#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৯
রাজশাহীতে দুটো দিন কাটিয়ে আবারও ঢাকা ফিরলো দুজন। শুভ্র ঢাকা ফিরেই ব্যস্ত হয়ে গেল। সকালে যায় বিকেলে ফিরে আসে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে বাকী সময় টা ল্যাপটপে মুখ গুজে কাটায়। এই রুটিনেই সারা সপ্তাহ চলে যায়। শুধু শুক্রবার দিন টা ব্যতিক্রম। শুক্রবার অভ্র’ ও বাসায় থাকে। আনিকাও পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভাই’দের সাথে গল্প করতে আসে। মাহফুজা বিভিন্ন ধরনের খাবার বানায়, সেগুলো খেতে খেতে সবাই আড্ডা দেয়, সিনেমা দেখে, হৈ হুল্লোড় করে। তানির খুব ভালো লাগে শুক্রবার। বিয়ের পর মোট তিনটা শুক্রবার পেয়েছে তানি। বৃহস্পতিবার রাত টা তানির কাছে ঈদের আগের রাতের মতো লাগে। শুক্রবার সারাদিন এমনকি সন্ধ্যার পর ও একটা উৎসব উৎসব আমেজ থাকে। তানি শাশুড়ীর সাথে কথা বলে জেনেছে যে এই নিয়ম তৈরী করেছে মাহফুজা। সাফ সাফ বলে দিয়েছে সারা সপ্তাহ যেমন তেমন শুক্রবার দিনটা আমাদের সবার। তানির ব্যাপার টা খুব পছন্দ হলো। এরকম একটা পরিবার কে না চায়! বাড়িতে ভাই, বোন, ভাবী, মা, বাবা এদের সাথে থাকলেও তানিকে থাকতে হতো একা একা। কারণ তানিদের বাড়িতে এসব মিলেমিশে থাকার রেওয়াজ ছিলো না। সবাই ই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এমনকি তিনবেলার খাবারেও কোনো শৃংখলা মানা হতো না। যার যখন ক্ষিদে পেত খেয়ে নিতো। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি মানে শুভ্রদের বাড়ি এসে তানি বুঝেছে পরিবার কী হয়! রাতে খাবার খেতে খেতে গল্প করা, সন্ধ্যা বেলা কারও ফিরতে দেরি হলে তার জন্য অপেক্ষা করে চা দেরি করে খাওয়া। আরেকটা ব্যাপার যেটা তানিকে চমৎকৃত করেছে সেটা হলো বয়সের লম্বা গ্যাপ থাকলেও সবার বন্ধুসুলভ আচরণ।
তানি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে অল্প সময়েই। মাহফুজা ১০ টায় স্কুলে চলে যায়, আনিকা যায় কোচিং-এ। অভ্র, শুভ্র যে যার মতো অফিসে গেলে পুরো বাড়িতে তানি একা’ই থাকে। নিজের মতো ঘর সাজায়, রান্না করে, বই পড়ে, ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে বস্তির মানুষের ব্যস্ত জীবন কে দেখে। এইসব কিছুর পর দিনশেষে যখন বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তখন মনে হয় জীবন টা খুব একটা মন্দ নয়! অবশ্য যার সাথে শুভ্র পরিবার আছে তার জীবন মন্দ হতেই পারে না।
আজ মঙ্গলবার। শুক্রবার ছাড়াও এই দিন টা শুভ্র বাসায় থাকে। ইউনিভার্সিটিতেও যায় না, আবার অন্য কাজেও যায় না। বাসায় থাকলেও অন্যান্য দিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে স্টাডি রুমে চলে যায়। এই বাসায় ছোট একটা রুমে বইয়ে ঠাসা আছে। তানি সেখান থেকে রবিন্দ্রগুচ্ছ, বঙ্কিমসমগ্র নিয়ে পড়ে। এছাড়াও ইকোনোমিক্স, স্ট্যাটাটিক্সের গাব্দা গাব্দা বই আছে যেগুলো শুভ্র একরকম গিলে খায়।
তানি দুপুরের রান্না বসিয়েছে। বাসায় শুভ্র ছাড়া আর কেউ নেই। যেদিন ই এমন হয় সেদিন ই তানির অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। কেমন একটা চাপা আনন্দ বুকের ভিতর। শুভ্র সারাদিন হয়তো চশমা চোখে বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে থাকবে তবুও মানুষটা কাছে আছে সেটাই বা কম কিসে! এই হাটার শব্দ পাওয়া যাবে, ড্রয়ার খোলার শব্দ, শাওয়ারের শব্দ। তানি কান খাড়া করে থাকে। দিন টা চলে যায় এইসবের মধ্যেই।
তানি আজ রান্না করবে ইলিশ মাছের ডিম, দই মাংস আর ফুলকপির ঝোল। সবগুলো আইটেম ই শুভ্র’র পছন্দের। শাশুড়ীর কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিয়েছে। খুব আয়োজন করে রান্না করছে। শুভ্র খেতে খুব ভালোবাসে সেটা এতোদিনে বুঝে গেছে। দই মাংসে আগে থেকে মসলা মাখিয়ে রাখছিলো তখন ই শুভ্র রান্নাঘরের দরজায় এসে বলল, তানি কী করছ?
আচমকা ডাকায় তানি একটু কেঁপে উঠল। শুভ্র ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ভয় পেয়ে গিয়েছিলে?”
তানি ভয় পেলেও সেটা স্বীকার করলো না। বলল, না না ভয় কেন পাব? আমি তো জানি ই আপনি বাসায় আছেন।
শুভ্র নিঃশব্দে হাসলো। যখনই এভাবে হাসে তখনই তানি মুগ্ধ হয়ে মনে মনে বলে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
শুভ্র হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী করছিলে?
“মাংসে মসলা মাখাচ্ছিলাম। ”
শুভ্র কিছু একটা ভেবে বলল, তুমি খিচুড়ি রাঁধতে পারো?
তানি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ পারি।
শুভ্র এক চোখ ছোট করে অনুনয়ের সুরে বলল, তাহলে প্লিজ খিচুড়ি রেঁধে ফেলো না! আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
তানি হেসে বলল, আচ্ছা।
শুভ্র খুশি খুশি গলায় বলল, থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার বেটার হাফ।
তানি লজ্জাও পেল আবার ভালোও লাগলো। কী সুন্দর করে বলল!
****
তানি ভুনা খিচুড়ি আর ঝাল মাংস রেঁধে টেবিলে যখন রাখলো তখন প্রায় দুটো বাজে। তাড়াহুড়ো করে সব রান্না শেষ করেছে। শুভ্র চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে বলল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে রান্না দারুন হয়েছে।
তানি বলল, আপনি খেতে বসুন।
“তুমি খাবে না?”
“আমি পরে খাব। ”
“পরে কেন? আসো একসাথে খাই। ”
তানি ইতস্তত করে বলল, এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিলাম। গোসল না করে খেতে পারব না।
“তাহলে শাওয়ার নিয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”
তানি বলল, আপনার তো খেতে দেরি হবে?
শুভ্র বলল, আসলে এতো সুন্দর দেখতে খাবার গুলোর জন্য অপেক্ষা করা সত্যিই কষ্টের। কিন্তু তোমার জন্য এইটুকু করাই যায়।
তানি হেসে ফেলল। তড়িঘড়ি করে ছুটে চলল, শাওয়ার নিতে।
শাওয়ার নিতে তানির সময় লাগলো নয় মিনিট। অন্যান্য দিন যেটা চল্লিশ মিনিটেও হয় না। এতো তাড়াতাড়ি আসতে দেখে শুভ্র বলল, আরে বাহ! এতো তাড়াতাড়ি! আমিতো ভেবেছিলাম এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নেব।
তানি হাসলো। খেতে বসে শুভ্র গাপুসগুপুস করে খেতে লাগলো। তানি খাচ্ছে অল্প করে। কিন্তু নিজে যতটা খাচ্ছে তারচেয়ে বেশী শুভ্র’র খাওয়া দেখছে। শুভ্র খেতে খেতে বলল, তানি আমি অতি শিগগিরই তোমাকে একটা বেস্ট শেফের সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা করব”।
তানি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ধ্যাৎ।
“উঁহু সত্যি বলছি। এতো ভালো খিচুড়ি আমি শেষ খেয়েছিলাম খুলনার এক রেস্তোরাঁয়। পরের বার যখন খিচুড়ির টানে আবারও গেলাম তখন খেতে ভালো লাগে নি।
“আপনি একটু বাড়িয়ে বলছেন। ”
“উঁহু। এক ফোটাও বাড়িয়ে বলছি না। ”
তানি আর কিছু বলল না। শুভ্র’র কাছে প্রশংসা পেয়ে খুব খুশি হলো।
শুভ্র আবারও বলল, তানি তুমি তেহারি রাঁধতে জানো?
“জানি। ”
শুভ্র চমৎকৃত গলায় বলল, তুমি তো দেখছি চমৎকার মেয়ে! এতো ভালো যার রান্নার হাত সে এখনো এখানে কী করছে! তোমার তো ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার কথা!
তানি হেসে ফেলল। বলল, আপনি পারেন ও সত্যি।
“একদিন তেহারি করে খাইয়ো তো! আর পায়েস? পায়েস রাঁধতে জানো? ”
তানি নিচু গলায় বলল, জানি।
“ওয়াও!”
তানি অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সব রান্না শিখেছিল আরিফের জন্য। শিখেছিল না বলে বলা উচিত শিখতে বাধ্য হয়েছিল। আরিফের স্বভাব ই ছিলো বন্ধু, বান্ধবদের সাথে সপ্তাহে একদিন খাওয়া দাওয়া। সেই ফরমায়েশ মতো রান্না শিখতে গিয়ে সব শিখে নিয়েছিল। আজ সেটা কাজে লাগলো!
শুভ্র বলল, তানি তোমার ফেভারিট আইটেম কী?
“মোরগপোলাও”
“পুরান ঢাকায় খুব ভালো একটা মোরগ পোলাও পাওয়া যায়। তোমাকে একদিন নিয়ে যাব”।
তানি স্মিত হেসে বলল, কবে নিয়ে যাবেন?
শুভ্র তানির চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তানি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
বিকেলে তানি একটু শুয়েছিল। শুভ্র এসে বলল, চলো তানি আমরা একটু ঘুরে আসি।
তানির মনে হলো ও ভুল শুনছে। বিয়ের পর এ’কদিনে মাহফুজা অনেক বার বললেও শুভ্র গা, গুই করে এড়িয়ে গেছে। আজ নিজে থেকেই বলছে দেখে তানির বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। শুভ্র তানিকে অবাক হতে দেখে বলল, তাহলে তুমি যাবে না?
তানি ঝড়ের বেগে উঠে দাঁড়ালো।
রিকশায় বসে শুভ্র বলল, এই তানি তুমি ওভাবে বসেছ কেন? পড়ে টড়ে দাঁত, মুখ ভাঙতে।
তানি সংকোচে এগিয়ে বসতে পারলো না। লজ্জায় আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল। শুভ্র হাল ছেড়ে দিয়ে তানির হাত ধরে কাছাকাছি নিয়ে আসলো। হাতটা ধরে রেখেই বলল, তোমার মধ্যে আশির দশকের শাবানা, ববিতাদের স্বভাব রয়ে গেছে। ভেরি ব্যাড!
তানি কিচ্ছু শুনলো না। বিয়ের পর এই প্রথম শুভ্র’র এতো কাছাকাছি এলো। এতো কাছে যে নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। ভালো লাগার আবেশে তানি থরথর করে কাঁপছে।
শুভ্র দেখলো তানির ধরে রাখা হাত টা অনবরত কাঁপছে।
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা