#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৮
মাহফুজা নিজেকে শান্ত করতে কিছু সময় নিলেন। বললেন,
“ঠিক কী কী বলেছে তোর বন্ধু সব টা বলবি। ”
শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। মাহফুজা বলল,
“উঁহু। তানি এখানেই থাকবে। ওর সব টা শোনার দরকার আছে।
শুভ্র গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলো।
ঘটনা হলো, শুভ্র’র যে বন্ধু সে ছিলো তানির প্রাক্তন স্বামীর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তার ভাষ্যমতে, তানির প্রাক্তন স্বামী ছিলো পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বড় তিনজন বোন ও আছে। অবস্থাপন্ন ফ্যামিলি দেখে তারা তানির বিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারেন যে মেয়ে মোটেও সংসারী টাইপ না। সংসার, স্বামী কারও প্রতিই কোনো মন নেই। এরমধ্যে তানি প্রেগন্যান্ট হলো। বাচ্চা নেয়ার পর পর ই নাকি তারা টের পেল তানির এ্যাফেয়ার আছে। সেটা ফ্যামিলির সবাই জেনে যাওয়ায় এক রাতে তানি ননদ দের মেরে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে শোনা যায় এবোর্শন করিয়ে স্বামীকে নাকি ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
সব শুনে মাহফুজা বলল, ব্যাস! এইটুকুই?
শুভ্র কোনো কথা বলল না। তানি নিজেও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এতো বড় ধাক্কা খেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল যেন। শুভ্র’র সব কথা শুনতেও পেল না। তানি উঠে দাঁড়ালো। মাহফুজা বলল, তানি এখানে বস চুপচাপ। আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। তানি শুকনো গলায় বলল, আমার শরীর ভালো লাগছে না মা। আমি একটু শোব। আর ওনাকে সত্যিই আমার বলার কিছু নাই। যার কাছে আমার কোনো গুরুত্ব ই নেই। তাকে আর নতুন করে কী বলার থাকতে পারে।
মাহফুজা আরও কিছু বলতে গেলে অভ্র বাধা দিলো। বলল, মা ভাবী একটু বিশ্রাম করুক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক টায়ার্ড।
আনিকা তানিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে গিয়ে তানি বিছানায় শুয়ে থাকলো।
মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, বিয়ের আগে আমি যখন বলেছিলাম তানির সাথে কথা বল, খোঁজ খবর নে। তখন বলেছিলি মা তোমার উপর ভরসা আছে। তা আজ তো মনে হচ্ছে আমার কিংবা তানির চেয়ে বন্ধুর কথায় তোর বেশী ভরসা।
“মা আমার বন্ধুটা অনেক দিনের পরিচিত। ও যে মিথ্যে বলবে না সেটা আমার বিশ্বাস ছিলো “।
“কিন্তু মা যে মিথ্যা বলতে পারে এ ব্যাপারেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস ছিলো?”
শুভ্র অস্ফুটস্বরে বলল, মা!
মাহফুজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, আগে আমাকে শেষ করতে দে।
তানির বাবা পাত্রের ভালো চাকরি আর পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। একবারও বুঝতে পারেন নি যে তার বিশ বছরের মেয়ে সংসারের মারপ্যাঁচ শিখে ওঠে নি। শুধু তানি কেন! ওই বয়সী কোনো মেয়েরাই শিখে আসে না। আমার বিয়ে যখন হয়েছে তখন আমি কলেজে পড়ি। ঠিকঠাক এক কাপ চা’ও বানাতে পারি না। হাত কেটে, পুড়িয়ে সংসারের রান্নাবান্না, কাজ শিখেছি। কিন্তু তানির কাছ থেকে ওর আগের স্বামী আর তার পরিবার সবকিছু একবারে চেয়েছেন। একটা বিশ বছরের মেয়ে তার পক্ষে কী প্রথমেই সব কাজ পারা সম্ভব? তাছাড়া তানি ওর মায়ের আদরের মেয়ে। পৃথিবীর কোনো মায়েরাই তাদের মেয়েকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে কাজ শেখায় না। মায়েদের মন মেয়ের জন্য সব সময় উতলা থাকে। তুই তোর বোন কে জিজ্ঞেস করতো চুলা জ্বালিয়ে এক কাপ চা বানাতে পারে কি না!
ঘরের মধ্যে সবাই চুপচাপ মাহফুজার কথা শুনছে। একটু থেমে মাহফুজা আবারও বলল,
বিয়ের দুইমাসের মাথায় তানির গায়ে প্রথমে হাত তুলল স্বামী। দোষ হলো, বন্ধুদের জন্য তানি রান্না করেছিল। সেই রান্না মুখরোচক না হওয়ার কারনে কষে থাপ্পড় মেরে বলেছিল, আজকের এই থাপ্পড় তোকে সারাজীবনের জন্য ভালো রান্না করা শিখিয়ে দেবে।
শাশুড়ী ছাড়াও তিন ননদ ছিলো যাদের একজন ঘরে আর বাকী দুজন ওই একই বিল্ডিং এ থাকতো। এরা গায়ে হাত দিতো না ঠিক ই। কিন্তু এরা কথা দিয়েই মেরে দিতো। কথায় কথায় বাপের বাড়ির দূর্বলতার খোটা, কাজ না জানার খোটা এসব প্রতিদিন ভাত খাওয়ার মতো করেই শুনতে হতো।
আরেকটা কথা মিস হয়ে গেছে। তানিকে বিয়ে করার কারণ মূলত এটাই ছিলো যে ছোট ঘরের মেয়ে ঘরে আনলে পায়ের তলায় পিষে মারতে সুবিধা হবে। এরা ছেলের জন্য বউ না, বাসার পার্মানেন্ট কাজের লোক এনেছিল। কনসিভ করার পর শুরু হলো এদের আরেক ঝামেলা। ছেলে এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায় না। তার বন্ধুদের এখনো বাচ্চা হয় নি। বাচ্চার বাপ হওয়া মানে তার কাছে বুড়ো হয়ে যাওয়া। অথচ তার মা, বোনদের বাচ্চা লাগবে। এই নিয়ে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। শেষমেস তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলো যে বাচ্চা হয়ে গেলে বোনেদের মধ্যে একজন আছে যার বাচ্চা নেই, সে নিয়ে নেবে। অর্থাৎ বাইরের মানুষ কে জানতে দিবে না যে তানি প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঠিক সেকারনে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হতো তানিকে। অল্প বয়সী মেয়েটা তখন একটু সাহস করে ওই কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। ওদের ব্যাচের একটা গ্রুপ ছিলো যাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। তাদের একজনের ফোন নম্বরে ফোন করে সব টা বললে সে মানবতার খাতিরে ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের সাহায্যে তানিকে উদ্ধার করেছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্যে ও রাজশাহী পৌছেছিল। কিন্তু কপাল খারাপ থাকায় সেই বাস জার্নিতেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
এরপরে তানি একটা ভয়ংকর কাজ করেছিল। সুস্থ হয়ে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল মা, খালার সহযোগিতায়। সেই মামলায় তাদের অনেক ভোগান্তিও হয়েছে শুনেছি। তা তোমার বন্ধু বুঝি সেটুকু বলে নি?
শুভ্র লজ্জায় মাথানত করে রাখলো। তানির কাছে মাফ চাওয়ার ও মুখ নেই।
মাহফুজা এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে ফেলায় গলা শুকিয়ে গেছে। এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“অবন্তী তো সবাইকে বলতো আমি খারাপ। আমি ওর উপর টর্চার করি। সেগুলো কী সত্যি ছিলো? অবন্তীর কথা অনুযায়ী আমিও তো খারাপ মানুষ। আমাকে মা বলতে তোর ঘেন্না হওয়া উচিত। ”
শুভ্র কাতর গলায় বলল, মা আমি ভুল করে ফেলেছি।
মাহফুজা থামিয়ে দিয়ে বলল, না বাবা ভুল আমার হইছে। তোমার জন্য অবন্তীর মতো মেয়েরাই ঠিক, তানি বেমানান।
অভ্র সাফাই গেয়ে বলল, মা ভাইয়া ভুল করে ফেলেছে। দেখো যে বলেছে সে কিন্তু ভাইয়ার বন্ধু ছিলো।
“আর আমি মা। ও যতটা তানিকে অপমান করেছে ততটা অপমান আমাকেও করেছে।”
শুভ্র’র কিছু বলার মতো মুখ নেই। মাথানিচু করে থাকা। ইশ! তানি বিয়ের আগে দেখা করতে চেয়ে এই কথাগুলোই হয়তো বলতে চেয়েছিল। আর ও তখন বারন করে দিয়েছিল যে ও কিছু শুনতে চায় না। আর সেই ও কী না আজ এরকম একটা বিশ্রী কাজ করলো। তানির পা ধরে ক্ষমা চাইলেও হয়তো কম হয়ে যাবে।
অভ্র’র যতটা খারাপ তানির জন্য লাগছে, তারচেয়ে বেশী লাগছে শুভ্র’র জন্য। আর কেউ না জানুক ও জানে যে, আজকের এই অবিশ্বাস করার ঘটনার পিছনে যে ওর অতীতের কোনো ঘটনার মিল আছে।
মাহফুজা চলে যেতেই আনিকা শুভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, ভাইয়া ঘরে চলো। তোমার হাত কেটে গেছে অনেকখানি।
অভ্র খেয়াল করলো যে দেয়ালে ঘুষি দেয়ার সময় যে লেগে গিয়েছিল সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। এতক্ষন সেটা কেউ খেয়াল করে নি।
অভ্র উঠে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ভাইয়া ওঠো।
আনিকাকে ইশারায় ফার্স্ট এইড বক্সের কথা বলল।
শুভ্র উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। বলল, তানির কাছে ক্ষমা চাওয়ার যে কোনো মুখ রইলো না। এখন আমি কী করব?
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা