গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪২
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
যে মেয়ে ঠিকমতো মেহেদী ধরতে পারে না, সে মেয়ে আজ এত কষ্ট করে মেহেদী দিয়ে আবিরের নাম লিখেছে৷ কোথায় আবির একটু খুশি হবে তা না রাগে নামটায় মুছে দিল। আবিরের কার্যকলাপে মেঘের গালসহ পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে। নিরুদ্যম ক্রোধে আবিরের চোখ জ্বলছে। মেঘ জড়বস্তুর ন্যায় স্তব্ধ হয়ে আছে,ওষ্ঠদ্বয় অবিরাম কাঁপছে। আবির ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল,
“সবকিছুর একটা লিমিট থাকা দরকার। তুই কি ভাবছিস, তুই যা ইচ্ছে করবি আর কেউ তোকে কিচ্ছু বলবে না? কোন সাহসে আমার নাম লিখেছিস?”
একদমে কথাগুলো বলে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। চোখ ফেটে যেন আগুন বের হচ্ছে। আবিরের অগ্নিদৃষ্টি দেখে মেঘের বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। আবির ভাইয়ের এই রূপ আর কখনও দেখে নি সে। ভয়ে বুক কাঁপছে। অক্ষিপট ভিজে আসছে। হঠাৎ হাতে ব্যথা অনুভব হওয়ার চিবুক নামিয়ে তাকালো হাতে৷ আবির মেঘের হাতটা এখনও শক্ত করে চেপে ধরে আছে। অতীব ব্যথা অনুভব হওয়া স্বত্তেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না৷ আবিরের অভিমুখে চেয়ে আছে, চোখ টলমল করছে সাথে হৃদয়ে জমছে এক আকাশ সম অভিমান। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মানুষটার চোখে বিবশ হয়ে চেয়ে আছে। অকস্মাৎ পল্লব ঝাপ্টাতেই অষ্টাদশীর গাল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। আবির কপাল গুজিয়ে প্রখর নেত্রে খেয়াল করল। প্রণয়ের নারীর চোখে পানি দেখে আবিরের মেজাজ দ্বিগুণ পরিমাণে খারাপ হলো। রাগে কটমট করে বলল,
“চুপ, একদম কাঁদবি না।এক ফোঁটা পানি মাটি স্পর্শ করতে দেরি হলেও, আমার হাত তোর গাল স্পর্শ করতে দেরি হবে না।”
ভয়ে মেঘের সর্বাঙ্গ কম্পিত হলো। ডানহাতে তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছার চেষ্টা করল। গাল বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে, চোখ মুছে কুলাতে পারছে না। ভেতর ফেটে কান্না আসছে তার। কোনোভাবেই সেই ক্রন্দন আটকাতে পারছে না৷ বুকের ভেতর জমা অভিমানগুলো ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
আবির চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল,
” আমি জানি, আমার গতিবিধি তোর হৃদয়ে আঘাত করেছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। বিশ্বাস কর, যেই হাত দিয়ে আজ নামটা মুছেছি, সেই হাত দিয়েই একদিন তোর হাতে আমার নাম লিখে দিব। শুধু মেহেদী দিয়ে নয় কাগজে-কলমে লিখিত থাকবে, সাজ্জাদুল খান আবির শুধুই মাহদিবা খান মেঘের। সেই নাম হবে চিরস্থায়ী। পৃথিবীর কেউ কোনোদিন সেই নাম মুছতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। ”
অতিরিক্ত কান্নায় মেঘের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। শ্বাস ফেলতে পারছে না। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে আর চোখ মুছছে৷ মেঘের এ অবস্থা দেখে আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
“কি হলো?”
ধমকের শব্দে মেঘ হকচকিয়ে তাকালো। কান্নায় ভেজা চোখের পাপড়ি, লালবর্ণের কপোল আর লেপ্টে যাওয়া কাজল দেখে অষ্টাদশীকে জড়িয়ে ধরার প্রতিষেধ ইচ্ছে জাগছে আবিরের অন্তরে। হঠাৎ মেঘের চোখ পড়ে মালার দিকে। নতুন জামাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিলো। মালাকে দেখেই মেঘের পুরোনো ঘটনা মনে পরছে। ভেতরে জমা অভিমানরা অভিযোগ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মেঘ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
” প্রতিনিয়ত থাপ্পড়ের ভয় না দেখিয়ে, আপনি বরং আমায় একেবারে মে*রে ফেলুন। দুনিয়ার সবাই ধৌয়া তুলসি পাতা, একমাত্র আমি ব্যতিত। কারো দোষ আপনার চোখে পরে না শুধু আমারগুলোই চোখে পরে।”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে শুধালো,
“কি বলতে চাচ্ছিস?”
” অন্য কেউ ও তো হাতে নাম লিখেছে কই তাকে তো কিছু বললেন না!”
মেঘ এটুকু বলেই থেমে গেছে। আবির অবাক লোচনে মেঘকে দেখছে। পেছন ফিরে মালাকে একবার দেখে নিল। পুনরায় মেঘের দিকে চেয়ে ঢোক গিলে ভারী কন্ঠে বলল,
” সবমেয়ের উপর নজরদারি করার দায়িত্ব আমি নেই নি, আর যার তার উপর আবির অধিকারও খাটায়
না। তোর উপর আমার যতটা অধিকার আছে তা আর কারো উপর নেই৷ ”
মেঘ মালার দিকে তাকিয়ে থেকেই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“যেই অধিকারবোধের সবটুকু জুড়েই শুধু রাগ আর অসন্তোষ, প্রয়োজন নেই সেই অধিকার দেখানোর। ”
মেঘের মুখে বিষবাক্য শুনে আবির বিমোহিত নয়নে স্তিমিত মুখের পানে চেয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হঠাৎ ই মেঘের হাত ছেড়ে দিয়েছে। আবির হাত ছাড়তেই মেঘের হুঁশ ফেরে৷ মালার প্রতি তীব্র আক্রোশে কি না কি বলে ফেলছে সে নিজেও জানে না। এদিকে আবির প্রবল চেষ্টায় নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছিল কিন্তু মেঘের কথায় সেই রাগ দ্বিগুণ বেড়েছে। হাতে থাকা মেহেদী টা ছুঁড়ে ফেলে দিল। মেঘ আবিরকে দূর থেকে দেখেই তানবির ভয়ে তটস্থ হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের কাছে আসে। তানভির কাছাকাছি এসে নরম স্বরে মেঘকে ডাকলো,
“বনু..!”
মেঘ সিক্ত চোখে তাকাতেই তানভিরের বুক কেঁপে উঠলো। প্রগাঢ় চোখে তাকালো আবিরের অভিমুখে। তানভিরের দৃষ্টিতে ব্যাকুলতা। বনু কেনো কাঁদছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছে। আবির বাড়ি থেকেই বলে আসছিল, মেঘ কাঁদলে মালার খবর আছে! তবে কি কোনো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। হয়েছেই বা কি! তানভিরের উপস্থিতিতে মেঘ ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। আবির ভাইয়ের নাম লিখেছে এটা তানভির জানতে পারলে কি হবে সেটা ভেবেই ভয়ে চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আবির আড়চোখে চেয়ে মনে মনে বলল,
“প্রয়োজন নেই বললেই তো আমি তোকে ছেড়ে দিতে পারবো না। তুই যদি আমার রাগের কারণ ই না বুঝিস তবে আমার অর্ধাঙ্গিনী হবি কেমন করে!”
মেঘ একটু দূরে যেতেই তানভির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“বনু কাঁদছে কেন ভাইয়া?”
আবির কিছু বলতে পারছে না, কথা আঁটকে আসছে তার। বার বার ঢোক গিলে ভিতরের কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে। যেই মেঘের জন্য আবির নিজের জীবন দিতে রাজি সেই মেঘ আজ এত বড় কথা বলেছে। আবিরের অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে তানভির আবিরের বাহুতে ধরে ডাকল,
“ভাইয়া কি হয়ছে?”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে তানভিরের মুখের পানে চাইলো। আবিরের চোখের প্রতিটা শিরা-উপশিরা রক্তাভ হয়ে আছে। দৃষ্টিতে তীব্র আগুন নির্গত হচ্ছে। প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,
“তোর বোন মেহেদী দিয়ে হাতে আমার নাম লিখছে!”
“কি সর্বনাশ! ”
“একটাবারের জন্য ভাবলোও না, বাসার কারো চোখে এই নাম পড়লে কি অবস্থা হতে পারতো! ও কে কিভাবে বুঝাবো এখন আমার পক্ষে ওর মাত্রাতিরিক্ত পাগলামিকে সাপোর্ট করা সম্ভব না। আমার মনের অবস্থা বলতে পারছি না কারণ এই বয়সে ও কে পারিবারিক ঝামেলায় কোনোভাবেই জড়াতে চাই না আমি।”
তানভির আবিরের কথাগুলো শুনে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“তুমি মাথা ঠান্ডা রাখো,প্লিজ ভাইয়া।”
” তোর বোনের জন্য কি পরিমাণ পীড়া আমি সহ্য করতেছি, এর একাংশ যদি তোর বোন বুঝতো!”
কথাগুলো বলেই আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। মেঘকে জেনে-বুঝে কখনও কষ্ট দিতে চাই না আবির। কিন্তু মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে নিজের অনিচ্ছা স্বত্তেও মেঘকে শাসন করতে হয়। মীম বা আদিও যদি মেঘের হাতে আবিরের নাম দেখে সেই কথা আদির মা, মেঘের মা বা আবিরের মায়ের কান পর্যন্ত যেতে বেশি সময় লাগবে না। মা, কাকি জানা মানেই বাবাদের কানে পৌছাবে। বাসার মানুষ কিছু টের পেলে কি হবে এটায় ভেবেই, নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেয়সীর হাতে জ্বলজ্বল করা নিজের নামটা মুছে যতটা কষ্ট মেঘকে দিয়েছে, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট আবির পাচ্ছে। তানভির কিছু বলতে চাচ্ছিলো হঠাৎ ই আলী আহমদ খান কিছুটা দূর থেকে ডাকলেন,
“আবির, কোনো সমস্যা? ”
আলী আহমদ খানের ডাকে আবির আর তানভির দুজনেই আঁতকে উঠেছে। আবির নিজেকে সামলে আস্তে করে গলা ঝেড়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“কিছু হয় নি আব্বু। ”
আবিরের রক্তিম আঁখি যুগল এখনও অপরিবর্তিত, চোখেমুখে লেপ্টে আছে তীব্র আক্রোশ। এ অবস্থায় আব্বুর মুখোমুখি হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না, এজন্য কয়েক কদম এগিয়ে চোখ-মুখে পানি ছিটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল।
আলী আহমদ খান তানভিরের কাছাকাছি এসে শুধালেন,
“কি হয়েছে আবিরের?”
তানভির সোজাসাপ্টা উত্তর দিল,
“তেমন কিছু না বড় আব্বু৷ শরীরটা বোধহয় একটু খারাপ লাগছে। ”
আলী আহমদ খান আবিরকে এক পলক দেখে একটু উঁচু গলায় বললেন,
“প্রথমবারের মতো মেহমানদারি করছে খারাপ লাগাটায় তো স্বাভাবিক।”
আবির হাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চলে যেতে নিলে আলী আহমদ খান পুনরায় বললেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“খাওয়ানো শেষ হয় নি ”
আবিরের আব্বু স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“খাবারের ঐখানে আর যেতে হবে না। তোমরা দুভাই বরং দেখে আসো নতুন জামাইয়ের ঠিকঠাক মতো আপ্যায়ন করা হচ্ছে কি না!”
“আচ্ছা” বলে বাধ্য ছেলের মতো আবির স্থান ত্যাগ করল৷ তানভিরও আবিরকে অনুসরণ করল। চোখে মুখে পানি দিয়েও রাগ কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হলো। যেতে যেতে দুই ভাইয়ের মধ্যে আরও কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা চলল। কি হচ্ছে আর কি হতে যাচ্ছে সেসব ভেবেই তানভির ঘাবড়ে যাচ্ছে, তারপরও ভাইকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। আবিরের ক্রোধের কাছে সবই বৃথা। স্টেজের কাছে যেতেই চোখ পরল মালার দিকে সাথে ৩-৪ জন কাজিন। মেঘের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল,
“অন্য কেউ ও তো হাতে নাম লিখেছে কই তাকে তো কিছু বললেন না!”
আবির সূক্ষ্ম নেত্রে মালার হাতটা খেয়াল করছে। হঠাৎ ই চোখে পড়ে বড় করে লেখা A অক্ষরটায়। মেঘ যতটা জায়গা নিয়ে আবির নাম লিখেছে প্রায় ততটুকু জায়গা নিয়েই মালা অক্ষরটা লিখেছে। মালা আবিরকে দেখে লাজুক হাসলো। এতে আবিরের মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। আবিরের দৃষ্টিতে তিক্ততা।
কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে গেল। মেহমান খাওয়ানো প্রায় শেষ দিকে। সাকিবের রুম থেকে বেড়িয়ে উঠোনের মাঝখান থেকে আবির উচ্চস্বরে ডাকল,
“সাকিব!”
আবিরের রাগী কন্ঠ শুনে সাকিবের সঙ্গে সঙ্গে তিন মামাও অবাক চোখে তাকালেন৷ ছোট মামা সাকিবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“কি হয়ছে দেখ তো গিয়ে!”
“আচ্ছা”
সাকিব হাতদুটা কোনোমতে ধৌয়ে ছুটে আসল। আবির পাঞ্জাবি হাতা ভাজ করতে করতে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“মালা কে নিয়ে বাড়ির পেছনে আয়৷ ”
সাকিব আশপাশ তাকালো, তানভিরের চিন্তিত মুখবিবর আর আবিরের রাগান্বিত কন্ঠ শুনে বুঝতেই পারছে কিছু একটা হয়েছে। সাকিব মোলায়েম কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“এখনি?”
আবির নিস্তব্ধ কন্ঠে বলল,
“Right now ”
“Okay Vaiya ”
মেঘ রুমে আসার পর থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। মালার উস্কানিতেই মেঘ এমন কান্ড করেছে, না হয় কখনো সে এমনটা করতো না। বিষয়টা নিয়ে যত ভাবছে তত বেশি কান্না পাচ্ছে। আবির ভাইয়ের আচরণের থেকেও নিজের উপর রাগ বেশি উঠতেছে। নাম লেখার সময় একবারের জন্যও বাসার কথা মনে হয় নি তার শুধু মালার প্রতিই জেদ কাজ করছিল। আবির ভাই রাগে নামটায় মুছে দিয়েছেন অথচ আব্বু আর বড় আব্বু দেখলে যে কি হতো! হয়তো বাড়িতে ঢুকতেই দিতেন না। আদো বাড়ির কেউ হাতের নাম দেখে ফেলল কি না এটা ভেবে ভয় ও পাচ্ছে। এই ঘটনার পর আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলা তো দূর সামনে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা নেই মেঘের। নিজের করা অপকর্মের জন্য লজ্জা, আবিরের প্রতি সুপ্ত অভিমান, মালার প্রতি ক্ষোভ সবকিছু মিলে অষ্টাদশীর কোমল মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে। গতকাল থেকে আজ নাগাদ আবিরের সঙ্গে কত ভালো সময় কাটছিল, একটা ভুলের কারণে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আবিরের সামনে কিভাবে দাঁড়াবে এই ভেবেই আরও বেশি কান্না পাচ্ছে। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে গেছে মেঘের মন। অষ্টাদশীর মেঘাচ্ছন্ন মনের অস্ফুট বাসনা ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও যদি ভারী বর্ষণ হতো। বৃষ্টির মতোই মেঘের মনের সকল শঙ্কা, আক্রোশ, শোক সব ধুয়েমুছে যেত। আচমকা তানভির দরজা থেকে ডাকল,
“বনু, আসবো?”
মেঘ তাড়াতাড়ি করে চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল। স্তিমিত কন্ঠে বলল,
“আসো।”
তানভির নরম কন্ঠে বলল,
“মন খারাপ কেন?”
“এমনি। ”
উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে তানভির পুনরায় বলল,
” থাক আর কাঁদতে হবে না, তোকে এখনি বিয়ে দিচ্ছি না। ”
মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। তানভির হাসছে। তানভিরের হাসি দেখে মেঘ মন খারাপ করে বলল,
“ভাইয়া তুমি এখন যাও।”
তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে পুনরায় বলল,
” তোকে শাস্তি না দিয়ে তো যাব না। ”
ঠোঁট ভিজিয়ে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কিসের শাস্তি? ”
আতঙ্কে মেঘের বুক কেঁপে উঠলো। তবে কি আবির ভাই সব বলে দিয়েছেন? ভাইয়া তার ই শাস্তি দিতে এসেছেন৷ মেঘ চিবুক নেমে গলায় আটকালো। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। আজ কোনোভাবেই রক্ষা নেই।
তানভির হাসিমুখে উত্তর দিল,
“তুই যে শুধু ভাইয়ার সঙ্গে ছবি পোস্ট করলি, আমার সঙ্গে করলি না। কাজটা কি ঠিক করছিস?”
মেঘ নিশ্চুপ। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও বলল,
“এটার শাস্তিস্বরূপ তুই এখন ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবি, আমার সঙ্গে ছবি তুলবি সেই ছবি পোস্ট করবি। ”
মেঘ প্রখর নেত্রে তানভিরকে দেখল। ভাইয়ার হাসিমুখ দেখে মেঘ না চাইতেও হাসলো। মেঘের মুখে হাসি দেখে তানভির স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। একদিকে আবিরের রাগ অন্যদিকে মেঘের কান্না, ভাই হিসেবে তানভিরের দুদিক ই সামলাতে হয়৷ তানভিরের কথা শুনে মেঘের মনের ভয় অনেকাংশে কেটে গেছে। সকাল বেলা ছবি পোস্ট করার সময় তানভিরের কথা মনে ছিল না মেঘের৷ কোনোকিছু না ভেবেই আবিরের সাথে ছবি পোস্ট করেছিল। সারাদিনে আর মোবাইল ধরা হয় নি। মেঘ নিচে নামতেই মীম আর আদি দুজনেই ছবি তুলার জন্য ছুটে আসছে। তানভির আগেই ওদেরকে বলে গেছিলো। তানভিরের সঙ্গে ছবি তোলার পরপর তানভির নিজেই সেখান থেকে একটা ছবি মেঘের ফে*সবু*ক আইডিতে পোস্ট করেছে। তারপর মীম, আদির সঙ্গে, নবদম্পতির সঙ্গে ছবি তুলেছে। মীম হঠাৎ ই মেঘের হাত ধরে প্রশ্ন করল,
“আপু মেহেদী দিয়ে হাতটা এভাবে নষ্ট করেছো কেন? ”
আদিও মেঘের হাতটা খেয়াল করে বলল,
“মেঘাপু তোমার হাতটা খুব পঁচা দেখাচ্ছে। ”
মেঘ মৃদু হাসলো। ভাই বোনদেরকে তো বলতে পারবে না আবির ভাইয়ের নাম লেখার শাস্তিস্বরূপ আবির ভাই হাতটা নষ্ট করেছেন। মাইশা সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে তানভিরকে প্রশ্ন করল,
“আবির কোথায়?”
“ভাইয়া ফ্রেশ হতে গেছিল। আসতেছে।”
“ওহ আচ্ছা ”
আবির ভাই আসতেছে শুনেই মেঘের বক্ষস্থলে কম্পন শুরু হয়ে গেছে। পা কাঁপছে। আবির ভাইয়ের মুখোমুখি হবার জন্য অষ্টাদশীর বিন্দুমাত্র সাহস বেঁচে নেই। চলে যাওয়ার জন্য দু পা বাড়াতেই আবির উপস্থিত হলো৷ পাঞ্জাবি পাল্টে খয়েরী রঙের শার্ট সাথে কালো প্যান্ট ইন করে পরেছে, ভেজা চুলগুলো হাত দিয়েই সেট করেছে, সাথে বডিস্প্রের ঝাঁঝালো গন্ধ অষ্টাদশীর হৃদয় কেড়ে নিচ্ছে। যতই রাগ, অভিমান আর মনোমালিন্য থাকুক না কেন প্রিয়জনের উপস্থিতি ই যেন সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। সব ভুলে মেঘ ব্যগ্রভাবে আবিরকে দেখছে, হৃদয়ে ঝড় চলছে। ঝড়ের আবাস বুঝতে পেরে আবির নিজের দৃষ্টি প্রতিরুদ্ধ করে পাশ কেটে স্টেজে চলে গেল। আবির আসায় নতুন করে আবারও ছবি তোলা হচ্ছে, পাঁচ ভাইবোন, মাইশা আর তার হাসব্যান্ডের সঙ্গে, সাকিব, মামারা, বাবা-চাচা মোটামুটি সবার সঙ্গেই ছবি তুলেছে। বেশকিছু ছবিতে মেঘ আবির পাশাপাশি থাকলেও কেউ কারো দিকে তাকায় নি। ছবি তোলা শেষ হতেই মেঘ হালিমা খানের সাথে বাড়ির ভেতরে চলে গেছে। ছোটবেলা থেকেই মেঘের অভ্যাস কারো প্রতি অভিমান হলে, সেটা প্রকাশ করতে না পারলে গম্ভীর হয়ে যায়। কারো সাথে বেশি কথা বলে না, মায়ের পিছনে ঘুরঘুর করে।
আচমকা বিয়ে বাড়ির অভিলাষ বদলে গেছে। চারদিকে কান্নার রব। কনেপক্ষের জন্য সবচেয়ে কষ্টকর মুহুর্ত হলো কনে বিদায়। গায়ে হলুদ, মেহেন্দি, বিয়ে পর্যন্ত সবার মধ্যে যতটা আমেজ থাকে, কনে বিদায়ে সবটায় অভিষঙ্গে মিশে যায়। জন্মের পর থেকে ২০-২৫ বছর এক বাড়িতে বেড়ে ওঠা মেয়েটাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় এক অচেনা পরিবারে। বাবা-মা, ভাইবোনদের প্রতি এতবছরের ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতির বাঁধন ছিঁড়ে চিরতরে চলে যেতে হয়। বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনের কারণে বাবার-মায়ের আদরে বড় করা রাজকন্যারা বাবার বাড়ির মেহমান হয়ে যায়। শুরু হয় এক নতুন জীবন। যেই জীবনের প্রথম লড়াই টায় হলো অচেনা, অপরিচিত মানুষগুলোকে আপন করে নেয়া। বড় মামার বড় মেয়ে মাইশা তাই সবার খুব আদরের। বড় মামা, মামি, মাইশার বাধভাঙ্গা কান্না দেখে বিয়ে বাড়ির প্রতিটা মেহমান কাঁদছে৷ বোনকে জড়িয়ে ধরে বিরামহীন কাঁদছে মালা আর দিশা। দিশার থেকেও মালার কান্নার গভীরতা অনেক বেশি। দুই বোনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। মাইশার বড় ভাই না থাকায় আবির,তানভির,সাকিব আরেকটা কাজিনকে মাইশার সাথে শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে তবে তারা রাতেই চলে আসবে। মেয়েদের মধ্যে স্মৃতি আর দিশা যাচ্ছে মাইশার সঙ্গে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে নবদম্পতি গাড়িতে উঠল। ফুল দিয়ে সজ্জিত এক সাদা রঙের প্রাইভেট কার ধীর গতিতে যাত্রা শুরু করেছে। গাড়ি চলছে ধীর গতিতে, মাইশা কেঁদেই যাচ্ছে, একপাশে দিশা অপর পাশে মাইশার হাসব্যান্ড। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের কান্নার শব্দ, মাইশার বিদায়ের পর আত্মীয়দের ভিড় ঠেলে সেই যে মালা রুমে ঢুকেছে, রুম থেকে আর বের হয় নি। মেঘ বিকেল থেকেই মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। মাইশা আপুর কান্না দেখে নিজের অজান্তেই মেঘের চোখ বেয়ে অনর্গল জল পরছিল, মায়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আঁচল ভিজিয়ে ফেলেছে। আজ এত কাছে থেকে কনে বিদায় দেখে মেঘের নিজের প্রতি প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। সে যে এত সামান্য কারণে কেঁদে একাকার অবস্থা করে, বিয়েতে কি অবস্থা হবে! তৎক্ষনাৎ মনে মনে বিড়বিড় করল,
“আবির ভাইকে বিয়ে করলে তো আমায় বিদায় ও দিবে না আর আমার কাঁদতেও হবে না। ”
কান্নায় ভেজা চোখ, গাল বেয়ে পড়া পানির দাগ তারসঙ্গে মুখে অকৃত্রিম মায়াবী হাসি৷একটা বয়স পর থেকে মেয়েটা সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে। তেমনি মাইশা আপুর বিদায় দেখে মেঘ নিজের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছে। তবে অকৃত্রিম, অকৃপণ হাসিটা বেশিসময়ের জন্য স্থির হতে পারে নি। আবির ভাইয়ের লেপ্টে দেয়া মেহেদীর দিকে নজর পরতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ আনমনে বিড়বিড় করে বলল,
” আবির ভাইয়ের অনুভূতির রাজ্য জুড়ে কোন মহীয়সীর বসবাস! আমার হাত থেকে নাম মুছার কারণ কি শুধুই পরিবার নাকি অন্য কোনো রমণী ?”
সন্ধ্যার বেশ খানিকটা সময় পর বিয়ে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। আবিরের মামারা, আবিরের বাবা-চাচ্চু, মাইশার মামা, খালু সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতে বসেছেন। যার যার ব্যবসা, চাকরি, সন্তান নিয়ে কথা বলতে বলতে আবিরের বিয়ে নিয়ে কথা উঠেছে। আলী আহমদ খানকে প্রশ্ন করায় তিনি স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিয়েছেন, ” ছেলে রাজি থাকলে আগামী বছর ই ছেলেকে বিয়ে করাবো। ” মীম, মেঘ, আদি মাইশার কাজিনদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করেছে। মালা আপুকেও ডেকেছে কিন্তু মালা দরজায় খুলে নি। সবার ডাকাডাকিতে অনেকক্ষণ পর মালা রুম থেকে বেরিয়ে আসছে৷ মীমরা তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলো৷ কাঁদতে কাঁদতে মালার চোখ-মুখ ফোলে গেছে, সারাদিন খায় নি, তাই জোর করেই খেতে বসানো হয়ছে৷ মালার প্রতি মেঘের বিতৃষ্ণা আর ক্ষোভ থাকলেও বোনের প্রতি বোনের ভালোবাসা দেখে মেঘের বড্ড মায়া হচ্ছে। মেঘ নিজে থেকেই মালার সঙ্গে বেশকয়েকবার কথা বলেছে। কিন্তু মালার আচরণে মনে হচ্ছে মেঘকে সে সহ্য ই করতে পারছে না তা বুঝতে পেরে মেঘ রুমে চলে গেছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে৷
আবিররা ফিরেছে প্রায় ১০ টার দিকে, ততক্ষণে বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ শেষ। শীতের সময় ১০ টা মানেই গভীর রাত। মামিরা ব্যতিত সকলেই শুয়ে পরেছে। আবিররা ফ্রেশ হয়ে উঠোনের শেষ প্রান্তে আগুন জ্বালিয়েছে। আবার কবে কাজিনরা একত্রিত হতে পারলে তা জানা নেই৷ দিনটাকে স্বরণীয় করে রাখতেই সমবয়সী সকলে গভীর রাতে আগুন পোহাচ্ছে আর সবার জীবনের গল্প বলছে ৷ ঘন্টাখানেক গল্প করার পর সাকিব তানভিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কিরে তানভির,তোর অন্তরের প্রদেশে যে এক ললনা বসতি স্থাপন করছে তা তো বললি না”
তানভির কন্ঠ খাদে নামিয়ে উত্তর দিল,
“তেমন কিছু না৷ ”
“তুই বলবি কি না বল”
“কি বলব?”
“তুই মেঘবতীর বান্ধবীকে কবে থেকে পছন্দ করিস?”
“কিছুদিন হবে। ”
সাকিব মাথা চুলকে শুধালো,
“আমি তো শুনেছিলাম তুই অনেক বছর যাবৎ বন্যাকে ফলো করিস। ”
তানভির ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল,
” এত বছর কি আমার জন্য ফলো করেছি নাকি। ভাইয়া ই তো বলছে বনুর কাছের বান্ধবীদের উপর নজরদারি করার জন্য । ”
আবির প্রখর নেত্রে তানভিরকে দেখে বলল,
“আমি না হয় নজরদারি করতে বলছিলাম। প্রেমে পড়তে তো বলি নাই৷ ”
সাকিব ভাব নিয়ে বলল,
“কথা সত্য।”
তানভির মন খারাপ করে উত্তর দিল,
“প্রেমে পড়েছি কি পড়ি নি সেটা তো আর সেই মেয়ে জানে না। আমি কখনো বলতেও যাব না তাহলেই তো হবে”
সাকিব আর আবির দুজনেই স্ব শব্দে হেসে উঠল। সাকিব হাসিমুখে বলল,
“এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস কেন? আমরা তো মজা করছি। তুই শুধু বল প্রেমে কবে পড়েছিস তাহলেই হবে।”
আবিরের হাসি দেখে তানভির এক বুক সাহস নিয়ে বলা শুরু করল,
“বনুদের বিদায় অনুষ্ঠানে বনুকে নিয়ে কলেজে গেছিলাম। ভাইয়া বারণ করেছিল বিধায় বনুকে শাড়ি পড়তে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু কলেজ গেইটে ওনাকে শাড়ি পড়া দেখে আমার মনোযোগ থমকে গেছিল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত মায়া কাজ করছিল। বনুর ফ্রেন্ড হিসেবে মেয়েটাকে ছোট থেকেই দেখে আসছি অথচ কখনও এমনটা মনে হয় নি। সেদিন তাকে দেখে মনে হয়েছিল, আজীবন ক্লান্তিহীন তাকিয়ে থাকলেও তাকে দেখার তৃপ্তি মিটবে না।”
আবির, সাকিব সহ বাকিরাও মুগ্ধ আঁখিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে তানভির ই লজ্জায় পড়ে গেছে।
সাকিব মৃদু হেসে সোজাসাপ্টা জবাব দিল,
“ওনাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেয়া উচিত যে তোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে টেনে এনেছে। বিষাদ ছুঁতে চাওয়া তানভির পুনরায় কারো মোহমায়ায় জড়িয়েছে।”
আবির হিমশীতল কন্ঠে বলল,
” তুই ঠিক থাকলে বাকিটা আমি সামলে নিব। কিন্তু এবার যদি তোর মধ্যে উল্টাপাল্টা কিছু দেখি তাহলে তোর একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে। ”
তানভির ঘাড় বেঁকিয়ে সম্মতি দিল। মীমের ডাকে সকাল সকাল ঘুম ভাঙে মেঘের। মেঘ ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই মীম পুনরায় বলল,
“ভাইয়া তোমায় রেডি হতে বলছে।”
মেঘ ঘুমের ঘোরেই বলল,
“কেন?”
“তোমায় ঢাকা নিয়ে যাবে।”
“এখন?”
“হ্যাঁ৷ ভাইয়া রেডি হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি উঠো।”
মীমের কথা শুনে মেঘের ঘুম উধাও হয়ে গেছে।
(চলবে)