আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব- ৩৯ লেখিকা- সালমা চৌধুরী

0
642

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ৩৯
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

মাইশার শ্বশুর বাড়ির লোকজন চলে গেছে অনেকক্ষণ হলো। তবুও মেঘ, মীমের পাত্তা নেই। আবির আদিকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছে অথচ মেঘ আর মীম এখনও নামছে না। হঠাৎ আবিরের মনে হলো, মেঘের জন্য সে আলাদা করে গায়ে হলুদের ড্রেস নিয়ে আসছিল, যেটা আবিরের ব্যাগেই আছে৷ আবির সাকিবদের ঘরে গিয়ে ড্রেসটা বের করে দেখছে। গায়ে হলুদ উপলক্ষে সবার জন্য রানী গোলাপি রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি আনা হয়েছে। কালার পছন্দ করার দায়িত্ব আবিরের ছিল, তাই হলুদ রঙ বাদ দিয়ে অন্য রঙকেই প্রাধান্য দিয়েছে সে ৷ শাড়ি- পাঞ্জাবি কেনার দিন ই মেঘের জন্য একটা ড্রেস কিনেছিল। কিন্তু বাসায় আসার পর সেই জামা দেখে মন ভরছিল না। তাই গতকাল রাতে মার্কেটে গিয়ে অনেক খোঁজে মেঘের জন্য পছন্দমতো রানী গোলাপি রঙের একটা ড্রেস নিয়ে আসছে। ড্রেসটা পড়লে তার Sparrow কে কেমন লাগবে সেটায় ভাবছে। কিছু একটা ভেবেই নিজের মাথায় গাট্টা মেরে আনমনে হেসে ফেলল । ড্রেসটা শপিং এ ভরে মালাদের ঘরের সামনে উঠান পর্যন্ত আসতেই মালিহা খান ডাকলেন,

“এসে থেকে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস? ভাবি বললো আসার পর নাকি অল্প ভাত খাইছিলি ৷ তোর কি খিদে পায় না? পিঠা দিব তোকে? নাকি ভাত খাবি?”

“এখন কিছু খাবো না, আম্মু। বিকেলে পিঠা খাইছি। খুদা লাগলে খাব। তুমি টেনশন করো না। ”

আবির মায়ের সাথে কথা বলে যেই না ঘরে ঢুকতে যাবে। তখনই সামনে মালা হাজির হলো। আবিরের কন্ঠ শুনেই নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। মালা উত্তেজিত কন্ঠে শুধালো,

“ভাইয়া, তোমার কি কিছু লাগবে? আমায় বলো আমি এখনি দিচ্ছি। ”

আবিরের হাতে শপিং ব্যাগ দেখে পুনরায় প্রশ্ন করল,
“শপিং ব্যাগে কি?”

আবির রাগান্বিত কন্ঠে উত্তর দিল,
“সে যায় থাকুক, তোর ভাবতে হবে না। আর আমার কিছু লাগলে আমি নিজেই নিতে পারবো। তুই নিজের চরকায় তেল দে। ”

আবিরের রাগান্বিত কন্ঠ শুনে মালা মাথা নিচু করে মনে মনে বলল,
“আমার ই তো ভাবতে হবে। আমি যে তোমাকে ভালো..”

আবির ধমক দিল,
“রাস্তা থেকে সরে দাঁড়া। ”

মালা তড়িঘড়ি করে সরে দাঁড়ালো। আবিরকে যেতে দেখে মালাও নিজের রুমে সাজতে চলে গেছে।

আবির বারান্দা পেরিয়ে দুতলায় যাওয়ার জন্য কয়েক সিঁড়ি উঠতেই, আচমকা আলতা রাঙা একটা পা চোখে পরলো৷ পায়ের মালিক দুতলা থেকে নামছিল, সিঁড়িতে এক পা রেখেই যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। আবির স্বাভাবিক ভাবে চোখ তুলে তাকাতেই আশ্চর্য বনে গেল। চোখ পড়ে এক মায়াবিনীর দিকে, সহসা মুগ্ধ আঁখিতে তাকায়। সেই মায়াবিনী যেন মায়ার জাল বিছিয়ে রেখেছে, আবিরের মতো হাজারো সুপুরুষ যুবক তার এই রূপে ঝলসে যাবে। বাঙালি স্টাইলে রানী গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিতা মায়াবিনীর কোমড় ছাড়ানো চুলগুলো অতিশয় ধীর গতিতে উড়ছে। মুখে হালকা মেকাপ, চোখে আইলানারের সঙ্গে গাঢ় করে কাজলও লাগানো, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক ৷ গলায় হালকা গহনা তার সঙ্গে কোমড়ের বিছা ৷ আবির কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বিষ্ময় চোখে মায়াবিনীকে আপাদমস্তক দেখলো। বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেই আঁখি জোড়ায় । মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে, উপরের সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলে সঙ্গে সঙ্গে হ্যান্ডরেলে ধরে কোনোরকমে নিজেকে সামলালো।

আবিরকে হোঁচট খেতে দেখে মায়াবিনী কয়েক সিঁড়ি নেমে আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়েছে আপনার?”

মায়াবিনীকে কাছে আসতে দেখে আবির তৎক্ষনাৎ ২/৩ সিঁড়ি নিচে নেমে, নেশাক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে কি যেন বলল,

মায়াবিনী শুধু শেষে বলা “উফফ” টায় বুঝতে পেরেছে। মায়াবিনী চিন্তিত স্বরে শুধালো,

“আপনি ঠিক আছেন তো?”

আবির উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
“তুই কি ঠিক থাকতে দিচ্ছিস ?”

আবিরের প্রশ্ন শুনে মায়াবিনী অপলক দৃষ্টিতে তাকালো৷ চোখে মুখে উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে। উত্তেজিত কন্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করল,

“শাড়িতে কেমন লাগছে আমায়?”

আবির পুনরায় তাকালো, ক্লান্তিহীন অমত্ত চেয়ে রইলো কিছুটা সময়। মেঘ তীর্যক চোখে চেয়ে আছে, মুখে তার মিষ্টি হাসি৷ আবিরের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না। দৃষ্টি তার সরছেই না। মনে হচ্ছে, মায়াবিনীকে দেখার ব্যাকুলতা এই জনমে আর শেষ হবে না। মৃত্যু ব্যতীত মায়াবিনীর মায়ার জাল থেকে বের হতে পারবে না সে ৷

মেঘ পুনরায় প্রশ্ন করল,
“কেমন লাগছে বললেন না!”

মেঘের কথায় আবিরের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে, আবেশিত কন্ঠে বলল,
” মায়াবিনী ”

আবির ভাইয়ের মুখে মায়াবিনী শব্দ শুনে অষ্টাদশী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। ব্লাশ দেয়া কপোল আরও বেশি রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। ডিসেম্বরের তীব্র শীতেও অষ্টাদশীর নাক ঘামে চিকচিক করছে। প্রিয় মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে অষ্টাদশীর কলেবরে অন্যরকম শিহরণ জাগছে।

এতক্ষণ আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, এখন লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

আবির গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“হাতটা দেখি। ”

আবির নিজের হাত বাড়ালো, মেঘ ডান হাত একটু এগুতেই আবির মেঘের হাত ধরে, এক সিঁড়ি উপরে উঠে মেঘের ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুল মুখের কাছে নিল। মেঘের কনিষ্ঠা আঙ্গুল ব্যতিত বাকি আঙুলগুলো স্থান পেল আবিরের গালে। আবিরের গালে থাকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি স্পর্শ করতেই অষ্টাদশীর বুকের ভেতর উতালপাতাল ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। আবির মেঘের কনিষ্ঠা আঙুলে আস্তে করে কামড় দিল৷ ওমনি অষ্টাদশী কেঁপে উঠলো। মেঘের অস্বস্তি বুঝতে পেরে আবির হাত ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো।

আবির স্বভাবসুলভ ভারী কন্ঠে বলল,
” আমায় সুন্দর লাগছিল বলে তুই একদিন নজর কাটিয়েছিলি, আজ আমি কাটালাম। ”

মেঘ নিস্তব্ধ, নিরেট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আবির নিজেকে সামলে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” মানুষ মা*রার প্ল্যান টা কার?”

“মানে?”

” তুই তো কোনোদিন শাড়ি পড়িস নি, আজ হঠাৎ শাড়ি পরার কারণ কি?”

মেঘ আমতা আমতা করে বলল,
“মাইশা আপু জোর করলো শাড়ি পড়ার জন্য। আপু আর আপুর বান্ধবী মিলেই আমায় সাজিয়ে দিয়েছে। ”

“তাই তো বলি…”

“কি?”

“কিছু না। পড়েছিস ভাল কথা কিন্তু তোর জন্য শাড়ি আনা হয় নি। এইযে তোর ড্রেস, শাড়ি টা পাল্টে ড্রেস টা পড়ে নিচে আসবি। ”

মেঘ শপিং ব্যাগ টা হাতে নিয়ে একটু দেখল, তারপর মন খারাপ করে বলল,

” আনা হয় নি মানে শাড়িটা তো মাইশা আপুই আমায় দিয়েছে৷ ওখানে তো অনেক শাড়ি ছিল৷ ”

“এত বেশি বুঝিস কেন? শাড়ি বেশি থাকলেই কি পড়তে হবে?”

একটু থেমে পুনরায় বলল,
” তুই এভাবে স্টেজে গেলে মাইশা আপুর বদলে, সবাই তোকেই হলুদ লাগাতে আসবে। তার থেকেও বড় বিষয়, বিয়ে বাড়িতে এত এত মানুষ, কত বাজে মেন্টালিটির ছেলে আছে, কখন কোন ছেলে কি বলে ফেলবে, তখন তো গাল ফুলাইয়া কান্না শুরু করে দিবি৷ আমি তানভির না, যে সর্বক্ষণ তোকে চোখে চোখে রাখবো, কোনো সমস্যা হলে ঠান্ডা মাথায় সমাধান করবো। বাই এনি চান্স কোনো ছেলে উল্টাপাল্টা কিছু বললে,তখন আমার হাত উঠে যাবে।আমি বিয়ে খেতে আসছি, মা*রপিট করতে নয়৷ তুই কি চাস, তোর জন্য আমি বিয়ে বাড়িতেও মা*রপিট করি?”

মেঘ ডানে-বামে মাথা নেড়ে উচ্চস্বরে বলল,
“নাহ”

আবির মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” যদি বিয়ে বাড়িতে কোনোরকম ঝামেলা না চাস, তাহলে এসব মেকাপ তুলে, ড্রেসটা পড়ে সিম্পলি নিচে আসবি। আর যদি মনে হয়, সবাই শাড়ি পড়েছে তাই তোকেও শাড়িই পড়তে হবে তাহলে এভাবেই যেতে পারিস৷ চয়েজ ইজ ইউর’স৷ ”

মেঘ আর কিছু বলল না ৷ শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। মন খারাপ হওয়ার বদলে অষ্টাদশীর চোখে-মুখে প্রখর উজ্জ্বলতা । আবির ভাইয়ের বলা “মায়াবিনী” শব্দটা বার বার কানে বাজছে৷ আবির ভাই যে তাকে নিয়ে চিন্তা করে, এটা ভাবতেই মেঘের হৃদয়ে প্রশান্তির হওয়া বয়ে গেল।

আবিরের দৃষ্টি মেঘেতে নিবদ্ধ, অকস্মাৎ বুকে হাত রাখল। মস্তিষ্কের নিউরনে অবিরাম বাজছে,
“তোর রূপে এই আবির বিধ্বস্ত। ”
মানসিক টানাপোড়েনে ভুগছে সে৷ অশান্ত মনকে শান্ত করার কোনো শব্দ খোঁজে পাচ্ছে না। হৃদয়ে গান বাজছে,

“Yeh dil pagal bana baitha
Isey ab tu hi samjha de
Dikhe tujhme meri duniya
Meri duniya tu banja re”

যতক্ষণ অষ্টাদশীকে দেখা যাচ্ছিল, আবির ততক্ষণ দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অষ্টাদশী আড়াল হতেই আবির ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়েছে, হাত দিয়ে চোখ-মুখ ডেকছে । বক্ষপিঞ্জরে উতালপাতাল ঢেউ৷

তখনই সাকিব আসছে৷ আবিরকে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে চিন্তিত স্বরে শুধালো,
“কি হয়ছে ভাইয়া? এখানে বসে আছো কেন?”

আবির চোখ-মুখ থেকে হাত সরিয়ে সাকিবের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
“সাকিবরে আমি শেষ। ”

সাকিব আবিরের কাছাকাছি এসে শুধালো,
” কি হয়ছে বলবা তো ”

“যত দিন যাচ্ছে, আমি ওর প্রতি তত বেশি আসক্ত হয়ে যাচ্ছি। মায়াবিনীর মায়া কাটানোর ক্ষমতা যে আমার নেই।”

“মায়া কাটানোর দরকার কি? তুমি তো মেঘবতীকেই ভালোবাসো। বিয়ে করে নাও, তাহলে এই মায়ার বাঁধন আরও বেশি শক্ত হবে৷ তোমাদের দুজনকে পাশাপাশি দেখলে আমার কি যে ভাল লাগে ”

সাকিব মাথা চুলকে শুধালো,
“ভাইয়া, তুমি না বলছিলা দেশে আসার ৩ মাসের মধ্যে বিয়ে করবা। এখন তো ৬ মাস হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে করছো না কেন?”

বিয়ের কথা শুনতেই আবিরের চোখে-মুখে বিষন্নতা ছেয়ে গেছে। মামা-মামিরা ব্যতীত আবিরের ফুপ্পির ঘটনা আর কেউ জানে না৷ আবিরও নিজে থেকে সাকিবকে কিছু বলে নি৷ আবির সিঁড়ি থেকে উঠে যেতে যেতে বলল,

” পরিস্থিতি বলতে একটা শব্দ আছে৷ জানিস তো? আমি এখন পরিস্থিতির অধস্তনে বন্দি। পরিস্থিতি যেদিকে নিয়ে যাবে আমি সেদিকে যেতে বাধ্য। ”

সাকিব কিছুই বুঝলো না। আবিরকে প্রশ্ন করার আগেই আবির সেই জায়গা ত্যাগ করল। আশপাশে না তাকিয়ে সোজা সাকিবের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকেই বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। বক্ষে তার তীব্র কম্পন, পৃথিবীর সবার চোখে অদম্য, গুরুগম্ভীর আর শক্তপোক্ত ব্যক্তিটা আজ এক মায়াবিনীর রূপে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এত বছর বুকের ভেতর চেপে রাখা অনুভূতিরা যেন খাঁচা ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। অষ্টাদশী কি করে বুঝবে, তাকে এই রূপে দেখে আবিরের হৃদয়ে কতটা তোলপাড় চলছে।

২০ মিনিট কেটে গেল। আবিরের এক হাত মাথার নিচে অপর হাত বুকের বা পাশে। আচমকা চোখ মেলে তাকায়, ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। বিছানার পাশে রাখা ফোনটা হাতে নিল। গ্যালারিতে ঢুকেই প্রথম ছবিটাতে চাপ দিল। ওমনি মেঘের শাড়ি পরা একটা ছবি ভেসে উঠেছে। মেঘের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই ২ টা ছবি তুলেছিল আবির। সেখান থেকেই একটা ছবি সুদীর্ঘ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। কাজল কালো চোখ, লজ্জায় লালিত মুখমণ্ডল, ওষ্ঠদ্বয়ে মায়াবী হাসি আবিরের অশান্ত মন জানান দিচ্ছে,

“মায়াবিনীর মায়াজালে আবিরের মৃত্যু নিশ্চিত। ”

আবির ফেসবুকে ঢুকে নিজের টাইমলাইনে একটা পোস্ট করে,
“মনের বিরুদ্ধে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে যুদ্ধে শহীদ হওয়া বোধহয় অধিকতর শান্তিপূর্ণ। ”

নিচে ছোট করে লিখেছে ” Best Surprise ever 🖤”

আবির পুনরায় মেঘের শাড়ি পরা ছবিটা বের করেছে৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। অকস্মাৎ ফোনের যান্ত্রিক আওয়াজ বেজে উঠলো৷ তানভির কল করেছে। আবির রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে এলো,

“ভাইয়া, তুমি ঠিক আছো ? বনু ঠিক আছে তো? ”

আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,
“তোর বোন বোধহয় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিছে, আমায় না মে*রে থামবে না।

“কেন? কি হয়ছে? বনু কিছু করছে? রাগে বকা দাও নি তো আবার! ”

“তোর বোন এমন রূপে আমার সামনে আসছে, ধমক দেয়া বহু দূর, আমি তো…….. ”

“তুমি তো কি? বনু কেমন রূপে আসছে?”

“তুই না আমার সম্বন্ধি হোস, ছোট বোনের প্রেমালাপ শুনতে চাস, লজ্জা লাগে না তোর। ”

“আচ্ছা সরি। তোমরা ঠিকঠাক থাকলেই হলো। তোমাদের দুজনকে একসাথে পাঠিয়ে এখন টেনশনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তোমার স্ট্যাটাস দেখে আরও বেশি ভয় লাগছিল। তাই তাড়াতাড়ি কল দিলাম। কিছুক্ষণ আগে মাইশা আপু কল দিয়েছিল আমায়। যাই নি বলে রাগারাগি করছে। আমি বলছি সকাল সকাল চলে আসবো। ”

“আচ্ছা। সাবধানে থাকিস । আর আসার সময় আমার বাইকটা নিয়ে আসিস। ”

“আচ্ছা। ”
“রাখছি। ”
“ভাইয়া শুনো”
“হ্যাঁ বল।”
“বনুর সাথে রাগ দেখিও না প্লিজ। ”

“এখন রাগ দেখানোর অবস্থায় আমি নেই। তোর বোনকে নিয়ে পালাইয়া না যায়, এই টেনশনে আছি৷ রাখছি ”

আবির কল কেটে ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধৌয়ে আসছে। তানভির আহাম্মকের মতো বসে আছে, বনু কি করছে, ভাইয়ার কি হয়ছে, কি বললো সব যেনো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আবির ভাইয়া পরিবারের জন্য এত দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, হুট করে পালিয়ে যাওয়ার কথায় বা কেন বলছে। ভাইকে কল দিলেও লাভ নাই। মাঝে মাঝে তানভির ভাবে, ভাইয়ার সম্বন্ধি না হয়ে শালা হলেই ভালো হতো। মজার ছলেও অন্ততপক্ষে ভাই কিছু বলতো। যাতে ভাইয়ের মনোভাব বুঝতে পারতো সে। আবির কিছুক্ষণের মধ্যে রেডি হয়ে বের হয়ছে, রানী গোলাপী রঙের পাঞ্জাবি পরায় আজ আবিরকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সাদা, কালো আর ধূসররঙের ভিড়ে উজ্জ্বল বর্ণটা আবিরকে বেশ মানিয়েছে। প্যান্ডেলে ঢুকতে গিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো, মেঘ কোথাও নেই। মীম, দিশা আরও কয়েকজন মিলে গল্প করছে।

আবির মীমকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
“মেঘ কোথায়?”

মীম ও আশেপাশে তাকাচ্ছে, ধীর কন্ঠে বলল,
“আপুকে তো দেখছিলাম নিচে আসছিল, এখন তো দেখছি না।রুমে গিয়ে দেখে আসবো ভাইয়া ?”

“তোর যেতে হবে না। ”

আবির দুপা এগুলোতেই সাকিব ছুটে আসছে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া এতক্ষণে আসছো তুমি। তোমার মেঘবতী তো সেজেগুজে নিচে আসছিল, ঐনে মালা আর ওর দুই বান্ধবী কথা বলছিল। কি কথা বলছে তো শুনি নাই কিন্তু দেখলাম মেঘবতী মুখ গোমড়া করে উপরে চলে যাচ্ছে। তখন আব্বু, চাচ্চু আমায় ডেকে নিয়ে গেছে, কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আনার দরকার ছিল। তাড়াহুড়োতে রুম পর্যন্ত যেতে পারছিলাম না, ফোনটাও রুমে চার্জে রেখে আসছি তাই জানাতেও পারছিলাম না। কাজ শেষে দৌড়ে আসছি..”

আবির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“যে ভ*য়টা পাচ্ছিলাম….”

আবির ঝড়ের গতিতে মেঘদের রুমে গেছে। রুমে কেউ নেই, বিছানার উপর শাড়ি, কসমেটিকস এলেমেলো পরে আছে। আবির আশেপাশের ২-৩ টা রুম চেক করল। কোথাও কেউ নেই। হঠাৎ সিঁড়ির দিকে নজর পরতেই ছুটলো সেদিকে৷ ছাদ জুড়ে ঝলমল করছে লাল নীল আর সবুজ রঙের আলো, তার একপাশে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে । হাতে একটা গাছের ঢাল যেটা দিয়ে ছাদের রেলিং এ অবিরত আঘাত করছে।

মেঘ ড্রেস পড়ে নিচে নামতেই চোখ পরে মালা আপু আর তাদের বান্ধবীদের দিকে। তারা কোনো বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন। মেঘ সেসবে পাত্তা না দিয়ে দু পা এগুতেই কানে আসে,
” আবির ভাইয়ার সাথে আমার দুবছর যাবৎ ফোনে কথা হয়, প্রায় ই ভিডিও কলে কথা হয়,আমি যে ওনাকে ভালোবাসি এই কথাটা এখনও বলি নি। আজকে সুযোগ পেলে ভাইয়াকে বলে ফেলব। তোরা আমায় বুদ্ধি দে, কিভাবে বললে ওনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবেন। ”

কথাগুলো কানে আসতেই মেঘ স্তব্ধ হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল। ক্রোধে কপালের শিরাগুলো দৃশ্যমান হয়ে গেছে। মেঘের চোখ-মুখ রক্তাভ হয়ে ওঠেছে। দাঁত কিড়মিড় করছে। আবির ভাই মালা আপুর সাথে কথা বলে, এই কথাটা অষ্টাদশীর মনে চরমভাবে আঘাত করেছে। রাগে গজগজিয়ে ছাদে চলে আসছে। রাগ টা আসলে কার উপর উঠেছে সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না। মালা আপুর আচরণ ভালো লাগে নি এজন্য মালা আপুকে আগে থেকেই সহ্য করতে পারে না। অথচ আবির ভাই..! ভাবতেই বক্ষস্পন্দন থমকে গেল। রাগে ফুঁসতে আর ভাবছে,
” এতগুলো বছরে একটাবারও আপনি আমার সঙ্গে কথা বলেন নি, এখন জোর করতে পারলে তখন কেন জোর করে আমার সাথে কথা বললেন না। যদি কথা না ই বলবেন, তাহলে মালা আপুর সাথে কেন কথা বলেছেন। তাহলে কি আপনি….!”

এটুকু ভেবেই থেমে গেল৷ ক্রোধ যেন কমছেই না বরং বাড়ছে। পাশে একটা গাছ থেকে একটা ঢাল ভেঙে সেটা দিয়ে রেলিং এ আঘাত করেই নিজের ক্রোধ কমানোর চেষ্টা করছে।

আবির বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে মেঘের হাত চেপে ধরল৷ হাত থেকে ঢাল টা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। আবির সরু নেত্রে খেয়াল করল অষ্টাদশীর চোখ-মুখ। লাইটের আলোতে বারবার পরিবর্তন হচ্ছে চেহারার বর্ণ। মেঘের চোখে-মুখে তীব্র ক্ষিপ্রতা। আবিরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে রাগ যেন তিনগুণ বেড়ে গেছে। আবিরের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কেটেছে কি না, আবির সেটা দেখার চেষ্টা করছে। অথচ মেঘ নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে হাত সরানোর চেষ্টা করছে। মেঘের এমন কান্ডে আবির অগ্নি চোখে তাকিয়েছে৷ ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল, ঢোক গিলে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। মেঘের অন্য হাতটা টেনে নিল। মেঘের দু’হাত একসঙ্গে রেখে কব্জি বরাবর চেপে ধরে তপ্ত স্বরে বলল,

“এখন দেখব কিভাবে নিজের হাত ছাড়াস ”

মেঘ রাগে কটমট করে বলল,
“ছাড়ুন আমায়৷ ”

“না ছাড়লে কি করবি?”

রাগে কটমট করছে মেঘ প্রশ্ন করল,
“কোন অধিকারে আমায় ছুঁয়েছেন? ”
মেঘ রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কথাটা বলল।

আবির নিরেট কন্ঠে উত্তর দিল,
” আমায় অধিকারবোধ শেখাতে আসিস না। তোকে ছোঁয়ার জন্য যদি অধিকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়, আমি সেই অধিকারনামায় স্বাক্ষর করে হলেও তোকে ছুঁবো।”

রাগের মাথায় আবিরের কথাগুলো মেঘ শুনলো কিনা কে জানে৷ অতিরিক্ত ক্রোধে মেঘের মাথা ঘুরছে, তবুও শান্ত হওয়ার নাম নেই৷ মেঘ রাগান্বিত কন্ঠে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠল,

“আমায় ছাড়ুন বলছি৷ ”

“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি, ছাড়িয়ে নিতে পারলে নে। ”

মেঘ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“আমি কিন্তু চিৎকার করব।”

আবির এবার স্ব শব্দে হাসলো। মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে বলল,
“হাসছেন কেন? আমি কিন্তু সত্যি সত্যি চিৎকার করবো।”

আবির তপ্ত স্বরে প্রশ্ন করল,
“তুই যে অগাচণ্ডী সেটা কি জানিস?”

“মানে…”

“এইযে চিৎকার করবি বললি, চিৎকার তুই করতেই পারিস, কিন্তু সবাই আসলে বলবি টা কি শুনি? আমি তোর হাত ধরেছি এটায় নালিশ করবি? তোর কি মনে হয়, তোর এই নালিশের ভয়ে আমি তোর হাত ছেড়ে দিব? জীবনেও না। বরং তুই নালিশ করলে আমার সুবিধায় হবে। দে চিৎকার। ”

আবিরের কথাগুলো শুনে মেঘ হঠাৎ ই আবিরের দিকে কেমন করে তাকালো। এতক্ষণ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আবিরের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির ঝলক দেখে অষ্টাদশীর রাগ কিছুটা কমে এসেছে। তবে এখনও পুরোপুরি শান্ত হতে পারে নি। আবিরের মুখের পানে দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি নামাতেই চোখ পরে রানী গোলাপী পাঞ্জাবিতে। সঙ্গে সঙ্গে অষ্টাদশীর অভিব্যক্তি পাল্টাতে শুরু করলো। আবির ভাইকে এভাবে দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। আচমকা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। নিজের ভেতরের সমস্ত রাগ ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। এই মানুষটার সাথে আর যাই হোক রাগ করা অষ্টাদশীর পক্ষে অসম্ভব বিষয়।

আবির গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল,

“তোর কি হয়েছে আমি জানি না, জানতেও চাই না। আমি কিছু কথা বলবো তুই চুপচাপ সেগুলো শুনবি।”

আবিরের কথায় মেঘের দৃষ্টি সরল, মাথা নিচু করে দাঁড়ালো। আবির বলে,

“মনে কর, তুই একটা ড্রেস কিনতে একটা দোকানে গেছিস, অনেক খোঁজার পর একটা ড্রেস তোর খুব পছন্দ হয়েছে। যেই ড্রেসটা নিতে যাবি তখনি অন্য একজন এসে তোর পছন্দের ড্রেসটা নিয়ে দেখতে লাগল । তারও ড্রেসটা খুব পছন্দ হয়েছে। তখন তুই কি করবি ড্রেসটা হাসিমুখে তাকে দিয়ে দিবি? নাকি শক্ত গলায় বলবি, এই ড্রেসটা আমি নিব। যদি অভিমান করে তোর পছন্দের জিনিস গুলো মানুষকে দিতে থাকিস, পরে একটা সময় দেখবি তোর আশেপাশে প্রিয় জিনিস বলতে কিচ্ছু নেই। ”

মেঘ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনলো। আবির মেঘের হাত ছেড়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“আমাদের আশেপাশে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যেগুলো দেখেও না দেখার মতো করে চলতে হয়। যদি আমরা সেগুলোকে পাত্তা দেয়, তাহলে আমাদের জীবন ধ্বংস। অনিশ্চিত জীবনে যতদিন বাঁচবি, ততদিন নিজেকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবি। আমি নিচে যাচ্ছি, ১০ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসবি। ”

আবির দীর্ঘ পা ফেলে সিঁড়ির কাছে গিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকালো, উচ্চস্বরে বলল,

“My Dear Sparrow,
সবকিছু চাইলেই পেয়ে যাবেন, এমনটা নাও হতে পারে৷ প্রয়োজনে কিছু জিনিস আদায় করে নিতে হয়।”

আবির চলে গেছে। মেঘ ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ঘুরছে আবির ভাইয়ের বলা শেষ কথাটা৷ “প্রয়োজনে কিছু জিনিস আদায় করে নিতে হয়।” মেঘের রাগ, অভিমান, মন খারাপের কারণগুলো এক মুহুর্তেই পালিয়েছে। আবির ভাই যেন অষ্টাদশীকে ইন্ডাইরেক্টলি তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, “আবির ভাইয়ের ভালোবাসা আদায় করে নিতে হবে৷ ” সহসা মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। এই হাসিতে কোনো খাদ নেই। মনের ভেতর নেই কোনো অভিযোগ।

মেঘ দ্রুত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, অন্তহীন পায়ে ছুটতে ছুটতে নিচে নামলো। মেঘের ছুটোছুটি দেখে হালিমা খান বিরক্ত হয়ে বললেন,

“এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন, পরে ব্যথা পেলে কি হবে?”

মেঘ এক গাল হেসে উত্তর দিল,
“আমার কিচ্ছু হবে না। ”

দৌড়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। আঁখি জোড়া কাউকে খোঁজছে। হঠাৎ চোখ পরে প্যান্ডেলের দিকে। একটা ব্রেঞ্চে আবির ভাই বসে আছে।পেছনের সাইড দেখা যাচ্ছে, মেঘ চুলগুলো দেখেই চিনতে পেরেছে। আবিরের পাশে সাকিবকে দেখে সিউর হয়েছে। সাকিব এদিকেই তাকিয়ে ছিল।

সাকিব আবিরের কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল,
“ভাইয়া, তোমার প্রেয়সী আসছে কিন্তু সাথে শত্রুপক্ষের আগমন হচ্ছে। বি কেয়ারফুল। ”

সাকিব আবিরের পাশ থেকে উঠে আবিরের বিপরীতে একটা চেয়ার টেনে বসল। মেঘ আবিরের কাছাকাছি আসতেই চোখে পরল, মালা একটা ট্রে নিয়ে মেঘের আগে আবিরের সামনে হাজির হলো। কিছু খাবার আর এক গ্লাস শরবত। আবিরের কাছে এসে মালা মোলায়েম কন্ঠে বলল,

“ভাইয়া, তোমাকে কতক্ষণ যাবৎ খোঁজতেছিলাম। তুমি তো দুপুরের পর আর কিছু খাও নি। তাই খাবার নিয়ে আসছি। ”

মালার আহ্লাদী কন্ঠে আবিরের মেজাজ খারাপ হলো। তবুও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল। আবির প্রখর তপ্ত স্বরে জানাল,
“আমি এখন খাবো না। নিয়ে যা। ”

মেঘের রাগ ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। গাল ফুলিয়ে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে আবিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। সামনে থেকে আবিরকে দেখছে। অথচ আবির কারো দিকেই তাকাচ্ছে না।

মালা পুনরায় বলল,
“খাবার টা খেয়ে নাও প্লিজ।”

আবির রাগান্বিত কন্ঠে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ আবিরের কাছাকাছি দাঁড়ালো। ঝোঁকে আবিরের মুখোমুখি হলো। মেঘকে কাছে আসতে দেখে আবির একটু পিছিয়ে গেল। মেঘ আচমকা আবিরের বুকের উপরের বোতাম টা লাগাতে লাগাতে বলল,

“পাঞ্জাবি তো পরেছেন ঠিকই, বোতাম গুলোও ঠিকমতো লাগাতে পারেন নি। ”

বোতাম লাগিয়ে তাকালো মাথায়, এক মুহুর্তের ব্যবধানে চুলে হাত দিল। দুহাতে চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,

“ইশশ, চুলগুলোও এলোমেলো করে ফেলেছেন। আমি না থাকলে যে আপনার কি হবে, এটায় ভেবে পায় না।”

আবির অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মেঘকে দেখছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিম্নাষ্ঠ কামড়ে ধরল। চোখে মুখের বিস্ময় যেন সরছেই না। মেঘ যে এমন কান্ড করবে, এটা আবির কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি। মেঘের কান্ডে স্তব্ধ হয়ে গেছে আবির। মেঘ চুল ঠিক করে এক পা পিছিয়ে আবিরকে ভালোভাবে পরখ করে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

“এইতো এখন ভালো লাগছে৷ মাশাআল্লাহ। ”

কথাটা বলেই ধপ করে আবিরের পাশে বসে পরল। সাকিব চেয়ারে বসে এতক্ষণ বিপুল চোখে সব ঘটনা দেখছিল। ছেলেটা মুখ চেপে হেসেই যাচ্ছে। সবার মুখে হাসি থাকলেও। মালা রাগে ফুঁসছে। মেঘকে আবিরের বোন ব্যতিত কিছু ভাবে নি সে। তবে এখন মেঘের আচরণ দেখে মালার সহ্য হচ্ছে না৷

মেঘ মালার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“আপু, আবির ভাই এ সময় কিছু খায় না। কিছু লাগলে আমি এনে দিব নে। তুমি বরং তোমার বান্ধবীদের সময় দাও। ”

মালা রাগে কটমট করে চলে যাচ্ছিল। সাকিব পেছন থেকে ডাকল,

“মালা, খাবার টা বরং আমায় দিয়ে যা। আমি খেয়ে তোর জন্য দোয়া করবো। ”

মালা হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“তোর দোয়া আমার লাগতো না। ”

আবির মেঘের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজ সকাল থেকে যা যা ঘটছে তারপর আবির আর কোনোভাবেই নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না। মালা চলে যাওয়ায় মেঘও আবিরের দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই আবির ভ্রু নাচালো। মেঘ নিঃশব্দে হাসলো। কাজল কালো চোখ সাথে অকৃত্রিম হাসিতে আবির ঘায়েল হয়ে গেছে। নেশাক্ত কন্ঠে শুধালো,

“এটা কি ছিল?”

মেঘ হাসিমুখে উত্তর দিল,
“আপনি বুঝবেন না৷ ”

আবির ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সাকিব বলে উঠল,
“ভাইয়া, শুধু হাতে পায়ে লম্বা হলেই হয় না। বুদ্ধির ও প্রয়োজন আছে। তোমার উচিত মেঘবতীর থেকে কিছু বুদ্ধি ধার নেয়া৷ ”

আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকেই মুচকি হেসে জানাল,

“আমিও তাই ভাবছি। এখন থেকে যখন ই বুদ্ধির প্রয়োজন হবে, তখন ই ওর কাছে যাবো।”

মেঘ আবিরের মুখের পানে চেয়ে ভেঙচি কেটে উঠে চলে গেছে । আবির নিঃশব্দে হাসছে আর অষ্টাদশীর প্রস্থান দেখছে। আবিররা যেখানে বসেছে তার পেছনে কিছুটা দূরে গায়ে হলুদের স্টেজ৷ মীম, দিশা আরও কয়েকটা মেয়ে সেখানেই বসে আছে। মীমকে দেখে মেঘও সেখানে গিয়ে মীমের পাশে বসেছে।

সাকিব চেয়ার থেকে উঠে এসে আবিরের পাশে বসতে বসতে মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নাও তোমার ভিডিও আর ছবি। ঠিক আছে কি না দেখো।”

আবির টেনে টেনে সবগুলো দেখছে। মেঘের ভেঙচি থেকে শুরু করে আরও অনেক ছবি তুলে ফেলছে। ১ টা ছবিতে দু’জন দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ভিডিও করেছে। ভিডিওটা তে বোতাম লাগানো, চুল ঠিক করার দৃশ্য।

সাকিব আস্তে করে বলল,
” ভাইয়া আমার কিন্তু খুব রাগ উঠতেছে। ”

আবির ফোনটা পকেটে রেখে বলল,
” কেন? ”

আবির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল মেঘ সবার সঙ্গে কথা বলছে আর হাসছে। সাকিবের কাঁধে মাথা রেখে আবির মেঘকে দেখছে। সাকিব ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

” তোমাদের লুকোচুরি প্রেম আর কতদিন চলবে? ”

“জানি না।”

“এইযে কিছু বলতে পারো না তোমার খারাপ লাগে না?”

“খারাপ তো লাগেই। ওর জন্য কত নির্ঘুম রাত কাটে আমার। ও যদি জানতো! নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালবেলা ওর মায়াবী আঁখি জোড়া দেখলে মনে হয় আরও শত শত রাত নির্ঘুম কাটাতে পারবো।”

সাকিব মজা করে বলল,
“আহারে ভালোবাসা। ”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here