আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব- ৪৩ লেখিকা- সালমা চৌধুরী

0
632

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪৩
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

এক লাফে শুয়া থেকে উঠে বসে মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে, সদ্য ফোটা ভোরের আলোয় মেঘের কুহকী মুখমন্ডলে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চোখ কচলাতে গিয়ে দৃষ্টি পরে হাতের দিকে, ক্ষণিকের ব্যবধানে ছোট্ট হৃদয়ে হানা দেয় রাজ্যের অভিমান।গতকাল সকাল টা কত মিষ্টি ছিল, আবিরের কন্ঠে ঘুম ভেঙেছিল। অথচ আজ! অষ্টাদশীর হৃদয়ে পুষা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো অভিষঙ্গে রূপ নিয়েছে। মেঘ অভিমানী কন্ঠে বলে,

” ওনাকে বলে দিস, বাসায় ফিরলে সবার সঙ্গেই ফিরব। আমি এখন ঘুমাবো, আমায় আর ডাকবি না। ”

কথাটা বলেই মেঘ গায়ে লেপ জরিয়ে শুয়ে পরেছে৷ মীম বোনের কথা মতো নিচে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। একে একে আম্মু, বড় আম্মু, কাকিয়া সবাই ডেকেছে কিন্তু মেঘের জেদের কাছে সকলেই হার মানতে বাধ্য হয়েছে। তানভির শীতল কণ্ঠে আবিরকে বলল,
“বনু যেহেতু এখন যেতে চাচ্ছে না, জোর করে নেয়ার চেয়ে পরে আমাদের সঙ্গে নিলে ভালো হতো না?”

আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” ও কে রেখে যাওয়ার রিস্ক আমি নিব না। ”

“আমি আছি তো। মালার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ই দিব না। চোখে চোখে রাখবো বনুকে। ”

“কিভাবে ভরসা করবো বল! নিজেকেই তো ভরসা করতে পারছি না। তোর বোন যেন কষ্ট না পায় তার জন্য যতটা সম্ভব সময় দিয়েছি, আশেপাশে থেকেছি, এমনকি ১২ বছর পর ওর জন্যই মেহেদী ছুঁয়েছি। এতকিছু করেও তোর বোনের মুখের হাসি ধরে রাখতে পারলাম না!”

“বনু এমনিতেই তোমার উপর রেগে আছে, ওর মনের বিরুদ্ধে জোর করে নিয়ে গেলে যদি আরও বেশি রেগে যায়!”

আবির নিশ্চুপ। মেঘকে নিয়ে দুশ্চিন্তা আবিরের মনেও ঘুরপাক খাচ্ছে। গতকাল মেঘের বলা কথায় আবির অনেক কষ্ট পেয়েছে, প্রচন্ড ঠান্তায় গভীর রাতে নদীর পাড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা একাকী বসে ছিল। হাত- পা জমে বরফ হওয়ার জোয়ার হয়েছে অথচ হৃদয়ের র*ক্তক্ষরণ থামানোর সামর্থ্য ছিল না। শেষরাতে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়েই রেডি হয়েছে। বাবা, কাকা আর মামাদের গতকাল রাতেই জানিয়ে দিয়েছিল৷ আবির ঢাকা ফিরবে বলে সকাল সকাল নিশ্চিন্তে আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান আর বড় মামা ঘুরতে বেড়িয়েছেন। মেয়েকে উঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় হালিমা খান তানভির আবিরকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“এই মেয়ে মনে হয় না এখন আর উঠবে। আজকের ক্লাস না হয় মিস ই দিয়ে দিক।”

আবির রাশভারি কন্ঠে বলল,
” দু ঘন্টার জন্য ক্লাস মিস দেয়ার কোনো মানে হয় না। তোমরা আজ থাকলে আমি কিছুই বলতাম না।একটু পর তোমরা যদি যাও ই তাহলে এখন আমার সঙ্গে ক্লাসে যেতে সমস্যা টা কোথায়? ”

“তোর সাথে যেতে সমস্যা হবে কেন, ঠান্ডার মধ্যে উঠতে হয়তো আলসি লাগছে।”

“আমি দেখছি।” বলে আবির ঘরে ঢুকলো, মেঘের রুমের সামনে এসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। আশেপাশে কেউ নেই। বিছানায় লেপ মুড়ি দিয়ে মেঘ গভীর ঘুমে মগ্ন। ধীর গতিতে রুমে ঢুকে বিছানার পাশে বসল। ঘুমন্ত মেঘের মুখের পানে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। সামনের দিকের ছোট চুলগুলো মেঘের গালে, কপালে এলোমেলো হয়ে আছে, তা দেখে আবিরের ভ্রুযুগল কুঁচকে আসে। চুলগুলোকে বড্ড হিংসে হচ্ছে তার৷ অতি সামান্য কারণেই আবিরের নাক ক্রোধে ফুঁসে ওঠেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুই হাতের কনুই এ ভর দিয়ে এগিয়ে গেল মেঘের কাছাকাছি। ফুঁ দিয়ে অগোছালো চুলগুলো সরানোর চেষ্টা করল। দু-একটা চুলের খোঁচায় মেঘ ঘুমের মধ্যেই বাম হাত দিয়ে বাকি চুল গুলো সরিয়ে কপালের উপর হাত রেখে পুনরায় ঘুমের রাজ্যে ডুব দিল। আবির মেঘের হাতের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে মেঘের হাত নিজের কাছে টেনে আলতোভাবে ওষ্ঠ ছোঁয়াল মেহেদী দিয়ে লেপ্টানো রঙের উপর। যার কারণে আবিরের প্রেয়সীকে কাঁদতে হয়েছিল। আবির মেঘের হাতে হাত রেখেই মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,
“ম্যাম!”

মেঘের সাড়া নেই দেখে দ্বিতীয় বারের মতো হাতে অনুগ্র চুমু খেয়ে হাত ছেড়ে পুনরায় কিছুটা উচ্চস্বরে ডাকল,
“ম্যাম! ”

ঘুমন্ত কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসলো,
“হুমমমমমমম।”
মেঘের নেশাক্ত আওয়াজে আবিরের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিমিষেই থেমে গেছে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির ঝলক দেখা গেল। প্রেয়সীর ডাকের প্রতিত্তোরে সর্বদায় “হুমমমমমমম” বলা আবির আজ প্রেয়সীর মুখে এই শব্দ শুনে নে*শাগ্রস্ত হয়ে পরেছে। আনমনে বিড়বিড় করে বলল,
“উফফ! আপনার ঘুম ভাঙানোর সম্পূর্ণ দায়িত্বটা যে কবে নিতে পারবো!”

আবির গলা খাঁকারি দিয়ে একটু গম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,
“এর বেশি লেইট হলে অফিস, ক্লাস কোনোটায় ধরতে পারবো না কিন্তু। ”

আবিরের কথা মেঘের কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই সহসা চোখ মেলল। চোখ পরল আবিরের গভীর নেত্রে। শ্যামবর্ণের পুরুষের কোমলপ্রাণ দৃষ্টি অকারণেই সেই পুরুষের প্রেমে পড়তে বাধ্য করে, হৃদপিণ্ডের চার প্রকোষ্ঠ জুড়ে অনুভূতিদের বিচরণ শুরু হয়েছে। আবিরের ছুরির ন্যায় চাউনী দেখে মেঘ পল্লব ঝাপ্টালো। দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো অন্য দিকে। মনের পাড়ায় জমে থাকা অভিমানেরা ক্রোধে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় লাগল না। রাগান্বিত কন্ঠে “আমি এখন যাব না” বলতেই আবির বাজখাঁই কন্ঠে বলল,

“তুই যাবি কি না সেই সিদ্ধান্ত শুনতে আসি নি। ২০ মিনিট সময় দিলাম তোকে। ২০ মিনিটের মধ্যে রেডি হবি। ”

মেঘের প্রবল জেদ আবিরের হুঙ্কারের সামনে নিস্তেজ হয়ে পরেছে। মেঘ মিনমিনে স্বরে বলার চেষ্টা করল,
“আমি বললাম….”

“১৯ মিনিট বাকি। ”

মেঘ সরু নেত্রে আবিরের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“ফালতু ব্যাটা”

আবির মেঘের চোখে চোখ রেখে বলল,
“১৮”

মেঘ বিড়বিড় করতে করতে তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকতে গিয়ে, ছুটে এসে ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করে পুনরায় ওয়াশরুমে ঢুকলো। আবির মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোন বের করল। মেঘ ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে আবির বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন চাপতেছে, মেঘ বের হতেই আড়চোখে একবার দেখে নিল। ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত-মুখ ধৌয়ায় মেঘের হাত-পা থেকে শুরু করে সারা শরীর অনবরত কাঁপছে। কাঁপা-কাঁপি দেখে আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“খুব বেশি ঠান্ডা লাগছে? বাইকে যেতে পারবি নাকি গাড়ি নিয়ে যেতে হবে?”

আবির ভাইয়ের যত্ন দেখে প্রতিটা ক্ষণে নতুন করে আবিরের প্রেমে পড়লেও আজ সবকিছু বিরক্ত লাগছে। বারবার শুধু মালা আপু আর নাম মুছার কথা মনে পড়ছে। আর মনে মনে বলছে,
” আবির ভাই শুধু আমাকেই শাস্তি দিলেন, অথচ মালা আপুকে কিচ্ছু বললেন না! এখন আমার যত্ন নিতে হবে না। ”

আবির আবারও শুধালো,
“কি হলো? গাড়ি বের করবো?”

“প্রয়োজন নেই৷”

মেঘের অভিমানী স্বর বুঝতে পেরে আবির আর কথা বাড়ায় নি। রেডি হতে বলে নিচে চলে আসছে। আবির মামী, নানু, কাজিনদের সঙ্গে কথা বলছে। মেঘ নিচে আসতেই মামীরা তাড়াতাড়ি করে পিঠা খেতে দিয়েছেন। এত সকালে রান্না হয় নি। না খেয়ে বের হলে বড় মামা রাগারাগি করবেন। আবির, সাকিব, তানভির ওরা ভোরবেলায় পিঠা খেয়েছিল। মেঘ অল্প খেয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মালার রুমে ঢুকল। মালা শুয়ে শুয়ে ফোন চাপতেছিল, মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আপু আসছি৷ ভালো থাকবেন। ”

মালা মেঘের দিকে কেমন করে চেয়ে আছে। মিনিটখানেক নিরব থেকে কঠিন স্বরে বলল,

“তুমিও ভালো থেকো৷ খুব বেশি ভালো থেকো।”

মেঘ হতভম্ব হয়ে মালার মুখের পানে তাকিয়ে আছে৷ মালা ভিতরের সবটুকু আক্রোশ নিয়ে কথাটা বলেছে। মাইশা আপু যতটা ঠান্ডা, মালা ঠিক ততটায় উগ্র। সেটা তার আচরণেই প্রকাশ পায়। ভারী জ্যাকেট, হেলমেট, হ্যান্ডগ্লাভস, বুট পড়ে, হাতের ব্যাগ টা মাঝখানে রেখে বসেছে। সকলকে বিদায় দিয়ে রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। সাকিব আর তানভির গত রাত থেকে আবিরকে বুঝাচ্ছে। মেঘের আচরণে যতই খারাপ লাগুক, আবির সহজে সেটা মেঘের সামনে প্রকাশ করবে না। কিন্তু সেই খারাপ লাগার মাত্রা বেড়ে গেলে সবটা ঝড় আবিরের উপর দিয়ে যাবে। রাগের বশে নিজের ক্ষতি করে ফেলবে এই ভয়ে আছে দুজন। বাইক চলছে নিজস্ব গতিতে, কিছুদূর গিয়ে আবির বাইক থামায়, নিজের ব্যাগ থেকে চাদর বের করে মেঘের গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে, কিছুদূর এগিয়ে চায়ের স্টল থেকে চা খেয়েছে, ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে কম করে হলেও দশবার বাইক থামিয়েছে। সচরাচর বাইক চালানোর সময় আবির এত ব্রেক নেয় না, গন্তব্যে পৌঁছে তবেই থামে। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। প্রেয়সীর অভিমান ভাঙানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে বারবার। এতটা পথ একসঙ্গে এসেছে, কতবার বাইক থামিয়ে এটা সেটা কিনেছে, চা খেয়েছে অথচ সম্পূর্ণ পথেই মেঘ নিশ্চুপ ছিল। ভুলকরেও একটাবারের জন্য চোখ তুলে তাকায় নি। ভার্সিটির গেইটের কাছেই বন্যা, লিজা,সাদিয়া,মিষ্টি, মিনহাজ, তামিম সকলে আড্ডা দিচ্ছিল। মেঘ তাদের দেখে আবিরকে বলল,
“এখানেই নামবো। ”

আবির যথারীতি ব্রেক কষলো। মেঘ নেমে হেলমেট খুলতেই তামিম আর লিজা একসঙ্গে বলল,
“ঐ তো মেঘ এসেছে। ”

বাকিরাও মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ ঘুরে ওদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই হাসিতে নেই কোনো মুগ্ধতা। মেঘ কয়েক পা এগুতেই আবির পিছু ডাকল,
“ক্লাস শেষ হলে ওয়েট করিস।আমি নিতে আসবো। ”

বাইকে হেলমেট পড়া আবিরকে দেখে মিনহাজ ভ্রু কুঁচকে তামিমের দিকে তাকালো। দু’জন তাকাতাকি করল কিছুক্ষণ। তামিম বন্যাকে জিজ্ঞেস করল,
“বাইকার টা কে রে বন্যা?”

বন্যা মুচকি হেসে বলল,
“যার আশিকিতে মেঘ অত্যাসক্ত। ”

মিনহাজ, তামিম সহ সাদিয়া, মিষ্টি সকলেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল,
“What”

বন্যা ভ্রুক্ষেপহীন উত্তর দিল,
“এত অবাক হওয়ার কি আছে!”

মিনহাজ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
“কি হয় মেঘের?”

“চাচাতো ভাই। ”
“আপন?”
“হ্যাঁ”

ততক্ষণে মেঘ কাছাকাছি চলে আসছে। মেঘের গোমড়া মুখ দেখে সাদিয়া আহ্লাদী কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়ছে আমার জানুটার? বয়ফ্রেন্ড চলে যাচ্ছে বলে মন খারাপ?”

লিজা, সাদিয়া, মিষ্টি তিনজনেই উচ্চস্বরে হাসছে। বন্যা মৃদু হাসছে। মেঘ বন্যার দিকে রাগী চেহারায় তাকিয়ে আছে। সাদিয়ারা হাসলেও হাসি নেই তামিম আর মিনহাজের মুখে। দুই বন্ধু বার বার চাওয়াচাওয়ি করতেছে। শুভেচ্ছা ক্লাসের দিন গেইটের সামনে প্রথমবার মেঘকে দেখেই মিনহাজের ভালো লেগেছিল। অফিসে কাজ থাকায় তাড়াহুড়ো করে অফিসে চলে গিয়েছিল বিধায় মেঘের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। কিছুক্ষণ পর মেঘ আর বন্যা যখন ক্লাস খোঁজতেছিল তখন মিনহাজ মেঘকে দেখে ইচ্ছেকৃত ধাক্কা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মেঘ সরে যাওয়ায় ধাক্কাটা লাগে নি। তারপর সিনিয়রের ভাব নেয়া, ফাজলামো করা, বন্ধুত্ব সবটায় ছিল মিনহাজের প্ল্যান। একবার বন্ধুত্ব হয়ে গেলে সময় সুযোগ বুঝে প্রপোজ করবে এই আশাতেই দিন গুনছিল। কিন্তু মেঘ অন্য পুরুষে আসক্ত শুনে মিনহাজের মাথায় আকাশ ভেঙে পরেছে। শীতের সকালেও মিনহাজের শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে। অস্বস্তি লাগছে। শুকনো গলায় ঢোক গিলল।

মেঘ ঘড়িতে টাইম দেখে সবার উদ্দেশ্যে রাগী স্বরে বলল,
“তোরা কি ক্লাসে যাবি নাকি আমি একায় চলে যাব?”

“যাব” বলে ওরা ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মিনহাজ ধীর পায়ে হাঁটছে আর তামিমকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

“আমি যে মেঘকে ভালোবেসে ফেলেছি তার কি হবে?”

“টেনশন করিস না। চল ক্লাস শেষ করে আসি। তারপর মেঘকে নিয়ে বসবো। মেঘের সাথে ঐ ছেলের প্রেমের সম্পর্ক আছে নাকি শুধু ভালোলাগা সবটায় জেনে নিব।”

বন্যা সামনে থেকে ব্যস্ত গলায় বলল,
“কিরে, তোরা ক্লাস করবি না?”

তামিম উচ্চস্বরে বলল,
“এখনি আসছি।”

মিনহাজ হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে তামিমের দিকে তাকালো, তামিম নিরুদ্বেগ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে?”

“তোর যদি বন্যাকে ভালো লেগে থাকে। তাহলে প্রপোজ করে ফেল। মেঘের মতো বন্যার জীবনে কেউ থাকলে পরে কান্না করিস না। ”

ক্লাস শেষ করে বের হতে না হতেই মিনহাজ বলল,
“চল, তোদের আজকে ফুচকা খাওয়াবো।”

মিষ্টি প্রশ্ন করল,
হঠাৎ? কাহিনী কি? প্রেমে টেমে পরছিস নাকি?”

“তোরা আমার বান্ধবী, তোদের খাওয়াতে কারণ লাগে নাকি?”

লিজা হাসতে হাসতে বলল,
“বান্ধবী বলেই আজ পর্যন্ত একটা চকলেটও কপালে জুটে নি। ”

“খাবি কি না বল!”

“অবশ্যই খাবো, চল। ”

মিনহাজ মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল,
“চল। ”

মেঘ আস্তে করে বলল,
” তোরা যাহ, আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে না৷ ”

“ফুচকা না খেলে অন্য কিছু খাবি তবুও চল, প্লিজ। ”
“আমি যাব না বললাম তো। ”

লিজা, সাদিয়া, মিষ্টি আর তামিমের জোরাজোরিতে মেঘ আর বন্যা দু’জনেই রাজি হয়েছে। মিনহাজদের পরিচিত এক ফুচকার দোকানে সবার পছন্দমতো খাবার অর্ডার দিয়ে, চা খেতে খেতে গল্প করছে।

তামিম মেঘকে প্রশ্ন করল,
“ঐ ছেলেটা কি সত্যি ই তোর বয়ফ্রেন্ড? ”

মেঘ গম্ভীর গলায় জবাব দিল,
“না, দূর্ভাগ্যবশত ওনি আমার চাচাতো ভাই।”

বন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মেঘকে শুধালো,
“কালকে পর্যন্ত তো ওনার জন্য দেওয়ানা ছিলি, ডে তে ছবি আপলোড করলি। আজ হঠাৎ কি হলো?”

“কিছু না৷”

মিনহাজ ভারী গলায় প্রশ্ন করল,
“তোদের কি রিলেশন চলে?”

“নাহ। ”
“তাহলে?”

মেঘ রাগে গজগজ করে বলল,
“একতরফা ভালোবাসা বুঝিস? আমি ওনাকে পছন্দ করি কিন্তু ওনি করেন না। এটুকুই। এর বেশি প্রশ্ন করবি না। ”

তামিম আর মিনহাজ চাওয়াচাওয়ি করে বলল,
“আচ্ছা। তোরা বস আমরা খাবার নিয়ে আসি।”

বন্যা এক দৃষ্টিতে মেঘকে দেখেই যাচ্ছে। একবারের জন্য পলক ফেলছে না। মেঘ চিবুক নামিয়ে বসে আছে। ছটফটে স্বভাবের মেয়েটা আজ এত শান্ত হয়ে বসে আছে। বন্যার একদম ভালো লাগছে না। মেঘকে আপাদমস্তক দেখল, হাতের মেহেদী ক্লাসেও দেখেছিল কিন্তু কিছু বলে নি। মেঘ কথা বলছে না দেখে মেঘের হাতের মেহেদী ডিজাইন দেখতে দেখতে বলল,
“এত সুন্দর করে মেহেদী কে দিয়ে দিল?”

“আবির ভাই। ”

বন্যা চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল,
” কি! এটা কিভাবে সম্ভব! সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি। ”

“আবির ভাইয়া মেহেদী দিয়ে দিয়েছেন তারপরও তোর মন খারাপ? ”

মেঘ পুনরায় চিবুক নামালো। বন্যা হাত উল্টাতেই হাতের তালুর লেপ্টানো রঙ চোখে পরল, স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“মাঝখানটা এভাবে নষ্ট করেছিস কেন?”
“আমি করি নি। ”
“কে করছে?”
“আবির ভাই। ”
“ওমা কেন?”
“ওনার নাম লিখেছিলাম তাই। ”

মেঘের কথা শুনে বন্যা স্তব্ধ হয়ে আছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নির্বিকার হয়ে বসে আছে। মেঘের অবস্থা দেখে বুঝায় যাচ্ছে, কিছু বললেই কেঁদে ভাসাবে। বন্যা আশেপাশে মাথা ঘুরালো। লিজারা একটু দূরে বসে তিনজন গল্প করছে। তামিম আর মিনহাজও দূরে। বন্যা অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেঘের হাতে হাত বুলাতে বুলাতে নমনীয় কন্ঠে শুধালো,
” নাম লিখেছিলি কেন?”

মেঘ অভিমানী কন্ঠে বলা শুরু করল,
“আবির ভাইয়ের মামাতো বোন মালা, ওনি অনেকদিন যাবৎ আবির ভাইকে পছন্দ করেন। আবির ভাই দেশে ফেরার পরপর একদিন আমাদের বাসায়ও আসছিলেন। তখন থেকেই ওনার ভাব ভালো লাগে নি। ওনাদের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই আবির ভাইয়ের পিছে ঘুরঘুর করছিল, আমার সাথেও খারাপ ব্যবহার করেছে। শেষ পর্যন্ত ওনার হাতে “A” লিখে আমায় দেখাচ্ছিল। সেই রাগে আমিও আমার হাতে “Abir” লিখেছিলাম। সেটা আবির ভাই দেখে এমনটা করেছেন। অথচ মালা আপুকে কিছুই বললেন না। ”

বিরহের অনলে পুড়ছে মেয়েটা। বেস্ট ফ্রেন্ডকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পর্যন্ত খোঁজে পাচ্ছে না। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,
” ওনি কি কোনোভাবে ঐ মেয়েকে পছন্দ করেন?”
“জানি না। ”

তামিমরা খাবার নিয়ে চলে আসছে। মেঘের চোখ টলমল করছে। তামিম খাবার দিতে দিতে বলল,
“কিরে কি হয়ছে তোর? কাঁদছিস কেন?”

সাদিয়া, মিষ্টি সকলেই এবার মেঘকে লক্ষ্য করছে। মেঘের মতো প্রাণোচ্ছল মেয়ের চোখে পানি, এটা কেউ ই মানতে পারছে না। একের পর এক প্রশ্ন করছে, বন্যা সবার উদ্দেশ্যে গুরুতর কন্ঠে বলল,
“কিছু হয় নি। এমনিতেই। খা তোরা। ”

মিনহাজ,তামিম মেঘ আর বন্যার মুখোমুখি বসেছে। মিনহাজ খাচ্ছে, খানিকক্ষণ পর পর মেঘকে দেখছে। মেঘ চিবুক নামিয়ে বসে চটপটি খাচ্ছে। খাওয়া শেষে বাটি রাখতে গিয়ে চোখ পরে রাস্তার পাশে বাইকের দিকে। রক্তাভ আঁখিতে চোখ পরায় অকস্মাৎ কেঁপে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে এগিয়ে গেল বাইকের দিকে। ফোনের স্ক্রিনে তিনটা মিসডকল ভেসে আছে। তিনটা কল ই আবির করেছিল। ক্লাসে ঢুকলে মেঘ সবসময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখে, ক্লাস শেষে ভাইব্রেশন মুড অন করে দেয়। আজ ক্লাস শেষে খেতে চলে আসায় ফোন হাতেই নেয় নি। আবিরের কাছাকাছি এসে কাঁপা গলায় বলল,
“ফোন সাইলেন্ট ছিল।”

আবির অন্য দিকে মুখ করে বিরক্ত হয়ে বলল,
“১০ মিনিট ওয়েট করার ধৈর্য হয় নি! আড্ডা দেয়ায় এত ইচ্ছে ছিল, আমায় জানালেই হতো। অফিসের কাজ ফেলে কাউকে বিরক্ত করতে আসতাম না। ”

মেঘ ড্যাবড্যাব করে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবুও ঘাড় কাথ করে মেঘ আবিরের মুখ দেখার চেষ্টা করছে। সকাল বেলা হেলমেট না খুলায় কেউ আবিরকে দেখতে পারে নি। এখন হেলমেট খুলায় মিনহাজ, তামিম সহ মেয়েগুলোও দাঁড়িয়ে আবিরকে দেখার চেষ্টা করছে । আবির একটা রিক্সা ডেকে ভাড়া দিয়ে বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এই মেয়ে, বাসায় যাও। ”

বন্যা না করতে যাবে, তখনই চোখাচোখি হয় আবিরের সঙ্গে। কপালে ভাঁজ সাথে আবিরের রাগান্বিত চাহনি দেখে না করার সাহস হয় নি। ভদ্র মেয়ের মতো রিক্সায় উঠে পরে। বন্যা যাওয়ার পর আবির মিনহাজ আর তামিমকে এক পলক দেখে বাইক স্টার্ট দেয়। বাড়ির মানুষজন অনেকক্ষণ আগেই চলে এসেছে। আবির তানভিরের সঙ্গে কথা বলে এক মুহুর্তও দাঁড়ালো না। বাসা থেকে বেড়িয়ে রওনা দিল অফিসের উদ্দেশ্যে। পাঁচমিনিটের মধ্যে তানভিরও বেরিয়ে পরেছে। সপ্তাহ খানেক পর নির্বাচন, যার জন্য তানভির দীর্ঘদিন যাবৎ অপেক্ষা করছে। মেঘ ফ্রেশ হয়ে সেই যে ঘুমিয়েছে মীমের ডাকে উঠেছে প্রায় সন্ধ্যে বেলায়। ফ্রেশ হয়ে দুবোন ছাদের গাছগুলোকে দেখতে গেছে। কিছু গাছের আগাছা পরিষ্কার করে গাছগুলোতে পানি দিয়ে আজানের সঙ্গে সঙ্গে রুমে চলে এসেছে।

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)

★★★★

বছর শেষ হতে চলল, একবছরের সকল হিসেব মেলাতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে আবির। তারমধ্যে তানভিরের নির্বাচনের প্রেশার। সে রিস্ক নিয়ে তানভিরকে রাজনীতিতে পাঠিয়েছে, তানভির ব্যর্থ হলে সেই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায় পরবে আবিরের উপর তার থেকেও বড় বিষয় হলো তানভিরকে ঠিক রাখতে কষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে মেঘের আচরণ ভালো লাগছে না। মেয়েটা ইদানীং অনেক বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন ম্যাচিউরিট ভর করেছে মেঘের উপরে। কথায় কোনো চঞ্চলতা নেই, খাবার সময় ছাড়া নিচে সচরাচর নামতেই দেখা যায় না। ভার্সিটি,ঘুম আর গাছের যত্ন নিয়েই দিন কাটিয়ে দেয়। সন্ধ্যার পর থেকে পড়াশোনা করে বাকিটা সময় অনলাইনে হ্যান্ডপ্রিন্টিং এর কাজ শেখে। খুব বেশি মন খারাপ থাকলে মাকে জরিয়ে ধরে শুয়ে থাকে। আবিরের সঙ্গে সকালে খাবার টেবিল ব্যতিত দেখায় হয় না। আবিরও বাসায় ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। সারাদিন দুই অফিস সামলে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে জিমে যায়। জিম থেকে ফিরতে প্রায় ১২ টা বেজে যায়। রেগুলার চলছে এই রুটিন।

ভার্সিটির বন্ধুরা কেউ মেঘের ফ্রেন্ডলিস্টে এড ছিল না। স্কুল, কলেজের ফ্রেন্ডরায় শুধু এড ছিল। মিনহাজ আর তামিম বলতে বলতে এড করেছে ওদেরকে। সাথে সাদিয়া, মিষ্টি ওদেরকেও এড করেছে। এক বিকেলে মেঘ আর মীম দুবোন ছাদের গাছে পানি দিতে দিতে গল্প করছিল হঠাৎ ই মীম বলল,
“আপু, একটা কথা তোমায় বলা হয় নি!”

মেঘ সন্দিহান হয়ে প্রশ্ন করল,
“কি কথা?”

“মালা আপুর হাতে না মেহেদী দিয়ে নাম লেখা দেখেছিলাম।”

অকস্মাৎ মেঘের মন খারাপ হয়ে গেছে। কিছুদিন যাবৎ সবকিছু এড়িয়ে চলছে যেন স্বাভাবিক হতে পারে। হাতের মেহেদীও ওঠতে শুরু করেছিল। মীম পুনরায় মনে করিয়ে দিল। মীম পুনরায় বলল,
“কি নাম ছিল জানো আপু?”

মেঘ “A” অক্ষর দেখেছিল। কোনো নাম ছিল না। কিন্তু মীম নাম কোথায় পেল। তবে কি পরে আবির ভাইয়ের নাম লিখেছিল! মেঘ আনমনে এসব ভেবে প্রশ্ন করল,

“কি নাম?”

“Ashik”

মেঘ চমকে উঠে প্রশ্ন করল,
“আশিক? তুই ঠিক দেখেছিস?”

“হ্যাঁ। আমি একদম ঠিক দেখেছি। বিয়ের দিন রাতে দেখেছি। তোমাকে বলতে গিয়ে দেখি তুমি ঘুমিয়ে পরেছো। তারপর দিশাকে জিজ্ঞেস করছি, আশিক কে? তখন দিশা বলছে মালা আপুর এক্স বয়ফ্রেন্ডের নাম আশিক। ”

“এক্স বয়ফ্রেন্ড?”

“দিশা তো তাই বললো। ”

মেঘ গভীর চিন্তায় পরে গেছে। মালা আপুর বান্ধবীদের সঙ্গে বলা কথা আর ওনার আচরণে স্পষ্ট বুঝা গেছে ওনি আবির ভাইকে পছন্দ করেন। সকালবেলা হাতে শুধু “A” অক্ষরটায় ছিল, খুব উৎসাহ নিয়েই দেখাচ্ছিলেন। রাতে সেই অক্ষর Ashik কিভাবে হলো? কেউ কি হাতে কখনো এক্স এর নাম লিখে? তবে কি অন্য কেউ ওনার হাতে নাম লেখিয়ে দিয়েছে। কে সে? আবির ভাই নয় তো!
মেঘের হৃদয়ের শক্ত খোলস ভেদ করে অকৃত্রিম হাসি ফুটে ওঠেছে। তাড়াতাড়ি গাছে পানি দিয়ে রুমে চলে গেছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আবিরের জন্য অপেক্ষা করছে। আবির সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই মেঘ রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো ঠোঁট লেগে আছে মায়াবী হাসি। আবির ভ্রু কুঁচকালো। মেঘ হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,
“আবির ভাই..!”

আবির কোনোপ্রকার ভাবাবেগ প্রকাশ না করে কিছুটা তপ্ত স্বরে বলল,
“কিছু বলবেন?”

মেঘের হাসিমুখ মুহুর্তেই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আবিরের এমন উত্তর আশা করে নি সে। মুখ গোমড়া করে বলল,

“আমি যা বলতে চাই তা শুনার ধৈর্য আপনার হবে না। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ”

দুপা পিছিয়ে রুমে ঢুকেই মেঘ দরজা আঁটকে দিয়েছে। আবির অভিভূতের ন্যায় বন্ধ দরজার পানে চেয়ে আছে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here