প্রিয়_রুদ্র_ভাই #পর্ব-৩৬ #তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

0
366

#প্রিয়_রুদ্র_ভাই
#পর্ব-৩৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

গোধুলি বিকেল। সূর্যের আলো অল্প অল্প। সাদা রঙের পোশাকে ইরাবতীকে অপ্সরার থেকে কম লাগছে না। কিছু মানুষ আছে যাদের সাদা রঙের মাত্রাতিরিক্ত মানায়। ইরাবতীর চেরার গড়ন মারাত্মক সুন্দর। বিশেষ করে তার হাসি। নামের মতোই সুন্দরী সে। এই অবেলায় টিউশনি পড়িয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ইরাবতী। সে এইবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। নিজের খরচ নিজেই চালাতে হয়। পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। হোস্টেলেই থাকা হয় সারাবছর। ঈদে বা কোনো ছুটিতে আর সবার মতো সে বাড়িতে যায় না আর। বরং জমানো টাকা দিয়ে ট্যুর দিয়ে কাটিয়ে দেয় সেই দিনগুলো। ইরাবতী বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু একজন মানুষের বেলায় তার বুদ্ধিরা সব হাওয়া হয়ে যায়। সেই মানুষটা হলো মাহেন্দ্র। যার জন্য আজ সে পরিবার থেকে আলাদা। বাবা বলেছেন যদি সে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করে তো তাকে ত্যাজ্য করা হবে। ইরাবতী তেমন কিছু বলেনি। যেখানে সে নিজেই জানে না তার ভবিষ্যত কি সেখানে বুক ফুলিয়ে কিছু বলাটা সাজে না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যাকে নিয়ে এতোকিছু সে এসবের কিছুই জানে না। সে শুধু জানে ইরাবতী ও তার মধ্যে অ-প্রেম নামক এক অধ্যায় তৈরি হয়ে গেছে। ব্যস আর কিছু না।

ইরাবতী এসব অ-প্রেম নিয়ে কখনো তার পরিবারকে কিছু বলেনি। কিন্তু কিভাবে যেনো একদিন সবাই জেনে গেলো সব। সবার ধারণা ইরাবতী ভিন্নধর্মী কারো সাথে সম্পর্কে রয়েছে। বাবা ভাই খুঁজ নিলেন। মা ইরাবতীকে বন্ধ ঘরে চড়-থাপ্পড় দিয়েও কোনো কথা বের করতে পারলেন না। শেষে কথায় কথায় রটে গেলো ইরাবতী মাহেন্দ্রের সাথে সম্পর্কে রয়েছে!

কিন্তু আদোও কি তারা কোনো সম্পর্কে ছিলো? দুজন জানে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু পুরো দুনিয়া জানে তারা গোপনে সম্পর্কে রয়েছে! হাস্যকর না?

গোধুলি বিকালের পর ধরনীতে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। সূর্য নিভে যাচ্ছে। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমেছে আকাশ হতে। ফাঁকা রাস্তায় তটিনী দুহাত দু’দিকে মেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলো। মুখ তার আকাশের দিকে। একেকটা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তার চোখেমুখে আছড়ে পড়ছে। বৃষ্টিবিলাসীর মাথার উপর হঠাৎ করে একটি ছাতার পদার্পণ ঘটলো। ইরাবতী সম্মুখে কারো উপস্থিতি অনুভব করলো। কি আশ্চর্য সে না দেখেই চিনে ফেললো ছাতার মালিক কে।

ছাতার মালিক কিঞ্চিৎ তাড়া দেখালেন, ‘জলদি হাঁটা শুরু করো, ভিজে গেলে তো।’

ইরাবতী পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। পুরুষটির চোখেমুখে ইতিমধ্যেই বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা জল পড়ে গেছে। স্নিগ্ধ পবিত্র লাগছে দেখতে। পড়োনের সাদা শার্ট গলিয়ে দেখা যাচ্ছে বুকের কিছু অংশ। ইরাবতীর চোখ সেখানে আটকে গেলো। পুরুষটি পুনরায় তাড়া দিতেই সে নিজের নিষিদ্ধ ইচ্ছেকে নিজের ভিতরেই আটকে ফেললো। একই ছাতার তলে দুজন। পুরুষটির কাঁধে বার-বার ইরাবতীর কাঁধ লেগে যাচ্ছে। তার একটুও অস্বস্তি লাগছে না। আর না লাগছে পুরুষটির। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা এসবে অভ্যস্ত। অথচ এভাবে পাশাপাশি ছাতার তলে হাঁটাহাঁটি করা তাদের প্রথম।

দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলো তারা। পুরুষটি মাথার চুল ঝেড়ে নিলো। ইরাবতী মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখলো। পুরুষটি গলা ছেড়ে কেশে মনোযোগ আকর্ষণ করলো, ‘তুমি কি করছিলে এতো বৃষ্টিতে?’

ইরাবতীর উত্তর, ‘টিউশনি করিয়ে ফিরছিলাম। বৃষ্টি শুরু হলো সেজন্য বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলাম।’

‘তার মানে আমি তোমার বৃষ্টিবিলাসে বিঘ্ন ঘটালাম?’

ইরাবতী চোখে চোখ রেখে বলল, ‘উঁহু! বিঘ্ন না ঘটালে তো কাউকে দেখা হতো না! সুতরাং আপনাকে কৃতজ্ঞতা মাহেন্দ্র!

মাহেন্দ্র চমৎকার ভঙ্গিতে হাসলো, ‘তোমাকেও ধন্যবাদ, বৃষ্টিবিলাসীকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য!’

এ যেনো এক বিষাক্ত প্রেম। কাউকে বলা যায় না, আর না নিজে সহ্য করা যায়। শুধু গোপনে রেখে দিতে হয় সবসময়!’

মাহেন্দ্র বলল, ‘বৃষ্টিবিলাসীকে নিয়ে একটু রিকশায় ঘুরার ইচ্ছে ছিল। পূর্ণ হবে কি?’

ইরাবতী হাসলো, ‘বৃষ্টিবিলাসী কখনো তার বেঁচে থাকাকে অস্বীকার করতে পারে না। যেমনটা করতে পারছে না আপনার আবদার কে!

মাহেন্দ্র রিকশা ঠিক করলো। দু’জন উঠে বসলো সেটায়। প্রথমবারের মতো হাতে হাত রেখে রিকশা ভ্রমণ। ইরাবতী শিহরিত হলো। সব বাঁধা ভুলে মাথা রাখলো মাহেন্দ্রের কাঁধে। মাহেন্দ্র এক হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।’

ইরাবতী মনেপ্রাণে চাইলো এই মুহুর্তে সব ভুলে যেতে। একটু প্রশ্রয় দেওয়া যাক না। ছোট্ট জীবনে এতো দুঃখ নেওয়া যায়? কিন্তু! সে যখন আবেশে চোখ বন্ধ করলো, তখনই তার ভাবনাতে জেগে উঠলো অদৃশ্য এক আন্দোলন। সেই আন্দোলন তাকে মাহেন্দ্রের সাথে এক রিকশায় বসতে দিলো না। ইরাবতী চট করে রিকশা থামাতে বলে নেমে পড়লো। মাহেন্দ্র হাসলো,

‘আমি জানতাম এমনটাই হবে। তুমি বরং রিকশাতে উঠে চলে যাও। আমি অন্য রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছি।

ইরাবতী নিজেও হাসলো, ‘আপনার আমার পথ সর্বদার মতোই ভিন্ন। নিজের জন্য রিকশা ঠিক করার যোগ্যতা আমার আছে। আসছি ভালো থাকুন।

অতঃপর ক্লান্ত পথিকের মতো ইরাবতী হারিয়ে গেলো অন্ধকারে। মাহেন্দ্রের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে চোখে হাত ভুলিয়ে নিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালো। শুধালো,

‘তার আল্লাহ, আমার ঈশ্বর। আমি তার আল্লাহকে বলবো তাকে যেন সর্বদা ভালো রাখে। ইরাবতীর হাসি অম্লান হোক।’

*

আনুষ্ঠানিক বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গা মোটামুটি ঘুরা শেষ রুদ্র ও তটিণী-র। রুদ্রের মতে এটা হলো বাংলাদেশের হানিমুন। এটা শেষ হলে শুরু হবে বিদেশের হানিমুন।

প্রায় এক বছর আগে মজা করে মিনহাজকে রাগিয়ে দিয়ে রুপান্তরের সর্বনাশ হয়ে গেছিল। শান্তশিষ্ট মিনহাজ হঠাৎ রেখে গিয়ে প্রথমবারের মতো ফটফট করে বাবাকে ফোন করে বলেছিল, ‘আপনার বউমা চৌধুরী বাড়িতে পা রাখার জন্য অপেক্ষা করছে আব্বা। ব্যবস্থা করুন।’

ব্যস তারপর মিনহাজ সরাসরি রূপান্তরের বাসায়। সোজা রুপান্তরের বাবার মুখোমুখি হয়েছে সে। ভদ্র ছেলের মতো নিজের ইচ্ছে পোষণ করেছে। রুপান্তরের বাবা হা করে ছেলেটির কথা শুনেছেন। এভাবে কোনো ছেলে এসে তার কাছে তার মেয়ের হাত চাইবে তিনি ইহো জন্মেও ভাবেন নি। রুপান্তর তখন সিঁড়ির আড়ালে দাড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে রুপান্তরের বাবা মিনহাজের বাবা মাকে নিয়ে আসতে বললেন। তারপর রুপকথার মতো হলো সবকিছু। সুন্দর একটি দিনে বিয়ে ঠিক হলো তাদের।

তখন শীতকাল। রুপান্তর ও মিনহাজের বিয়ের দিন আচমকা প্রকৃতি অন্যরকম কিছু করলো। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো ধরণীতে। সেই বৃষ্টিভেজা শীতের দিনে লাল লেহেঙ্গা পড়ে রুপান্তর সোনালি পাঞ্জাবি ওয়ালা নামক মিনহাজের বউ হয়ে গেলো।

বাসর হলো ঢাকাতেই। তটিনী বুদ্ধি করে বাসর ঘরে সিসিক্যামেরা লাগানোর প্লান করেছিল। কিন্তু রুদ্রের জন্য বেচারি শেষে চুপসে গেছিল। রুদ্রের সে-ই কি ধমক। বাসর দেখবে? আসো অন্যেরটা না দেখে প্রাকটিকালি দেখাই!

লজ্জায় তটিনী রুদ্রের সামনে যায়নি। রুপান্তরকে বাসর ঘরে রেখে সে কাঁথার নিচে ঘুমানের অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল। রুদ্র মধ্যরাতে ঘরে এসে এই অবস্থা দেখে নিজ মনে হেসেছিল। সে ভেবেছিল রুপান্তরদের বাসায় তার বউয়ের সহজে ঘুম আসবে না। কিন্তু মহারানী তো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন।

রুপান্তর ও মিনহাজের বাসর রাত স্মরণীয় করে রাখার মতো। ঘটনাটা এমন।

রুপান্তর লেহেঙ্গার ওড়না খুলে খাটে পা ঝুলিয়ে মিনহাজের জন্য অপেক্ষা করছিল। নতুন বউয়ের অবস্থা দেখে মিনহাজের চোখ কপালে। বউ ঘোমটা দিয়ে বসে না থেকে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কেন?

মিনহাজের চার বেটারি চশমা রুপান্তর ফট করে খুলে নিলো। লাফঝাপ করে নাচলো কিছুক্ষণ। সবকিছু মিনহাজের মাথার উপর দিয়ে গেছিল। সে জানে রুপান্তর চঞ্চল তাই বলে এতো?’

রুপান্তর সেটুকু করেও থামেনি। মিনহাজ কলেজ স্টুডেন্ট থাকতে কি না কি বলেছিল সেটা নিয়ে খোঁচা মারছিল।

‘দোস্ত তোর জামাইরে আমি গোপন প্যাকেট গিফট করমু তুই চিন্তা করিস না!

কথাটা এমন ছিলো। কলেজ লাইফে শান্তশিষ্ট মিনহাজ তটিনী ও রুপান্তরের পাল্লায় পড়ে কিছুটা চঞ্চল হয়ে গেছিল। বন্ধুত্বের দাবীতে মজা করে বলেছিল কথাটি। কিন্তু কে জানতো সেই বিখ্যাত জামাই সে নিজেই হবে!

রুপান্তরের এক কথা, ‘আমার বন্ধু মজনু তোমাকে গোপন প্যাকেট দিয়েছে তো?’

মিনহাজ হেসে বলেছিল, ‘অবশ্যই অবশ্যই।’

তারপর! তারপরের কাহিনিটা দুজনার। মিনহাজ সেই গোপন প্যাকেট কাজে লাগালো।ব্যস!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here