#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৩
বাতাসে রুমের পর্দাগুলো দুলে দুলে যাচ্ছে। যেন জোয়ারে মাঝে উত্তাল নদীতে পাল তুলে আছড়ে পরা এক নৌকা। বাতাসের দাপট ঠিক আজ কতটা তা বাইশ তলার উপর থেকে ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। তোঁষা’র অল্পসল্প শীত লাগাতে আলমারি খুলে একটা পাতলা চাদরে নিজেকে পেঁচিয়ে নিলো। আরহাম রুমে নেই। জরুরি কিছু কথা বলতে রুমের বাইরে গিয়েছে কারণ রুমে কথা বললে ওদের ছোট্ট সোনা উঠে যাবে। তোঁষা তাকালো বাবুটার দিকে। আফ্রাহাম শেখ প্রাণ গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। ভারী এই নামটা মোটেও মানায় না বাবুটাকে। তাই শেষমেষ কিভাবে জানি প্রাণ নামটা ও জুড়ে গেলো ওর নামের সাথে। গোলাপি ছোট্ট ঠোঁটদুটো যখন নড়াচড়া শুরু করলো তখন কিছুটা মায়া হলো তোঁষা’র। ঘুমের মাঝেই বাচ্চাটা মুখে শব্দ করছে। এগিয়ে গিয়ে তোঁষা দাঁড়ালো ওর কাছে। এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে আচমকা হাত বাড়ালো ওর দিকে।
আরহাম অনেকক্ষণ যাবৎ কথা বললো আদনানে’র সাথে। ওদের বিয়ের দিনগুলো শেখ বাড়ীতে থাকার অনুরোধ করলো। আরহাম নিজেও চাইছে কিন্তু তোঁষাটা মানবে কি না কে জানে? প্রাণ ও এখন অনেক ছোট। বাবা-মা ছাড়া এই পর্যন্ত তেমন কারো কাছে থাকে নি। তথ্য আর তুষারের কাছে যা একটু থেকেছে এই যা।
একটু ভেবে আরহাম জানালো,
— আচ্ছা তোকে পরে জানাচ্ছি। তুঁষ দেখি রাজি হয় কি না।
— তোমার সব কথাতেই ও রাজি থাকবে ভাই। বলেই দেখো।
ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আরহাম বললো,
— ভয়টা অন্য কোথাও।
— কেউ কিছু বলবে না ভাই। এসো তুমি। আমরা সবাই অপেক্ষায় থাকব।
— রাখি।
— আচ্ছা।
কথা শেষ হওয়া নাগাদ আরহাম চোখ ডললো। এদিক ওদিক ঘাড় কাত করে আলস্য ভেঙে পা বাড়ালো রুমে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে তোঁষা। আরহাম একবার ডাকলো,
— তুঁষ ঘুমে?
তোঁষা উত্তর করলো না। আরহাম ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুঁয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বেরুলো। একপলক তাকালো ছেলের দোলনার দিকে। এগিয়ে গিয়ে দেখতেই চমকালো। ভরকালো। তড়িৎ হাতে বালিশ সরালো। না নেই। ওর ছোট্ট প্রাণ’টা এখানে নেই। ধ্বক করে উঠে আরহামে’র বুক। স্পষ্ট খেয়াল আছে এখানেই রেখে গিয়েছিলো ছেলেকে। ছয় মাসের ছেলে যাবে কোথায়? তোঁষা’কে ডাকতে লাগলো আরহাম,
— তুঁষ? এই তুঁষ। উঠ। প্রাণ কোথায়?
তোঁষা উঠলো না দেখে ভয়ে আরহাম তোঁষা’র মুখ করে কাঁথাটা সরিয়ে বললো,
— প্রাণ কোথায়?
— আমি কি জানি?
— তোঁষা!! কি করেছিস ওকে? বল! আমি রেখে যাই নি দোলনায়? কোথায় আমার ছেলে?
আরহামে’র ধমক খেয়ে তোঁষা মুখ কালো করে ফেললো। আস্তে করে বুক থেকে কাঁথাটা সরিয়ে দেখালো প্রাণ’কে। মায়ের বুকে ঘাপটি মে’রে ঘুমাচ্ছে সে। আরহামে’র কলিজায় পানি এলো যেন। মাত্র ই ওর কলিজা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
আরহাম তোঁষা’র বুকে থাকা ছেলেকে চুমু খেলো। অপরাধীর মতো তাকালো তোঁষা’র দিকে। তোঁষা কালো মুখেই বললো,
— নাও তোমার ছেলেকে।
— থাকুক।
— না।
— ঘুমাচ্ছে। দেখ।
— নাও ওকে।
— ঘুমাক তোর কাছে।
— নাও নাহয় এখনই ছুঁড়ে ফেলে দিব।
কথাটা শক্ত গলায় বলতেই আরহাম দ্রুত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। অল্প কেঁদে উঠলো প্রাণ। আরহাম পিঠ চাপড়ে কান্না থামিয়ে তোঁষা’র পাশেই শুয়িয়ে দিলো। নিজে বসলো পাশে। তোঁষা পুণরায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বিরবির করলো,
— এমনিতে বলে আমাদের বাবু এখন বলে নিজের বাবু। তুঁষ আর কখনো কোলে নিবে না৷ আমার কোলে দিলে একদম ফেলে দিব৷ শয়তান৷
আরহাম সবটা শুনলো। তোঁষা’র অভিযোগ আর অভিমান শুনে খারাপ লাগা থেকে বেশি ভালো লাগলো। এরমানে তোঁষা ভাবে আফ্রাহাম ওদের সন্তান। তোঁষা ও তাহলে আফ্রাহামে’র প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। আরহামে’র চোখ ভরে উঠলো। বুক জুড়ে খেলে গেলো উত্থান পাত্থাল ঢেউ। ঠোঁটে দেখা মিললো এক সুখের হাসির ঝলকানি।
অতি সন্তপর্ণে ছেলেকে বুকের একপাশে নিয়ে তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। তোঁষা আসবে না। ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো ও। আরহাম ধীরে ওর হাত চেপে ফিসফিস করে বললো,
— বাবু উঠে যাবে।
— তাতে আমার কি?
— তোর ছেলে।
— তোমার।
— কার পেটে ছিলো?
— আমার।
— বাবু কার পেটে থাকে?
— মায়ের।
— তাহলে ওর মা কে?
— আমি।
নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলো তোঁষা। আরহাম হাসছে। তোঁষা চোখ রাঙিয়ে তাকালো ওর দিকে। একপাশে ঘুমন্ত প্রাণে’র মিষ্টি দানা। অপরপাশটা খালি। তোঁষা’র চোখ রাঙানো মিলিয়ে গেলো আরহামে’র হাসির সামনে। এত সুন্দর কেন হাসে আরহাম ভাই? তোঁষা’র নরম মনটা যে রাগ পুষে রাখা শিখে নি। টলমলে চোখে আরহামে’র বুকে মাথা রাখলো ও। একসাথে তিনজনকে ঢেকে নিলো আরহাম৷ তোঁষা এক হাত রাখলো ওদের ছোট্ট প্রাণে’র উপর। ছেলের পিঠ’টা একদম নরম। তুলতুলে। তোঁষা হাসলো। ওর হাসিতে হাসলো আরহাম।
তোঁষা’র মাথায় হাত দিয়ে আরহাম ডাকলো,
— প্রাণ?
— হু।
— একটা কথা রাখবি?
— কি?
— ভালোবাসি তোকে।
— জানি তো।
— বল তাহলে কথাটা রাখবি?
— আচ্ছা।
— শেখ বাড়ীতে যেতে হবে সোনা৷
— ঐ মহিলাকে দেখতে মন চায় না আমার।
— চাচি’কে এভাবে বলিস না তুঁষ। মা হয়….
বাকিটা বলার আগেই তোঁষা চেঁচালো,
— সে আমার মা না।
তোঁষা’র কণ্ঠে অল্প কাঁপলো ঘুমন্ত প্রাণ৷ ঠোঁট কাঁপিয়ে সে বাবা’র বুকে নড়েচড়ে উঠলো। তোঁষা কি মনে করে ছেলেকে টেনে নিলো নিজের কাছে। টলমল চোখে মা’কে দেখে তার কান্না বাড়লো বৈ কমলো না। তোঁষা ওর বুকে আদর করে বললো,
— থাম নাহলে মা’রব।
আরহাম তাকে তাকে রইলো যদি সত্যি ই মে’রে বসে? তবে না এমনটা হলো না। তোঁষা খাওয়ালো তার ছেলেকে। একটা সুন্দর সংসারের সূচনা দেখতে পেলো আরহাম। নিজ হাতে ধ্বংস করা ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন বেঁচে যাওয়া রাখ টোকাচ্ছে আরহাম৷ বলা তো যায় না যদি সুখের দেখা মিলে?
#চলবে……