকা জায়গাটি লক্ষ্য করলো বলল,”কোথায় তুই?”
প্রশান্ত হাঁসলো বলল,”বধূর এমন এলোমেলো রূপ কেনো শুনি?”
“তুই ছাড়া আমি পুরোটাই এলোমেলো প্রশান্ত,প্লিজ বল তুই কোথায়?”
প্রশান্ত ঘড়ির দিকে চাইলো সময় দেখে ভ্রু কুচকে বলল,”তোর বিয়ে তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা,তুই মাঝ রাস্তায় এমন এলোমেলো রূপে কী করছিস টা কি?”
জুনায়না ধমকে উঠলো,উচ্চ কণ্ঠে বলল,”আগে তুই বল তুই কোথায়?আমি একই প্রশ্ন বারবার করতে একদম পছন্দ করি না।”
প্রশান্ত মৃদু হাঁসলো বলল,”চলে যাচ্ছি আমি।বিমানবন্দরের বাইরেই দাড়িয়ে আছি এখন।আর আধ ঘণ্টা পর আমার ফ্লাইট।”,থেমে থেমে কথাগুলো বলল প্রশান্ত।
জুনায়নার মুখখানা রক্তিম আভায় চেয়ে এসেছে, চোখে জল টলমল করছে বোধ হচ্ছে এখনই অবাধ্য জল কোনো বাধা না মেনেই গড়িয়ে পড়বে।জুনায়না কম্পিত কণ্ঠে বলে,”চলে যাচ্ছিস মানে?”
“হম বিজনেস এর জন্যই চলে যাচ্ছি,আসা হবে না আর।”
জুনায়না ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে চেয়ে রিকশা খুঁজলো,বড় বড় কদম ফেলে সামনে এগিয়ে রিকশার সন্ধান করতে শুরু করলো।তখনই একটি গাড়ি এসে থামলো জুনায়নার সম্মুখে।জুনায়না বিরক্ত হলো রেগে গেলো,মুখ ফুটে কিছু বলার পূর্বেই গাড়ির জানালার গ্লাস নামিয়ে গাড়ির ভিতরে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা ফাইজ মেজাজ দেখাইয়ে বলে উঠলো,”আমাকে তো নিয়ে আসবি ভাই।একা একাই চলে এসেছিস।”
জুনায়না দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে।ফোনের দিকে চেয়ে দেখে প্রশান্ত লাইন কেটে দিয়েছে।
জুনায়না আরও অস্থির হয়ে ওঠে,বলে,”ফাইজ দ্রুত শাহজালাল বিমানবন্দরের দিকে গাড়ি ঘোরা।আধ ঘণ্টার মধ্যে যেকোনো উপায়ে আমাদের যেতে হবে।”
ফাইজ গাড়ি স্টার্ট দিলো জিজ্ঞেস করলো,”কেনো?”
পিছনের সিটে বসে থাকা মেহরা সেও জিজ্ঞেস করলো,”কেনো?কী হয়েছে?”
জুনায়না মেহরার দিকে চেয়ে বলে,”প্রশান্ত লন্ডন চলে যাচ্ছে।আর আধ ঘণ্টা পর ওর ফ্লাইট।”
বাক্যটি শ্রবণ হতেই ফাইজ বিস্মিত কণ্ঠে বলে,”এই প্রশান্ত’র বাচ্চা চলে কেনো যাচ্ছে আবার!”
“প্লিজ ফাইজ তুই দ্রুত গাড়ি চালা।”
“বইন এইটা গাড়ি,এইটা কোনো প্লেন না।এর থেকেও বেশি স্পিড তুললে আমরা বিমানবন্দর না বরং স্বর্গে গিয়ে ল্যান্ড করবো।”
জুনায়না ঠাস করে ফাইজ এর পিঠে থাপ্পর বসিয়ে দিয়ে বলে,”ফাজিল তোর এখনও ফাইজলামি করতে হয়?”
“আরেহ বইন বোঝার চেষ্টা কর।যেকোনো ধরনের এক্সিডেন্ট হতে পারে।তুই শান্ত হ প্লিজ।”
মেহরা ফোনের স্ক্রিনে আঙ্গুল চালিয়ে,ফোন কানের কাছে চেপে ধরলো।ঐপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই মেহরা থমথমে কণ্ঠে বলল,”আর আধ ঘণ্টা পর লন্ডন যাওয়ার কোনো ফ্লাইট আছে?”
“জি ম্যাম।বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৭৮৭ যাচ্ছে।”
“প্রশান্ত রেহমান নামে একজনের এই ফ্লাইটে লন্ডন যাওয়ার কথা।সে কী ভিতরে চলে গিয়েছে?”
লোকটি সময় নিলো অতঃপর বলল,”নাহ ম্যাম সে তো আমার সামনেই দাঁড়িয়ে।”
“তাকে যেতে দেয়া যাবে না।”
“কোনো পা’চা’র’কা’রী কেস ম্যাম?”
“আরেহ আমরা ফোন দি মানেই কী কোনো কেস নিয়ে নাকি?আপনাকে যা বললাম তাই করুন।”
মেহরা ফোন রেখে দিলো জুনায়নাকে উদ্দেশ্য করে বলল,”জুনায়না শান্ত হ।প্রশান্ত যাচ্ছে না কোথাও।”
ফাইজ হাঁসলো বলল,”ভাবি আপনি তো আরশমান এর মতো গ্রেট।”
মেহরা মুচকি হাসলো।
.
চল্লিশ মিনিটের অধিক সময় লাগলো বিমানবন্দরে পৌঁছাতে।গাড়ি থামতেই জুনায়না বেরিয়ে এলো।তার দৃষ্টি গোচর হলো প্রশান্ত।প্রশান্ত বিমানবন্দরের বাইরেই পকেটে দুই হাত গুজে দাড়িয়ে আছে।চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন গার্ড।বার বার সে গার্ডদের সঙ্গে বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে একেক কথা আওড়াচ্ছে।
জুনায়না শাড়ি ধরেই দৌড় লাগালো।প্রশান্ত জুনায়নাকে এমন ভাবে আসতে দেখে ভড়কে গেলো।প্রশান্ত কয়েক কদমও এগিয়ে এলো দৌড়ে আসা জুনায়না প্রশান্ত’র সম্মুখে এসে প্রশান্তকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।প্রশান্ত স্তব্ধ ধীর গতিতে হাত উঠিয়ে জুনায়নার মাথায় রাখলো বলল,”কী হয়েছে জুনায়না?”
জুনায়না হেঁচকি তুলে কাদঁছে।বলে ওঠে,”তুই কোথায় যাচ্ছিলি আমাকে ছেড়ে?আমি তোকে ছাড়া থাকবো কী করে।আমি তো ভালোবাসি তোকে প্রশান্ত।”
“তোর বিয়ে অন্য একজনের সঙ্গে হচ্ছে আর তুই আমাকে এখনও এইসব বলছিস।হচ্ছে কী এতক্ষনে হয়তো বিয়ে সেরে এসেছিস।”
জুনায়না আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো প্রশান্তকে বলল,”চুপ কর প্রশান্ত কোনো বিয়ে হয়নি।প্লিজ তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না প্রশান্ত।এইখানে থেকেই বিজনেস কর না,যাওয়ার কী দরকার।”
প্রশান্ত শুকনো ঢোক গিললো তার গলায় সকল কথা দলা পাকিয়ে এসেছে।জুনায়না পুনরায় বলল,”আমি শুধু মাত্রই তোকে চাই।আমি তোকে ভালবাসি।আসাদ আর আমার বিয়ের ব্যাপার পুরোটাই নাটক ছিল।তোকে জ্বালানোর জন্য এইসব করেছি আমি।ভেবেছিলাম তুই এইসব দেখে সহ্য করতে না পেরে আমাকে এসে তোর মনের কথা বলে দিবি কিন্তু।”
জুনায়নার মাথায় থাকা প্রশান্তর হাতের অবস্থান পরিবর্তন হলো।দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো প্রশান্ত জুনায়নাকে।জুনায়না বলল,”প্রশান্ত আমি জানি তুই কেনো এমন করিস।দেখ যার চলে যাওয়ার সময় আসে তাকে যেতেই হয়।এর জন্য যে তুই দো’ষী তা তো নয়।আর তুই আমাকে ভালোবাসলে তুই তো আমাকে আগলে রাখবি সবসময়।তুই কি আমাকে আগলেও রাখতে পারবি না?তুই সত্যি ভালবাসিস না আমাকে?সবই কী আমার ভুল বোঝা?”
প্রশান্ত চুপ করে রইলো।
“কী হলো উত্তর দে।আমার কসম তোকে,মিথ্যে বলবি না।”
প্রশান্ত আঁখিযুগল বন্ধ করে ফেললো,সময় নিয়ে বলল,”শেষ মেষ এসে এইভাবে আটকে ফেললি আমায়।”
“প্লিজ বল প্রশান্ত।”
“হ্যাঁ ভালোবাসি আমি।বড্ডো ভালোবাসি এই জুনায়নাকে।”
#চলবে।