আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব- ৪৪ লেখিকা- সালমা চৌধুরী

0
461

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪৪
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

কিছু মুহুর্তের জন্য আবিরের দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল। আবিরের মলিন চাহনি দেখে তানভির নিজের রুমের দরজা থেকে ডাকলো,
” কি হয়েছে, ভাইয়া?”

বন্ধ দরজা থেকে মনোযোগ সরলো আবিরের৷ তানভিরের দিকে না তাকিয়েই ছোট করে বলল,
“কিছু না৷ ”

নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে তানভির পুনরায় বলল,
“ভাইয়া, তোমার কি কিছুক্ষণ সময় হবে?”
“কেন?”‘
“এমপি তোমাকে দেখা করতে বলছিল।”
“আমাকে কেন?”
“জানিনা৷ সামনে নির্বাচন হয়তো সেই বিষয়েই কথা বলবেন৷ ”
“কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, ফ্রেশ হয়ে আসছি। ”
“আচ্ছা।”

আবির ফ্রেশ হয়ে তানভিরের সঙ্গে বেড়িয়ে গেছে। মেঘ রুমে বসে বসে হ্যান্ডপ্রিন্টিং এর কাজ করছিল। বেশ কিছুদিন যাবৎ মীমের একটা ড্রেসে কাজ করছে। ড্রেসের কাজ শেষ করেই বন্যাকে ছবি পাঠিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবি দেখে বন্যা কল করেছে৷ দুই বান্ধবী প্রায় ৩০ মিনিট গল্প করেছে। বন্যা জামা-কাপড় সেলাই করতে পারে, মেঘ যেহেতু হ্যান্ডপ্রিন্টিং শিখে ফেলছে দুই বান্ধবী মিলে অনলাইনে বিজনেস করবে৷ সেই বিজনেস এর টাকা দিয়ে তারা দেশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো ঘুরবে তারপর দেশের বাহিরে ট্যুর দিতে যাবে। যখন যা ইচ্ছে করতে পারবে, কারো কাছে অনুমতি নিতে হবে না এসব নিয়েই আড্ডা দিচ্ছিলো। কথা শেষ করেই মেঘ ড্রেসটাকে নিয়ে হুটোপুটি করে নিচে নামলো। আম্মু, কাকিয়া, আব্বু সবাইকে দেখানোর জন্য। সবার প্রশংসা শুনতে শুনতে মেঘের গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। মীম তো খুশিতে বোনকে জরিয়ে ধরেছে।আদি ওয়ারড্রব থেকে নিজের ৫-৭ টা শার্ট আর টিশার্ট বের করে নিয়ে আসছে, মেঘ যেন সেগুলোতে কার্টুনের ক্যারেক্টার আর্ট করে দেয়। আদির এমন কান্ড দেখে বাড়ির প্রত্যেকেই হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। এমন সময় তানভির আর আবির বাসায় ঢুকল। ড্রয়িংরুমের হাস্যোজ্জল পরিবেশ দেখে তাদের মনোযোগও সেদিকে গেল। মোজাম্মেল খান তানভীরকে উদ্দেশ্য করে ঠাট্টার স্বরে বললেন,

“দেখো, আমার মেয়ে কত সুন্দর করে জামা প্রিন্ট করেছে। আমার মেয়ে বলে কথা!”

তানভির ড্রেস টা ভালোভাবে দেখে নিল। ড্রেস দেখে বুঝায় যাচ্ছে কাঁচা হাতের কাজ। প্রথমবারে কোনো কাজ ই পারফেক্ট হয় না তারপরও দূর থেকে তেমন কিছু বুঝা যায় না, কালার কম্বিনেশন ভালো হওয়াতে দূর থেকে দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে। তানভিরের পাশাপাশি আবিরও ড্রেসের দিকে তাকালো। চোখাচোখি হলো আবির মেঘের। অভিমানে মেঘ চোখ নামিয়ে নিল৷ কয়েক সেকেন্ড পর আবিরও অন্যদিকে তাকালো। তানভির আব্বুর ঠাট্টা বুঝতে পেরে সেও মজার ছলে বলল,
” শুধু আপনার মেয়ে বলে না। আমার বোন বলে এত সুন্দর প্রিন্ট করতে পেরেছে৷ আমার বোনের মতো লক্ষ্মী মেয়ে আর একটাও খোঁজে পাওয়া যাবে না। ”

তানভিরের কথা শুনে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। একটা ড্রেস প্রিন্ট করা নিয়ে বাবা-ছেলে মিলে মেঘকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। তানভির খানিক হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচালো। আবিরের ওষ্ঠদ্বয় কিছুটা প্রশস্ত হলো। তানভির যে আবিরকে শুনানোর জন্যই ইচ্ছেকৃত বোনকে লক্ষ্মী বলে সম্বোধন করেছে এটা আবিরের বুঝতে বাকি নেই। আবির আর মেঘের মধ্যে কোনোকিছু নিয়ে মানঅভিমান চলছে সেটা বুঝতে পেরেই তানভির সন্ধ্যে থেকে আবিরকে জিজ্ঞেস করছে। কিন্তু আবির কিছুই বলছে না। মেঘের বিষয়ে কিছু বললেই কথা এড়িয়ে যাচ্ছে।

মোজাম্মেল খান তানভিরের কথার প্রতিত্তোরে বললেন,
” আমার মেয়ের এত এত গুণ যে আমার মেয়ে যেই বাড়িতে বউ হয়ে যাবে সেই বাড়িতেই রাণীর মতো থাকবে, বুঝলে। ”

তানভির দ্বিতীয়বারের মতো আবিরের দিকে তাকিয়ে হালকা কাশি দিয়ে ভ্রু নাচালো। ইশারাতেই যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আবিরকে,
” কি রাখবে তো রাণীর মতো?”

তানভিরের মুখে হাসি থাকলেও আবিরের ভ্রু যুগল কুঁচকানো। আব্বু, চাচ্চুকে সে এক বিন্দু বিশ্বাস করতে পারে না। আজ মজার ছলে বলছেন কিন্তু দুদিন পর যে তার ব্যবস্থা করতে যাবেন না তার কি গ্যারেন্টি আছে। ভাবতেই আবিরের কলিজা কেঁপে উঠলো। আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মালিহা খানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“আম্মু খাবার রেডি করো। ”

মেঘ চোখজোড়া ছোট করে সিঁড়ির পানে চেয়ে আছে। অষ্টাদশীর অভিমানী মনে অভিমানেরা তীব্রভাবে হানা দিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা আবির ভাইকে রাগ দেখালো অথচ আবির ভাই নিজ থেকে একবারের জন্যও কথা বলার চেষ্টা করল না। ড্রেস দেখে সকলেই প্রশংসা করেছে। কিছুএকটা কমেন্টস হলেও করেছে অথচ আবির ভাই কিচ্ছু বললেন না। পৃথিবীর বুকে এই একটা মানুষের হৃদয় ই বোধহয় শক্ত পাথরের তৈরি। যেই হৃদয়ে না আছে কোনো অনুভূতি আর না আছে আবেগ। ড্রেসটা মীমকে দিয়ে দিল৷ এখনও রঙ ঠিকমতো শুকায় নি। শুকালেই ব্যবহার করতে পারবে। সবার সঙ্গে মেঘও খেতে বসেছে৷ আবির একটা ব্যাগে ল্যাপটপ আর কিছু জামাপ্যান্ট নিয়ে নিচে এসেছে৷ ব্যাগ রেখে খেতে বসেছে। খুব তাড়াহুড়োতে খাবার শেষ করছে। আলী আহমদ খান একবার ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছেন একবার আবিরের দিকে। ছেলের তাড়াহুড়ো দেখে কিছু বলতে গিয়ে বারবার আঁটকে যাচ্ছেন। অবশেষে শুধালেন,
“এত রাতে কোথায় যাবে?”
“কাজ আছে৷ ”
” আসবে কখন? ”
“তিন-চারদিন পর।”
“অফিস?”
“ঢাকাতেই থাকবো। সমস্যা নেই অফিসে সময়মতো চলে আসবো। ”
“ঢাকাতে থাকবে মানে? ঢাকা তোমার কি এমন কাজ যে বাসা ছেড়ে বাহিরে থাকতে হবে?”

“আছে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ।”

সকলেই নির্বাক৷ আবির খাবার শেষ করে হাত ধৌয়ে ব্যাগ নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পরেছে। সকলের মতো মেঘও স্তব্ধ হয়ে গেছে। কথাবার্তা নেই হুট করে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলেন। এসব কাজ ছেলেদের পক্ষেই সম্ভব৷ বাহিরে রাত কাটানো, বড়দের মুখের উপর কথা বলা, বেপরোয়া চলাফেরা সব স্বাধীনতায় ছেলেদের । মালিহা খান রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে বললেন,
“আপনাকে কতবার বলেছি ছেলেকে বিয়ে করাতে। ঘরে বউ থাকলে এভাবে রাত-বিরেতে বাহিরে ঘুরতে পারবে না।”
“আচ্ছা দেখছি। ”

দেখতে দেখতে তিনদিন কেটে গেল। আবির এখনও বাসায় ফিরে নি৷ অভিমানী মেঘ সারাক্ষণ নিজেকে ব্যস্ত রাখে যেন আবির ভাইয়ের কথা মনে না পরে। মীম, আদির সঙ্গে খেলাধুলা করে, টিভি দেখে, ক্লাসে যায় অথচ সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝেও হঠাৎ করেই বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। কারো কন্ঠ শুনার জন্য মনটা ছটপট করতে থাকে। সহ্য করতে না পেরে কল দিল সেই পাথুরে হৃদয়ের মানবকে। পরপর দুবার কল দিল অথচ রিসিভ হচ্ছে না। মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, “হয়তো ব্যস্ত আছেন”। কিন্তু মনটাও মাঝে মাঝে সান্ত্বনা মানতে চাই না। মনটা যেন চিৎকার করে বলছে,” তাকে লাগবে মানে লাগবেই, এখন এই মুহুর্তেই লাগবে।” মনের কথা রাখতে তৃতীয়বারের মতো ডায়াল করল অথচ নো রেসপন্স। পাঁচমিনিটের মতো নিশ্চুপ বসে রইল মেঘ। বার বার ফোনের দিকে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে এই বুঝি সেই পাথুরে মানবের কল আসলো। নিজের প্রতি রাগ আর অভিমান বেড়েই চলেছে । নিজে রাগ করে নিজেই বেহায়ার মতো কল দিচ্ছে৷ অথচ আবির ভাই রিসিভও করছেন না৷ রাগে ক্ষোভে একসময় দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে । বিকেল পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে অথচ আবির ভাইয়ের কোনো খবর নেই। প্রায় ১০ টার দিকে আবির কল ব্যাক করেছে৷ একবার রিং হতেই মেঘ সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করল। ওপাশ থেকে আবির বলল,
” সরি, কাজে ব্যস্ত ছিলাম। ফোন দেখি নি৷ ”

প্রখর অভিমান মুহুর্তেই গলে পানি হয়ে গেছে। মেঘ ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“মেঘ, কি হয়েছে তোর।
এই মেঘ। ”

সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়েছে মেঘ। আবির কলের পর কল করছে অথচ রিসিভ হচ্ছে না৷ প্রেয়সীর মলিন চেহারা যেখানে আবিরের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে। সেখানে তার প্রেয়সী কাঁদছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ই আবির বাড়িতে ফিরল । ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে ইকবাল খান নিউজ দেখছিলেন। আবিরকে দেখে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
” তুই না আরও দুদিন পরে আসবি বলছিলি?”

জবাবে আবির বলল,
” ইচ্ছে হলো তাই চলে আসছি।”

আবির দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই মেঘের রুমে ঢুকল। মেঘ বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। আবির ব্যাগটা চেয়ারের উপর রাখতেই মেঘ উঠে বসেছে৷ সিক্ত চোখে একপলক আবিরকে আপাদমস্তক দেখেই চিবুক নামিয়ে নিল।
আবির মেঘের কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে তোর?”

মেঘের নিস্তব্ধতা দেখে আবির মেঘের কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করল, কপাল ঠান্ডা, তবে হলো টা কি? কয়েকবার মেঘকে জিজ্ঞেস করার পর সাড়া না পাওয়ায় আবির বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে পরেছে। ফ্লোরে বসে বিছানার পাশে মাথা রেখে মেঘের অভিমানী মুখের পানে চেয়ে আছে। আবিরের কান্ড দেখে মেঘ তার চিবুক নামিয়ে গলায় ঠেকালো। তবে আবিরের দৃষ্টি সরলো না। হঠাৎ ই আবির হাত বাড়িয়ে ব্যাগ টা নিজের কাছে নিয়ে সেখান থেকে একটা শপিং ব্যাগ আর একটা কাচ্চির প্যাকেট বের করে চেয়ারের উপর রেখে সেই শপিং ব্যাগ থেকে কয়েকটা বেলীফুলের মালা বের করল। মেঘ আড়চোখে মালাগুলোর দিকে তাকিয়ে সহসা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলেছে। আবির মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,
“ম্যাম।”

মেঘ আবিরের দিকে তাকিয়ে ভেঙছি কেটে বিড়বিড় করে বলল,
“আহ্লাদী ডাকে মেঘের রাগ ভাঙবে না!”
মেঘ পুনরায় মুখ ঘুরালো। আবির মৃদু হেসে বলল,

“হৃ*দয়ে বহিছে প্লাবন, তীব্র ব্যাকুলতা।
তুই আমার নিভৃতে যতনে রাখা
বেলিফুলের পুষ্পমালা।”

মেঘ কপাল কুঁচকে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“এসব ভাবের কথা আমায় শুনাতে আসবেন না। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যায়৷ ”

আবির কিছুটা শব্দ করেই হাসলো। মন খারাপ,রাগ, অভিমান দূরে সরিয়ে হাত বাড়িয়ে নমনীয় কন্ঠে বলল,
“দেখি হাতটা দে। ”

“দরকার নেই।”

আবির কন্ঠস্বর ভারি করে বলল,
“শরীরে আকাশ সম ক্লান্তি নিয়েও জ্যাম পেরিয়ে শহর ঘুরে ফুল নিয়ে আসছি৷ ঢং করিস না প্লিজ। ”

“আমি ঢং করছি?”
“ঢংগীরা ঢং করবে এটায় তো স্বাভাবিক। ”

মেঘের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই আবির মেঘের হাত টেনে আলতোভাবে হাতে বেলীফুলের মালা বেঁধে দিচ্ছে। মেঘ কয়েকবার হাত সরাতেও চেয়েছে কিন্তু আবিরের অগ্নিদৃষ্টি দেখে মাথা নিচু করে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“আপনার কি আমাকে লোভী মনে হয়?”
“কেন?”
“যখন যা ইচ্ছে আচরণ করবেন, যা তা বলবেন, যেভাবে খুশি ভাব দেখাবেন তারপর কাচ্চি,মালা, চকলেট হাবিজাবি নিয়ে এসে আমার মন গলানোর চেষ্টা করবেন।”

আবির কন্ঠস্বর ভারি করে বলল,
” যা ইচ্ছে আচরণ আমি করতে চাই না৷ তোর কিছুকিছু কর্মকান্ড আমায় সেসব আচরণ করতে বাধ্য করে। ”

“সেজন্যই তো কল দিলে কল ধরেন না, পাষাণ। ”

আবির শান্ত কন্ঠে বলা শুরু করল,
“আমি সত্যি সত্যি ব্যস্ত ছিলাম। অফিসের পাশাপাশি অন্যান্য কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। বিকেলের পর ফোন হাতে নেয়ার ই সময় পায় নি। সত্যি বলছি আমি। বিশ্বাস কর৷”

মেঘ বিরক্তির স্বরে বলল,
“আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।”

আবির চোখের বর্ণ কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আবির ভ্রু কুঁচকে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“তুই আমায় বিশ্বাস করিস না?”
“নাহ।”
“একটুও করিস না?”
“না”
“সত্যি? ”
“হুম”

“যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে আবিরের কোনো কথাও নেই৷ ”

আবির চলে যেতে নিলে মেঘ মুচকি হেসে বলে,
“একটু একটু বিশ্বাস করি৷ ”

” একচিমটি বিশ্বাসের কোনো প্রয়োজন নেই, চোখ বন্ধ করে আমায় বিশ্বাস করতে পারলে তবেই বলিস। আবির কারো অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে থাকতে চাই না। ”

মেঘ আহাম্মকের মতো চেয়ে আছে। সামান্য কথাতে আবির ভাই এভাবে রেগে যাবে মেঘ সেটা ভাবতেও পারে নি। আবির রাগে ব্যাগ নিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে । রাত ১১.৫০ নাগাদ মেঘ চুপিচুপি আবিরের রুমের সামনে এসেছে। ড্রয়িং রুমের একটা লাইট ব্যতিত পুরো বাড়ির লাইট অফ। ১২ টায় নিউ ইয়ার। এজন্যই মূলত আবির ভাইকে বেশি মিস করছিল। কল দিয়েই বলতো কিন্তু আবিরের কন্ঠ শুনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে নি। বুকের ভেতরের অভিমানের পাহাড় গলতে শুরু করেছিল। নতুন বছর প্রিয় মানুষের সঙ্গে কাটাবে ভেবেই সন্ধ্যায় ছাদ থেকে অনেকগুলো ফুল এনে সেগুলোকে সাজিয়েছে। সাথে একটা সুন্দর গিফটকার্ড বানিয়ে তাতে ডিজাইন করে “Happy New Year” ও লিখেছে সাথে সুন্দর একটা চাবির রিং কিনে এনেছে । মানুষ বলে বছরের প্রথম দিন যেভাবে কাটে সারাবছর নাকি সেভাবেই কাটে। কুসংস্কার জেনেও মেঘের ইচ্ছে সে আবিরের সাথে নতুন বছর শুরু করবে। গিফটগুলো নিয়ে আস্তে করে দরজা ধাক্কা দিতেই চোখ পরে বিছানার দিকে৷ সামান্য আলোতে আবিরের নাক আর কপাল দেখা যাচ্ছে। লেপে ঢাকা সম্পূর্ণ শরীর। মেঘ সেখানে দাঁড়িয়েই পায়ের নুপুর দুটাকে নিচ থেকে হাত দিয়ে উপরে তুলে পায়ের মাংসল অংশে আঁটকে দিয়েছে যেন হাঁটলে শব্দ কম হয়। খুব সতর্কতার সহিত পা রাখলো রুমের মধ্যে। গিফট গুলো যত্নসহকারে টেবিলের উপর রেখে তাকালো আবিরের অভিমুখে। গত তিনদিন ঠিকমতো ঘুম খাওয়া কিছুই হয় নি। ক্লান্তিতে আবিরের চোখের পাতা বারবার বন্ধ হয়ে আসছিল তাই রুমে এসে শাওয়ার নিয়েই শুয়ে পরেছে। মেঘ আবিরের মাথার কাছে দাঁড়ানোতে আবিরের থুতনি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো৷ থুতনির নিচ থেকে বাকি শরীর লেপের নিচে ঢাকা। মেঘের বুকে চাপা অভিমান দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেড়িয়ে আসছে৷ সঙ্গে সঙ্গে ঢোক গিলে নিজের নাক-মুখ চেপে ধরল। একবার আবির ভাই বলেছিল,

“নিঃশ্বাসের শব্দে আমি তোর অস্তি*ত্ব উপল*ব্ধি করতে পারি”
পুরোনো কথাটা মনে পড়তেই নাক-মুখ চেপে ধরেছে। এবার আর কোনোভাবেই ফাঁসা যাবে না। মন বারবার চলে যেতে বলছে অথচ মেঘ দৃষ্টি সরাতে পারছে না। আবির ভাইয়ের ঘুমন্ত, মায়াময় চেহারার পানে মুগ্ধ আঁখিতে চেয়ে আছে। যে মানুষটার উপস্থিতি হৃদয়ে তোলপাড় চালায়, যার শাণিত দৃষ্টি হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করে সেই মানুষটা কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছেন! অষ্টাদশীর মনের রাজ্যে অনুভূতিরা সব অভিমান ভুলে নবরূপে সেই শ্যামবর্ণের পুরুষের প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে৷ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,
“আপনি এত কিউট কেন? মনে হয় আল্লাহ আপনাকে বানানোর সময় কিউটনেসের ডিব্বা আপনার উপর ঢেলে দিয়েছিল।”

বেলকনি দিয়ে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে পরেছে। সেই সঙ্গে মেঘও কেঁপে ওঠে। এই ঠান্ডায় বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবে না। শরীরের কম্পনের শব্দেই আবির ভাই সজাগ হয়ে যাবে৷ বারবার যেতে চাইছে কিন্তু ঘুমন্ত আবির ভাইকে দেখার লোভ সামলিয়ে যেতে পারছে না। কে বলবে এই মেয়ে গত ৯ বছর যাবৎ আবিরকে সহ্য ই করতে পারতো না৷ আবির বাড়ি ফিরেছে সবেমাত্র ৬ মাস হয়েছে। এতেই আবিরের প্রতি পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পরেছে। যে মেয়ের রাগ আর জেদের কাছে খান বাড়ির প্রতিটা সদস্য হার মানতো সেই মেয়ের রাগ-অভিমান এখন আবিরের রাগের সামনে তুচ্ছ। ভালোবাসা বোধহয় এমনই হয়, শতরাগের পরও প্রিয় মানুষটার উপস্থিতি হৃদয় প্রশান্ত করে তুলে।

দেয়াল ঘড়ির টিনটিন শব্দে মেঘের ঘোর কাটে, ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখল ঘড়িতে ১২.০০ বাজে। বুক ধুকপুক করতে শুরু করেছে। মনে অপরাধমূলক কাজ করার নিষিদ্ধ ইচ্ছে জেগেছে। বুক ফুলিয়ে অনেকটা শ্বাস টেনে নিঃশ্বাস আঁটকে আবিরের কপাল বরাবর মুখ এগিয়ে নিল, উদ্দেশ্য আবিরের কপালে চুমু খাবে৷ একটু সামনে এগুতেই বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। অষ্টাদশী বুঝতে পারছে এই কাজ তার পক্ষে সম্ভব না৷ ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলাতে বাম হাত দিয়ে মুখ চেপে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবে ওমনি ডানহাতে টান অনুভব করে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। আবির মেঘের ডানহাতে জোরে টান দেয়ায়, মেঘ আবিরের উপর এসে পরে, তৎক্ষনাৎ মেঘকে উপর থেকে পাশে সরিয়ে আবিরের গায়ের লেপ দিয়ে মেঘের গা ঢেকে দিয়ে মেঘের কাঁধের দুপাশে দু’হাতে ভর দিয়ে মেঘের মুখোমুখি উপুড় হয়ে শুয়েছে । আবিরের শরীরে না আছে লেপ না আছে শীতের ভারী কোনো জ্যাকেট। একটা টাওজার আর ফুলহাতা টিশার্ট পড়নে। মেঘ দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছে, বন্ধ দু’চোখের পাতা। হাত খোঁপায় বাঁধা চুলগুলো খুলে এলোমেলো হয়ে আছে, দুহাতে বেলীফুলের মালা। বেলীফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে রুমে।

নিশ্চুপ আবির, দৃষ্টি মেঘেতে নিবদ্ধ। মেঘ নিভু নিভু চোখে তাকাতেই আবিরের ঘনিষ্ঠতা উপলব্ধি করল। পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। অষ্টাদশীর হৃৎস্পন্দনের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুন। বেলীফুলের সুবাসের সঙ্গে আবির ভাইয়ের শরীর থেকে আসা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে। আবির ভাইয়ের এত কাছাকাছি আসায় মেঘের শরীরের রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাচ্ছে, অজানা শিহরণ বইছে শরীরে। আবিরের আঁখি যুগলে ঘুম লেপ্টে আছে। শান্তিময় ঘুমের দেশে নিমগ্ন ছিল আবির। কিন্তু অষ্টাদশীর অনাদেয় কর্মকান্ড আবিরের গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে৷ আবির ঘুমঘুম চোখেই মেঘকে দেখছে৷
মেঘ কয়েকবার ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলল। চোখাচোখি হলো আবিরের সঙ্গে। লেপের ভেতর মেঘের শরীর ঘামতে শুরু করেছে। বুকের ভেতর প্রবল ঝড় বইছে। মেঘ চোখ নামিয়ে বলতে চেষ্টা করল,

“আ…আমা….আমার…”

আবির একহাতে শরীরের সম্পূর্ণ ভর ফেলে অন্যহাতের আঙ্গুল দিয়ে মেঘের ঠোঁট স্পর্শ করল। ওমনি মেঘ পাথর বনে গেল। আবিরের দৃষ্টি, স্পর্শ কোনোকিছুই আজ স্বাভাবিক নয়৷ অষ্টাদশীর মস্তিষ্ক জোড়ে চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে। কি হতে চলেছে তার সাথে? একদিকে আবির ভাইয়ের কাছে ধরা পরার ভয় অন্যদিকে আবির ভাইয়ের এত কাছে আসা। প্রচন্ড অস্বস্তিতে ভুগছে মেঘ। দীর্ঘকালীন নিরবতা ভেঙে আবির ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
” নিষেধ অমান্য করার শাস্তি তবে দিতেই হচ্ছে। ”

মেঘ বিপুল চোখে তাকিয়েছে৷ শরীরের কম্পন তীব্র থেকেও তীব্রতর হচ্ছে। ভয়ে নাক ঘামছে। আবির ঠোঁটের উপর থেকে আঙুল সরিয়ে মেঘের নাকের ঘাম মুছে পুনরায় কাঁধের পাশে হাত রাখল। মেঘের গলা ভার হয়ে আসছে, কথা আঁটকে যাচ্ছে, জোরপূর্বক বলল,
“Sorry!”

“এসব সরি-টরিতে আবিরের মন গলানো সম্ভব না। আগেই সাবধান করেছিলাম, অঘটন ঘটলে আমি দায়ী না। তারপরও কথা মানিস নি, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসেছিস। ”

মেঘ ভয়ে ভয়ে বলল,
“প্লিজ ছাড়ুন।”

আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ধরিই তো নি৷ ছাড়বো কেমন করে?”

“সরুন, আমি যাব।”

“এত সহজে তো সরছি না, ম্যাম৷ আপনি অপরাধ করেছেন শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। ”

মেঘ চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। আজ তারসঙ্গে কি হতে চলেছে সে নিজেও জানে না৷ এদিকে আবির দু’হাতে ভর রেখেই অষ্টাদশী মুখোমুখি এগিয়ে যাচ্ছে। দু’জোড়া ওষ্ঠের মাঝে শুধু কয়েক সেন্টিমিটারের ব্যবধান৷ মেঘের চোখ বন্ধ, ক্রমাগত কাঁপছে ওষ্ঠদ্বয়। তখনই আবিরের ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো রিংটোনের শব্দে আবির মেঘের কাছ থেকে সরে শুয়া থেকে উঠে বসলো। মেঘের এলোমেলো চুলের নিচে আবিরের ফোন৷ মেঘ মাথা তুলে হাত বাড়িতে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকাতেই দেখল, “Mala” নামে সেইভ করা নাম্বার থেকে কল আসছে। ফোন এগিয়ে দিল আবিরের দিকে। মেঘের লজ্জায় লালিত মুখমণ্ডল মুহুর্তেই বদলে গেছে। ক্রোধে চোখ দুটি জ্বলছে। মালা নাম দেখে আবির সাইলেন্ট করে ফোন পাশে রেখে দিয়েছে। মালা আপু রাতবিরেতে আবির ভাইকে কল করে এটা মেঘ সহ্যই করতে পারছে না। গা থেকে লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে নামতেই আবির আলতোভাবে মেঘের হাত ধরে। কিন্তু মেঘ রাগে এক ঝটকায় আবিরের হাত ছাড়িয়ে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, আবির তপ্ত স্বরে বলল,

“শাস্তিটা তোলা রইলো পরের বার ছাড় দিব না।”

মেঘ রাগে আবিরের দিকে তাকিয়েছে। দরজা টা ঠাস করে লাগিয়ে রুমে চলে গেছে।

মালা আপু আবির ভাইকে পছন্দ করে। হয়তো আবির ভাই পছন্দ করেন না। মীমের বলা ঘটনা যদি সত্যি হয় তবে মালা আপুর হাতে “Ashik” নাম আবির ভাই ই লিখিয়েছেন আর সেই কাজ মেঘের জন্য ই করেছেন৷ মেঘ সবই বুঝতে পারছে। কিন্তু এত রাতে মালা আপুর কল দেয়া সে মেনে নিতে পারছে না। আজ মেঘ দেখেছে বিধায় রাগ করছে, সবসময় তো সে দেখে না। “তবে কি প্রতিদিনই মালা আপুর সঙ্গে আবির ভাইয়ের কথা হয়?” মেঘের রাগ বেড়েই চলেছে। মালা আপুর থেকেও আবির ভাইয়ের প্রতি বেশি রাগ হচ্ছে।

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)

★★★★★

কেটে গেল কিছুদিন। মেঘ ইদানীং আবিরকে ইগ্নোর করে চলে। আবির ভাইকে দেখলেই মালা আপুর কথা মনে হয় আর রাগে ফুঁসতে থাকে।
আজ সভাপতি নির্বাচন। সভাপতি নির্বাচনের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় তবে তানভিরদের ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু ঝামেলার৷ যেমন বর্তমান সভাপতি আর তানভির দুজনের জনপ্রিয়তায় প্রায় সমান সমান৷ তবে কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, কথা বলার দক্ষতা, জনসাধারণের প্রতি আচরণ এসব ক্ষেত্রে সভাপতির থেকেও তানভির এগিয়ে আছে। তাছাড়া এমপির পছন্দের প্রার্থীও তানভির৷ তানভির আর আবির দুজনকেই বলেছিল, এমপি কথা বলে সরাসরি সভাপতি পদ তানভিরকে দিয়ে দিবে। কিন্তু দুভাইয়ের কেউ ই রাজি হয় নি৷ জিতলে নির্বাচন করেই জিতবে।

সকাল সকাল দুভাই বেড়িয়ে গেছে। বাড়ির মহিলারা যেমন দুশ্চিন্তা করছে, তেমনি তানভিরের আব্বু মোজাম্মেল খানও চিন্তায় আছেন৷ হাজার হোক একমাত্র ছেলে বলে কথা। উপরে যতই রাগ দেখাক না কেন, ছেলে যেই কাজ করছে সেটাতে যেন সফল হতে পারে সেই দোয়ায় করছেন তিনি। ২-৩ বার আবিরকে কল দিয়ে খবর ও নিয়েছেন৷ সারাদিন না খেয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় বসে আছেন৷

সন্ধ্যার পর পর আবির মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরেছে৷ আবিরের পিছন পিছন তানভিরও প্রবেশ করল৷ সোফায় তিনভাই, আদি বসে আছে। মেঘ আর মীম ডাইনিং এ বসে গল্প করছিল। আবির ঢুকতেই ইকবাল খান শুধালেন,
“খবর কি?”
আবির হাসিমুখে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ।”

তিনভাই ই একজোটে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ।”

মেঘ আর মীম দুজনেই ছুটে এসে তানভির কে প্রশ্ন করে,
” জিতছো?”

তানভির হেসে উপরনিচ মাথা নাড়ে।
“Congratulation Vaiya”

“Thank you bonu, আজ থেকে তোর নতুন পরিচয়৷ তুই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বোন।”

মীম গাল ফুলিয়ে প্রশ্ন করল,
“আর আমি?”

“তোকেও কি আলাদা করে বলতে হবে? আচ্ছা ঠিক আছে তুই ও সভাপতির বোন।”
মীম আস্তে করে বলে, ” ট্রিট দিবা না?”
“অবশ্যই দিব।”

আম্মু, বড় আম্মু, কাকিয়া সবাই তানভিরকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। তানভির ভয়ে আছে কখন জানি আব্বু বা বড় আব্বু লেকচার দেয়া শুরু করেন। আবির মায়ের হাতে মিষ্টির বক্সগুলো দিয়ে সবাইকে মিষ্টি দিতে বলল। তানভির সিঁড়ি পর্যন্ত যেতেই মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“মিষ্টি ভাবি কেন দিবে, তানভিরের উচিত সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো।”

তানভির আঁতকে উঠে। আব্বু তাকে মিষ্টি খাওয়াতে বলছে, ভাবা যায়। তানভির হাসিমুখে মিষ্টির বক্সগুলো থেকে একটা বক্স হাতে নিয়ে বড় আব্বু, আব্বু, কাকামনি, বড় আম্মু, আম্মু, কাকিয়া, আবির,মেঘ, মীম,আদি সবাইকেই নিজের হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে বড় আব্বু আর আব্বুর সঙ্গেও বেশকিছুক্ষণ কথা বলেছে। তানভির ভেবেছিলাম রাজনীতির জন্য তাকে নিজের বাড়িতে সবসময় চোরের মতো চলতে হবে অথচ আব্বু, বড় আব্বু এত সুন্দর ভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে যে সে অভিভূত হয়ে যাচ্ছে।

মেঘ রুমে গিয়েই তানভিরের সঙ্গে একটা ছবি খোঁজে বের করে ফেসবুকে অভিনন্দন পোস্ট করেছে। সেই পোস্টে মেঘের সব বান্ধবীরা লাইক কমেন্টস করছে, বন্যাও Congratulation লিখে কমেন্ট করেছে। পরক্ষণেই মনে হলো তানভির ভাইকে কল দেয়া উচিত। কিন্তু সাহস পাচ্ছে না, কি না কি মনে করে এসব ভেবে অবশেষে কল করলো। প্রথমবারে রিসিভ হলো না৷ দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো।
“আসসালামু আলাইকুম। ”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“হঠাৎ কি মনে করে কল দিলে?”
“Congratulation”

তানভির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“বাব্বাহ! তুমি আমায় অভিনন্দন জানাবে তা তো কল্পনাও করতে পারছি না।”

“না মানে, মনে হলো জানানো উচিত। ”

“যাক বাবা, মনে তো হইছে। Thank you so much.”
“এখন রাখি।”
“শুনো”
“জ্বি বলুন।”
“আগামীকাল ফ্রী আছো?”
“কেন?”
“ছোটখাটো একটা ট্রিট দিতাম।”
” শুধু শুধু ট্রিট দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ”

“শুনো মেয়ে, ট্রিট দেয়া কখনো প্রয়োজনের আওতায় পরে না৷ এটা যার যার ইচ্ছে থেকে আসে। বিকেলে কল দিব রেডি থেকো।”

“শুনেন।”
“বলো”
“আমি কিন্তু একা যাব না।”

“তো কাকে নিয়ে আসবা?”

” ট্রিট দিলে মেঘ আর আমাকে একসঙ্গে দিতে হবে৷ আমি একা যাব না।”

“ঠিক আছে, তোমাদের ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই আমি ভার্সিটির সামনে থাকবো।”

“আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ। ”

“আল্লাহ হাফেজ।”

কল কেটেই বন্যা মেঘকে কল দিয়ে সবকিছু জানিয়েছে।

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)

★★★★★

মেঘ আর বন্যা দু’জনেই আজ সকাল সকাল বেড়িয়েছে। তানভিরের জন্য গিফট কিনবে সেটা রাতেই প্ল্যান করে রেখেছিল, দুজনে ঘুরেফিরে গিফট কিনে তারপর ভার্সিটিতে এসেছে। ততক্ষণে সাদিয়া, মিষ্টি, মিনহাজ, তামিম চলে আসছে৷ দুএকটা কথা বলে মেঘ আর বন্যা ক্লাসে চলে গেছে। মিনহাজ আর তামিম দুজন বাহিরের দাঁড়িয়ে আছে৷ মিনহাজের মেঘকে সেই প্রথমদিন থেকে পছন্দ হলেও তামিম বন্যার উপর ঐরকম ভাবে ক্রাশ খায় নি৷ তবে মিনহাজ আর তামিম সর্বক্ষণ একসাথে থাকায়, দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে একসময় কথা উঠে বন্যার বিষয়ে।মিনহাজ আর তামিম যেমন বেস্ট ফ্রেন্ড, মেঘ আর বন্যাও তেমন বেস্ট ফ্রেন্ড। মিনহাজ যেহেতু মেঘকে পছন্দ করে, তাদের সম্পর্ক হলে সেই সাথে বন্যা আর তামিমের জুটি হলে তাদের বেশ মানাবে এসব ভেবেই মূলত বন্যার প্রতি কিছুটা সিরিয়াস হয়েছে। এখন মিনহাজ তামিমকে বুঝাচ্ছে, যেন বন্যাকে আজকেই প্রপোজ করে৷ মেঘ যেহেতু আবিরকে পছন্দ করে তাই মেঘকে হুটকরে প্রপোজ করতে গেলে কখনোই মানবে না বরং বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে পারে৷ তবে বন্যার এখন পর্যন্ত কারো প্রতি কিছুই শুনে নি তাই মিনহাজ তামিমকে একপ্রকার জোর করছে যেন বন্যাকে প্রপোজ করে৷

ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র ই মেঘ আর বন্যা গল্প করতে করতে বেড়িয়ে পরেছে। তামিমও তাদের সঙ্গে হাঁটছে। একসময় তামিম বন্যাকে ডাকল, দুজনেই থেমে গেল। বন্যা স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ!”
“বল”

“দেখ বন্যা, আমি এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। তোর সঙ্গে প্রায় অনেকদিনের বন্ধুত্ব। তুই, মেঘ দুজনেই খুব ভালো আর আন্তরিক। তবে ইদানীং আমার তোর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে যেটা বন্ধুত্বের থেকেও বেশিকিছু। তুই যদি রাজি থাকিস তাহলে বন্ধুত্বের সম্পর্কের পাশাপাশি আমরা ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতে পারি।”

মেঘ হা হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রথমবারের মতো কেউ বন্যাকে প্রপোজ করছে দেখে মেঘ খুব মজা নিচ্ছে । কোচিং চলাকালীন বন্যা বলেছিল প্রেম করলে ভার্সিটিতে উঠে করবে, ভার্সিটিতে এটায় প্রথম প্রপোজাল। বন্যা কিছুক্ষণ নিরব থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলতে শুরু করল,

“তোর মনে অনুভূতি জেগেছে তা আমায় জানিয়েছিস কিন্তু আমার মনে তোর প্রতি এরকম কোনো অনুভূতি নেই। আমি এখন কোনোরকম সম্পর্কে জড়াতে চাই না, আর সমবয়সী কোনো ছেলের সাথে তো নয় ই। তোকে বন্ধু ভেবেছি সবসময় তাই ভাববো৷ এর বেশি কিছু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব না। সরি৷ ”

বন্যা চলে যাচ্ছে। মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থেকে সেও বন্যার পিছু নিল৷ তামিম ছেলে হিসেবে খারাপ না৷ দেখতেও মাশাআল্লাহ। দুজনকে মানাবেও ভালো। মেঘ ভেবেছিল হয়তো বন্যা রাজি হয়ে যাবে, না হয় ভাবার জন্য সময় নিবে। কিন্তু সরাসরি না করাতে মেঘ বেশ অবাক হয়েছে। মেঘ গেইট পর্যন্ত ছুটে আসতেই তানভিরকে দেখল। আজ সে গাড়ি নিয়ে এসেছে৷ মেঘকে ছুটতে দেখে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“ছুটছিলি কেন?”
“এমনি৷ ”
বন্যার চোখে মুখে কিঞ্চিৎ রাগ। তানভির দুজনকেই এক পলক দেখে, পুনরায় প্রশ্ন করল,
“কি হয়েছে বনু? কোনো সমস্যা?”
“না না। সমস্যা নেই। ”
” বল কি হয়ছে”
“Actually, আমাদের একটা ফ্রেন্ড বন্যাকে মাত্রই প্রপোজ করেছিল। ”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here