#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৪
বউ, বাচ্চা নিয়ে আরহাম হাজির শেখ বাড়ীতে। কাল আদনানে’র গায়ে হলুদ। শেখ বাড়ী তাই সেজেছে উজ্জ্বল লাল, নীল বাতি’তে। রংবেরঙের বাহার দেখে ছয় মাসের প্রাণ খুবই উচ্ছাসিত। তার মুখের হাসি আর হাত, পা নাড়ানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা প্রাণবন্ত আপাতত সে। আরহাম থেকে একে একে সবাই কোলে নিলো ওকে। তোঁষা আরহামে’র পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণ’কে এক পর্যায়ে যেই না ওর মা কোলে নিলো ওমনিই ফুঁসে উঠলো তোঁষা। আরহাম’কে ছেড়ে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো প্রাণ’কে ওর মায়ের কোল থেকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত চেপে বললো,
— আমার বাবু ধরবে না।
মূহুর্তের ব্যাবধানে সবাই থমকে গেলো। হঠাৎ করে তোঁষা টেনে নেয়াতে প্রাণ ও ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে জোরে। এতে যেন তোঁষা তেঁতেঁ উঠলো আরো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,
— কেন কাঁদছিস? জানিস না এই মহিলা ভালো না? তোর মা’কে অনেক মে’রেছে। তোকেও মা’রবে।
ছোট্ট প্রাণ বুঝলো না মায়ের কথা। সে কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আরহাম দ্রততার সাথে এগিয়ে এসে কোনমতে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে তোঁষা’কে টেনে রুমে নিয়ে গেলো। পেছনে অশ্রু চোখে তাকিয়ে রইলো তোঁষা’র মা। তুষার ধীর পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। এক কাঁধে হাত রাখতেই তিনি বলে উঠলেন,
— ও কি আমায় মাফ করবে না?
— ওকে করেছিলে?
চমকে ছেলের চোখে তাকালেন উনি। তুষার মৃদু হাসলো। ধরফর করে উঠলো ওর মায়ের বুক। তুষার তাকে নিয়ে বসালো সোফায়। ওর মা ছলছল চোখ করে তাকিয়ে বললো,
— আমার ভুলের কি মাফ নেই?
— ভুল? সেটা পাপ ছিলো আম্মু। তুমি, আব্বু আর চাচ্চু মিলে করেছিলে সেই পাপ। আমার ছোট্ট পুতুলটাকে কতটা আঘাত দিয়েছিলে আম্মু। সত্যি টা আজও আরহাম’কে জানাই নি আমি। ও ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছে আম্মু। ভাবছে নিজের জ্ঞান এর অপব্যবহার করেছে ও অথচ সত্যি টা তো এখানে অর্ধ। সম্পূর্ণ সত্যি জানলে তোঁষা কেন কেউ তোমাকে মাফ করবে না।
হু হু করে কেঁদে উঠলো তোঁষা’র মা। রাগের বশে নিজের মেয়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটাই তার হাতে হয়েছে। তুষার মা’কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তথ্য রুমে একা। ওকে খাওয়াতে হবে এখন।
.
রুমে ঢুকেই দরজা লক করেছে আরহাম। না জানি তোঁষা কখন বের হয়ে কোন আকাম করে। এদিকে প্রাণ কেঁদেই যাচ্ছে। থামাথামির নাম নেই। আরহাম ভয়ে তোঁষা’কে বলতেও পারছে না একটু খাওয়াতে। ছেলেটা ফিডার মুখেই তুলছে না আজ। তোঁষা পা ছড়িয়ে বসা বিছানায়। রাগে লাল হওয়া মুখটা আপাতত কিছুটা স্থির। এক হাত তোঁষা’র পেটে। আরহাম সেদিকে খেয়াল করার সুযোগ পেলো না। প্রাণে’র মাত্রারিক্ত কান্না যখন কিছুতেই থামলো না তখন তোঁষা বিরক্ত হয়ে বললো,
— ও কাঁদছে না? দাও আমাকে। খাবে এখন। এটাও বুঝো না আবার বলো তোমার ছেলে!
আরহাম যেন দৌড়ে ছেলে নিয়ে হাজির হলো। তোঁষা তখনও বিরক্ত কিন্তু ছেলেকে দিয়ে আরহাম যখন ওকে শুয়িয়ে দিলো তখন শান্ত স্বরে তোঁষা বললো,
— তুমি শুবে না?
আরহাম নিঃশব্দে শুয়ে পরলো। এখনও শরীর কাঁপছে প্রাণ’টার কিন্তু কান্না নেই। সে আরামের সহিত মায়ের বুকে চোখ বুজে আছে।
_____________________
হলুদের অনুষ্ঠান জোরেসোরে শুরু হলো। চারদিকে চকচকে তকতকে একটা রমরমা ভাব৷ তোঁষা’কে তথ্য ধরে হলুদ একটা শাড়ী পরিয়ে সুন্দর করে সাজাতে বসালো। নিজেও এই ভারী শরীরে শাড়ী পেঁচালো তথ্য। তুষারের এই নিয়ে রাগারাগি’র অন্ত নেই। যদি বউটা শাড়ীতে পেঁচিয়ে পরে যায় তখন? যদি এই সুন্দর মুখটা দেখে নজর লেগে যায় তখন? কতশত ভাবনা তুষারের। এসব কি তথ্য বুঝে? মোটেও বুঝে না৷ হাতে দুধ নিয়ে গোমড়া মুখে তা তথ্য’কে দিলো তুষার। তথ্য ও পাত্তা দিলো না৷ নিজের মতো খেয়ে গ্লাসটা সাইডে রেখে তোঁষা’কে বললো,
— রুমে যেতে পারবে? আরহাম ভাই রুমে।
— পারব আপি।
হাসিমুখে উত্তর দিলো তোঁষা। তবুও তুষার বোনের হাতটা ধরে গালে আরেক হাত দিয়ে বললো,
— অনেক সুন্দর লাগছে পুতুল।
তোঁষা হাসলো। তুষার বোনকে হাত ধরে তার রুমে দিয়ে পা বাড়ালো নিজের রুমে। বউটাকে বুঝাতে হবে। এত সুন্দর হয়ে চলাফেরা করা যাবে না পাছে নজর লাগছে?
তোঁষা রুমে ঢুকতেই ওকে দেখে থমকে গেলো আরহামে’র হাত। ছেলেকে ডায়াপার পড়াচ্ছিলো ও। আজ বহুমাস পর তোঁষাকে এভাবে শাড়ী পরা দেখলো। নেশাময় চোখে তাকিয়ে রইলো আরহাম৷ ছোট্ট প্রাণ ও টুকুর টুকুর করে মা’কে দেখে যাচ্ছে। আরহামে’র চোখে আজ ভিন্ন কিছু দেখা গেলো৷ কি দেখা গেলো বুঝা গেলো না। ছেলেটার টলমলে চোখ শুধু জানান দিলো সে কৃতজ্ঞ। সে ব্যাথিত। সে অনুতপ্ত নিজের বিষাক্ত ভালোবাসা নিয়ে।
তোঁষা বিড়াল পায়ে এগিয়ে এলো। আস্তে করে হাত রাখলো আরহামে’র পিঠে। আরহাম হুট করে তোঁষার কোমড় জড়িয়ে ধরে। পেটে মুখ গুজে কেঁদে ফেলে ফুপিয়ে।
তোঁষা ওর প্রাণের চুলের ভাজে আঙুল চালনা করলো। ডাকলো মৃদু শব্দে,
— এই আরহাম ভাই?
ঝট করে সরে গেলো আরহাম। এই ডাকটা ওর কলিজাটা এফার ওফার করে দিলো মুহুর্তে। ছোট্ট প্রাণটাও উউ আআ করে তার কথা বলতে চাইলো। তোঁষা একটু ঝুঁকে আরহামে’র কপালে চুমু খেলো। ফিসফিস করে বললো,
— আজ রাতে ভালোবাসব তোমাকে।
কথাটা বলেই ছেলেকে ডায়াপার পরালো তোঁষা।
.
বেশ সুন্দর ভাবে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হলো। তোঁষা একদম স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু কোন ভাবেই আদনান’কে হলুদ ছোঁয়াতে চাইলো না। আরহাম আর তুষার বাদে অন্য কোন পুরুষের সামনেই তোঁষা থাকতে বিরক্ত তা আরহাম স্পর্শ দেখতে পেয়েছিলো।
প্রাণ ঘুমিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। আজ অনেক আনন্দ করেছে সে বুঝা গিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। ইদানীং আবার বায়না ও বেড়েছে। মা’কে ছাড়া চলে না৷ তোঁষা’র কাছ থেকে ওকে নিয়ে ছোট্ট দোলনাতে রাখলো আরহাম৷
আরহাম এক লাফে বিছানায় উঠলো। তোঁষা কপাল কুঁচকে বললো,
— কিহ?
— প্রাণ ঘুমিয়ে গিয়েছে।
— হু। মাত্র ই ঘুমালো।
— তুই না বলেছিলি রাতে ভালোবাসবি?
বলেই বাঁকা হাসলো আরহাম৷ তোঁষা হাই তুলে বললো,
— ঘুম পাচ্ছে।
— শোন না।
— ঘুমাব।
— এই প্রাণ?
— প্রাণ ঘুম।
এবারে আরহাম ধৈর্য হারা হলো। হামলে পড়লো কিছুটা তোঁষার উপর। তোঁষা ভরকে গিয়ে যেই না চিৎকার করবে ওমনিই ওকে থামিয়ে দিলো আরহাম। ছেলে উঠলে এখন সব যাবে। আমও যাবে ছালা ও যাবে। তোঁষা দুষ্ট হাসলো। আরহাম টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে বললো,
— এখন ঘুমিয়ে দেখা।
— দেখাবই তো।
— দেখা?
— কি দেখাব?
— তাও ঠিক সবই দেখা আমার।
তোঁষা কামড়ে ধরলো আরহাম’কে। থামিয়ে দিলো অসভ্য কথা। দুজন ভালোবাসা দেয়া শুরু করলো দুজনকে। একে একে হারালো দুজন ভালোবাসার মানুষ তাদের সুখের রাজ্যে।
.
বেশ সুন্দর ভাবেই কাটলো আদনানের বিয়ে। নতুন বউ’কে রুমে দিয়ে মাত্র ই সবাই যার যার রুমে গেলো তখনই গগন বিদারী চিৎকার করে উঠে তথ্য। এক সময়ের আর্মি ম্যান তুষার ছোট্ট বাচ্চার মতো আচরণ শুরু করলো। তোঁষা’কে নিজের মায়ের কাছে রেখে আরহাম সহ বাসর ছেড়ে আদনান ছুটলো হাসপাতালে।
সকলকে চিন্তামুক্ত করে ছোট্ট একটা পরি এলো তথ্য তুষারের ঘরে। তুষার নিজের মেয়েকে কোলে নিবে না৷ কিছুতেই না। তার শক্ত হাতে নাকি মেয়ে ব্যাথা পাবে অগত্যা তথ্য ক্লান্ত দেহেই রেগে বললো,
— আমার মেয়ে আমাকে দাও। কোনদিন যাতে আমার মেয়ে ধরতে না আসে এই লোক।
তড়িৎ বেগে মেয়েকে কোলে তুললো তুষার। ওর আচরণে হাসির রোল পরলো হসপিটালের কক্ষতে।
#চলবে…..