গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৪৭
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
ভার্সিটি থেকে ফেরার পর থেকে মেঘ হালিমা খানের রুমেই শুয়ে আছে। এই বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির মানুষগুলোকে ছেড়ে, আম্মুকে ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাবে ভাবতেও বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেঘ৷ হালিমা খান পাশ ফিরে মেঘের মুখের দিকে তাকাল। কান্নায় ভেজা চোখের দিকে চেয়ে অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে শুধালেন,
“কি হয়ছে মা? কাঁদছিস কেন এভাবে? কেউ কিছু বলছে?”
“কিছু হয় নি আম্মু।”
হালিমা খান বেশকয়েকবার মেঘকে জিজ্ঞেস করেছেন কিন্তু মেঘ উত্তর দেয় নি৷ আম্মুকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পরেছে। সন্ধ্যার দিকে হালিমা খান উঠে গেছেন। মেঘ সন্ধ্যার আরও অনেক পর পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ইদানীং মন খারাপের কারণে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে না মেয়েটা, শরীরও অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। আবির সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরেছে। মেঘের রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নজর পরে মেঘের রুমের দরজা খোলা, ফোনটাও বিছানার উপর পরে আছে। গতকাল রাতে ধমক দেয়ার পর থেকে এখনও মেঘকে দেখে নি আবির৷ মেঘের রুমে পা বাড়ালো কিন্তু মেঘ কোথাও নেই। ফাঁকা রুম দেখে আবিরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছে। নিচে মীম আর আদি খেলতেছে ওখানে মেঘ নেই, রুমেও নেই, ফোনটাও রুমে ফেলে গেছে। রুম থেকে বের হওয়ার জন্য দু কদম এগুতেই মেঘের ফোনে কল বেজে উঠেছে। আবির ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো ফোনের দিকে৷ ‘Minhaz’ নামে সেইভ করা নাম্বার দেখে আবিরের মেজাজ চরম মাত্রায় খারাপ হলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিনহাজ বলে উঠে,
“কিরে তুই কি বাসায় বলছিস? বাসার মানুষ রাজি হয়ছে? কবে আসতেছিস তাহলে?”
আবির অত্যন্ত গুরুতর কন্ঠে শুধালো,
“কোথায়?”
মেঘের ফোনে কোনো পুরুষের কন্ঠস্বর শুনে মিনহাজ সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়েছে। ভয়ে মিনহাজের হাত- পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তানভির নাকি আবির কল রিসিভ করেছে এটাও বুঝতে পারে নি সে। অবশ্য বুঝার কথাও না কারণ আবিরকে দেখলেও ঠিকমতো কথা শুনেনি। আর তানভিরের কথা মিনহাজ শুনেছে তাছাড়া ফেসবুকে ছবি দেখেছে। এখনও বাস্তবে দেখে নি তাই কন্ঠস্বর বুঝার কোনো উপায় নেই৷ এখন মেঘের জন্য মিনহাজের খুব চিন্তা হচ্ছে। মেঘ বাসায় না বলে থাকলে নিশ্চয় এখন বকা খাবে। আবির মেঘের ফোন রেখে নিজের রুমে চলে গেছে। জানুয়ারি মাসের হাড় কাঁপানো শীতেও রাগে আবিরের শরীর ঘামছে। ফ্রেশ হয়ে সোজা নিচে আসছে।। আবিরকে আসতে দেখে মীম আর আদি যে যার মতো রুমে চলে গেছে। আবির ড্রয়িং রুম থেকে মামনিকে প্রশ্ন করে,
“মামনি, মেঘ কোথায়?”
“ও তো আমার রুমে ঘুমাচ্ছে। কেন, কোনো দরকার? ”
“নাহ। তেমন কিছু না। দেখছি না যে তাই ভাবলাম বাসায় নাকি বাহিরে৷ ”
হালিমা খান চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
” আমার মেয়েটার কি যেন হয়ছে, কিছু বলে না সারাদিন ই মন খারাপ করে বসে থাকে। বেশি কিছু বলতে গেলে কান্নাকাটি শুরু করে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ ”
আবির কয়েক মুহুর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে সোফায় গিয়ে বসল। দুহাতে মাথা চেপে ধরে আছে। চারদিকের নানান দুশ্চিন্তায় মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তানভির নিচে আসছে। আবিরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আবিরের কাছে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়ছে ভাইয়া?”
আবির অসহায় দৃষ্টিতে তানভিরের দিকে তাকালো। আবিরের চোখ-মুখের দূরাবস্থা দেখে তানভির শান্ত কন্ঠে শুধালো,
” এত টেনশন করছো কি নিয়ে?”
আবির আশেপাশে চেয়ে দেখে নিল। কোথাও কেউ নেই দেখে আস্তে করে বলা শুরু করল,
“আমি আর পারতেছি না ভাই। দিনকে দিন মানুষের সহ্য ধৈর্যের সীমা বাড়ে আমার উল্টো সহ্য ধৈর্যের মাত্রা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তোর বোনের এই অবস্থা সহ্য করার সামর্থ্য আমার নেই। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারি না আমি, নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। প্রতিনিয়ত নিজের মনের সঙ্গে যু*দ্ধ করেই চলেছি। নিজেকে সামলাতে না পেরে সবসময় ওরে দূরে সরিয়ে রাখি। বুকে পাথর রেখে আর কতদিন চলবো? তোর বোনের কান্নায় আমার বুকের উপর জমানো পাথর পর্যন্ত গলে গেছে । আমি এমনই অভাগা যে মনের রাজ্যের রানীকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে পারছি না৷ ওর দুচোখের পানি মুছে বলতে পারছি না, ” আজকের পর তোকে আমার কারণে কাঁদতে হবে না। ও কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে পারছি না, “আমি তোকে আকাশ সম ভালোবাসি।”
“বনুকে সময় দিলে তো ওর মনটা একটু হালকা হতো।”
“ঐদিন দেখলি তো তোর বোন কি করল, তুই, আমি এতবার বলার পরও বের হতে রাজি হলো না। আমি জানি ও আমার উপর রেগে আছে, আর কেন রেগে আছে সেটাও খুব ভাল করে জানি। তারপরও ওর রাগ ভাঙাতে পারছি না৷ রাগ ভাঙাতে গেলেই একের পর এক প্রশ্ন করবে, আমি সেই প্রশ্নগুলোর মিথ্যা উত্তর দিতে পারব না৷ দরকার হয় দূরে থাকব তবুও আমি
ও কে আর কোনো মিথ্যে কথা বলবো না। এটা আমার প্রমিজ”
“ফুপ্পির বিষয়ে কিছু ভাবছো?”
“সেটায় ভাবতেছি। কিভাবে ভাই বোনদের সামনাসামনি করব আর কি রিয়াকশন হবে এসব ভেবেই মাথা আওলে যাচ্ছে আমার। ”
হালিমা খান দুভাইয়ের জন্য কফি আর নুডলস নিয়ে আসতেই দুভাইয়ের কথোপকথন থেমে গেছে। আবির নিজের ফোন হাতে নিয়ে চাপাচাপি করতেছে৷ কফি দেয়ায় এক হাতে কফি নিয়ে অন্য হাতে ফোন ধরে তানভিরের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলা শুরু করল। মেঘ ঘুম থেকে উঠে মায়ের রুম থেকে বের হতেই সোফায় আবির আর তানভিরকে দেখে মাথায় ভালোভাবে ওড়না দিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছিলো। তাকাবে না ভেবেও নিজেকে আটকাতে পারল না। সিঁড়ি থেকে তাকালো আবিরের দিকে। নজর পড়ে সোজা আবিরের ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে। গতকাল ফোন চেক করার সময়ও ওয়ালপেপারে এই ছবিটা দেখেছিল, যেখানে আবিরের গাল,কান সহ মাথার একপাশ দেখা যাচ্ছিল, নিচু হয়ে কিছু করছিল। কললিস্ট চেক করার তাগিদে ওয়ালপেপারের ছবিটা ভালোভাবে দেখতে পারে নি৷ তবে আজ আবিরের হাতে থাকা ফোনে ওয়ালপেপার টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছবিটাতে আবির ঝুঁকে আছে, একহাতে কোনো মেয়ের হাতের আঙুলগুলো ধরে রেখেছে। সেই সাথে আবিরের ওষ্ঠদ্বয় সেই হাতের উল্টোপিঠের ঠিক মাঝ বরাবর স্পর্শ করে আছে।
সদ্য ঘুম থেকে উঠা মেঘ, ঘুম ঘুম চোখে ছবিটা দেখতেই বুকটা ছ্যাত করে উঠল। নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই ছবির দিকে। যে আবির ভাইকে ঘিরে রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিল মেঘ সেই আবির কোনো মেয়ের হাতে চুমু খাচ্ছে। ভাবতেই মেঘের দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে নিজের রুমে চলে গেছে। চোখের সামনে থেকে সেই দৃশ্য যেন সরছেই না। গতকাল আবির ভাই বলেছেন, ওনি বিবাহিত। মেঘ সেকথা বিশ্বাস করলেও পুরোপুরি করে নি। তবে আজ প্রমাণ পেয়েছে তাই অবিশ্বাস করার কোনো অপশন নেই। কান্নারাও আজ বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছে না। গলায় আঁটকে আসছেন কান্না।
★
আজ পুরো টেবিল ফাঁকা শুধু এক কোণে মেঘ বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবৎ ই মেঘ খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে। আব্বু আর বড় আব্বুকে হোস্টেলের ব্যাপার টা কিভাবে বলবে সেটায় ভাবছে। স্যারের থেকে আনা হোস্টেলের ফরম টা গতরাতেই পূরণ করে রেখেছে। এই বাড়িতে আর থাকবে না বলে মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে নিয়েছে। আস্তে আস্তে সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হলো। মেঘ সবার আগে খাবার শেষ করে বসে আছে। কিভাবে বলবে এই সাহসটুকু হচ্ছে না। সামনে আবির বসা এজন্য মূলত আরও বলছে না । আবির খাবার শেষ করে বেসিনের দিকে যেতেই মেঘ বলল,
“আব্বু, আমার একটা কথা বলার ছিল ”
“বলো আম্মু। কিছু লাগবে তোমার ”
“প্রতিদিন বাসা থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত যেতে অনেক সময় লেগে যায়, আংকেলকেও আমার জন্য গাড়ি নিয়ে ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হয়। তারপর যানজট পেরিয়ে আবার বাসায় ফিরতে হয়। এত জার্নি করে আমারও খুব টায়ার্ড লাগে, পড়াশোনা হয় না ঠিকমতো। তাই বলছিলাম আমি হোস্টেলে সিট নিব। বান্ধবীদের সাথেই থাকবো। মাঝে মাঝে বাসায় এসে ঘুরে যাব। ”
তানভিরের খাবার আঁটকে গেছে গলায়। চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বেসিনের দিকে। আবির নেই, আতঙ্কিত হয়ে তানভির ঢোক গিলল। আবির ভাইয়া শুনেনি ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আলী আহমদ খান আর মোজাম্মেল খান দু’জনেই নিরব। মেঘ পুনরায় বলল,
“আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। ফরম পূরণও করেছি। আপনারা অনুমতি দিলে আমি আজই ফরম জমা দিব। ”
বলেই মেঘ বাম হাতটা টেবিলের নিচ থেকে তুলে, হাতে হোস্টেলের সেই ফরম টা। তানভির কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবির টেবিলের অপর পাশ থেকে ফরম টা নিয়ে এক টানে ছিঁড়ে ফেলেছে। আচমকা আবিরকে দেখে আঁতকে উঠে তানভির। সে ভেবেছিল আবির হয়তো চলে গেছে। কিন্তু আবির যে তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল এটা তানভির খেয়াল ই করে নি।
আবির রাগান্বিত কন্ঠে চিৎকার করে উঠে,
” কোন সাহসে তুই হোস্টেলে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছিস। কে তোকে এত সাহস দিচ্ছে?যে বা যারা তোকে উস্কাচ্ছে তাদের বলে দিস, সব কয়টাকে আধমরা করে নিজের বাড়ি পাঠাবো। ঢাকা থেকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে না! তোকে কিছু বলি না বলে যা ইচ্ছে করবি, জেদ দেখালেই সব পেয়ে যাবি ভাবছিস? তোকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি, পড়াশোনা করলে এই বাড়িতে থেকেই করতে হবে, বাড়ির বাহিরে যেতে চাইলে পা দুটা ভেঙে ঘরে বসাইয়া রাখব।”
আলী আহমদ খান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“আবির, হচ্ছে টা কি! বাড়ির মেয়েদের সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবা না। যাও এখান থেকে৷ ”
আবির রাগে কটমট করতে করতে চলে যাচ্ছে আর বলছে,
“এরপরও যদি কেউ অনুমতি দেন৷ এর ফল খুব খারাপ হবে ”
গতকালের মিনহাজের বলা কথাগুলো বার বার মনে পরছে। ওদের উস্কানিতেই মেঘ এসব করছে এটা বুঝতে বাকি নেই আবিরের । এদিকে তানভির কি বলবে বুঝতে পারছে না। আবির এভাবে চিৎকার করল, আব্বু বা বড় আব্বু কিভাবে রিয়েক্ট করবে এটাও বুঝতে পারছে না। তারপরও তানভির বলল,
” প্রয়োজনে আমি তোকে বাইকে দিয়ে আসবো, ক্লাস শেষে কল দিলে আবার গিয়ে নিয়ে আসবো। তবুও হোস্টেলে যেতে হবে না। ”
মেঘ চিবুক নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“থাক তোমার আর নিয়ে যেতে হবে না। তোমাদের দুই ভাই-বোনকে একসাথে যেতে দিব না তাও আবার বাইকে৷ এক্সিডেন্ট করে রাস্তাঘাটে পরে থাকবা, নিজেও ব্যথা পাবা সাথে আমার মেয়েটাকেও ব্যথা দিবা৷ দরকার হলে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাব।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তানভির ঠাট্টার স্বরে বলল,
“আপনি আমায় এত অবিশ্বাস করেন?”
“বাইকারদের উপর আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নাই। ”
“ভয় পাইয়েন না। আমার জীবন থাকতে আপনার মেয়ে আর আমার বোনের গায়ে একটা আঁচড় ও পড়তে দিব না আমি। এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন৷ ”
মেঘ এবার ছলছল নয়নে তানভিরের দিকে তাকিয়েছে। তানভির মেঘকে অনেক ভালোবাসে এটা মেঘ বুঝতে পারে। কিন্তু আজ এত কনফিডেন্স নিয়ে আব্বুর সামনে এভাবে কথা বলছে দেখেই মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে আছে। আচমকা আবিরের রুম থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দ আসে৷ শব্দ শুনে মেঘ সেদিকে এক পলক তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ সিঁড়ির দিকে ছুটে। তানভিরও খাবার রেখে বেসিনে হাত ধৌতে যায়। রান্নাঘর থেকে মালিহা খান আর হালিমা খান আর্তনাদ করে উঠেন। ইকবাল খান উঠে যেতে চাইলে আলী আহমদ খান আঁটকে দেন। গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“এটা ওদের ভাই বোনের ব্যাপার। ওদেরকে বুঝে নিতে দাও। বড় রা সেখানে উপস্থিত থাকলে বিষয়টা আরও খারাপের দিকে যাবে। ”
মালিহা খান যেতে চাইলে ওনাকেও আঁটকে দেন। মালিহা খান চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
“আবির যদি রেগে গিয়ে মেঘের গায়ে যদি হাত তোলে!”
“তানভির মাত্র কি বলল শুনলে না, বোনের গায়ে একটা আঁচড় ও পড়তে দিবে না৷ দেখি সে তার দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারে৷ ”
এদিকে মেঘ অন্তহীন পায়ে ছুটে যায় আবিরের রুমে।দরজা থেকে তাকায় ভেতরে। আবির তাকে রুমে ঢুকতে নিষেধ করেছিল। তাই সরাসরি ঢুকতে পারছে না। দরজা থেকে উঁকি দিতেই দেখে আবির বিছানার একপাশে বসে আছে। দু হাঁটুর উপর দু’হাত। ডানহাতের কয়েক জায়গায় ভাঙা কাঁচের টুকরো লেগে আছে। সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পরছে৷ মেঘ সব ভুলে রুমে ঢুকে চিৎকার করে উঠে,
“এটা কি করেছেন আপনি?”
ড্রেসিং টেবিলের ঠিক মাঝবরাবর আবির ঘুষি টা দিয়েছে। অর্ধেক কাচঁ ভেঙে পরে গেছে আর অর্ধেকটা এখনও লেগে আছে। মেঘ হাত থেকে কাঁচ ছুটাতে গেলে আবির নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
“Don’t touch me. ”
মেঘ সেসব কথায় কান না দিয়ে আবার এগিয়ে যায় আবিরের কাছে। দ্বিতীয় বারের মতো হাত ধরতে গেলে আবির চারগুণ ভারি কন্ঠে চিৎকার করে উঠে,
“বললাম তো, ছুঁবি না আমায়”
বলেই পাশের টেবিলে থাকা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারে ড্রেসিং টেবিলের দিকে৷ এই দৃশ্য দেখে মেঘ আতঙ্কে দু কদম পিছিয়ে যায়। ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। হাত পা কাঁপছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের বাকি অর্ধেক কাঁচ সাথে গ্লাসের ভাঙা টুকরোতে ফ্লোর ভরে গেছে। মেঘ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে আবিরের হাতের দিকে৷ কাঁচের টুকরো গুলো এখনও হাতে ঢুকে আছে৷ খুলার চেষ্টাও করছেন না৷ ফ্লোরে লাল টকটকে রক্ত ভেসে যাচ্ছে। ভয়ে মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এমন সময় তানভির রুমে ঢুকে৷ আবিরের কাছে যেতেই আবির রাগী স্বরে বলল,
“তানভির, তোর বোনকে এখান থেকে যেতে বল”
তানভির স্বাভাবিক কন্ঠেই মেঘকে বলল,
“তুই রুমে যা। ”
মেঘ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“ওনার হাতে কাঁচ….”
” আমি দেখছি। তুই যা, প্লিজ । ”
মেঘ রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে। চোখ ছলছল করছে। সামান্য হোস্টেলে যাওয়ার কথাতে আবির ভাই এভাবে রিয়েক্ট করবেন মেঘ ভাবতেও পারে নি। আজ ভার্সিটিতেও যায় নি। মিনহাজ, সাদিয়া, মিষ্টি অনেকবার কল দিয়েছে। কল ও রিসিভ করে নি। তানভির আবিরের হাত পরিষ্কার করে একজন ডাক্তার এনে ব্যান্ডেজ করিয়েছে। মেঘ সারাদিনেও রুম থেকে বের হয় নি।
সন্ধ্যার পর তানভির মেঘের রুমে আসছে৷
তানভির- ভাইয়াকে দেখতে গেছিলি?
মেঘ- নাহ। ওনি বারণ করেছেন যেতে।
তানভির- তখন তো রাগে বারণ করেছে৷ একবার গিয়ে দেখে আসিস৷
মেঘ- আমি যাব না।
তানভির- কেন?
মেঘ- ওনি আমায় ওনার রুমে যেতে বারণ করেছেন। ওনাকে ছুঁতে নিষেধ করেছেন। আমি কেন যাব ওনাকে দেখতে?
তানভির- এত রাগ,জেদ ভালো না বনু।
মেঘ- আমাকে বলছো কেন। রাগ, জেদ ভালো না এগুলো তোমার ভাইয়াকে বলো গিয়ে।
তানভির উঠে যেতে যেতে তপ্ত স্বরে বলল,
“থাক তোরা তোদের রাগ নিয়ে। আমার কি”
মেঘ মিহি কন্ঠে ডাকল,
“ভাইয়া ”
“কি?”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কর”
“আবির ভাই কি বিবাহিত? ”
তানভির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
“তোকে কে বলছে?”
“আবির ভাই”
“ভাইয়া তোকে এই কথা বলছে?”
“হ্যাঁ”
“ভাইয়া তোকেই বলছে?”
“ঠিক আমাকে না। মালা আপুকে মেসেজে বলছে।পরে আমি জিজ্ঞেস করছি তখন বলছে হ্যাঁ বিবাহিত। ”
“ওহ আচ্ছা। মালা ভাইয়াকে অনেকদিন যাবৎ ডিস্টার্ব করে। পিছু ছুটাতে বাধ্য হয়ে হয়তো বিবাহিত বলেছে। ”
“আমাকেও তো বলেছে। আমি কি ওনাকে ডিস্টার্ব করি নাকি?”
“দূর পাগলী৷ তোকে তো মজা করে বলছে। ”
“আর বাচ্চা? ”
তানভির কপাল গুটিয়ে আহাম্মকের মতে প্রশ্ন করল,
“কিসের বাচ্চা? ”
“ওনি যে বলল ওনার একটা বাচ্চা আছে। ”
“হায় আল্লাহ। ভাইয়া বলছে আর তুই বিশ্বাসও করে ফেলছিস। তোর সাথে ফাজলামো করছে পাগল। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভাইয়াকে দেখে আসিস৷ ”
তানভির চলে গেছে৷ মেঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। কিন্তু মনের ভেতরের অস্বস্তি কাটল না । আবির ভাইয়ের ফোনের ওয়ালপেপারটা বার বার চোখে ভাসছে। যদি বিবাহিত না হোন তবে ঐ ছবিতে মেয়েটা কে? আগেও একবার আবির ভাইয়ের ওয়ালপেপারে একটা মেয়ের ছবি ছিল। ঐ মেয়েই বা কে? অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে অবশেষে আবিরের রুমের সামনে আসলো। দরজায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে। আবির ঘুমাচ্ছে তাই ভেতরে ঢুকছে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে আবিরকে দেখছে। এত রাগ, অভিমান, ক্ষোভ সবকিছুর পরেও ওনার প্রতি এক অন্যরকম টান কাজ করে। এই অনুভূতি পৃথিবীর সব অনুভূতিকে হার মানাবে। ১০ মিনিট পর আবির সজাগ হয়েছে। দরজায় মেঘকে দেখে আস্তে করে বলল,
“ভেতরে আয়।”
পুরুষালি কন্ঠ মস্তিষ্কে পৌছাতেই মেঘের ঘোর কেটে যায়। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে। দাঁড়িয়ে আছে দেখে আবির বসতে বলল। মেঘ চেয়ারে বসতে গেলে আবির বিছানার পাশে দেখিয়ে বলল,
“এখানে বস।”
মেঘও আবিরের কথামতো আবিরের মাথার কাছে বসলো। দুজনেই বেশখানিকটা সময় নিরবতা পালন করল৷ অবশেষে মেঘ নমনীয় কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“হাতে কি ব্যথা আছে?”
“কম”
“ঔষধ খাইছেন?”
“নাহ”
“কেন?”
“এমনি। ইচ্ছে হয় নি”
“ঔষধ খেতে কি কারো ইচ্ছে হয়?”
“কি জানি!”
“আপনি তো এমন ছিলেন না। এমন হচ্ছেন কেন?”
“কেমন হচ্ছি?”
“ভ*ন্ড”
“মনে হয় তোর ছোঁয়া লেগে হইতেছি।”
“ইসসস, আমি মোটেই ভ*ন্ড না৷ ”
“হুমমমমমমম। মাঝে মাঝে একটু ভন্ডামি করিস আর কি। ”
আবির ভাইয়ের মায়াবী কন্ঠে হুমমমমম শুনে মেঘের সব অভিমান গলে গেছে। মুখ গোমড়া করে ডাকল,
“আবির ভাই..”
আবির দৃষ্টি সরাসরি মেঘের চোখে পরে, চাওয়াচাওয়ি হয় দুজনের। এবার আবির হুমমমম না বলে ভ্রু জোড়া পরপর দুবার নাচায়। আবিরের এমন কান্ডে মেঘ নিঃশব্দে হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। আবির ভাইয়ের এমন চাহনি প্রতিবার মেঘকে লজ্জায় আড়ষ্ট করে৷
আবির মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
“কিছু বলবি?”
মেঘ উপর নিচ মাথা নাড়ে। আবির বলে,
“বল”
“আপনি কি সত্যি বিবাহিত?”
“হয়তো”
“বাচ্চা?”
“প্ল্যানিং করব ভাবছি। ”
“মানে কি এসবের ”
“বিয়ে করেছি, বাচ্চার প্ল্যানিং করব না?”
“কাল যে বললেন বাচ্চা আছে।”
“ওটা তো কল্পনায়”
মেঘ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ফাইজলামি বন্ধ করুন৷ ভাইয়া বলছে আপনার বউ বাচ্চা কিচ্ছু নাই। ”
“নাহ। এ হতে পারে না। আমার বউ আছে, কল্পনায় বাচ্চাও আছে। আরেকটা প্ল্যানিং করব ভাবছি।”
“ফাজলামো বাদ দিন। সত্যি করে বলুন প্লিজ। ”
“আচ্ছা তুই না আমায় বিশ্বাস করিস না। তাহলে এই কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে ফেলছিস কিভাবে?”
“তারমানে ভাইয়া যা বলছে তা সত্যি? ”
“আল্লাহ জানেন। ”
আবিরের ওয়ালপেপারের ছবিটার কথা ভেবে
মেঘ পুনরায় ডাকে, “আবির ভাই”
“হুমমমমম”
“আপনার ওয়ালপেপারের ছবিটা কার?”
“আমার কেন?”
“আপনার তো জানি। কিন্তু মেয়েটা কে?”
“মেয়ে আসলো কোথা থেকে? ”
“আমি দেখেছি!”
আবির পাশ থেকে ফোন নিয়ে লক খুলে মেঘের দিকে ধরল৷ ছবিটাতে আবির ঝুঁকে জুতার ফিতা বাঁধতেছিল। আবিরের থেকে কিছুটা দূরে একটা ছেলে একটা মেয়ের হাতে চুমু খাচ্ছে। ওয়ালপেপার টা দূর থেকে দেখলে মনে হবে আবির ই মেয়েটার হাতে চুমু খাচ্ছে। মেঘ ছবি টা দেখে আবিরের দিকে ফোন দিয়ে বলল, “ওয়ালপেপার দেয়ার মতো আর ছবি নেই আপনার?”
“আছে। ”
“এটা Change করবেন।”
“ওকে ম্যাম।”
মেঘ নিশ্চুপ। নিজের পঁচা চিন্তাভাবনার জন্য লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে৷ আবির মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” আসছিস যখন এক কাজ কর”
“কি”
“ঐখানে তেল আছে। আমার চুলে তেল দিয়ে দে।”
“আমি?”
“তো কে? আমার যে বউ আছে এটা তো তুই মানতেছিস না। এখন দিয়ে দে তেল। ”
“আপনাকে ছুঁতে নিষেধ করেছিলেন। হয়তো ভুলে গেছেন। চুলে তেল দিলে তো স্পর্শ করতে হবে। ”
“ওহ আচ্ছা। তারমানে ছুঁবি না বলে মনস্থির করেই ফেলছিস?”
“জ্বি”
“এত জেদ কোথায় থাকে তোর?”
“জানি না। ”
আবির বামহাতে মেঘের ডানহাত টেনে নিজের কপালের উপর রেখে বলল,
“দেখ গায়ে কত জ্বর! মাথা ব্যথায় তাকিয়ে থাকতে পারছি না। তারপরও তুই যদি জেদ নিয়ে থাকতে চাস আমার কিছুই বলার নেই। ”
মেঘ তাড়াতাড়ি গিয়ে তেলের বোতল টা নিয়ে আসছে। এতক্ষণ গা ছুঁয় নি বলে জ্বরের মাত্রা বুঝতে পারে নি৷ অল্প অল্প করে তেল হাতে নিয়ে আবিরের চুলে ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। আবির অপলক দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির ঝলক । মেঘের নজর পড়তেই মেঘ হালকা ধমকের স্বরে বলল,
” মাথায় না ব্যথা, চোখ খুলে রেখেছেন কেন?”
আবির সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মেঘ বেশ খানিকক্ষণ চুলে ম্যাসেজ করে, মাথা টিপে দিয়েছে। চোখ বন্ধ রাখতে রাখতে আবির কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে নিজেও জানে না। মেঘ ১০ মিনিট চুপচাপ বসে রইলো। কি করবে বুঝতে না পেরে ভাবলো রুমে চলে যাবে। যেই না উঠতে যাবে ওমনি আবির কাথ হয়ে মেঘের হাত জড়িয়ে ধরেছে। আবির জ্বরের ঘোরেই বিড়বিড় করতেছে,
“তুই যাইস না, প্লিজ ”
মেঘ দুবার আবিরকে ডাকে কিন্তু আবির গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। জ্বর বাড়তেছে। জলপট্টি দিবে যে তার ব্যবস্থাও নেই৷ আবির হাত আঁকড়ে ধরায় উঠতেও পারছে না। আবিরের মাথায় হাত বুলাচ্ছে, আবিরকে ডাকছে কিন্তু আবিরের কোনো সারা নেই। কপালে, গলায় হাত দিয়ে মেঘ বার বার জ্বর পরীক্ষা করছে। দিশাবিশা না পেয়ে মেঘ নিজের গাল আবিরের কপালের সঙ্গে মিশিয়ে রেখেছে যেন গায়ের তাপ কিছুটা হলেও মেঘের শরীরে চলে আসে।
(চলবে)