#আমার তুমি ২
#পর্বঃ১৩
#তানিশা সুলতানা
এই সায়ানকে তুলতুল মানুষ বলে মানতে নারাজ। মানুষরা কখনো এমন হয়? কই তুলতুল তো কখনো এরকম মানুষ দেখে নি।
এই যে এখন তুলতুলকে দেয়ালে ঠেসে কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলতুল কি এখানে আসার আগে ভেবেছিলো এরকম হবে?
তুলতুল চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এভাবে কেউ এতো কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ঠিকভাবে নিশ্বাস নেওয়া যায়?
“আমি বিরি খাই? সব থেকে বাজে আমার ঠোঁট? লিপস্টিক লাগিয়ে লাল করে রাখি?
সায়ান তুলতুলের গালে হাত বুলাতে বুলাতে স্লো ভয়েসে বলে। তুলতুল শুকনো ঢোল গিলে। দুই হাতে জামা খাঁমচে ধরে।
গলা কাঁপছে
“কথা বল। খুব তো কথা বলতে পারিস। এখনো বল। শুনি আমি একটু।
নাক টিপে ধরে বলে সায়ান। তুলতুল কপাল কুঁচকে পিটপিট করে চোখ খুলে। কেউ নাক আটকে ধরে?
” আআমার ঠান্ডা লাগছে।
তুলতুল রিনরিনিয়ে বলে। সাথে সায়ান নাক ছেড়ে দেয়। তুলতুলের। তাও আবার ডান হাত দিয়ে ধরেছে।
তুলতুলের হাসি পাচ্ছে তবুও হাসতে পারছে না। হাসলে না জানি আবার হালুম করে খে*য়ে নেয়।
“ইডিয়েট
সায়ান তুলতুলের ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে। তুলতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
” আমাকে ভয় করে না তোর?
হাত মোছা শেষ করে তুলতুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে সায়ান। তুলতুল শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে পর পর কয়েকবার অনবরত মাথা নারায়। মানে হ্যাঁ বোঝায়।
“ভয় লাগে তো সামনে বকবক করিস কিভাবে?
বলতে বলতে ঠাসস করে তুলতুলের গলার ঠিক মাঝখানের লাল তিলের ওপর ঠোঁট ছোঁয়ায়। কি হচ্ছে বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায় তুলতুলের। বড়বড় চোখ করে সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চায়। কিন্তু এক চুলও নরাতে পারে না।
ছোট ছোট করে কয়েকটা চুমু দিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে দুরে সরে দাঁড়ায় সায়ান। তুলতুল এখনো ফ্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। আপনাআপনি হাতটা চলে যায় গলায়। ভেজা ভেজা লাগছে। তুলতুল মাথা নিচু করে জীভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। হাত পা কাঁপছে।
” পাগল করে ছাড়বি আমায়।
সায়ান বা হাতে লম্বা চুল গুলো পেছনে ঢেলে ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলে।
“আমি ফ্রেশ হয়ো আসছি। ততখনে আলমারিটা গুছিয়ে দে।
বলেই বড়বড় পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সায়ান।
সায়ান যেতে তুলতুল মাথা তুলে। ওড়না দিয়ে গলা মুছে।
” আমি সত্যিই একটা স্টুপিট। কি দরকার ছিলো এই হনুমানকে দেখতে আসার? রূপ গজিয়েছিলো এর? যতসব। দিন দিন ভীষণ বোকা হয়ে যাচ্ছিস তুলার বাচ্চা তুই।
এই লোকটার আশেপাশেও আর আসা যাবে না। মানসম্মান উগান্ডা পাঠিয়ে দেবে এ।
জলদি বাসায় যেতে হবে। আর এর সামনে তো একদম থাকা যাবে না। শা*লা বজ্জাত জীবনেও বউ পাবি না তুই। অভিশাপ দিলাম। তুলতুলের অভিশাপ জীবনেও বিফলে যায় না।
তুলতুল সায়ানকে ঝাড়তে ঝাড়তে গলায় হাত দিয়েই সায়ানের রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
সুমু হাতে স্বর্নের আংটি নিয়ে ছাঁদে চলে যায়। গত ঈদে সালামির টাকা দিয়ে গড়িয়েছিলো এই আংটি তন্ময়ের জন্য। অনেক কষ্ট তন্ময়ের আঙুলের মাপ নিয়েছিলো। আজকে এই আংটি দিয়েই প্রপোজ করবে তন্ময়কে।
তন্ময় ছাঁদের রেলিং এর ওপর বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে। সিগারেট এখানেই পেয়েছে। ফুলের টবের পেছনে লুকানো ছিলো। হয়ত হাসিবের কাজ এটা।
“তন্ময়
হঠাৎ করে সুমুর কন্ঠ পেয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে পেছনে ঘুরে তন্ময়। ঠোঁটের ভাজে এখনো সিগারেট।
সুমু হাঁটু মুরে বসে পড়ে। ছাঁদে থাকা গোলাপ ফুল গাছ থেকে কয়েকটা ফুলও ছিঁড়ে এনেছে। ছিঁড়তে গিয়ে হাতের কয়েক জায়গায় কাঁটা ফুঁড়ে র*ক্ত বেরিয়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই।
” আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি তন্ময়। সেই যে প্রথমবার যখন আপনি কালো শার্ট আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে প্রথমবার ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সেই দিনই ফেঁসে গেছিলাম৷ আপনি আমার কাছে কোটি কোটি টাকার থেকেও বেশি মূল্যবান। গোটা দুনিয়া এক দিকে আর আপনি একদিকে। আপনাকে ছাড়া আমি একটা সেকেন্ড থাকার কথা চিন্তাও করতে পারি না।
“Will You Marry Me??
সারাজীবন ভীষণ ভালোবাসবো আপনাকে।
তন্ময় এক হাত পকেটে পুরে অন্য হাত দিয়ে সিগারেট টানছে আর সুমুর কথা গুলো শুনছে। এই মেয়েকে পাগল ছাড়া আর কোনো উপাধি দিতে পারছে না তন্ময়। পাগলরাও বোধহয় এমন হয় না।
সুমু বিরক্ত হয়। কতোখন ফুলগুলো এগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? উঠে দাঁড়ায় সুমু। তন্ময়ের হাত টেনে হাতে ফুল ধরিয়ে দেয়।
তন্ময় কিছু না বলে শুধু দেখছে। সুমুর হাতের র*ক্তও খেয়াল করেছে। তবুও চুপচাপ আছে। এবার তুলতুল তন্ময়ের বা হাতের দুই আঙুলের ভাজ থেকে সিগারেট ফেলে দিতে হাতটা নিজের দিকে টেনে নেয়। তারপর আংটিটা পড়িয়ে দিতে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায়। নরেচরে ওঠে তন্ময়। হাতটা টেনে সুমুর থেকে নিয়ে নেয়। সুমুর ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। তন্ময় রেগে চোয়াল শক্ত করে ফেলে।
“তোমার সাহ
তন্ময় সুমুকে ধমক দিতে যায় তার আগেই হিমু চলে আসে।
” বুড়ি দাদু ডাকছে।
সুমু মুচকি হেসে হিমুর কাছে যায়। হিমু মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“তন্ময় এসো।
আবারও সেই গুমোট পরিস্থিতি। এখন শুধু পুরুষ না মহিলারাও উপস্থিত হয়েছে। একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওনারা। তুলতুল সুমুর মা কাকিমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সুমুর দাদিমা খুকি বেগম ছেলেদের পাশে বসে আছে।
সায়ান হিমু হাসিব তিন ভাইও বসেছে বাবাদের সাথে। আব্দুল্লাহর এক কথা। সুমু তিন ভাইয়ের একটা মাএ বোন। তাদেরও অধিকার আছে বোনের হয়ে কথা বলার।
সুমু এসে দাদাভাইয়ের একদম পাশ ঘেসে বসে। তন্ময় এক পাশে দাঁড়ায়।
” তন্ময় তুলতুল তোমরা এখানে এসে বসো।
সালমান গম্ভীর গলায় বলে। চমকে ওঠে তন্ময়। তুলতুল কেঁপে ওঠে।
“কিচ্ছু হবে না যাও”
সায়ানের মা চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করেন। তুলতুল একটু হাসার চেষ্টা করে এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে। তারপর দুই ভাইবোন বসে পড়ে ওনাদের সামনে রাখা সোফায়।
“তুমি কি করো?
সুলাইমান জিজ্ঞেস করে।
“মাস্টার্স শেষ করেছি।এখনো সেরকম কিছু করি না। চাকরি খুঁজছি।
তন্ময় ভনিতা ছাড়া বলে৷ সুমু হাসিহাসি মুখ নিয়ে তাকায় তন্ময়ের দিকে।
” এখনো কিছুই করছো না। করবে। তোমার বাবার সেলারি কতো? হাই স্কুলের টিচার তো? কতো হবে?
সর্বোচ্চ ত্রিশ হাজার। তোমাদের ফ্যামেলিতে সদস্য কতো জন?
আনোয়ার খানিকখন সময় নিয়ে থেমে থেমে বলে।
“ছয় জন।
তুলতুল উওর দেয়।
” একেকটা মানুষের পেছনে প্রতিমাসে ১০০০০ টাকা করে খরচ করলে তোমাদের মাস চলবে না। আরও কম খরচ করতে হয়। তারপর বাজার কেনাকাটা বিদ্যুৎ গ্যাস আরও অনেক কিছু তো আছেই। মাসের প্রথম দিকে মাছ মাংস আর শেষের দিকে শাকসবজি খেয়েই কাটাতে হয়। তাই না?
তন্ময় মাথা নিচু করে ফেলে। তুলতুল সরু চোখে তাকায়। ওনারা কি অপমান করতে চাইছে?
সুমু রেগে কিছু বলতে যায় আব্দুল্লাহ থামিয়ে দেয়।
“বড় বাবা আপনি
” সায়ান কথা তোমাকেও বলার সুযোগ দেওয়া হবে। আগে আমি শেষ করি? তুমিও জানো আমি ভুল কিছু বলছি না।
সায়ান থেমে যায়।
“তুমি খুব ভালো ছেলে৷ দেখতে ভালো। শিক্ষিত।
কিন্তু তোমারও একটু ভুল আছে। ভুলটা কি নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছো?
শোনো ছেলে তোমার বয়স কম। আবেগ বেশি। প্রেম বন্ধুত্ব এসব উঁচুতে নিচুতে হতেই পারে। কিন্তু বিয়েটা হতে হয় সমানে সমানে। আর যদি হয় আমাদের রাজকন্যার বিয়ে তাহলে তো সবার আগে আমাদের থেকেও হাই সোসাইটি পরিবার লাগবে।
তবে আমি আমাদের রাজকন্যার কথা ভেবে পরিবার ভুলে গেছি। শুধু তোমার দিকেই মনোযোগ দিয়েছি।
বিয়েটা আজকেই হবে। আর তুমি আমাদের রাজপ্রাসাদেই থাকবা রাজকন্যার সাথে। সারাজীবন তুমি বসে খেলেও আমাদের অর্থ ফুরাবে না।
আমাদের রাজকন্যা তোমার পরিবারের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে না।
আনোয়ার আলতো হেসে বলে। তুলতুলের গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। তন্ময় কিছু বলবে তার আগেই সুমু বলে ওঠে।
” বড় বাবা তুমি ভুল করছো। আমি শুধু তন্ময়কে না ওর পরিবারকেও ভালোবাসি। আমি শুধু ওর সাথে না ওর পরিবারের সাথেও সংসার করতে চায়। মধ্যবিও পরিবারের শাক সবজি খেয়েই জীবন যাপন করতে চাই।
মাছ মাংস খেতে খেতে মুখে রুচি উঠে গেছে একদম।
চিন্তা কেনো করছো? আমি লিখে দিতে পারি। শশুড় বাড়ি যাওয়ার পরে আমি তোমাদের থেকে একটা পয়সাও চাইবো না।
সুমু দাঁড়িয়ে কাটকাট গলায় বলে। সায়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তুলতুল মাথা নিচু করে বসে আছে। তন্ময় হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে।
তিন ভাইয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। আব্দুল্লাহও বেশ রেগে যায়।
“বোনু বাবা কাকাদের কথা বলতে দাও।
খুকি বলে।
” দেবো না। ওনারা তন্ময়কে অপমান করতে চাইছে। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।
সুমুর চোখে পানি টলমল করছে। নাক ফুলে উঠছে একটু পর পর।
“দুনিয়া সম্পর্কে কিচ্ছু জানো না মামনি তুমি। তাই বুঝতে পারছো না। তোমার জন্য আমরা আকাশের চাঁদটাও এনে দিতে পারি। তাহলে তুমি কেনো জোনাকির পেছনে ছুঁটছো?
সালমান বলে ওঠে।
” আই লাভ জোনাকি। বুঝতে পেরেছো তুমি?
চিৎকার করে বলে ওঠে সুমু।
তন্ময় এবার উঠে দাঁড়ায়।
“আংকেল আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় নি। আমি আমাদের মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারি। অবুঝ না আমি। আমরা মধ্যবিত্ত আমার বাবা একজন শিক্ষক। আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এভাবেই আমরা ভালো আছি।
আর এমনই থাকতে চাই। আপনাদের টাকায় বসে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি আপনাদের রাজকন্যাকে চায় না।
এটা ওকে আগেও বলছি আর এখন আপনাদেরও বললাম।
আসি
বলেই হাতের আংটিটা খুলে সুমুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ল তুলতুলের হাত ধরে হনহনিয়ে চলে যায়। সুমু ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সায়ান নির্বাক হয়ে বসে থাকে। তিন ভাই মনে মনে ভীষণ খুশি হয়।
হাসিব ছোটে ওদের পেছনে। বোনটা যে ভীষণ কষ্ট পাবে। হিমু খেয়াল করে সুমুর হাতে র*ক্ত।
” বুড়ি তোর হাতে কি হইছে?
সুমু উওর দিতে পারে না। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসে।
চলবে